রবিবার, ২রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ঐতিহাসিক শহর ‘ইস্ফাহান’

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৫, ২০১৬ 

news-image

ফার্সীতে প্রবাদের মতো বলা হয়ে থাকে `ইস্ফাহান নেসফে জাহান’ অর্থাৎ ইস্ফাহান হলো অর্ধবিশ্ব। তারমানে ইস্ফাহান দেখা হলে বিশ্বের প্রায় অর্ধেকই দেখা হয়ে যায়। ইস্ফাহান প্রদেশটি কেন্দ্রীয় ইরানে এক লক্ষ ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। ইস্ফাহানের চতুর্দিকে আরো নয়টি প্রদেশ রয়েছে। অর্থাৎ নয়টি প্রদেশের মাঝখানে অবস্থিত এই প্রদেশটি। জনবহুল প্রদেশের দিক থেকে ইস্ফাহানের স্থান পঞ্চম। সমগ্র ইরানের জনসংখ্যার প্রায় ৬/৭ শতাংশ এই প্রদেশে বাস করে। ইরানের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় ইস্ফাহান প্রদেশের ইতিহাস একটু স্বতন্ত্র। এই প্রদেশের প্রাচীন ইতিহাস ইরানের অন্যান্য প্রদেশ থেকে ইস্ফাহানকে বিশেষত্ব দান করেছে। ইস্ফাহানের কেন্দ্রীয় শহরটিও প্রাচীনকাল থেকেই বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। যোগাযোগ ও ভৌগোলিক দিক থেকে এই প্রদেশটি উত্তর ও দক্ষিণ ইরানের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় এই প্রদেশটির একটা ভৌগোলিক বিশেষত্ব রয়েছে। এই কৌশলগত অবস্থান এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানে প্রচুর শিল্প-কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। এই শিল্প-কল-কারখানার প্রাচুর্যের দিক থেকে ইস্ফাহানকে ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রদেশ বলে গণ্য করা হয়। এখানে লোহা গলানোর কারখানা , ইস্পাত কারখানা ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য খনিজ স্থাপনা।

9681266_6c808e8bbcকৃষিক্ষেত্রেও ইস্ফাহান বেশ উন্নত। কারণ এখানে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি। কেবল `যয়্যান্দে’ নদীর পানি দিয়েই প্রায় একলাখ হেক্টর জমিতে কৃষিকাজ করা যায়। এখানকার প্রধান কৃষিপণ্যের মধ্যে রয়েছে- গম, যব, চাউল, আলু , দানাদার শস্যাদি, খড় বা তৃণ জাতীয় পশুখাদ্য, বিট, তুলা এবং পেঁয়াজ। এছাড়া এখানে প্রচুর-পরিমাণ ফল-ফলাদিও উৎপন্ন হয়। এখানকার ফল-ফলাদির মধ্যে রয়েছে আপেল, নাশপাতি, খরবুজা , যারদালু বা খুবানি, আঙ্গুর, শসা প্রভৃতি।

আবহাওয়াগত দিক থেকে এই প্রদেশটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন, ভূমধ্য অঞ্চল, জনশূন্য মরু অঞ্চল এবং অর্ধমরু অঞ্চল। এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ক্ষেত্রে উঠানামা রয়েছে। তবে মোটামুটি বছরে প্রায় ১৫০ থেকে ৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় এখানে। প্রাকৃতিক দিক থেকে এই প্রদেশটি ইরানের কেন্দ্রীয় পর্বতমালা এবং জাগরোস পর্বতমালার পূর্ব উপত্যকার মাঝখানে অবস্থিত। ফলে এখানে ভূমিগত বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে। পর্বতগুলো একদিকে জন্ম দিয়েছে কিছূ উঁচু ভূমির, সেইসাথে এখানে সৃষ্টি হয়েছে বিস্তৃত সমতল ভূমি। এখানকার উঁচু পাহাড়গুলোর মধ্যে রয়েছে সিমান সাফে এবং বিদকান। আর উল্লেখযোগ্য নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে যয়্যান্দে রুদ, মারগাব এবং গান্দেমান। এখানকার অধিবাসীরা ফার্সীভাষী। তবে মুসলমানদের পাশাপাশি ইহুদি, আর্মেনী এবং জুরথ্রুস্টিয় ধর্মের অনুসারীরাও এখানে বসবাস করে।
esfahanইস্ফাহানের আবহাওয়া খুব ভালো। আর সবুজ-শ্যামলিম হবার কারণে ইস্ফাহানে বছরের প্রায় চার-পাঁচ মাস যাযাবর শ্রেণী বসবাস করে। বিখ্যাত ক্বাশক্বাঈ এবং বাখতিয়ারী উপজাতি প্রতি বছর বসন্তের শুরুতে এই প্রদেশের শ্যামল পরিবেশে তাঁবু খাটায় এবং তাদের পশুগুলোকে এখানে চরিয়ে বেড়ায়।

ইস্ফাহানের রয়েছে ইসলাম-পূর্ব যুগ পর্যন্ত বেশ দীর্ঘ ইতিহাস। ইতিহাসের এই দীর্ঘ পরিক্রমায় বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়েছে এই শহর। ইস্ফাহান প্রায় দুই যুগ ইরানের রাজধানী ছিল। রাজধানী থাকাকালে ইস্ফাহান বিশ্বের সুন্দরতম শহরের একটি ছিল বলে বহু বিদেশি পর্যটক তাঁদের ভাষ্যে উল্লেখ করেছেন। এ কারণেই শার্ডিন, তাভেরনিয়ের এবং পিট্রোডেলাভেলির মতো সেকালের বিশ্বপর্যটকগণ এই শহর সম্পর্কে পড়ালেখা করতে ভোলেন নি।

প্রাচীন নিদর্শনের দিক থেকেও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে এই শহরের নজীরবিহীন বিশেষত্ব রয়েছে। এই নিদর্শনগুলো কেবল শৈল্পিকই নয় বরং ঐতিহাসিকও বটে। এসব কারণেই হয়তো ইস্ফাহান শহরকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বৃহৎ শহরগুলোর তালিকায় নয় নম্বরে স্থান দেওয়া হয়েছে।

40sotoonইসফাহান শহরের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে শাহ মসজিদ, সিওসে পুল (স্থাপিত ১৬০২ ইং), নাকশে জাহান স্কয়ার, খাজু ব্রীজ (১৬৫০ ইং), শাহরেস্তান পোল, জুবী পোল (১৬৬৫ ইং), মারনান ব্রীজ প্রভৃতি। বিখ্যাত চার্চসমূহের মধ্যে রয়েছে বেদখেম চার্চ (১৬২৭ ইং), সেন্ট জর্জ চার্চ (১৭ শতক), সেন্ট মেরী চার্চ (১৭ শতক), ভানক ক্যাথেভরাল (১৬৬৪ ইং) প্রভৃতি।

পার্ক ও বাগানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বার্ডস গার্ডেন, ইসফাহান ফুল বাগান, প্রভৃতি। বিখ্যাত স্থাপনাসমূহের মধ্যে আছে আলম হাউজ, আমিন হাউজ, মালেক ভিনিয়ার্ড, কাজভীন হাউজ (১৯ শতক), শায়খ-উল-ইসলাম হাউজ, আশরাদ প্রাসাদ (১৬৫০ ইং), হাশ্ত বেহেশ্ত (অস্টম স্বর্গ) প্রাসাদ (১৬৬৯ ইং), চেহেল সেতুন (১৬৪৭ ইং) প্রভৃতি। বিখ্যাত মাযার ও সমাধির মধ্যে রয়েছে- মাযারে আল রশীদ, বাবা কাসেমের মাযার (১৪ শতক), সাফাভী রাজপুতদের মাযার, নিজামুল মুল্ক সমাধি (১৪ শতক), শায়েব মাযার, শাহ শাহান মাযার (১৫ শতক), সোলতান বখ্ত আগার মাযার (১৪ শতক) প্রভৃতি।

বিখ্যাত মসজিদসমূহের মধ্যে রয়েছে আগা নূর মসজিদ (১৬ শতক), হাকিম মসজিদ, ইল্চী মসজিদ, জামে মসজিদ (১৬০১ ইং), মোহাম্মাদ জাফর আবাদী মসজিদ (১৮৭৮ ইং), রহিম খান মসজিদ (১৯ শতক), রোকনুল মুল্ক মসজিদ, সাইয়্যেদ মসজিদ (১৯ শতক), শেখ লুতফুল্লাহ মসজিদ (১৬১৮ ইং) প্রভৃতি। এছাড়া অসংখ্য সুউচ্চ মিনার রয়েছে ইসফাহানে। বিখ্যাত যাদুঘরসমূহের মধ্যে রয়েছে কনটেমপোরারি আর্টস্ মিউজিয়াম, ডেকোরেটিভ আর্টস্ মিউজিয়াম, ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম (১৫ শতক) প্রভৃতি।