শনিবার, ৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৫শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এবং আমার জীবনে তাঁর প্রভাব

পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ৫, ২০১৪ 

news-image

মরিয়ম জামিলা

ছোটবেলা থেকেই আমি কড়া ধর্মীয় শাসনে বন্দি ছিলাম। আমার বয়ঃসন্ধিকাল এবং যৌবনের প্রথম দিকের সময়টাও সেই অবস্থায় কেটেছে। তখন থেকেই প্রতিষ্ঠিত ইয়াহুদী ধর্মালয় (সাইনাগগ) ও খ্রিস্টীয় চার্চের ধারণা থেকে আমার মোহমুক্তি ঘটে। আমি তখন নাস্তিক্যবাদকেই স্বীকার করে নিয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে পরম সত্যের সন্ধানে নিজেকে উৎসর্গ করি যে সত্যের মাধ্যমে জীবনের অর্থ, দিক-নির্দেশনা ও লক্ষ্য অর্জন করা যায়।

যাই হোক, সুস্থ কোন ধর্মীয় পরিবেশে আমি বড় হয়ে উঠিনি। আমার পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবরা ছিল নামমাত্র ইয়াহুদী। আমেরিকান জীবনধারায় তাঁরা ছিলেন সরাসরি সম্পৃক্ত। তাঁরা সর্বাংশেই ছিলেন ভদ্র, নম্র, উদারমনা, সংস্কৃতিবান এবং বুদ্ধিমান। নৈতিক যেসব মৌলিক আইন-কানুন রয়েছে তাতে তাঁরা বিশ্বাসী ছিলেন এবং নিষ্ঠার সাথে তা মেনেও চলতেন। তথাপি তাঁরা নৈতিক আচার-আচরণ ধর্মতত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল- একথা অস্বীকার করতেন। বস্তুত পক্ষে তাঁরা এই দুই বিষয়ের মধ্যকার প্রাসঙ্গিকতাও বুঝতে পারেননি। মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে শাস্তি ও পুরস্কার সম্পর্কিত যে কোন ধারণাকেই তাঁরা পুরানো দিনের কুসংস্কারপূর্ণ সেকেলে ধ্যান-ধারণা বলে মনে করতেন। ঠিক একই কারণে নবুওয়াত, ঐশী প্রত্যাদেশ, মানবীয় বিষয়াদি সরাসরি হস্তক্ষেপেকারী এবং ভক্তদের প্রার্থনা প্রশ্নকারী ব্যক্তিগত কোন উপাস্য সম্পর্কিত যে কোন ধারণাও বাতিল বলে গণ্য করেন। এই সমাজের মূল লক্ষ্য হলো সুখ-সমৃদ্ধি, আনন্দ আর ফুর্তি। যখনই আমি চিন্তা করতে সক্ষম হলাম এবং উপলব্ধি করলাম, তখন দেখতে পেলাম প্রচলিত মূল্যবোধের কারণে আমি সমাজ থেকে দূরে সরে পড়েছি। সর্বোপরি আমার একটি কামনা ছিল চিরস্থায়ীভাবে প্রয়োজনীয় কিছু অর্জন করা। যেহেতু এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে চূড়ান্ত কোন জবাব পাওয়া যাবে না তাই এই সব চিন্তা বাদ দিয়ে যে কেউ অন্তর্বর্তীকালীন এই জীবনের আনন্দ যতটুকু পারা যায় ভোগ করাকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করবে। যেমন সুস্বাস্থ্য, সুস্বাদু খাবার, আরামদায়ক জীবন যাপন, পারিবারিক ভালোবাসা, অন্তরঙ্গ বন্ধুদের সাহচর্য এবং বিবিধ প্রকারের আমোদ-প্রমোদ যা আধুনিক আমরিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে। কেন আমরা জন্মগ্রহণ করেছি, কে আমাদের সৃষ্টি করেছে। আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যই বা কি, কেন আমাদের মরতে হবে কিংবা মৃত্যুর পরে আমাদের কি হবে ইত্যাকার প্রশ্নাবলি কেউ করে না, পাছে সে হীনমন্যতা, দুঃখবাদ ও নৈরাশ্যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বিদেশীরা প্রায়ই আমেরিকানদের প্রশংসা করে স্থবির নয় বলে। এই প্রগতিবাদীদের মতে আমেরিকা আর প্রগতি একার্থবোধক। কারণ, তাদের ধারণা মতে, এটাই একমাত্র দেশ যেটা সামাজিক ও ধর্মীয় সব জটিল ও সেকেলে দর্শনের দ্বারা গতিশীল, অবাধ স্বাধীনতার দেশ, তাই সৃষ্টিশীল পরিবর্তনে সক্ষম।

আমি এই কারণে কখনো এই পরিবর্তনে স্বীকৃতি দেইনি। আমি মনে করি কোন জিনিসের সুস্থিতি ও স্থায়িত্ব না থাকার অর্থই হলো এর মূল্যহীনতা এবং এতে জীবন অর্থহীন ও হালকা হয়ে উঠে। তাই সব সময়েই আমার অনুসন্ধান ছিল পরম সত্যের জন্য।

ইয়াহুদীবাদ বা খ্রিস্টবাদ কোনটাই আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সিনাগগের নীচ ও সংকীর্ণমনার কারণে আমি তাড়িত হয়ে ফিরেছি এবং ফিলিস্তিনী আরবদের প্রতি ইয়াহুদীবাদের নিষ্ঠুর বর্বরতা দেখে আমি আতঙ্কিত হয়েছি। খ্রিস্টানদের জটিল ও অবোধ্য ধর্মতত্ত্বের প্রতি এবং নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুষ্কৃতির সাথে চার্চের অন্তহীন আপোষের সাথে আমি নিজেকে কখনো খাপ খাওয়াতে পারিনি। আমার দেখা সিনাগগ এবং চার্চ উভয়টিই ছিল দুর্নীতি আর কপটতায় পরিপূর্ণ। আমার ইয়াহুদী প্রশিক্ষণের প্রাক্কালে স্বাভাবিকভাবেই ইসলাম ধর্মের প্রতি আমার কৌতুহল জাগ্রত হয়। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে ইয়াহুদী ধর্মের সাথে ইসলাম ধর্মের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম, ইসলাম ও ইসলামী সভ্যতা সম্পর্কে ভালো রকম জ্ঞান না থাকলে আরবদের সম্পর্কে জানতে পারব না। আর যখন আমি জানতে পারলাম যে, আরবদের দ্বারাই ইসলাম বড় হয়ে উঠেনি। অন্য কোনভাবে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে তখন থেকেই আমি যথাসম্ভব ইসলামকে জানার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠি। ইয়াহুদী ধর্মের সংকীর্ণ ও জটিল জাতীয়তাবাদ এবং বাইবেলের ওপর আল-কুরআনের প্রাধান্য আমার কাছে সর্বাত্মক বিশ্বজনীন বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। এই বিশ্বজনীনতাই ক্রমে উচ্চতর নৈতিকতায় পর্যবসিত হয়ে এসব ধর্ম ও এসব ধর্মভিত্তিক সভ্যতাগুলোর ওপর এক প্রচ- চাপ প্রয়োগ করল। ইসলামের পরম মূল্যবোধের সন্ধানে এসে আমি সন্তুষ্ট। ইসলামে এসে আমি সবকিছুই সত্য, সুন্দর এবং ভালো দেখতে পেয়েছি যাতে জীবন ও মৃত্যুর উপলব্ধি রয়েছে এবং দিক নির্দেশনা রয়েছে। অপরদিকে অন্যান্য ধর্মে সত্যকে দেখেছি বিকৃত, পঙ্গু, সীমাবদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করে কীভাবে আমি জানতে পারলাম, তাহলে আমি শুধু বলতে পারি, আমার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতাই আমার মাঝে দৃঢ়-প্রত্যয় উৎপাদন করার জন্য যথেষ্ট। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা-ভাবনা করে এবং গভীর আত্মপ্রত্যয় সহকারে আমি ইসলামের সংস্পর্শে এসেছি। অন্যান্য নও মুসলিমের ন্যায় আমি কখনো নবী (সা.)-কে স্বপ্নে দেখিনি; কিংবা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রাক্কালে কোন রকম অলৌকিক বা নাটকীয় কিছুর অভিজ্ঞতাও আমার হয়নি। আমি মনে করি ইসলাম নামের কোন বিষয় যে আছে তা-ও জানার আগে আমি আসলে মন-মেজাজে মুসলমানই ছিলাম। আমার ধর্মান্তর ছিল একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কারণ, ধর্ম বদলের পর তেমন কোন মৌলিক পরিবর্তন আমার মাঝে আসেনি; বরং অনেক দিন ধরে যে চিন্তা-ভাবনা আমার মাঝে বিরাজমান ছিল তারই একটা আনুষ্ঠানিক রূপ লাভ হয়েছে মাত্র।

কুরআন অধ্যয়ন শুরু করার অব্যবহিত পর আমি বুঝতে পারলাম প্রাসঙ্গিক হাদীসের জ্ঞান অর্জন ছাড়া কুরআন মজীদকে সম্যকরূপে অনুধাবন করা যাবে না। কারণ, পাক কুরআন যাঁর কাছে নাযিল হয়েছে তিনিই তো এর শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাদাতা। আল-কুরআন আমাদেরকে ইসলামী জীবনের মৌলিক রূপরেখা প্রদান করেছে, আর আল-হাদীস তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরেছে।

যখন নবীপত্নী হযরত আয়েশা-এর কাছে নবী (সা.)-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানতে চাওয়া হলো তখন হযরত আয়েশা জবাবে বলেছিলেন, আল-কুরআনই হলো তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ নবী (সা.)-এর দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল-কুরআনের শিক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছে। কুরআন কর্তৃক যে সকল গুণ বিবৃত হয়েছে তিনি ছিলেন সেসবেরই মূর্ত প্রকাশ। তাঁর জীবনচিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একজন শিশু হিসাবে, একজন প্রতিবেশী হিসাবে, একজন ব্যবসায়ী হিসাবে, একজন ধর্মপ্রচারক, একজন নির্বাসিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, একজন বন্ধু, একজন যোদ্ধা, একজন সেনাপতি, একজন রাজ্যবিজেতা এবং বিচারক হিসাবে, একজন আইন প্রণেতা, একজন শাসক হিসাবে এবং সর্বোপরি একজন আল্লাহপ্রেমিক হিসাবে নবী (সা.)-এর সার্বিক আচার-আচরণই ছিল আল্লাহর কিতাব আল-কুরআনেরই প্রতিফলন। তাঁর দৈনন্দিন রুটিনে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠত তাঁর ধার্মিক জীবন যাপনের আন্তরিকতা এবং বিশুদ্ধতা। তিনি দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত কঠোর নিয়মানুবর্তী ছিলেন। ফজরের নামাযের পর তিনি লোকজনদের সাথে কথাবার্তা বলতেন তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য। এ সময় তিনি অনেক মামলা-মোকাদ্দমারও নিষ্পত্তি করতেন এবং সুবিচার কায়েম করতেন। বাইরের কোন দূত বা প্রতিনিধি এলে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং কোথাও কোন দূত বা প্রতিনিধি পাঠানোর প্রয়োজন থাকলে সে কাজ সম্পন্ন করতেন। এভাবে তাঁর সকালের বৈঠক শেষ হতো। এরপর তিনি বাড়ি রওয়ানা হতেন এবং যে কোন একজন স্ত্রীর খেদমতে হাজির হয়ে তাঁর কোন প্রয়োজন থাকলে তিনি সেটা পূরণ করতেন। প্রয়োজনবোধে তিনি বাজার করতে যেতেন, বাজার থেকে এসে নামায পড়ে রোগী ও গরীবদের খোঁজ-খবর নিতেন এবং বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে যোহরের নামায আদায় করতেন। যোহরের নামাযের পর তিনি বাড়ি এসে আহার গ্রহণ করতেন (যদি থাকত) এবং আহার শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন। তারপর মসজিদে গিয়ে আসরের নামায পড়ে বাড়ি ফিরে এসে নিজের স্ত্রীদের এবং সন্তান-সন্ততিদের সাথে কিছু সময় অতিবাহিত করতেন। এরপর মাগরিবের নামাযের পর বাড়ি ফিরে রাতের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ নির্জনে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থেকে পরে বিশ্রাম নিতেন। তিনি কয়েক ঘণ্টা মাত্র ঘুমিয়ে আবার শেষরাতে উঠে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হয়ে যেতেন এবং এরপর শুয়ে পড়তেন। অল্প কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে ফজরের নামাযের আগেই আবার ঘুম থেকে উঠে পড়তেন এবং নামায শেষে রীতিমত তাঁর আর এক নতুন দিনের কাজ শুরু হতো। তাঁর কর্মদক্ষতা ছিল অসাধারণ। খুব কমই তিনি ক্লান্তি বোধ করতেন।

এখন দেখা যাক নবী (সা.)-এর ধর্মীয় জীবন-যাপনের প্রভাব তাঁর পরিবারের মহিলাদের মাঝে কতটা ফেলেছিল! নবীদুহিতা হযরত ফাতেমা (আ.) সম্পর্কে বলতে গিয়ে হযরত আলী (আ.) বলেছিলেন : “ফাতেমা নিজ হাতে গম পিষত, যার ফলে তার হাতে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল। একটি চামড়ার থলিতে করে বাড়ির জন্য সে পানি বয়ে আনত। এতে তার বুকে দাগ পড়ে গিয়েছিল। সে নিজে তার ঘরদোর পরিষ্কার করত, এতে তার কাপড়-চোপড় ময়লা হয়ে যেত। একবার মদীনায় কিছু যুদ্ধবন্দি আনা হয়েছিল। তা দেখে আমি হযরত ফাতেমাকে বললাম : ‘তুমি নবীজির কাছে গিয়ে তোমার গৃহস্থালি কাজের সাহায্যের জন্য একজন চাকর প্রার্থনা কর। আমার কথামতো হযরত ফাতেমা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট গিয়ে দেখতে পেলে তার চারপাশে অনেক লোকজনের জমায়েত। অন্য লোকজনের সামনে তিনি নবীজীকে কিছু বলতে সংকোচ বোধ করলেন। পরদিন নবী (সা.) নিজে আমাদের বাড়ি এসে জানতে চাইলেন : ‘ফাতেমা! গতকাল তুমি আমার কাছে কি জন্য গিয়েছিলে?’ ফাতেমা লজ্জাবশত কোন জবাব দিতে পারল না, চুপ করে রইল। তখন আমি নবী (সা.)-কে ব্যাপারটি খুলে বললাম। এ শুনে হযরত বললেন : ‘ফাতেমা আল্লাহকে ভয় করো, তাকওয়া হাসিল করো এবং শোবার সময় ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ও ৩৪ বার আল্লাহু আকবার তাসবিহগুলো পাঠ করবে। একজন চাকরের চেয়ে এগুলোই তোমার জন্য বেশি উপকারী হবে।’ একথা শুনে হযরত ফাতেমা খুশি হয়ে বললেন : ‘আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি সন্তুষ্ট’।”

নবী (সা.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ কিভাবে জীবন-যাপন করতেন? এ সম্পর্কে হযরত আয়েশা বলেন : ‘হযরত মায়মুনা ছিলেন নবীপত্মিগণের মাঝে সবচেয়ে পুণ্যবতী মহিলা। তাঁকে প্রায়ই হয় নামাযে, না হয় গৃহস্থালি কাজে মশগুল দেখা যেত। যদি কোন কাজ না থাকত তাহলে তিনি গাছের ডাল দিয়ে মিসওয়াকে ব্যস্ত থাকতেন।’

এই উদাহরণ তথাকথিত ‘নারী স্বাধীনতার’ আধুনিক আন্দোলনের সপক্ষে কোন আবেদন রাখবে না; বরং এতে আধুনিক নারীরা আতঙ্কিত বোধ করবেন। তাঁরা নিশ্চয়ই আমার কাছে জানতে চাইবেন বিংশ শতাব্দীর আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী একজন আধুনিক মহিলা হয়েও আমি কি করে এ ধরনের সংকীর্ণ দরিদ্র, সীমিত এবং সঙ্কুচিত এক জীবনকে অনুমোদন করলাম? আমার জবাব হলো যে, মহানবী (সা.)-এর কাছে ব্যাপক বিস্তৃতির চেয়ে অভিজ্ঞতার গভীরতাই ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতা দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এর সাথে তাল মিলিয়ে চলাকেই আজকাল উন্নত গুণাবলি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু আধুনিক নারী-পুরুষের বিবিধ ও বিস্তারিত কর্ম অভিজ্ঞতা থাকতে পারে, তবুও তাদের অন্তঃকরণ অগভীর, ভাসাভাসা ও নড়বড়েই থেকে যায়। মহানবী (সা.)-এর কাছে জীবনের উদ্দেশ্যই ছিল অর্জন করা, উপভোগ করা নয়। নিজের বিবেক-বুদ্ধি মতো কাজ করে যে সন্তুষ্টি পাওয়া যায় তারই স্বাভাবিক প্রকাশ হলো সুখ, আনন্দ প্রভৃতি। বস্তুবাদী জগতে কোন কীর্তি বা অবদান বলতে কোন কিছুতে পূর্ণতা হাসিল, যেমন শিল্পে, বিজ্ঞানে অথবা কোন ব্যাপারে যশ, খ্যাতি অর্জন কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভূত সাফল্য লাভ ইত্যাদিকেই বুঝিয়ে থাকে। ইসলামে কীর্তি বা অবদান বলতে প্রয়োজনীয়, উপকারী এবং সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে স্থায়ী কার্যকরী কিছু হাসিল করা এবং সেই সাথে আত্ম প্রশংসায় অযথা সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকা এবং যথাসম্ভব দুষণীয় কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকা। প্রকৃতপক্ষে কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে যে শ্রেষ্ঠ কীর্তি বা অবদান আমাদের রাখতে হবে তা হলো পরকালের চিরন্তন ক্ষমা বা নাজাত।

এই ছিল নবী (সা.)-এর সকল শিক্ষার মূল বিষয়বস্তু। হিজরি প্রথম বছরে মদীনার মসজিদে নবী (সা.) কর্তৃক প্রদত্ত নিম্নলিখিত ভাষণে এই শিক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছে : “হে লোকসকল! আগে থেকেই তোমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করো। তোমাদের জেনে রাখা উচিত তোমরা প্রত্যেকেই দিশেহারা হয়ে পড়বে (কেয়ামতের দিন) যেন রাখালবিহীন ভেড়ার পাল। যখন কোন পথপ্রদর্শকও থাকবে না বা কোন আশ্রয়স্থলও থাকবে না। তবে প্রভু তাকে বলবেন : ‘আমার রাসূল কি তোমার কাছে আমার বাণী প্রকাশ করেনি? তোমাকে আমি সহায়-সম্পদ দান করেছিলাম। এর পর নিজের জন্য তুমি কি প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলে?’ এই কথা শুনে সে ডানে তাকাবে, বামে তাকাবে, কিন্তু কোন সাহায্যকারী দেখতে পাবে না। তারপর সে তার সামনে লক্ষ্য করবে এবং তখন দোযখের আগুনই শুধু সে দেখতে পাবে। সুতরাং এক টুকরা খেজুর খরচ করেও যদি কেউ দোযখের আগুন থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে তাহলে সে যেন তাই করে আর যে তাও পারে না সে যেন একটি ভালো কথা দিয়ে হলেও তাই করে। সৎ কাজকে পুরস্কৃত করা হবে এবং তা দশ থেকে সাতশ গুণ বৃদ্ধি করা হবে।”

নবম হিজরিতে সিরিয়ার তাবুকে নবী (সা.) ঘোষণা করেন : ‘নিশ্চয়ই সবচেয়ে সত্যাপরায়ণ রচনা হলো আল্লাহর কেতাব। সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপদেশ বাণী হলো ধর্মীয় উপদেশ। ধর্মের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম হলো হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ধর্ম (অর্থাৎ) ইসলাম)। শ্রেষ্ঠ নজির বা উদাহরণ হলো মুহাম্মাদের উদাহরণ। সবচেয়ে মহত্তম উক্তি হলো আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। সুন্দরতম বর্ণনা হলো আল-কুরআন। শ্রেষ্ঠ বিষয় হলো যা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ধর্মে সবচেয়ে খারাপ জিনিস হলো নতুন কিছু উদ্ভাবন (বিদআত)। সর্বশ্রেষ্ঠ পথ হলো নবী-রাসূলদের পথ। সবচেয়ে মহান মৃত্যু হলো শাহাদাতের মৃত্যু। সবচেয়ে বড় অন্ধত্ব হলো সঠিক পথ পাওয়ার পরও বিপথগামী হওয়া। শ্রেষ্ঠ কাজ যাতে উপকার রয়েছে। শ্রেষ্ঠ পথনিদর্শন হলো যা বাস্তবে অনুসরণ করা হয়। নিকৃষ্টতম অন্ধত্ব হলো হৃদয়ের অন্ধত্ব। প্রলুব্ধকর প্রাচুর্যের চেয়ে অল্পে তুষ্টি অনেক ভালো। মৃত্যুর আগমন মুহূর্তে যে ক্ষমা চাওয়া হয় তা হলো নিকৃষ্টতম ক্ষমা প্রার্থনা এবং সবচেয়ে বড় অনুশোচনা যা শেষ বিচারের দিন অনুভূত হবে।’

আর এভাবে নবী করিম (সা.) আমার কাছে তথা স্থান-কাল নির্বিশেষে সকল সময়ের জন্য সমগ্র মানবজাতির কাছে মানব জীবনের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং কোনটা গুরুত্বপূর্ণ ও কোনটা গুরুত্বপূর্ণ নয় তা বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। আধ্যাত্মিক জীবনে হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও খ্রিস্ট ধর্মের বৈরাগ্যবাদ ও সন্ন্যাস জীবনের গুরুত্বকে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে মহানবী (সা.) বাস্তব জীবনের কথাই বলেছেন। চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থায় তিনি পার্থিব জীবনের বৈধ আমোদ-প্রমোদের সমর্থনও দিয়েছেন। তিনি নির্মল হাস্যরসেও কোন বাধা দেননি। অনেক সময় শিশুদের সাথেও তাঁকে আনন্দ হাসি করতে দেখা গেছে। তবে পরকালের একমাত্র জীবনের তুলনায় যাতে এই পার্থিব জগতের স্বার্থ চিন্তা বেশি হয়ে না যায় সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন। অনেক সময় সাহাবীদের উদ্দেশে তিনি বলতেন : ‘আমি যা দেখেছি (পরকালের জীবন সম্পর্কে) তোমরা যদি তা দেখতে তাহলে অবশ্যই তোমরা হাসতে কম, কাঁদতে বেশি।’

মহানবী (সা.)-এর ইবাদত-বন্দেগি ছিল অনন্যসাধারণ, দুনিয়ার সমস্ত কিছু ছাড়িয়ে উঠেছিল তাঁর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি গভীর প্রেম ও ভালোবাসা। প্রতি রাতে ঘুমাবার আগে তিনি এই মুনাজাতটি করতে ভুলতেন না : ‘হে আল্লাহ! শেষ বিচারের দিনের দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে আমাকে রক্ষা কর। হে প্রভু! আমি তোমার নামেই বাঁচি আর তোমার নামেই মরি।’

 গ্রন্থপঞ্জি

1.   The Life of Muhammad, Abdul Hamid Siddiqi, Islamic Publications, Lahore. p. 389.

2.   The Stories of Sahabah, Maulana Muhammad Zakaria; Malik Bros Lyallpur Pn. dh. p. 157-158.

3.   Ibid. p. 197.

4.   The Oration of Muhammad, Maulana Muhammad Ubaidul Akbar, Shaykh Muhammad Ashraf, Lahore, 1954. p. 30-31.

5.   Idid. p. 197.

6.   Prayers of the Prophet. Abdul Hamid Siddiqi. Shaykh Muhammad Ashraf, Lahore. p. 13.