মানবাধিকার : ইসলামি ও পাশ্চাত্যের নিরিখ
পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ৩, ২০২১
মুজতাহিদ ফারুকী
মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদেরকে অধিকার কাকে বলে তা বুঝে নিতে হবে। বুঝতে হবে মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকারের মধ্যে পার্থক্য। এরপর আসবে মানবাধিকার ও ইসলামে মানবাধিকারের প্রসঙ্গ। সাধারণভাবে ‘অধিকার’ বলতে কোনো কিছুর উপর একজন মানুষের নৈতিক বা আইনগত দাবি বোঝায়। একজন মানুষ জন্ম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার খাবারের চাহিদা জন্মায়। এই দাবি বা চাহিদা তার বাবা-মার কাছে, পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে এবং রাষ্ট্রের কাছে। এই দাবিটি একেবারেই প্রাথমিক। এটা তার লাগবেই। এমনই আরও কিছু দাবি তার থাকে। সে কোথায় থাকবে, কী পরবে, কী শিখবে ইত্যাদি যৌক্তিক বিষয়গুলো তার পরিবার যেমন মেনে নেয়, তেমনই সমাজ ও রাষ্ট্রও স্বীকার করে। সুতরাং মৌলিক অধিকার হলো নাগরিকদের প্রাথমিক অধিকার যা সংবিধানে লিখিত। এটি হলো মানুষের মৌলিক চাহিদা, যা রাষ্ট্র নিশ্চিত করে।
অন্যদিকে মানবাধিকার হলো সেই সব অধিকার যা সব মানুষের ক্ষেত্রে সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য। যেমন, পৃথিবীর যে প্রান্তেই একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করে থাকুক না কেন, তার মর্যাদা হবে অন্য যে কোনও মানুষের সমান। ওই মানুষটি যে ধর্মের, যে জাতির, যে বর্ণের বা লিঙ্গের হোক না কেন তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ, সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে উন্নত জাতির একজন মানুষেরই সমান মর্যাদা, সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এটাই মানবাধিকার এবং এটিও মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। তবে এই অধিকার নিশ্চিত করে বিশ্বের সব দেশের অংশীদারিত্বে গড়ে ওঠা সবার অভিন্ন প্লাটফর্ম জাতিসংঘ। বুঝতে হবে, মৌলিক অধিকার দেশে দেশে ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু মানবাধিকার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নীতিমালা যা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য সম মর্যাদার নিশ্চয়তা দেয়। এটি মানব সমাজের সব সদস্যের জন্য সর্বজনীন, সহজাত, হস্তান্তরের অযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয়। বলা হয়, মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এমন এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে। এ চর্চার মধ্য দিয়ে অন্যের মানবাধিকার নিশ্চিত হলেই বিশ্বশান্তি নিশ্চিত ও মানবতার কল্যাণ হওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, সদস্য দেশগুলোর নাগরিকদের মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘ কোনও দেশকে নির্দেশ দিতে, এমনকি চাপ প্রয়োগও করতে পারে।
সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের বিষয়টি নানা কারণে বহুল আলোচিত। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ ঘোষিত হয় এবং এ সনদ কার্যকর করার জন্য মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়। এই সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে যে ৩০টি ধারা সংযোজিত রয়েছে তাতে মানুষের মৌলিক ও আইনগত অধিকার সংরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে ওই নীতিমালার বাস্তবায়ন ভিন্নতর হচ্ছে। ভিন্ন দেশ বা জাতিগোষ্ঠী বা ধর্মীয় জনসমষ্টির ক্ষেত্রে মানবাধিকারের ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হচ্ছে। আর এটি করছে কারা? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পরে পাশ্চাত্যের যেসব দেশ বিশ্বের মোড়ল হয়ে বসেছে তারাই। তারা নিজেদের স্বার্থে অর্থাৎ রাজনৈতিক সুবিধা লাভের হাতিয়ার হিসাবে মানবাধিকারের প্রসঙ্গটি সামনে আনছে বা ক্ষেত্রবিশেষে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। তার অর্থ হলো বিশ্বের সব মানুষ, সব দেশ, সব ধর্ম, সব জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার সমভাবে রক্ষা করা হচ্ছে না বা করতে দেওয়া হচ্ছে না। সমস্যাটা এখানেই।
এ প্রসঙ্গে সাধারণভাবে একজন মুসলমানের মনে আসবে কীভাবে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চলে আসছে গত ৭০ বছর ধরে। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, সামান্য নিন্দাটুকুও জানাতে পারেনি জাতিসংঘ। বরং কোনো কোনো পরাশক্তি বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে দেশটিকে তার মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়ে যেতে সাহায্য করে চলেছে। ধর্ম পালনের অধিকার মানবাধিকার সনদে অন্যতম অধিকার হিসাবে স্বীকৃত, কিন্তু এক্ষেত্রেও বৈষম্য দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে।
জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদকে যেন নির্দিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠীর বলে গণ্য করা হচ্ছে। যেমন আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের মানবধিকার শত শত বছর ধরে পদে পদে লঙ্ঘিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গদেরও জীবনের মূল্য- আমেরিকার সমাজে সেটিই অস্বীকৃত। আর সেজন্যেই এই ২০২০ সালে এসেও তাদেরকে ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস’ নামে আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে নামতে হয়। মানুষ হিসাবে ন্যূনতম অধিকার লাভের জন্য চিৎকার করে গলায় রক্ত তুলতে হয়। এখন মোটামুটি সবাই জানেন যে, পশ্চিমা দুনিয়ার অন্যায়, একদেশদর্শী ও স্বার্থবাদী আচরণের কারণেই বিশ্বে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, জাতিসংঘের এই মানবাধিকার সনদ নিয়ে বিকল্প ভাবনা-চিন্তা করা জরুরি। সেই ভাবনা-চিন্তারই বাস্তব প্রতিফলন হলো ইসলামি মানবাধিকারের সনদ। ১৯৯০ সালের ৫ আগস্ট ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণা পাস হয়। এরপর থেকেই প্রতি বছর ৫ আগস্ট মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামি মানবাধিকার ও মানবীয় মর্যাদা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। পাশ্চাত্যের বাইরের (অ-পশ্চিমা) দেশগুলোর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে ব্যর্থতার জন্য বিভিন্ন মুসলিম দেশ জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার (ইউডিএইচআর) সমালোচনা করেছিল। বিশেষ করে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর ১৯৮১ সালে, জাতিসংঘে ইরানি প্রতিনিধি সাইয়্যেদ রাজাই-খোরাসানি ইউডিএইচআর সম্পর্কে তাঁর দেশের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, এটি একটি আপেক্ষিক ‘ইহুদি-খ্রিস্টান ঐতিহ্যের ধর্মনিরপেক্ষ বোঝাপড়ামাত্র’, যা মুসলমানদের পক্ষে ইসলামি আইন লঙ্ঘন না করে নিজেদের সমাজে বাস্তবায়ন করা সম্ভবই না।
মুসলিম দেশগুলোর এই উপলব্ধি থেকেই জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা ও নির্দিষ্ট দিবস থাকার পরও ইসলামি মানবাধিকার দিবস পালনের যৌক্তিকতা স্পষ্ট হয়ে যায়। এইসব সমালোচনা ও উপলব্ধির বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ওআইসির সম্মেলনে মানবাধিকারের কায়রো ঘোষণা (সিডিএইচআরআই) প্রণয়ন ও ঘোষণা করা হয় যা পরে ওআইসিভুক্ত মুসলিম দেশগুলো অনুস্বাক্ষর করে।
এ পর্যায়ে আমরা জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সঙ্গে ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণার পার্থক্যটা এক নজরে দেখে নিতে পারি।
জাতিসংঘে নিজেদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য ব্যবহার করে পাশ্চাত্যের দেশগুলো সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ৩০ ধারাবিশিষ্ট জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার মূল ভিত্তি হলো পশ্চিমা লিবারেলিজম বা উদার নৈতিকতাবাদ। এ ঘোষণায় মুসলমানসহ অনেক জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি ও বাস্তবতা উপেক্ষিত হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণার বেশ কিছু দিক গ্রহণযোগ্য হলেও এর অনেক ধারাই ইসলামি বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
অন্যদিকে ইসলামে মানবাধিকারের বিষয়টি অত্যন্ত কঠোরভাবে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার আওতাভুক্ত। এর অর্থ হলো, কেউ যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তাহলে তার ঈমান রক্ষা করাই কঠিন হয়ে যায়। ঈমানদারি ঠিক রাখতে হলে মানবাধিকারের নীতি সমুন্নত রাখতে হবে। সুতরাং ইসলামে মানবাধিকারের ধারণা নিছক একটি ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা প্রতিপালন করা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব।
জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণায় যে বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়েছে, ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণার ২৫টি ধারায় সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। মানবীয় মর্যাদা, নীতি-নৈতিকতা ও মানুষের আধ্যাত্মিক চাহিদার বিষয়গুলো ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় গুরুত্ব পেয়েছে। এতে গোটা মানবজাতিকে একটি পরিবারের অংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, সব মানুষই আল্লাহর দাস ও আদমের সন্তান। তাই ধর্ম,বর্ণ, গোত্র, জাতি ও সমাজের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বৈষম্যের কোনো অবকাশ নেই। সেই মানুষই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে যে সবচেয়ে বেশি ন্যায়নিষ্ঠ বা তাকওয়াসম্পন্ন। ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব করতে নিষেধ করা হয়েছে। এটিই হলো মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার ভিত্তি। ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় আধ্যাত্মিকতা ও পার্থিব বিষয়গুলো পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসলাম মানবাধিকারের সীমা এত প্রশস্ত করেছে যে, মানুষের পুরো জীবন এর আওতায় পড়ে। পিতা-মাতার হক, সন্তানের হক, স্বামী-স্ত্রীর হক, নারীর অধিকার, বন্ধু-বান্ধবের হক, শ্রমিক-মালিক এবং শাসক ও জনগণের হক, সরকারের হক, শ্রমজীবী মানুষদের হক, দুর্বল ও অসহায়দের হক, এতিম-মিসকিনের হক, সাধারণ মুসলমানের হক, সাধারণ মানুষের হক ইত্যাদি ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীক ও আন্তর্জাতিক যাবতীয় বিষয় ইসলামের মানবাধিকারের অনুষঙ্গ।
ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণার ষষ্ঠ ধারায় নারী-পুরুষের সাম্যের কথা স্থান পেয়েছে। নারী ও পুরুষের যেমন আলাদা আলাদা কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তেমনি আলাদা আলাদা কিছু অধিকারও রয়েছে। নাগরিক অধিকার ছাড়াও তাদের রয়েছে স্বাধীনভাবে সম্পদ অর্জনের অধিকার। নারী ও পুরুষের শারীরিক ও চাহিদাগত পার্থক্যের কারণে তাদের দায়িত্ব ও অধিকারেও কিছু পার্থক্য রয়েছে বলে ইসলাম মনে করে, কিন্তু এসব পার্থক্যের অর্থ বৈষম্য নয়। সামাজিক অগ্রগতি ও সুষ্ঠুতার স্বার্থে প্রয়োজনীয় বিবেচনায় ঐশী নির্দেশনার (কুরআন ও সুন্নাহ) প্রেক্ষিতেই এটা করা হয়েছে।
ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণার ২২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক ব্যক্তিই তার মতামত প্রকাশের ব্যাপারে স্বাধীন, তবে তা ধর্মবিরোধী হওয়া চলবে না। ইসলামের দৃষ্টিতে বাক-স্বাধীনতা লাগামহীন নয়। বাক-স্বাধীনতার নামে অন্যদের ধর্মীয় চিন্তাধারা ও পবিত্র বিষয়গুলোর অবমাননা করার কোনো অধিকার কারো নেই। দুঃখজনকভাবে পশ্চিমা সরকার ও গণমাধ্যমগুলো এক্ষেত্রে স্বাধীনতার অপব্যবহার করছে এবং তারা এ পর্যন্ত ইসলামের পবিত্র বিষয়গুলোর যারপরনাই অবমাননা করেছে। তাই ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘ধর্মীয় পবিত্র বিষয় এবং নবী-রাসূলদের মর্যাদার প্রতি আঘাত কিংবা মূল্যবোধের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ও সমাজে বিভেদ সৃষ্টিকারী বা ঐশী বিশ্বাসের প্রতি অবমাননাকর যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিষিদ্ধ।’
ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় উপনিবেশবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে ন্যায্য অধিকার বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলো সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে অভিহিত করে। ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় স্বৈরাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারকেও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলাম অমুসলিমদেরকে যথাযথ নিরাপত্তা ও অধিকার, শিক্ষার অধিকার, মান-সম্মানের অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকারসহ সব রকমের অধিকার নিশ্চিত করেছে।
পাশ্চাত্য ও ইসলামের মানবাধিকার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেওয়ার পর এখন আমরা বাস্তব উপলব্ধির সঙ্গে বিশ্ব বাস্তবতার প্রেক্ষিত বিবেচনায় বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে পারি। বিষয়টি আমরা দেখতে পারি ইরানি চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম মুহাম্মাদ জাভাদ হুজ্জাতি কিরমানির চিন্তাধারার আলোকে। তাঁর ‘ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণায় মিল-অমিল’ শীর্ষক প্রবন্ধে এ বিষয়ে একটি সুনিশ্চিত নির্দেশনা পাওয়া যায় যা আমাদের বিবেচনায় অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং বাস্তবানুগ।
‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ।’ পবিত্র কুরআনের এই বাণী উদ্ধৃত করে কিরমানি বলছেন, সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার মুখবন্ধে প্রতিটি মানুষের সহজাত গুণাবলির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের মনে হয় যে, এই ঘোষণা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কুরআনের মাধ্যমে প্রভাবিত অথবা অন্ততপক্ষে উভয়টিই পরম কার্যকারণ এবং মানবিক প্রজ্ঞার ধারণার সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ। উভয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য শুধু এটুকু যে, একটির উদ্ভব সরাসরি ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ থেকে আরেকটি কিছু মধ্যবর্তী উপাদানের ভেতর দিয়ে প্রত্যাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত।
ইসলামে মানবাধিকার বা ইনসানিয়াত এবং পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ঘোষণা পাশাপাশি রেখে বিচার বিবেচনা করার সুযোগ আছে। সেটা যে কেউ করতে পারেন। তবে আমরা এ বিষয়ে ইরানি স্কলার হুজ্জাতুল ইসলাম মুহাম্মাদ জাভাদ কিরমানির দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য মনে করি। ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেইনীর নির্দেশনা অনুযায়ী দেশটি বিভিন্ন ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের প-িতদের নিয়ে আন্তঃধর্ম সংলাপ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। কিরমানির মানবাধিকার বিষয়ক এক প্রবন্ধে সেই পরিপ্রেক্ষিতটি ধরা পড়ে। তিনি সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা এবং ইসলামি মানবাধিকারের তুলনা করতে গিয়ে বলছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় পরিবারকে একক সত্তা হিসাবে গ্রহণের বিষয়টি ওই সময়ের জনমানস এবং একটি আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। মানুষের অস্তিত্বের বাস্তবতার ভিত্তিতেই তার ঐক্যের বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে আমরা ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকার ব্যবস্থার মধ্যে সাজুয্য খুঁজে পাই। ইসলামেও পরিবারকে অভিন্ন লাভ-ক্ষতির শরিক একটি একক সত্তা হিসাবে দেখা হয়। ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণার আরেকটি অভিন্ন উপাদান হলো মানুষের প্রকৃতিগত মূল্য ও তার প্রতি শ্রদ্ধা।’
জাভাদ কিরমানি উভয় ঘোষণার মধ্যে যেসব সামঞ্জস্য রয়েছে সেগুলোর উল্লেখ করে বলেন, ‘স্বাধীনতা বলতে আমরা সাধারণভাবে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণায় বর্ণিত স্বাধীনতাই বুঝি যেখানে মানুষকে জন্মগতভাবে স্বাধীন বলা হয়েছে এবং সব ধরনের দাসত্ব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিটি মানুষের স্বাধীন ও নিরাপত্তার সঙ্গে বাঁচার অধিকার দেওয়া হয়েছে।… মানুষের দায়িত্ববোধের জন্ম হয় তার স্বাধীনতার চেতনা থেকে। মানুষ স্বভাবগতভাবেই মুক্ত সত্তা। বিজ্ঞ বলেই সে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সংযম রক্ষা করে চলার বিষয়টিকে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার পরিচায়ক বলে মনে করে। সংযমের এই যৌক্তিক প্রয়াস আরও বিশুদ্ধ ও প্রকৃত রূপ লাভ করে অধ্যাত্মবাদ ও ঐশী প্রত্যাদেশের আলোকধারায়।’
ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণার মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকলে সেটা আছে স্বাধীনতার মাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। সেটা স্বাধীনতার যৌক্তিকতা ও মৌলিক ভিত্তির কোনও ব্যত্যয় ঘটায় না।
অন্য কথায়, মানবাধিকারের উভয় ধারণাই মানুষের জন্মগত স্বাধীনতার ওপর কিছু সীমারেখা টেনে দেয়। খোদায়ী বিধানে যৌন স্বাধীনতার ওপর যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তেমন নিয়ন্ত্রণ অনেক কম। তার পরও পাশ্চাত্যের ভোগবাদী আদর্শেও যৌন স্বাধীনতা সীমিত করা হয়েছে, যেমন ধর্ষণ এবং প্রকাশ্য যৌনাচার নিষিদ্ধ। তার মানে হলো, সবচেয়ে মুক্ত সমাজের ক্ষেত্রেও মানুষের যুক্তিশীলতা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েনি, সেখানেও খুব সামান্য হলেও স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
জাভাদ কিরমানি তাঁর প্রবন্ধে বলেন, বস্তুতপক্ষে ন্যায়বিচার বলবৎ করা এবং অবিচার দূর করার আকাক্সক্ষার উদাহরণ যা ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণায় খুবই জোরালো এবং সংহতরূপে রয়েছে, সেটি উভয়ের মধ্যে আরেকটি সংযোগসূত্র। প্রকৃতপক্ষে ন্যায়বিচারের ধারণাই গোটা বিশ্বকে স্থিতিশীল করেছে। তিনি উভয় ঘোষণার মধ্যে বিদ্যমান অসামঞ্জস্যগুলোও চিহ্নিত করেন। তবে আহ্বান জানান, সবাইকে নিজ নিজ আদর্শে অবিচল থেকেও একটি সমঝোতার জায়গায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো যায় কিনা সেই বিষয়ে প্রয়াসী হওয়ার। কারণ, বিশ্ববাসী এখনও বিভিন্ন ধর্ম তথা মানবজাতির বিভিন্ন আদর্শের কাছেই শান্তির প্রত্যাশা করে।