শেখ সাদির কবিতার চিরন্তন আবেদন
পোস্ট হয়েছে: জুন ১৫, ২০২১
ফারসি সাহিত্যগগণের প্রোজ্জ্বল দিকপাল কবি শেখ সাদি। তার গুলিস্তান ও বুস্তান বিশ^সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। শাসকশ্রেণি থেকে সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের বাস্তব রূপ চিত্রায়িত হয় তার কবিতায়। কাব্যরস উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পরিশীলিত ও উন্নত জীবনের বার্তাবহ। কুরআন, হাদিস, ইসলামি ঐতিহ্য, সমাজবিজ্ঞান, নৈতিক মূল্যবোধ ইত্যাকার বিষয় তাঁর সাহিত্যমানকে করে মহিমান্বিত। মানবিকতার মর্মবাণী ঝংকৃত হয় কবিতার পরতে পরতে। মনন ও বাস্তব জীবনে মানুষের কাক্সিক্ষত বাসনার প্রতিফলিত রূপ সাদির কবিতা। দৈশিক, ভাষিক ও কালিক সীমা-পরিসীমার ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার মৌলিক ভাবসম্মিলনে সাদির কবিতার আবেদন চিরন্তন ও অমর। মহাকালের উজ্জ্বল শিল্পনিদর্শন। অমর নান্দনিক রত্মভা-ার সৃষ্টির মাধ্যমে কবি বেঁচে আছেন মানবমনে যুগ যুগান্তরে।
সাহিত্যাকাশের এই মহান জ্যোতিষ্কের পূর্ণ নাম মোশাররাফ উদ্দিন মোসলেহ বিন সাদি শিরাজি। ১২০৯ সালে ইরানের ফারস প্রদেশের শিরাজ নগরে তাঁর জন্ম। সম্ভ্রান্ত পারিবারিক পরিবেশেই লেখাপড়ার হাতেখড়ি। শিরাজেই প্রাথমিক শিক্ষার পরিসমাপ্তি। সমকালীন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসা থেকে তাফসির, হাদিস, ফিকহ, আকাইদ, যুক্তিবিদ্যা, গ্রীকদর্শনে হয়ে ওঠেন পারঙ্গম। তাঁর বিখ্যাত শিক্ষাগুরু হলেন জামাল উদ্দিন আবুল ফারাজ আবদুর রহমান জাওজি ও শেখ শিহাব উদ্দিন সোহরাওয়ার্দি। শৈশবকাল থেকে প্রখর ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন কবি শেখ সাদি। সাহিত্যকর্মে যার নিদর্শন দীপ্যমান।
ভ্রমণপিপাসু এই মহান কবি পৃথিবীর নানা জনপদে বৈচিত্র্যময় মানুষের সান্নিধ্যে উপনীত হন। সমকালীন যুগজিজ্ঞাসার কৌতুহল নিবৃত হয় কাব্যরসের আস্বাদনের মাধ্যমে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জুলুম-নির্যাতন, মানবাধিকারের প্রতিফলন ঘটে কবিতায়। মূলত শেখ সাদির জীবন তিন ভাগে বিভাজ্যÑ অধ্যয়নকাল, ভ্রমণকাল ও শিরাজে প্রত্যাবর্তন। ১২২৬ থেকে ১২৫৬ সাল পর্যন্ত ব্যাপৃত তার বর্ণাঢ্য ভ্রমণজীবন। এশিয়া, তুরস্ক, বলখ, আরব, সিরিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল, ভারতবর্ষের পাঞ্জাব ও গুজরাট ভ্রমণ করেন। বিভিন্ন দেশ ও জাতির কৃষ্টি-কালচার, সভ্যতা, উত্থান-পতন, সমাজ, ধর্ম, রীতিনীতিসমৃক্ত অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করে ১২৫৬ সালে প্রিয় স্বদেশভূমি ইরানের শিরাজে প্রত্যাবর্তন করেন। মধ্যযুগের বিশ্বপর্যটকের মধ্যে ইবনে বতুতার পরই তাঁর স্থান। সমকালীন ইরানের শাসক আবু বকর বিন সাদ জাঙ্গি ছিলেন বিদ্যোৎসাহী সম্রাট। সাদি সাহিত্যচর্চায় তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তাঁরই প্রশংসায় রচিত হয় অসংখ্য কাসিদা বা প্রশস্তিমূলক কবিতা। ১২৯১ সালে তিনি এই ধরণীর মায়া ত্যাগ করে মহান ¯্রষ্টার সান্নিধ্যে উপনীত হন। শিরাজ শহরের সাদিয়া নামক স্থানে খানকার পাশেই তিনি সমাহিত হন।
যেসব মনীষীর প্রদীপ্ত আলোচ্ছটায় ফারসি সাহিত্যাকাশ উদ্ভাসিত কবি শেখ সাদি তাঁদের শীর্ষে। পদ্য ও গদ্য উভয় শাখায় তাঁর সফল চাষবাষ। প্রকৃতপক্ষে সুন্দর, পরিশীলিত, শান্তিময় পৃথিবী গড়ার গভীর প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়। ক্লাসিক সাহিত্যে বিশেষ শ্রেণির প্রাধান্য থাকলেও শেখ সাদির কবিতায় রাজা-বাদশাহ থেকে সাধারণের মনোলোকের সুপ্ত অনুভূতির চিত্রায়ণ ঘটে। কবিতার আবেদন সর্বজনীন। ‘বুস্তান’ ও ‘গুলিস্তান’ তাঁর অনবদ্য শিল্পকর্ম। ‘বুস্তান’ বা সাদিনামা কাব্যগ্রন্থটি দশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। রাষ্ট্রপরিচালনা পদ্ধতি ও ন্যায়বিচার, দয়া-অনুগ্রহ, প্রেম-ভালোবাসা, বিনয়-নম্রতা, সম্মতি, সন্তোষ বা তৃপ্তি, প্রশিক্ষণ, সুস্থতায় কৃতজ্ঞতা, অনুতাপ ও সঠিক পথ এবং আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা। ১২৫৭ সালে রচিত গ্রন্থটি সমকালীন শাসক সাদ বিন আবি বকর বিন সাদ জাঙ্গির নামে উৎসর্গীকৃত। রাষ্ট্রপরিচালনাবিধি, ন্যায়বিচার, দয়া-দাক্ষিণ্য, প্রেম-ভালোবাসা, বিনয়-নম্রতা, সন্তোষলাভ, প্রশিক্ষণ, কৃতজ্ঞতা এবং আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা এর প্রতিপাদ্য। রূপক, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, শিল্পরূপের সমাহারে এক প্রাতিস্বিক সৃষ্টিকর্ম ‘বুস্তানে সাদি’। সহজ, সরল ভাষায় রচিত এ গ্রন্থের আবেদন সর্বজনীন। ইতিহাস-ঐতিহ্য, জীবনগাথা, দর্শন, কাব্যরস, মূল্যবোধের এ অপরূপ সৃষ্টি। শেখ সাদির ‘বুস্তান’ মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের ভাবসম্মিলনে এক অপরূপ সৃষ্টি। প্রখ্যাত সাহিত্যসমালোচক ই জি ব্রাউনের মতে,
ডযবহ ঝধ‘ফর রং ফবংপৎরনবফ (ধং যব ড়ভঃবহ রং) ধং বংংবহঃরধষষু ধহ বঃযরপধষ ঢ়ড়বঃ, রঃ সঁংঃ নব নড়ৎহব রহ সরহফ ঃযধঃ, পড়ৎৎবপঃ ধং ঃযরং ারবি রহ ধ পবৎঃধরহ ংবহংব ঁহফড়ঁনঃবফষু রং, যরং বঃযরপং ধৎব ংড়সবযিধঃ ফরভভবৎবহঃ ভৎড়স ঃযব ঃযবড়ৎরবং পড়সসড়হষু ঢ়ৎড়ভবংংবফ রহ ডবংঃবৎহ ঊঁৎড়ঢ়ব.
শেখ সাদির অপর এক বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গুলিস্তান’ রচিত হয় ১২৫৮ সালে। গদ্য ও পদ্যে রচিত গুলিস্তানে রাজচরিত্র, সন্তোষের মূল্য, নীরবতার উপকারিতা, প্রেম ও যৌবন, দুর্বলতা ও বার্ধক্য, শিক্ষার গুণ ও কথাবার্তার শিষ্টাচারিতা ইত্যাকার বিষয় স্থান লাভ করেছে। ‘গুলিস্তান’-এর স^াতন্ত্র্য হলো এর প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে কাহিনী বা গল্পের অবতারণা এবং পরিসমাপ্তি ঘটেছে কবিতার মাধ্যমে। সাহিত্যচর্চায় গদ্য ও পদ্যের অপরূপ সম্মিলন ফারসি সাহিত্যে দুর্লভ।
‘কুল্লিয়াতে সাদি’ তাঁর বহুমাত্রিক কবিতাসংকলন। কাসিদা, গজল, কেতআ, তারজিবান্দ, রুবাই, মাকালাত ও আরবি কাসিদার সমাহার। জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, হাস্যরস ও কৌতুকপ্রিয়তা, সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, আবেগময় অভিব্যক্তি ও মানবপ্রেম তাকে পাঠকপ্রিয় করে তোলে। আল্লাহর প্রশংসা, রাসূল (সা.)-এর শানে নাত, বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের উপদেশ বাণী, শোকগাথা, শাসকশ্রেণির প্রশংসা এবং হালাকু খানের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, আরবি ছন্দের আলোকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের অবতারণা তাঁর কবিতাকে করেছে ঋদ্ধ। ফারসি ও আরবি ভাষার সম্মিলন কবিতার এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য।
কবিরা সত্য, সুন্দর, ন্যায়ের প্রতীক। নান্দনিক রসাস্বদনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা জীবনবোধের নিপুণ শিল্পী। এ ধারায় শেখ সাদি বিশ^সাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ শিল্পীসত্তা। তিনি রাজা-বাদশাহ থেকে সর্বস্তরের মানুষের জীবনকে সুন্দরের দিক অনুপ্রাণিত করেন। রাষ্ট্র, সমাজ, মূল্যবোধসহ নান্দনিকতার অপূর্ব সম্মিলন তাঁর কবিতা। মানুষের যাপিত জীবনের চিত্রায়ণ, সামাজিক ত্রুটি-বিচ্যুতি নিরূপণ, রাজা-প্রজার মৌল শিক্ষণীয় দিকগুলোর স্বরূপ উন্মোচিত হয় তাঁর কবিতায়। ‘বুস্তানে সাদি’র সূচনা হয় মহান আল্লাহর প্রশংসাবাণীর মধ্য দিয়েÑ
حکيم سخن در زبان آفرين بنام خداوند جان آفرين
کريم خطا بخش پوزش پذير خداوند بخشندهء دستگير
‘প্রাণের স্রষ্টা আল্লাহর নামে শুরু
তিনি মহাজ্ঞানী, মুখে ভাষা সৃষ্টিকারী।
আল্লাহ তাআলা ক্ষমাশীল ও সাহায্যকারী
দয়ালু এবং অপরাধীর গুণাহ মার্জনাকারী।’
রাসূলের (সা.) প্রশস্তিগাথা ইরানি কবিদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। শেখ সাদিও এর ব্যতিক্রম নন। রাসূলের জীবনাদর্শনের শ্রেষ্ঠতম নমুনার পরিচয় মেলে তাঁর কবিতায়। রাসূলের শানে তাঁর রচিত নাত যুগ যুগ ধরে ইসলামি ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সমাদৃত হয়ে এসেছেÑ
کشف الدجی بجماله بلغ العلی بکماله
صلوا عليه و آله حسنت جميع خصاله
‘চারিত্রিক মাধুর্যে সম্মানের উঁচুতে আসীন তিনি
স্বভাব ও সৌন্দর্যের দ্যুতিতে বিদূরিত হয় অন্ধকার।
তাঁর উন্নত গুণাবলি শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ শিখরে
তাঁর প্রতি দরুদ পড় এবং পরিবারের জন্য রহমত কামনা কর।’
মানবিক মূল্যবোধের নির্যাসে পূর্ণ শেখ সাদির কবিতা। সমাজ সংশোধনের ক্ষমতা যাঁদের হাতে নিবদ্ধ সেই শাসকেরা যেন মানুষের কল্যাণ সাধনে প্রবৃত্ত হন। অন্যায়কে প্রতিারোধ করেন। তাতেই নিহিত ধরণীর অধিবাসীদের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। তাঁর কবিতা শাসকশ্রেণিকে দায়িত্বানুগ হওয়ার প্রেরণা জোগায়। বিশ^চরাচরে মানবিকতা ও সভ্যতার উৎকর্ষে শেখ সাদির কবিতাÑ
ره پارسايان اميد ست و بيم اگر جادهء بايدت مستقيم
باميد نيکی و بيم بدی طبيعت شود مرد را بخردی
در اقليم و ملکش پنه يافتی گرين هردو در پادشاه يافتی
باميد بخشايش کردگار که بخشايش آرد بر اميدوار
‘যদি সরল সঠিক পথ নিশ্চিত করতে চাও
পরহেজগারগণের পথেই রয়েছে প্রত্যাশা ও ভয়।
জ্ঞানীদের জন্য এটাই স্বাভাবিক
কল্যাণের প্রত্যাশা ও মন্দের ভয়।
এ দুটি মহৎ গুণ বাদশাহের মধ্যে প্রত্যক্ষ হলে
দেশে-মহাদেশে কল্যাণের আধার হবে।
কেননা, আশাবাদীর জন্য রয়েছে তাঁর ক্ষমা
মহান স্রষ্টার ক্ষমার প্রত্যাশী হওয়ার তরে।’
এ পৃথিবীর সব মানুষের সৃষ্টিমূল একই উপাদান। আবার প্রত্যাবর্তনস্থলও একই। গর্ব ও অহংকার প্রদর্শনের মৌলিক কোনো উপাদান তার নেই। ওপারে সবাই সম্মুখীন হবে এপারের হিসেবে-নিকেশে। তাই শেখ সাদি জীবনকে পরিশীলিত ও বিনয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করেনÑ
پس ای بنده افتادگی کن چو خاک زخاک آفريدت خداوند پاک
چو گردن کشيد آتش هولناک حريص و جهان سوز و سرکش مباش
‘মাটি থেকে মহান আল্লাহ তোমাকে তৈরি করেন
বিনয়ী হও তুমি মাটির এ ধরণীতে।
লোভী, বিধ্বংসী ও অত্যাচারী হয়ো না তুমি
যেন ভয়াবহ আগুন মাথা গুটিয়ে নেয়।’
মানুষে মানুষে নেই কোনো ভেদাভেদ। সৃষ্টিমূলে সবাই একই উপাদান থেকে তৈরি। রাজা-প্রজার স্থায়ী বাসস্থান একই মাটির নিচে। ক্ষণস্থায়ী এ ধরণীতলে গৌরব-অংহারের কিছু নেই। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানী সেই যে নিজেকে পরম¯্রষ্টার সাথে সম্পৃক্ত করে তোলেন। এ পার্থিব জীবনযাত্রা সম্পর্কে শেখ সাদি বলেনÑ
دل اندر جهان آفرين بند و بس جهان، ای برادر، نماند به کس
که بسيار کس چون تو پرورد و کشت مکن تکيه بر ملک دنيا و پشت
چه بر تخت مردن، چه بر روی خاک چو آهنگ رفتن کند جان پاک
‘পৃথিবী কারো চরস্থায়ী আবাস নয়
স্রষ্টার সাথে হৃদয়কে আবদ্ধ করো।
পৃথিবী রাজত্বের লোভে হীন আচরণ করো না
তোমার মতো অনেকেই লালিত ও নিঃশেষ হয়ে গেছে
যখন পবিত্র প্রাণপাখি চলে যাবার সুর তোলে
সিংহাসনে অথবা মাটির ধূলিতে মৃত্যুতে কিইবা যায় আসে।’
মানুষের দৈনন্দিন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তাদের সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে। সৌজন্য-শিষ্টাচার পরিশীলিত মনসিকতার পরিচায়ক। সংস্কৃতিবান মানুষের কথা-বার্তা, আচার-আচরণ সবই উন্নত হয়। সমাজের বহুমাত্রিক দিকগুলো উন্নত হয়। পারস্পরিক সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহারের বিভিন্ন দিকও ফুটে ওঠে শেখ সাদির কবিতায়Ñ
سخن ر سر است اى خردمند و بن میاور سخن در میان سخن
خداوند تدبیر و فرهنگ و هوش نگوید سخن تا نبیند خموش
‘বক্তব্য রহস্যময় হে জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ
অপরের কথার মাঝে বলো না কোনো কথা।
সভ্য, সংস্কৃতিবান ও জ্ঞানবান ব্যক্তি
নীরবতা না দেখলে কথা বলে না কখনো।’
মানবতার মূলমন্ত্র সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এক আদমসন্তান। বিশে^র যে কোনো প্রান্তে একজন মানুুষ ব্যথিত হলে তার দুঃখে সবার পীড়িত হওয়া উচিত। এতেই নিহিত মানবতার মহান পরিচয়। যদি অপরের ব্যথায় হৃদয় কেঁপে না ওঠে তাহলে মনুষত্বের মর্যাদা হীন হয়ে যায়। পৃথিবী সব মানুষকে একই বন্ধনে বেঁেধ কবি সাম্য, শান্তি ও সুখের পৃথিবী গড়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেনÑ
بنی آدم اعضای یکدیگرند که در آفرینش ز یک گوهرند
چو عضوی به درد آورد روزگار دگر عضوها را نماند قرار
تو کز محنت دیگران بی غمی نشاید که نامت نهند آدمی
‘আদমসন্তান একে অপরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
সৃষ্টি হয়েছে মূলত একই মূল উৎস থেকে।
যদি একটি অঙ্গ কালের ঘূর্ণিতে হয় ব্যথিত
অপর অঙ্গের থাকে না কোনো প্রশস্তি।
তুমি যে অপরের দুঃখ-কষ্টে নির্বিকার
মানুষ নামের ভূষণ থাকতে পারে না তোমার।’
মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ মানবজীবনকে উন্নত করে। লোভ-লালসা, ধনসম্পদের আকাক্সক্ষা মানুষকে বিপথে নিয়ে যায়। পৃথিবীতে মানুষ যা অর্জন করে তার যৎসামান্যই ভোগ করতে পারে। তবু বৈষয়িক প্রভাব-প্রতিপত্তির চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি মানুষ পার্থিব প্রভাব, কর্তৃত্ব, সম্পদের পাহাড় গড়তে অন্যায় পথ বেছে নিতেও কুণ্ঠিত হয় না। প্রকৃতপক্ষে আত্মিক প্রশান্তি ও উন্নত জীবন প্রাপ্তসম্পদে সন্তুষ্ট থাকার ওপরই নির্ভরশীল। অসম, অন্যায় প্রতিযোগিতা মানুষকে মৃত্যু অবধি ঊধ্বশ^াসে এগিয়ে নিয়ে চলে। অথচ নিঃশ^াস বন্ধ হয়ে গেলে এসবই মূল্যহীন হয়ে যায়। কোনোকিছুই তার বিন্দুমাত্র কাজে আসে না। অল্পে তুষ্টি ও প্রতিকূলতায় ধৈর্য মানুষের জীবনকে সুন্দর, সত্য, কল্যাণের পথে ধাবিত করে। কবির ভাষায়Ñ
که ورائ تو هیچ نعمت نیست ای قناعت توانگرم گردان
هرکرا صبر نیست حکمت نیست. کنجِ صبر اختیار لقمان است
‘ওহে অল্পে তুষ্ট অবলম্বনকারী গতিশীল প্রাণ
তোমার মতো নেয়ামতের ধারক কেউ নেই এ ধরণীতে।
ধৈর্য অবলম্বন লোকমানেরই (আ.) শিক্ষার প্রতিফলন
ধৈর্য নেই যার; প্রজ্ঞার সন্ধানও মিলবে না তার।’
জীবনের এক আনন্দময় রূপ প্রেম। এ সৃষ্টিজগতের মূলে রয়েছে প্রেমেরই অনুভূতি। প্রেমেই ভাঙা, প্রেমেই গড়া। ঐশী প্রেমের বহ্নিশিখা মানবমনে এক অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। প্রতিনিয়ত তাকে পরমাত্মার সান্নিধ্যে উপনীত হবার দিকে তাড়িত করে। বৈষয়িক প্রেম-ভালোবাসাও জীবনকে মহিমান্বিত করে। নর-নারীর পূতঃপবিত্র প্রেম ¯্রষ্টারই এক বিশেষ নিদর্শন। ভালোবাসার পরশে মানুষ অসাধ্যকে সহজ করে তোলে। কাঁটাযুক্ত পথপরিক্রমাও পুষ্পকাননে পরিণত হয়। যুগে যুগের ভালোবাসার পরীক্ষায় মানুষ জীবন বিসর্জন দিতেও এতটুকু পিছপা হয়নি। সৃষ্টির প্রেরণামূলে রয়েছে প্রেম। প্রেম-ভালোবাসাহীন জীবন যেন মরীচিকায় বিচরণ। কোনো নান্দনিক দিকও তার কাছে সুন্দর রূপে ধরা দেয় না। শেখ সাদিও তাঁর কবিতায় প্রেমের ঐশ^র্য তুলে ধরেন এভাবেÑ
نشان صورت یوسف دهد بناخوبی کسی بدیدهءانکار گر نگاه کند
فرشته اش بنماید بچشم محبوبی. و گر بچشم ارادت نگه کند در دیو
‘কেউ যদি ভালোবাসাহীন হৃদয়ে কারো পানে তাকায়
ইউসুফের সৌন্দর্যময় অবয়বও তার কাছে অনুজ্জ্বল মনে হবে।
আর যদি কেউ প্রেমের মননে দৈত্য-দানবের প্রতি দৃষ্টি দেয়
প্রেমিকের চোখে তাকেও ফেরেশতার মতো মনে হবে।’
মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। এদের মাঝেও শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণিত হয় জ্ঞানের মানদ-ে। যে যত বেশি জ্ঞানী তার মর্যাদাও তত উন্নত। জ্ঞানই শক্তির মূল। জ্ঞান রাজা-বাদশাদের অলংকার। জ্ঞানই প্রকৃতপক্ষে সমৃদ্ধির মূল হাতিয়ার। সাধারণ মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বলে নেতৃত্বের মর্যাদায় আসীন। আবার রাজপুত্রও জ্ঞানের শক্তির অভাবে পরিণত হয় সাধারণ মানুষে। ইরানের জাতীয় কবি ফেরদৌসি থেকে শুরু করে প্রায় সব ফারসি কবিই জ্ঞানকে সবকিছুর চেয়ে মূল্যবান হিসেবে আখ্যা দেন। বর্তমান বিশে^ও তথ্য-প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ জাতির হাতের মুঠোয় সমগ্র পৃথিবী। যুগে যুগে জ্ঞানই মানুষের মর্যাদার নির্ণায়ক। শেখ সাদির কবিতায় রয়েছে সর্বজনীন সত্যের মূল প্রেরণা। জীবনকে গতিশীল, প্রাণময়, মর্যাদাবান করতে তাঁর কবিতা এক বিশেষ ভাবরসে পূর্ণ। কবির ভাষায়Ñ
بوزیری پادشاه رفتند روستازادگان دانشمند
بگدائی بروستا رفتند. پسران وزیر ناقس عقل
‘গ্রাম থেকে আসা জ্ঞানীরা
বাদশাহর মন্ত্রীর মর্যাদায় আসীন।
মন্ত্রীর জ্ঞানহীন সন্তানেরা
গ্রামের সাধারণ মানুষে পরিণত।’
মানবজীবনে প্রকৃত শিক্ষা ও উপযুক্ত পরিবেশের প্রভাব অপরিসীম। প্রতিটি মানুষ স্বাভাবিকভাবেই স্বীয় প্রতিভা নিয়ে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়। সঠিক শিক্ষা ও পরিচর্যায় কেউ হয় উন্নত চরিত্রবান আবার কেউ বিপথগামী। মৌলিক মানবিক গুণাবলির সমাহার জীবনকে পরিশীলিত ও সুন্দর করে তোলে। সঠিক শিক্ষা ও পরিবেশের অভাবে বেড়ে ওঠা সন্তান সমাজকেও করে কলুষিত। তাই শিশুর যথাযথ প্রতিপালন পিতামাতাসহ সংশ্লিষ্ট সবারই অপরিহার্য কর্তব্য। যথাসময়ে পরিচর্যার অভাবে এই প্রতিভাময় মানুষগুলোও কালের বিবর্তনে হারিয়ে যায় গহীন অন্ধকারে। আলোকিত জীবনের পথ থেকে তারা হয় বঞ্চিত। কবি শিশুকাল থেকেই তাদের পরিচর্যা ও যথাযথ শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেনÑ
نشود خشک جز بآتش راست چوبِ تر را چنانکه خواهی پیچ
‘কাঁচা কাঠকে যেভাবে খুশি করতে পারবে বাঁকা
শুকিয়ে গেলে তা আগুনের তাপ ছাড়া হবে না কখনো সোজা।’
ফারসি কবি শেখ সাদির কবিতা মানুষের মননকে পরিশীলিত ও নৈতিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে। দৈশিক, কালিক ও ভৌগোলিক সীমাপরিসীমা পেরিয়ে জীবনকে সভ্য, উন্নত করে তোলে। জীবনবোধ, দর্শন, মূল্যবোধ, নান্দনিকতার অপূর্ব সম্মিলনে তাঁর কবিতা জীবনকে সত্য ও নান্দনিকতায় পূর্ণ করে দেয়। মানবজীবনে তাঁর কবিতার বাহ্যিক ও অন্তর্লোকের প্রেরণা সুদূরপ্রসারী। কবিতার ভাব-বিষয় ও শৈল্পিক নান্দনিকতা সভ্যতার উপজীব্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে। শেখ সাদিও স্বীয় শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন মহাকালের ঘূর্ণিপাকে।