বুধবার, ৫ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২০শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

পশ্চিমা বেতারের প্রকৃত চরিত্র

পোস্ট হয়েছে: মে ২২, ২০১৩ 

news-image

নিজেদের ভবিষ্যৎ লাভের আশায় পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমগুলো মাঝে মধ্যে অথবা বিশ্বের কোনো বিশেষ ঘটনার পাশাপাশি বিশেষ সংবাদ রিপোর্ট পরিবেশন করে। অতঃপর পরবর্তী ফল লাভের জন্য সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে শুরু করে শোরগোল। মূলত এ মায়াকান্না বা গলাবাজি তারাই প্রদর্শন করে যারা পরিস্থিতিকে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চায়। সম্প্রতি (মার্চ ১৯৮৬) ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্বন্ধে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এবং এটি বিশ্বাস করার কারণ আছে যে, তা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত হবে। দুনিয়ার উদ্ধত শক্তিগুলো যখন কোনো আঞ্চলিক বা বিশ্বসমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয় তখন প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, তারা বহু পরীক্ষিত ব্যর্থ বাহানাগুলোকেই ব্যবহার করে।

সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনাবলি যা আমেরিকা, ব্রিটেন ও মিসরের পারস্পরিক সহায়তায় সংঘটিত হয়েছে, যেমন মাল্টা বিমান ঘাঁটিতে ষাটজন নিরপরাধ যাত্রী হত্যা, আমেরিকা ও ব্রিটেনের দালালদের দ্বারা দক্ষিণ আফ্রিকার বঞ্চিত কালো মানুষদের ব্যাপকভাবে হত্যা এবং পরাশক্তিদ্বয় কর্তৃক আফগানিস্তান, চিলি, সালভাদার ও ফিলিপাইনে প্রতিনিয়ত সংঘটিত অন্যান্য অপরাধ- এসবের কারণে বিশ্বজনমতে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে সেটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্যই তারা আর একবার ইরানে মানবাধিকার অস্ত্র প্রয়োগ করছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের অপরাধগুলো ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সংবাদণ্ডআবরণ সৃষ্টি করা এবং ইসলামি ইরানকে চাপের মধ্যে রাখা।

এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পশ্চিমা মাধ্যমগুলোয় ব্রিটেনের ভূমিকা, বিশেষ করে বেতার কেন্দ্রগুলোর অপপ্রচার। ব্রিটেনের প্রচারসংস্থা বিবিসি এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এ বেতার কেন্দ্রের এক ফরাসি অনুষ্ঠানে ঘোষিত হয় : সম্প্রতি প্রকাশিত ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’-এর এক বিবৃতিতে ইরানি জেলখানায় বন্দিদের হত্যা, তাদের ওপর অত্যাচার ও দুর্ব্যবহার সংক্রান্ত শত  শত ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। এসব বন্দি শুধু ধর্মীয় অথবা রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জন্যই গ্রেফতার হয়েছিল।

উক্ত বেতারকেন্দ্র আরও ঘোষণা করে : এ রিপোর্ট অনুযায়ী ১৩ জন প্রত্যক্ষদর্শী যাদের মধ্যে ইরানের একটি বিরুদ্ধবাদী দলের কিছুসংখ্যক সদস্যও রয়েছে তাঁরা বলেছেন যে, আজও পরিকল্পিত উপায়ে ইরানে নির্যাতন চালানো হচ্ছে, জেলখানায় কয়েদিদের অবস্থাও অসহনীয়।

প্রথমত বিবিসি প্রচার করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে হত্যা ও অত্যাচারের শত শত ঘটনার উল্লেখ আছে। পরবর্তী পর্যায়ে এসে বলে যে, এ রিপোর্টের ভিত্তি হচ্ছে তেরজন বিরোধী প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য। শেষ পর্যায় বলে : এ ছাড়া জাতিসংঘের একজন বিশেষ প্রতিনিধির লক্ষ্য ছিল এ বিষয়ে রিপোর্ট তৈরি করার। তিনি অভিযোগ করেছেন যে, তাঁকে ইরানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।

স্ববিরোধী ও চাতুর্যপূর্ণ বিবৃতির এটাই প্রথম ঘটনা নয়। ১৯৮২ সালে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের উদ্যোগে জাতিসংঘ থেকে ইহুদিবাদীদের উৎখাতের যে চেষ্টা চলছিল তার পাশাপাশি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইরানে মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত এক ব্যাপক রিপোর্ট প্রচার করে এবং বর্ধিত ফল লাভের জন্য ভয়েস অব আমেরিকা ও বিবিসি’র সাথে সাথে ইসরাইল বেতারও তাদের প্রোগ্রামসমূহের অর্ধেকটাই দীর্ঘ কয়েকদিনের জন্য এ প্রসঙ্গটির মধ্যেই সীমিত রেখেছিল।

সে সময়ে পশ্চিম জার্মানিস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত তথাকার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ডিরেক্টর জেনারেল হেলমুট ফোর্টিজকে এ বিষয়ে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য আবেদন রেখে এক পত্র লিখেন। মি. হেলমুট ফোর্টিজ তিন মাস বিলম্বের পর শেষাবধি এক সংক্ষিপ্ত উত্তরে ইরানি দূতাবাসকে লিখেন : ইরানের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং হত্যা সম্পর্কে আমি কোনো তথ্য বা দলিল পাইনি। আমি আশা করি, উত্তর দিতে পারব; ভবিষ্যৎ কোনো এক সময়ে যোগাযোগ করুন। অতঃপর দীর্ঘ তিন বছর অতিক্রম হওয়ার পরও তিনি তাঁর আশা পূর্ণ করতে পারেননি এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও গ্রহণযোগ্য কোনো দলিল পেশ করেনি; বরং তারা ইরানের বাইরে অবস্থানরত কিছুসংখ্যক ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিরোধীর কিছু বক্তব্যকেই উপস্থাপিত করেছে।

আমরা অবশ্য এ ধরনের সংস্থাগুলোর প্রকৃতি এবং পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমগুলোর প্রচারণার লক্ষ্য সম্বন্ধে অবহিত। পিটার নিসন নামক জনৈক ব্যক্তির সহায়তায় ১৯৬১ সালে লন্ডনে এ সংস্থার জন্ম। এ সংস্থা ঘোষণা করে যে, নির্যাতন, হত্যা, বেআইনি গ্রেফতার, গুম ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো এর লক্ষ্য। কিন্তু সংস্থাটির তৎপরতা প্রমাণ করে যে, এটি দুনিয়ার বঞ্চিত মানুষের বিপ্লবী তৎপরতার বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করার যন্ত্র হিসেবেই কাজ করে। পরাশক্তিকে সমর্থনদান এবং তাদের অপরাধকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করাই এর লক্ষ্য। পরাশক্তিসমূহের অপরাধী নোংরামুখ এ সংস্থার শান্তি ও মানবতার স্লোগানের অন্তরালে লুকিয়ে থাকে।

বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর এ ধরনের স্ববিরোধী বিবৃতিকে তাদের প্রচারণার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। এভাবে তারা ইরানে মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্বন্ধে মিথা ছড়াচ্ছে। বিবিসি তার আরবি প্রোগ্রামেই এ বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

এ সংস্থার মানবাধিকার কমিটি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যে রিপোর্ট পেশ করেছে সেখানে উল্লেখ আছে, ১৯৮৪-৮৫ সালে ৩০০ ইরানিকে হত্যা করা হয়েছে।

এবারের রিপোর্ট তারা কিন্তু নিজেদের দাবির যথার্থতা প্রমাণের জন্য কোনো দলিলের কথা উল্লেখ করেনি। রিপোর্টে শুধু বলা হয়েছে যে, জাতিসংঘ প্রতিনিধি ইরানের বাইরে অবস্থানরত তের জন বিরুদ্ধবাদী ইরানির সঙ্গে আলাপ করেছেন। শত শত হত্যা ও হাজার হাজার অত্যাচারের ঘটনার অস্তিত্ব কিভাবে বোঝা গেল, কেনই বা সরকারবিরোধী ১৩ জনের সাক্ষ্যকেই তাঁরা নির্ভরযোগ্য বলে মনে করলেন? অথচ ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে যখন ইরিক, স্পিথ ও ব্রীচ নামক তিনজন জেলার ব্রিটেনের উইংগ্রিন জেলখানায় ব্যারী প্যারাসো নামক একজন বন্দিকে করুণভাবে হত্যা করে তার তলপেট টুকরো টুকরো করে ফেলে তখন তারা টু শব্দও করেনি। যাক, লন্ডনে অবস্থিত যে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কেন্দ্রীয় কার্যালয় সে সংস্থাটিও এ ব্যাপারে একটি ক্ষুদ্র বিবৃতিও প্রচার করেনি এবং বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও রেডিও ইসরাইল এ প্রসঙ্গে কোনো কথাই বলেনি।

উক্ত ঘটনা ঘটছে ১৯৮০ সালে যখন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট অনুযায়ী এল-সালভাদরে বিনাবিচার চৌদ্দ সহস্র লোকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করা হয়। এল-সালভাদরের অপরাধের কথা বলা হলেও কোনো মানবাধিকারের প্রবক্তাই ব্রিটেনের ঘটনার ব্যাপারে কোনো কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেনি। ১৯৭০ সালের প্রথমদিকে মার্কিন ভাড়াটিয়াদের দ্বারা হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হলো নাইজেরিয়ার বায়াফ্রাতে। অথচ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং মানবাধিকারের সমর্থকদের মানবতাবোধ এ ব্যাপারে আদৌ জাগ্রত হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকা, আফগানিস্তান, ফিলিপাইন, চিলি, এল-সালভাদর এবং নিকারাগুয়ায় হাজার হাজার বঞ্চিত মানুষ নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত হচ্ছে, কিন্তু এ সংস্থা কর্তৃক জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সে সম্পর্কে কোনো রিপোর্ট প্রেরিত হয়নি। আসলে যখন আফগানিস্তানে আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেনের অপরাধ বিশ্ববিবেককে স্পর্শ করেছে, তখনই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অন্য কোনো প্রসঙ্গ নিয়ে হৈচৈ শুরু করেছে। আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গটি হচ্ছে পশ্চিমা বেতার কেন্দ্রগুলোর একান্ত উপযোগী উপকরণ। এ সকল বেতার কেন্দ্র ইরানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বলে কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন করে, কিন্তু ইরাকে গণহত্যার বিষয়ে নীরব থাকে। কিছুদিন আগে দুনিয়ার মুসলিম জনতার অভিমতের চাপে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইরাকে বন্দিদের অবস্থা ও নির্যাতন সম্বন্ধে একটি অসম্পূর্ণ রিপোর্ট তৈরি করেছিল। ১৯৬৮ সালের অভ্যুত্থানের পর এটাই ছিল ইরাকের ব্যাপারে বিশ্ববাসীর দাবির প্রথম প্রতিফলন। আজকে বিশ্বসমাজকে অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে যে, দুনিয়ার গর্বিত শক্তিগুলো আবার কোন উদ্দেশ্যে সেই পুরাতন অস্ত্র ইসলামি ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য টেনে আনছে!

(সূত্র : নিউজলেটার, এপ্রিল ১৯৮৬)