রবিবার, ২৩শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শেখ সা’দীর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সাহিত্য সভা

পোস্ট হয়েছে: মে ৯, ২০১৬ 

news-image

বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইরানের বিখ্যাত কবি শেখ সা’দী জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ৮ মে রোববার এক সাহিত্য সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের হাফেজ প্রাঙ্গণ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আবদুস সবুর খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এই দুই কবির সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর ড. ফরহাদ দরুদগারিয়ান, একই বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান, সহযোগী অধ্যাপক ড. আবু মূসা মোঃ আরিফ বিল্লাহ, অধ্যাপক ড. তারিক জিয়াউর রহমান সিরাজী ও প্রভাষক জনাব মেহেদী হাসান।

thumbnail_IMG_2556সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী বলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবি শেখ সা’দী ছিলেন বাংলা ও ফারসি সাহিত্যের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র। সাহিত্য অঙ্গনে এই দুই কবির খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। তাদের লেখা নৈতিক ও মানবিক বার্তা মানবসমাজের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে আছে।

তিনি বলেন, ফারসি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শেখ সা’দীর পুরো নাম ‘মোশারফ উদ্দিন বিন মোছলেহ উদ্দিন আবদুল্লাহ সা’দী শিরাজী’।

৫৮১ হিজরিতে ইরানের শিরাজ শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শিশু বয়সেই তিনি পরিবারে কাছ থেকে ধর্মীয় ও সাহিত্য শিক্ষা শুরু করেন।

প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি বাগদাদ গমন করেন। এই শহরের সে সময়ের অন্যতম বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্তমান ইরাকের রাজধানী বাগদাদে অবস্থিত নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেন। সেখানে তিনি ইসলাম ও বিজ্ঞান, আইনশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস ও আরবি সাহিত্যের ওপর ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণা করেন। তারপর বাস্তব জ্ঞান অর্জনের জন্য বের হয়ে পড়েন বিশ্বভ্রমণে। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ফিলিস্তিন ও সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন তিনি। খুব কাছ থেকে দেখা মানুষের জীবনের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, আবেগ-অনুভূতিগুলো তিনি তুলে ধরেন তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে।  তাঁর লেখা বিখ্যাত দু’টি গ্রন্থ হলো : ১. বোস্তান (বাগান) ২. গুলিস্তান (গোলাপ বাগান)

thumbnail_IMG_2618‘বোস্তান’ বইতে পরিপূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে সঠিক জীবন যাপন, ক্রোধ থেকে দূরে থাকা, সহমর্মিতা ও অপরের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হওয়ার মতো বিষয় তুলে ধরা হয়।

মহাকাব্যের ব্যঞ্জনায় তিনি ন্যায়বিচার, উদারতা, মধ্যমপন্থাকে উপস্থাপন করেছেন ‘বোস্তান’ কাব্যে। একজন সত্যিকারের মানুষের আচার-আচরণ কেমন হওয়া উচিত ‘বোস্তান’তে তিনি তা তুলে ধরেছেন সুন্দর ও অনুপম উপমার মাধ্যমে। আর ‘গুলিস্তান’ এ হৃদয়গ্রাহী পদ্ধতিতে নৈতিকতার বিষয়াদি গল্পাকারে পরিবেশন করা হয়েছে। চিত্তাকর্ষক করার উদ্দেশ্যে বর্ণনার মাঝে মাঝে কবিতার সংযোজন রয়েছে। কুরআন ও হাদীস থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করে বক্তব্য সুন্দর ও জোরালো করা হয়েছে। এ দুটি গ্রন্থ একত্রে ‘সা’দীনামাহ’ নামে পরিচিত। এতে বর্ণিত ঘটনাপুঞ্জ সা’দীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি।

শেখ সা’দীর বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম ‘গুলিস্তান’ ও ‘বোস্তান’ দুটিই গদ্য-পদ্যের মিশ্রণে রচিত। এ ছাড়াও তিনি লিখেছেন লিরিক বা গীতিকাব্য গ্রন্থ ‘গাজলিয়াত’ ও দীর্ঘ গীতি কবিতা বা ‘কাসিদা’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলা তথা ভারতবর্ষের বিশিষ্ট কবি, ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক।

তাঁর রচনা আজ বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে ও হচ্ছে। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথই এশিয়া মহাদেশের প্রথম নোবেলজয়ী সাহিত্যিক।

এই বিশ্বকবির ইরানের প্রতি ছিল ব্যাপক আগ্রহ। তিনি দুই বার ইরান সফর করেন। প্রথমবার তিনি ১৯৩১ সালে ইরান সরকারের আমন্ত্রণে ইরান সফর করেন। এই সফরে ইরানের বিভিন্ন লেখক, কবি ও সাহিত্যিকদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। এর মধ্য দিয়ে  ইরান ও ভারতবর্ষের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে  সাহিত্য ও সংস্কৃতির আদান প্রদানের একটা বিরাট ক্ষেত্র তৈরি হয়।

১৯৩৪ সালে রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় বার ইরান সফর করেন। এসময় তিনি তেহরান, ইসফাহান, শিরাজ ও বুশহর ঘুরে দেখেন এবং এই শহরগুলোর কবি-সাহিত্যিকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন।

ড. দরুদগারিয়ান বলেন, শেখ সা’দী ও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুজনই ছিলেন বিশ্ব মানবতার কবি। এই দুই বিশ্বকবিই শিশু বয়সেই এতিম হয়েছেন। বাল্য বয়সেই সা’দী তার বাবাকে হারিয়েছেন আর রবী ঠাকুর তার মাকে হারিয়েছেন। ১৩ বছর বয়সে মাতৃহারা হন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উচ্চ শিক্ষার জন্য ব্রিটেনে যান এবং পশ্চিমা সভ্যতার সাথে পরিচিত হন। ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।  তার সাহিত্যকর্মকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন ১. কবিতা সমগ্র ২. নাটক ৩. উপন্যাস ও ছোট গল্প এবং ৪. প্রবন্ধ ।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শেখ সা’দী দুজনই সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শেখ সা’দী বলেন, আমার পরিবারের সবাই ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। সা’দী আরবি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন আর রবী ঠাকুর ছিলেন ইংরেজি ভাষায়। নিজ ভাষার বাইরে বিদেশি ভাষায় তাদের এই পারদর্শিতা তাদের সাহিত্যকর্মকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।

ড. সাইফুল ইসলাম খান বলেন, ফারসি সাহিত্যে নীতিশাস্ত্র বা নীতিসাহিত্য রচনায় যে কয়েকজন কবি-সাহিত্যিকের নাম উল্লেখ করা যায় শেখ সা’দী তাদের অন্যতম। তিনি ছিলেন সুস্পষ্টভাষী। ফেরদৌসির পর ফারসি সাহিত্যের সুন্দর আকাশকে যিনি নিজ আলো দ্বারা উজ্জ্বলতর করেছেন তিনি হলেন ইরানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শেখ সা’দী।

ড. আরিফ বিল্লাহ বলেন, বিদেশি ভাষায় পারদর্শিতা সাহিত্যকর্মকে যে সমৃদ্ধ করে, সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতা থেকে আমি তা উপলব্ধি করি। তিনি বলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও  শেখ সা’দী বিদেশ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে তাদের অভিজ্ঞতাকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন এবং তাদের লেখার মাধ্যমে চারদিকে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। গেয়েছেন মানবতার জয়গান। তিনি বলেন, আমরা যদি এই দুই বিশ্বকবির মানবতার জয়গানকে অনুসরণ করি তাহলে বর্তমান বিশ্বে যে সহিংসতা চলছে তা আর থাকবে না।

ড. তারেক জিয়াউর রহমান সিরাজী বলেন, শেখ সা’দী হলেন বিশ্ববিখ্যাত কয়েকজন কবির অন্যতম। তাঁর রচিত ‘গুলিস্তান’ ও ‘বোস্তান’ বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। অনেকে মনে করেন, এই গ্রন্থ দুটি অধ্যয়ন ব্যতীত ফারসি সাহিত্য অধ্যয়ন অপূর্ণ থেকে যায়। এ গ্রন্থ দুটি একত্রে ‘সাদীনামাহ’ নামে পরিচিত। নৈতিকতা বিষয়ক কাব্য হলো ‘বোস্তান’। আর নৈতিকতা বিষয়ক গদ্যগ্রন্থ হলো ‘গুলিস্তান’। ‘গুলিস্তানে’য় লেখক অত্যন্ত সহজ সরল হৃদয়গ্রাহী ভাষায় নৈতিকতার বিষয় গল্পোচ্ছলে পরিবেশন করেছেন। এর ভেতর অবশ্য কবিতাও আছে। এমনকি কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতিও লেখক ব্যবহার করেছেন নিজের বক্তব্যকে সুন্দর ও জোরালো করার জন্য। ড. সিরাজী তার আলোচনা শেষে ‘কামলে মুহাম্মদ’ নামে কবি শেখ সা’দীর একটি গজল পড়ে শোনান।

একই বিভাগের শিক্ষক জনাব মেহেদী হাসানসহ বিশ্ববিদালয়ের কায়েকজন ছাত্রছাত্রীর আলোচনা, কবিতা ও গান পরিবেশনা অনুষ্ঠানকে আরো প্রাণবন্ত করেছে। অনুষ্ঠান শেষে কবি শেখ সা’দীর উপর একটি প্রামাণ্যচিত্রও দেখানো হয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন বিভাগের শিক্ষক জনাব আহসানুল হাদী।