শুক্রবার, ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

মাশহাদ ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানীর মর্যাদা পেল

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৬, ২০১৭ 

অতি সম্প্রতি ইসলামি জাহানে একটি বিরাট সাংস্কৃতিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে; তা হচ্ছে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মাশ্হাদকে ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-র অঙ্গ সংগঠন ইসলামিক এডুকেশন্যাল, সায়েন্টিফিক্ অ্যান্ড্ কাল্চারাল অর্গানাইযেশন (আইসেস্কো)-র পক্ষ থেকে চলতি ২০১৭ সালের জন্য ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মাশ্হাদ হচ্ছে ইরানের অন্যতম ধর্মীয় নগরী- যেখানে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পবিত্র আহ্লে বাইতের ধারাবাহিকতার অষ্টম মাসুম ইমাম হযরত আলী ইবনে মূসা র্আ-রেযা (আ.)-এর মাযার মুবারক অবস্থিত- যা বিশ্বের কোটি কোটি দ্বীনদার মুসলমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং এ কারণে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ যিয়ারতকারী ও পর্যটক এ শহরে আগমন করছেন।
উল্লেখ্য, ইসলামি সম্মেলন সংস্থা ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী নির্বাচনের দায়িত্ব স্বীয় অঙ্গ সংগঠন আইসেস্কো-র ওপর অর্পণ করেছে এবং সংগঠনটি মাশ্হাদকে এ বিরল মর্যাদার জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করেছে ও এ মর্যাদা প্রদান করেছে। স্মর্তব্য, বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে ওআইসি গঠন করা হয় এবং এর সদর দফতর মরোক্কোর রাজধানী রাবাতে অবস্থিত।
ওআইসি কর্তৃক আইসেস্কো গঠনের পেছনে নিহিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলিম দেশ সমূহে শিক্ষার বিস্তার সাধন, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রসার ঘটানো, মুসলিম পণ্ডিত ও মনীষীদের মধ্যে সহযোগিতা সৃষ্টি, পশ্চিমা বিশ্বের ও অন্যান্য অমুসলিম প্রধান দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান এবং সর্বোপরি সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে সহযোগিতা সৃষ্টি, বিশেষ করে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিনিময় গড়ে তোলা।
আইসেস্কো তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিশ্বের দেড়শ’ কোটিরও বেশি মুসলমানকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে স্বীয় কর্মতৎপরতার জন্য যেসব ক্ষেত্রকে বেছে নিয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে বিশ্বায়নের লাগামহীন সাংস্কৃতিক প্লাবন কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া সাংস্কৃতিক মানদ-ের মোকাবিলায় ইসলামি জাহানের জন্য একটি সাংস্কৃতিক কর্মকৌশল উদ্ভাবন ও তার বাস্তবায়ন। এ লক্ষ্যেই আইসেস্কো ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী নির্বাচনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে- যা নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন দিক থেকে ইসলামি উম্মাহ্র উত্তরাধিকারের বিষয়টি দৃষ্টিতে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ২০০১ সালে দোহা-য় অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে ওআইসি-র সদস্য দেশসমূহের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রীদের বৈঠকে প্রথম বারের মতো ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী নির্বাচনের বিষয়টি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং এর ভিত্তিতে পবিত্র মক্কা নগরীকে ২০০৫ সালের জন্য ইসলামি জাহানের প্রথম সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ বৈঠকে পরবর্তী বছর সমূহের জন্য ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী নির্বাচনের দায়িত্ব স্বয়ং আইসেস্কো-র ওপর অর্পণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আইসেস্কো মাশ্হাদকে ২০১৭ সালের জন্য ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করেছে।
আইসেস্কো কর্তৃক মাশ্হাদকে ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে নির্বাচনের কারণ হচ্ছে এই যে, মাশ্হাদের কতগুলো ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
বহু শতাব্দী যাবত মাশ্হাদ বহু বিখ্যাত দ্বীনী, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের লালনভূমি হিসেবে ভূািমকা পালন করে এসেছে। এসব ব্যক্তিত্বের মধ্যে রয়েছেন মহাকবি ফেরদৌসী, ইসলামি মনীষী শেখ বাহাই ও শেখ তূসী এবং নিযামুল্ মুল্ক্-এর মতো বিরাট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এছাড়া মাশ্হাদ তার গোটা ইতিহাস জুড়েই বিভিন্ন মতাদর্শের আন্তক্রিয়া এবং বিভিন্ন স্থানীয় নৃতাত্ত্বিক ও মাযহাবী গোত্র এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সংযোগ স্থল হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
গত ২৪ জানুয়ারি (২০১৭) ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে মাশ্হাদের উদ্বোধন করা হয়। এটি ছিল এক অনবদ্য সাংস্কৃতিক কর্মসূচি। কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সূচিত এ কর্মসূচির মধ্যে ছিল বিশেষ সংক্ষিপ্ত যিয়ারত তথা হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার এলাকার জাদুঘরের একটি হলে সমবেত হয়ে তাঁর উদ্দেশে সম্মিলিত কণ্ঠে দরূদ পাঠ।
এ অনুষ্ঠানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের সংস্কৃতি ও ইসলামি নির্দেশনাবিষয়ক মন্ত্রী জনাব সালেহী আমীরী, আইসেস্কো-র উপমহাপরিচালিকা ড. আমিনাহ্ আল্-হাজ্রী, ইরানের খোরাসানে রাযাভী প্রদেশের প্রাদেশিক কর্মকর্তাগণ ও এ প্রদেশের কেন্দ্র মাশ্হাদের শহর প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ ছাড়াও বিশ্বের ৫১টি মুসলিম প্রধান দেশের আড়াই শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী বিদেশি মেহমানদের মধ্যে ছিলেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে অবস্থিত মুসলিমপ্রধান দেশসমূহের রাষ্ট্রদূতগণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকর্তাগণ, বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ইসলামি মনীষী ও চিন্তাবিদগণ এবং বহু ইরানি দ্বীনী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
এ অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ প্রদান করেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের খোরাসানে রাযাভী প্রদেশের গভর্নর জনাব আলীরেযা রাশীদীয়ান। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, মাশ্হাদে রয়েছে বড় বড় দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্র এবং এ দিক থেকে আরো বেশি সমৃদ্ধ হবার সুযোগ ও সম্ভাবনাও মাশ্হাদের রয়েছে। এর ফলে ইসলামি জাহানের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে মাশ্হাদের পক্ষে একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করা সম্ভব। তাই আজকের দিনে মাশ্হাদ তার সুউচ্চ মিনারসমূহ থেকে সমগ্র বিশ্ববাসীর উদ্দেশে ঐক্য, সংহতি, শান্তি, আন্তরিকতা ও ভ্রাতৃত্বের বাণী পৌঁছে দিতে সক্ষম।
এ অনুষ্ঠানে আইসেস্কোর উপমহাপরিচালিকা ড. আমিনাহ্ আল্-হাজ্রী তাঁর ভাষণে মাশ্হাদের প্রতি ইসলামি জাহানের সাগ্রহ দৃষ্টির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মাশ্হাদ সব সময়ই মানবিক সংস্কৃতির অগ্রগতির লক্ষ্যে অনন্য প্রভাবের অধিকারী ছিল এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আর মাশ্হাদের এ ভূমিকা তার মর্যাদাকে আরো বেশি বৃদ্ধি করেছে।
উল্লেখ্য, ড. আমিনাহ্ আল্-হাজ্রী প্রতি বছর একবার মাশ্হাদ সফর করে থাকেন এবং এখানে কীভাবে নিয়মিত যিয়ারতকারী ও পর্যটকদের আগমন ঘটে থাকে তা তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, বছরে দুই কোটিরও বেশি যিয়ারতকারী ও পর্যটক মাশ্হাদ সফর করে থাকেন। তিনি বলেন, মাশহাদের প্রতি মুসলমানদের এ আকর্ষণের কারণ হচ্ছে এই যে, এখানে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযারের উপস্থিতির ফলে এখানকার পরিবেশ হচ্ছে একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশ।
ড. আমিনাহ্ আল্-হাজ্রী আরো বলেন যে, ইসলামি সরকারসমূহের শাসনামলে এ শহরটি যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে এবং এখানে যেভাবে ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুরা পরস্পরের পাশাপাশি শান্তি ও সৌহার্দ্রপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছে তা এ দেশের শক্তির সংরক্ষণে এবং সংস্কৃতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ফলে মাশহাদের পক্ষে সাংস্কৃতিক পরিমার্জন ও উদ্ভাবনীর শীর্ষচূড়ায় উপনীত হওয়া সম্ভব।
আইসেস্কো-র উপমহাপরিচালিকা তাঁর ভাষণে আইসেস্কো কর্তৃক কোনো শহরকে ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনুসৃত শর্তাবলির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এ শর্তাবলি হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট শহরের ঐতিহাসিকতা ও সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতার অকাট্য দলিল থাকতে হবে, মানবিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির অগ্রগতিতে সহায়তায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে হবে, তার গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শনাদি থাকতে হবে, বিভিন্ন সক্রিয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে এবং এ ধরনের আরো কতগুলো শর্ত রয়েছে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে ইসেস্কা-র মানদ- বেশ কঠিন এবং আইসেস্কো তার নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ মানদ- কঠোরভাবে অনুসরণ করে থাকে, আর মাশ্হাদ্ এ মানদ-ের বিচারে ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে নির্বাচিত হবার জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হয়েছে।
এ অনুষ্ঠানে ইরান সরকারের সংস্কৃতি ও ইসলামি নির্দেশনাবিষয়ক মন্ত্রী জনাব সালেহী আমীরী তাঁর ভাষণে বলেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের সকল ইসলামি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও নৈতিকতার ধ্বনি উচ্চকিত করা অপরিহার্য। তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে তাঁর মিশনের মূল লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করতেন এবং আইসেস্কো কর্তৃক নির্ধারিত ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী নির্বাচনের শর্তাবলি এর ওপর ভিত্তিশীল।
জনাব সালেহী আমীরী সকল মুসলমানের মূলনীতিমালার অভিন্নতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বের মুসলমানরা একটি মাত্র শত্রুর সাথে মোকাবিলা করছেÑ যে শত্রু ইসলামের একটি সহিংস চিত্র তুলে ধরছে। এ পরিস্থিতিতে ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুরা চরম পন্থার আশ্রয় নিচ্ছে এবং যায়নবাদীরা ইসলামি জাহানে অনৈক্য ও বিভেদের বীজ বপনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
ইরান সরকারের ইসলামি নির্দেশনাবিষয়ক মন্ত্রী তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেন যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ পালনের কর্মসূচি প্রবর্তন করেন এবং এভাবে তিনি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলার জন্য পতাকাবাহীর ভূমিকা পালন করেন।
জনাব সালেহী আমীরী আরো বলেন, বর্তমানে ইসলামি জাহান দুইটি রণাঙ্গন থেকে হামলার সম্মুখীন; এ কঠিন পরিস্থিতিতে টিকে থাকার লক্ষ্যে ইসলামি উম্মাহ্র জন্য ঐক্য ও পারস্পরিক সহমর্মিতা অপরিহার্য। তিনি বলেন, ইসলামি বিপ্লবের নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী সব সময়ই ঐক্যের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করে আসছেন এবং তিনি ঐক্যকে ইসলামি জাহানের সমস্যাবলির একমাত্র সমাধান হিসেবে অভিহিত করে আসছেন।
জনাব সালেহী আমীরী বলেন, বর্তমানে ইসলামি জাহানে অতীতের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে অনৈক্য, বিভেদ ও সহিংসতার শিকার; আমরা আমাদের আচরণে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর শিক্ষা অনুসরণ করলে পুনরায় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে ও টিকে থাকতে সক্ষম হব। তিনি আরো বলেন, হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর সংস্কৃতি হচ্ছে সংলাপ ও সহমর্মিতার সংস্কৃতি এবং খোরাসানে রাযাভী প্রদেশের কেন্দ্র মাশ্হাদ হচ্ছে সভ্যতা ও উন্নত যোগাযোগের সংযোগস্থল, নতুন কথা বলার জন্য উপযুক্ত কেন্দ্র এবং অতীতকাল থেকে শুরু করে বর্তমান কালেও এ শহর ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে আন্তঃক্রিয়ার ময়দান।
‘অস্তনে ক্বুদ্সে রাযাভী’ নামে সুপরিচিত হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার কমপ্লেক্সের মুতাওয়াল্লী হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়েদ ইবরাহীম রাইসী এ অনুষ্ঠানে বলেন, ইসলামি জাহানের ঐক্য, সংহতি ও আত্মপরিচিতির মূল রহস্য হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর শিক্ষায় নিহিত রয়েছে। তিনি বলেন, মাশ্হাদ ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানীÑ এর মানে হচ্ছে এই যে, হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর শিক্ষা ও আচরণের বরকতে আজকে আমরা সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে ইসলামি সভ্যতাকে পরিচিত করার জন্য তুলে ধরতে পারব।
অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় আইসেস্কো-র উপমহাপরিচালিকা ড. আমিনাহ্ আল্-হাজ্রী ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের সংস্কৃতি ও ইসলামি নির্দেশনাবিষয়ক মন্ত্রী জনাব সালেহী আমীরীর কাছে আইসিস্কো-র একটি ফলক হস্তান্তর করেন। এছাড়া এ উপলক্ষে বহু মহামূল্য সাংস্কৃতিক নিদর্শনের আবরণ উন্মোচন করা হয়। এসবের মধ্যে ছিল স্বনামখ্যাত ক্যালিগ্রাফি শিল্পী মরহুম নাযীরী কর্তৃক স্বহস্তে লিখিত কোরআন মজীদের একটি কপি, চিত্রশিল্পী ওস্তাদ র্ফাশ্চিয়ানের অঙ্কিত কয়েকটি মূল্যবান চিত্র, সা‘ঈদ্ র্আযাকান কর্তৃক অঙ্কিত চিত্র, শাম্স্ আল্-শোমাস্ ক্যালিগ্রাফি চিত্র, ক্লিপ আর্ট, ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানীর বিশেষ জাতীয় সংগীত, মুসলিমপ্রধান দেশ সমূহের পরিচয় সম্বলিত গ্রন্থ ও ক্যালিগ্রাফি স্ক্রোল।
অনুষ্ঠানে মাশ্হাদ শহরের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয় যাতে এ শহরের অতীতের বহু শতাব্দীর বিভিন্ন চিত্র দেখানো হয়Ñ যা এর আগে কখনো দেখানো হয় নি। এছাড়া এ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে “গধংযযধফ, ঈঁষঃঁৎধষ ঈধঢ়রঃধষ ড়ভ ঃযব ওংষধসরপ ডড়ৎষফ ভড়ৎ ২০১৭” লিখিত একটি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া মাশ্হাদ শহরে পুরো ২০১৭ সালে অনুষ্ঠেয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানÑ যেগুলোর মোট সময়ের পরিমাণ হবে ২৩৮ মিনিটÑ সেগুলোর পরিকল্পনা পত্রের আবরণও উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী অতিথিদেরকে মাশহাদের পবিত্র স্থান সমূহ, জাদুঘর, কোরআন মজীদের ওয়ার্কশপ ও অস্তনে ক্বুদ্সে রাযাভীর লাইব্রেরি পরিদর্শন করানো হয়।
এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে, যে কোনো ইসলামি শহরকে ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে নামকরণ করার ক্ষেত্রে ঐসব শহরের যে অভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নেয়া হয় তা হচ্ছে, পর্যটন শিল্পের সহায়তায় সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামকে পরিচিত করা। অধিকন্তু, ইসলামের পরিচয় তুলে ধরা ও এর প্রচারের পাশাপাশি এ বিষয়টি বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করা এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে সাহায্য করার লক্ষ্যে একটি কর্মকৌশল হিসেবেও ভূমিকা পালন করতে পারে।
এভাবে, এ ক্ষেত্রে গ্রহণীয় সর্বোত্তম পদক্ষেপ হতে পারে পর্যটনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় পর্যটনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপসহ মাশ্হাদের পর্যটন আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রতি দৃষ্টি প্রদান করা।
মাশ্হাদে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার অবস্থিত বিধায় এ শহরটি এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েছে। অধিকন্তু এখানে যথাযথ পর্যটন সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে ইসলামি জাহানে মাশ্হাদের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য এখানে বিচিত্র ধরনের কর্মসূচি গ্রহণের প্রয়োজন হবে। তাছাড়া হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পবিত্র আহ্লে বাইতের ধারাবাহিকতার নিষ্পাপ ইমাম হিসেবে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযারের পরিচয় তুলে ধরা হলে তা মানবজাতিকে তাঁর চিন্তাধারা, আমল ও আচরণের সাথে পরিচিত করবে।
উল্লেখ্য যে, হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর জীবন চরিত থেকে জানা যায় যে, তিনি মুসলমানদের মধ্যকার বিভিন্ন মায্হাব ও ফির্কাহ্র এবং আসমানি কিতাবের অধিকারী অন্যান্য ধর্মের মনীষীদের সাথে অনেক সংলাপ ও বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন, এমনকি, ধর্মসম্পর্কহীন (সেক্যুলার)-দের ও নাস্তিকদের সাথে পর্যন্ত তাঁর সংলাপ ও বিতর্ক হয়েছে। এছাড়া তাঁর উপস্থিতিতে তাঁর শিষ্য ও অনুসারীদের সাথে ঐ সব প-িতের অনেক বিস্তারিত আলোচনা ও মত বিনিময় হয়েছে।
হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর জীবনের এ বিশেষ বৈশিষ্ট্যটিকে সারা বিশ্বের ইসলামি মনীষী ও চিন্তাবিদগণের নিজেদের মধ্যকার আলোচনা ও সংলাপের ক্ষেত্রে এবং আসমানি কিতাবের অধিকারী অন্যান্য ধর্মের প-িতদের সাথে চিন্তা ও মত বিনিময়ের লক্ষ্যে একটি অক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এছাড়া মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশসমূহ ও সেসব দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনী অনুষ্ঠান, পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আকর্ষণীয় বিষয়ে উৎসব অনুষ্ঠান, তাদের ঐতিহ্য, উত্তরাধিকার ও রীতিনীতি উপস্থাপন, তেমনি হস্তশিল্প ও বিভিন্ন রীতিনীতি সংশ্লিষ্ট শিল্পকলা উপস্থাপন ইত্যাদি মাশ্হাদকে বিপুল সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে, অনারব দেশগুলোর মধ্য থেকে মাশ্হাদকে ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণার পাশাপাশি সূদানের সেন্নান্ শহর ও জর্দানের রাজধানী আম্মানকে যৌথভাবে আরব দেশ সমূহের মধ্যে এবং উগান্ডার রাজধানী কাম্পালাকে আফ্রিকা মহাদেশে ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী