সম্পাদকীয়
পোস্ট হয়েছে: ডিসেম্বর ১, ২০১৬
আশুরার মর্মকথা ও শিক্ষা
দশই মুহররম শোকাবহ আশুরা- সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ও বেহেশতে যুবকদের নেতা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের বার্ষিকী। হিজরি ৬১ সালের এ দিনে ইমাম হোসাইন কারবালায় তাঁর স্বজন ও সহচরগণসহ ইয়াযীদী বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন।
কারবালার ঘটনা ও তার প্রেক্ষাপট ইতিহাসের বিতর্কাতীত অকাট্য ঘটনাসমূহের অন্যতম।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের ঘটনার পরে হযরত ইমাম হাসান (আ.) খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ্কে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সম্ভাব্য রোমান হামলা থেকে রক্ষার লক্ষ্যে তিনি তাঁর বৈধ খেলাফতকে মুআবিয়ার হাতে ছেড়ে দেন। মুআবিয়া হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে কৃত সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে মৃত্যুকালে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর হাতে খেলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তরের পরিবর্তে স্বীয় চরিত্রহীন পাপাচারী পুত্র ইয়াযীদকে খেলাফতে অধিষ্ঠিত করে গেলে ইয়াযীদ হযরত ইমাম হুসাইনের কাছ থেকে শক্তিপ্রয়োগে বাই‘আত্ আদায়ের জন্য মদীনার উমাইয়্যাহ্ প্রশাসককে নির্দেশ দেয়। কিন্তু হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ন্যায় ব্যক্তি ইসলামের সমস্ত সীমারেখা অমান্যকারী ইয়াযীদের আনুগত্য করলে যে কারো জন্য তা ইসলামি মূল্যবোধ বিসর্জনের সপক্ষে দলিল হিসেবে গণ্য হতো। এ কারণে তিনি ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করা থেকে বিরত থাকেন এবং রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে রাতের বেলা মদীনা ত্যাগ করে মক্কায় চলে যান।
মক্কায় তিনি লোকদের মধ্যে মুসলমানদের হুকুমাতের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু ইয়াযীদ সেখানে তাঁকে হজের ভীড়ে হত্যার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠালে হযরত ইমাম পবিত্র স্থানে রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং কুফার জনগণের দাও‘আতে সাড়া দিয়ে সেখানে পৌঁছার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে কারবালায় উপনীত হন। সেখানে ইয়াযীদের নির্দেশে তার বাহিনী হযরত ইমামের ওপরে ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করার জন্য কঠোরভাবে চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) কোনো অবস্থায়ই ফাসেক্ব ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করাকে জায়েয গণ্য করেন নি বিধায় তাদের এ চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান। এমতাবস্থায় ইয়াযীদী বাহিনী তাঁকে স্বজন ও সহচরসহ এক অসম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ ইচ্ছায় হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ঐ সময় মরণাপন্ন অসুস্থ থাকায় তিনি এ হত্যাকা- থেকে রেহাই পান; এছাড়া হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গী-সাথিদের ও পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্যকেই জীবিত রাখা হয় নি।
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আত্মত্যাগের এ ঘটনা মানুষকে ভাবতে শেখায় এবং মুসলমানদের জন্য বাতিলকে সহ্য করার সীমারেখাকে সুস্পষ্ট করে দেয়। এভাবে কারবালার ঘটনা যুগ যুগান্তর ধরে প্রকৃত ইসলামের অনুসারীদের জন্য প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, কারবালার ঘটনা সম্পর্কে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা মতৈক্যের বরখেলাফে ইদানিং কিছুসংখ্যক লোক একদিকে কারবালার ঘটনার গুরুত্ব হ্রাস করার লক্ষ্যে অভিনব সব ব্যাখ্যা দিয়ে এমনকি আশুরার এ শোকের দিনকে আনন্দের দিন বলে অভিহিত করার মতো জঘন্য মানসিকতার প্রদর্শন করতে দ্বিধা করছে না। অন্যদিকে কারবালার এ ঘটনাকে তারা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ও ইয়াযীদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই হিসেবে চিত্রিত করার এবং ইয়াযীদকে নির্দোষ প্রমাণের ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা দাবি করছে যে, ইয়াযীদের অনুমতি ছাড়াই কারবালার ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। আমরা এ ব্যাপারে তাদের বিবেকের কাছে একটাই প্রশ্ন করব : যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে যারা এ জন্য দায়ী ইয়াযীদ তাদেরকে শাস্তি দেয় নি কেন?
আমরা আশুরা উপলক্ষে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি, বিশেষ করে নিউজ লেটারের পাঠক-পাঠিকাদের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।