শুক্রবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

তেহরানে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহে আগত মেহমানদের উদ্দেশে রাহবারের ভাষণ

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ৬, ২০১৭ 

পয়গাম্বরে আকরাম (সা.) ও ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিন উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী মেহমান ও ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রদত্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মহামান্য রাহবার সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ :
بسم‌الله‌الرّحمن‌الرّحیم
والحمدلله ربّ العالمین والصّلاة والسّلام علی سیّدنا محمّد و آله الطّاهرین و علی صحبه المنتجبین و علی من تابعهم باحسان الی یوم الدّین.
(বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি সমগ্র জাহানের প্রতিপালক। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নেতা হযরত মুহাম্মাদ (সা.), তাঁর পবিত্র বংশধর, তাঁর সুশীল সাহাবিগণ এবং কিয়ামত পর্যন্ত যাঁরা আন্তরিকভাবে তাঁদের অনুসরণ করবে তাদের প্রতি।)
অস্তিত্ব জগতের সকল মাখলুকের সরদার ও সৃষ্টিলোকের শিরোমণি মহান পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিন, একইভাবে ইমামতের যুগে পৃথিবীতে আল্লাহর দলিল ও হুজ্জাত পয়গাম্বর (আ.)-এর সন্তান হযরত আবি আবদিল্লাহ আস সাদেক (আ.)-এর জন্মদিবস উপলক্ষে আমি আপনাদের মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আশা করছি যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে সকল মুসলমানের, বিশ্বের সকল আলোকিত চিন্তার লোককে তাওফীক দেবেন, যাতে আমরা সবাই এই নেয়ামতের কদর বুঝি। এতবড় অনুগ্রহের গুরুত্ব যেন উপলব্ধি করতে সক্ষম হই। তাঁরা বিশাল অস্তিত্বজগতের খুঁটি। তাঁরা আমাদেরকে যে সিরাতুল মুস্তাকীমের পথ দেখিয়ে গেছেন সে পথ যেন আমরা চিনি এবং সে পথ ধরে অগ্রসর হই।
মহান পয়গাম্বর (আ.)-এর পবিত্র অস্তিত্বের বিদ্যমানতার গুরুত্ব এত অধিক যে, আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে এই বিরাট নেয়ামত প্রদান করার কারণে মানুষের প্রতি আপন অনুগ্রহের খোঁটা দিয়েছেন। বলেছেন : لَقَد مَنَّ اللّهُ عَلَی المُؤمِنینَ اِذ بَعَثَ فیهِم رَسولًا مِن اَنفُسِهِم. ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে রাসূল করে তাদের কাছে প্রেরণ করেছেন।’ (সূরা বাকারা : ১৬৪)
ইমাম সাজ্জাদ আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম ‘সাহীফায়ে সাজ্জাদিয়া’য় মহান আল্লাহর দরবারে এভাবে আরয করেন, اَلحَمدُلِلّهِ الَّذی مَنَّ عَلَینا بِمُحَمَّدٍ نَبیِّه دونَ الاُمَمِ الماضیَة وَ القُرونِ السّالِفَة ‘সেই আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা, যিনি মুহাম্মাদ (সা.)-কে প্রেরণ করে আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, যা বিগত উম্মতদের এবং অতীতের জাতিসমূহের প্রতি প্রদান করেন নি। (সাহীফায়ে সাজ্জাদিয়া, দ্বিতীয় দোয়া)
মানবজাতির প্রতি আল্লাহর এমন বিরাট দানের ব্যাপারে কুরআন মজীদে এবং ইমামগণের বাণীতে যে বর্ণনা এসেছে তা সত্যিই বিরাট বিষয়। এক বিরাট অনুদান। আল্লাহ তা‘আলা পয়গাম্বর (আ.)-কে জগৎবাসীর জন্য রহমত হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই রহমত জগতের কোন একটি মানবগোষ্ঠীর জন্য নয়, অথবা জগতের একটি বিশেষ সমষ্টির জন্য নয়; বরং রাহমাতাল লিল আলামীন رَحمَةً لِلعٰلَمین ‘সমগ্র জগতের জন্য রহমতস্বরূপ।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭) । তিনি আল্লাহর কাছ থেকে যে পয়গাম মানবজাতির জন্য নিয়ে এসেছেন তা মানবজাতিকে তিনি উপহার দিয়েছেন। তিনি এই তীক্ষè দৃষ্টিশক্তি, এই উজ্জ্বল চলার পথ মানবসমাজের প্রতিটি মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন।
অবশ্য এমনও অনেকে আছেন, যারা ক্ষমতার মালিক, যাদের হাতে অর্থবিত্ত আছে, ক্ষমতা ও প্রতাপ আছে, তারা চায় না আল্লাহর বিশাল বিস্তৃত রহমত সর্বস্তরের মানুষের জন্য অবারিত হোক। তারা শক্তিমত্তা দেখিয়ে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা আল্লাহমুখী এই তৎপরতা রুখে দাঁড়ায়। এই পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یٰاَیُّهَا النَّبِیُّ اتَّقِ اللّهَ وَ لا تُطِعِ الکٰفِرینَ وَ المُنٰفِقین ‘হে নবী! আপনি আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করুন এবং কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য করবেন না।’ (সূরা আহযাব : ১) অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়ে বলেন, یٰاَیُّهَا النَّبِیُّ جٰهِدِ الکُفّارَ وَ المُنٰفِقینَ وَ اغلُظ عَلَیْهِم‌ ‘হে নবী! আপনি কাফেরদের দল এবং মুনাফিকদের সাথে জিহাদ করুন এবং তাদের প্রতি কঠোর হোন।’ (সূরা তওবা : ৭৩ নং আয়াতের অংশবিশেষ।)
এখানে বলা হচ্ছে جاهِد ‘জিহাদ করো’। বলা হয় নি যে قاتِل ‘লড়াই কর’ বা قاتِلِ الکُفّارَ وَ المُنافِقین ‘কাফের ও মুনাফিকদের সাথে লড়াই কর।’ কারণ, লড়াই সব সময় প্রয়োজন নেই্। তবে জিহাদ সমসময় আবশ্যক। কখনো জিহাদ হয় রাজনৈতিক জিহাদ, কখনো জিহাদ সাংস্কৃতিক হয়ে থাকে। কখনো জিহাদ ন¤্র হয়ে থাকে, কখনো হয় শক্ত ও মজবুত। কখনো সশস্ত্র হয়ে থাকে, কখনো জ্ঞান দিয়ে হয়। সবগুলোই জিহাদ। কিন্ত সব কিছুতেই মনে রাখতে হবে যে, এই জিহাদ হবে দুশমনের বিরুদ্ধে। মানবতার শত্রুর বিরুদ্ধে। ঐসব দুশমনের বিরুদ্ধে যারা নিজের ক্ষমতা, অর্থ, দাপট ও শক্তিমত্তার ওপর নির্ভর করে নিজেদের স্বার্থ ও কর্তৃত্ব মানবতার ওপর চাপিয়ে দেয়। এদের সাথে আপস করার কোন অর্থ হয় না। اِتَّقِ اللّهَ وَ لا تُطِعِ الکٰفِرینَ وَ المُنٰفِقین. ‘আল্লাহকে ভয় কর এবং কাফের ও মুনাফিকদের অনুসরণ করো না।’
পয়গাম্বর (আ.) সম্পর্কে এবং তিনি যেসব শিক্ষা মানবজাতিকে দিয়েছেন, নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামি সমাজকে পায়ে পায়ে, এক বাক্য দুই বাক্য করে এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে কোরআন মজীদের আয়াতের সংখ্যা বহু। আমাদের নিজেদের প্রতি, নিজেদের তরুণ সমাজের প্রতি, ধর্মীয় প্রচারক মহলের প্রতি এবং মানুষের চিন্তার নাটাই যাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত, তাদের সবার প্রতি আমার পরামর্শ হচ্ছে, কোরআন মজীদের এ সকল আয়াত অধ্যয়ন করবেন। এসকল ভাবধারা কোরআন মজীদ থেকে আহরণ করবেন। এটি এক জ্ঞানসমগ্র। একটি পূর্ণাঙ্গ সমগ্র। আমাদের কাজের গলদটা হচ্ছে, পয়গাম্বর (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তা‘আলা যেসব শিক্ষা দিয়েছেন এবং পয়গাম্বরের যে পরিচয় ব্যক্ত করেছেন তার প্রতি আমরা অবহেলা প্রদর্শন করেছি। এই উপদেশ-সমষ্টি যদি আমরা পূর্ণাঙ্গরূপে আমাদের চোখের সামনে রাখি তাহলে আমাদের সামনে যে সিরাতুল মুস্তাকীমের ওপর নবী করিম (সা.) চলেছেন, সেই পথ আমাদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। اِنَّکَ عَلیٰ صِراطٍ مُستَقیم ‘নিশ্চয়ই আপনি সিরাতুল মুস্তাকীমের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ (সূরা যুখরুফ : ৪৩)
যেহেতু আমার ভাইয়েরা, আমাদের দেশের ও অন্যান্য দেশ থেকে আগত, ঐক্য সম্মেলনের সম্মানিত মেহমানবৃন্দ, ইসলামি দেশসমূহের রাষ্ট্রদূতগণ, শিয়া-সুন্নি বিভিন্ন মাযহাবের লোকজন, নানা চিন্তাধারা ও মতাদর্শের অনুসারীরা এ সমাবেশে উপস্থিত হয়েছেন, পরেও এসব কথা শোনা হবে, সেহেতু আমি প্রয়োজন মনে করেছি যে, আজকের এই সমাবেশে যে কথাটি আরয করতে চাই তা হলে আমার প্রিয় ভাইয়েরা ও বোনেরা! আজ ইসলামি জাহানের বড় রকমের সমস্যাদির সম্মুখীন হয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে ইসলামি ঐক্য। একতা, সহমত পোষণ, একে অপরকে সাহায্য করা এবং মাযহাবি ও চিন্তাগত অনৈক্যকে অতিক্রম করে যাওয়া।
বিশ^ক্ষমতাধর ও সা¤্রাজ্যবাদী চক্র ইসলামি জাহানের প্রতি যে দৃষ্টিতে তাকায় তা হচ্ছে, ইসলামি জাহানকে যতদূর পারা যায় ঐক্যের বাঁধন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে হবে। এই ঐক্য তাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। দেড়শ’ কোটি মুসলমান, এতগুলো ইসলামি দেশ, এত বিপুল সম্পদ সম্ভার, এই যে অসাধারণ জনশক্তি- যদি এসব সমষ্টি একত্রিত হয়, যদি ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামি লক্ষ্যসমূহের দিকে এগিয়ে যায়, তাহলে শক্তিমানরা বিশে^ তাদের ক্ষমতার ঘণ্টা বাজাতে পারবে না। আমেরিকা আর বিভিন্ন দেশের ওপর, বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারের ওপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে পারবে না। যায়নবাদী দুষ্টচক্র বিভিন্ন দেশ ও সরকারের ওপর তার চক্রান্তজাল বিস্তার করতে পারবে না। সে তখন তার অশুভ পাঁয়তারা সফল করতে ও স্বার্থ চরিতার্থ করতে সক্ষম হবে না। মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে এমনটিই হবে।
মুসলমানরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে তাহলে আজ ফিলিস্তিনের অবস্থা যেভাবে দেখছি সেভাবে থাকবে না। আজ ফিলিস্তিনের অবস্থা খুবই কঠিন ও নাজুক। গাজার অবস্থা এক রকম। পশ্চিম তীরের পরিস্থিতি অন্য রকম। ফিলিস্তিন জাতি আজ দৈনন্দিন প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে। তারা চাচ্ছে ফিলিস্তিনি ইস্যু মানুষের মন থেকে মুছে ফেলতে। একেবারে ভুলিয়ে দিতে চায়। তারা পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলকে- যার মধ্যে আমাদের দেশগুলো রয়েছে, যে অঞ্চলটি একেবারেই স্পর্শকাতর, আমাদেরকে আমাদের নিয়ে ব্যস্ত করে দিতে চায়। মুসলমানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে, আরবরা আরবদের বিরুদ্ধে যেন রুখে দাঁড়ায়. একে অন্যকে যেন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে, একে অন্যের যেন নিপাত সাধন করে। যেন মুসলিম দেশগুলোর সেনাবাহিনী বিশেষ করে যেসব সেনাবাহিনী যায়নবাদী ইসরাইলের প্রতিবেশিত্বে অবস্থান করছে দিন দিন দুর্বল হয়ে যায়। তাদের লক্ষ্য এটিই।
আজকের দিনে এতদঞ্চলে দু’টি ইচ্ছা পরস্পরের সাথে সাংঘর্ষিক। একটি ইচ্ছা ঐক্যের ইচ্ছা। আরেকটি ইচ্ছা বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্যের ইচ্ছা। ঐক্যের যে ইচ্ছা তা মুমিনদের সাথে সংশ্লিষ্ট। ইখলাসের কণ্ঠস্বর হতে ঐক্য ও একতার আহ্বান ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত। তাতে মুসলমানদের আহ্বান জানানো হচ্ছে, আপনারা আপনাদের মধ্যে যেসব অভিন্ন বিষয় রয়েছে সেগুলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন। যদি এমনটি হয়, যদি এই ঐক্য সম্পন্ন হয় তাহলে মুসলমানদের যে অবস্থা বর্তমানে বিরাজ করছে তা ভবিষ্যতে তেমনটি থাকবে না। মুসলমানরা মর্যাদাপূর্ণ অবস্থা লাভ করবে। আজকের দিনে আপনারা লক্ষ করুন, পূর্ব এশিয়ার শেষ প্রান্ত থেকেÑযেখানে মায়ানমারে মুসলমান নিধন চলছে- পশ্চিম আফ্রিকা পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় মুসলিম হত্যা চলছে। কোথাও বৌদ্ধদের হাতে নিহত হচ্ছে। কোথাও বোকো হারাম ও আইএস বা এ জাতীয় গোষ্ঠীগুলোর হাতে নিহত হচ্ছে। ব্রিটিশ শিয়া ও আমেরিকান সুন্নি একই রকম। সবাই একটি কাঁচির দুই ফলার ন্যায়। তাদের চেষ্টা হলো, মুসলমানদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া। এটিই হচ্ছে বিচ্ছিন্নতার ইচ্ছার বার্তা। এই ইচ্ছা হচ্ছে শয়তানি ইচ্ছা। তবে ঐক্যের বার্তাটি হলো : এই অনৈক্য থেকে অতিক্রম করতে হবে। পরস্পরের কাছে অবস্থান করবে। এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।
আজ বিশে^র ক্ষমতাদর্পী ও জাতিসমূূহের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো দখলকারীদের বক্তব্যের দিকে আপনারা যদি লক্ষ করেন দেখবেন যে, সবখানেই অনৈক্যের আহ্বান। প্রাচীনকাল থেকেই ইংরেজদের পলিসি সম্পর্কে বলা হত যে, ‘অনৈক্য সৃষ্টি কর আর শাসন কর।’ ডিভাইড অ্যান্ড রুল অর্থাৎ অনৈক্যের সুযোগ নিয়েই কর্তৃত্ব চালাও। ইংরেজদের হাতে যতদিন ক্ষমতা ছিল এটি ছিল তাদের নীতি। আজকেও এই পলিসি আজকের বস্তুগত দুনিয়ার ক্ষমতাধররা চালিয়ে যাচ্ছে। তা আমেরিকা হোক বা আবারো সাম্প্রতিক ইংরেজরা হোক।
ইংরেজরা আমাদের এ অঞ্চলে সবসময় মন্দের উৎস ছিল। সর্বদা জাতিসমূহের দুর্দশা-দুর্গতির কারণ ছিল। এরা এতদঞ্চলের জাতিসমূহের জীবনের ওপর যেসব আঘাত হেনেছে তা দুনিয়ার কোন অংশেই কোন শক্তির দ্বারা হানা হয়েছে কিনা তার নজির নেই। ভারতীয় উপমহাদেশে- যা বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ- এমন আঘাত হেনেছে, সেখানকার জনগণের ওপর এতখানি যুলুম চালিয়েছে, আফগানিস্তানের ওপর এক রকম যুলুম, ইরানের ওপর অন্যভাবে, ইরাক অঞ্চলে একভাবে, অবশেষে ফিলিস্তিনেও এমন খবিসিপূর্ণ তৎপরতা চালিয়েছে, তাতে মুসলমানদেরকে এবং প্রকৃতপক্ষে একটি জাতিকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে। তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করেছে। কয়েক হাজার বছর থেকে ইতিহাসে ‘ফিলিস্তিন’ নামে রেকর্ড আছে এমন একটি দেশ ইংরেজদের পলিসির কারণে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। এতদঞ্চলে দুই শতক থেকে এ দিকে, দুই শতাব্দী ও আরো কিছুকাল হবে, প্রায় ১৮০০ সাল থেকে নিয়ে এদিকে ইংরেজদের দ্বারা যা কিছু সংঘটিত হয়েছে সবই ছিল মন্দ, বিপর্যয় ও হুমকি। এ সময় এই ইংরেজ গভর্নর (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বাহরাইনে অনুষ্ঠিত পরস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের বৈঠকে এ কথা বলেন) এখানে এসে বলেন যে, ইরান এতদঞ্চলের জন্য হুমকি। ইরান কি এতদঞ্চলের জন্য হুমকি? এটা বলার জন্য বড় ধরনের নির্লজ্জতার দরকার। যারা বছরের পর বছর, দীর্ঘকাল ধরে এতদঞ্চলের জন্য হুমকি, দুর্দশা-দুর্গতি ও বিপদ ডেকে এনেছে তারা এসে আমাদের প্রিয় মযলুম দেশটিকে অভিযুক্ত করছে! এদের চরিত্রটাই আসলে এমন।
[লাল কালি এই অংশ হাইলাইট হবে
যখন থেকে এতদঞ্চলে ইসলামি জাগরণের আলামত দেখা গেছে, তখন থেকে অনৈক্য সৃষ্টির তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এরা জাতিসমূহের ঘাড়ে সওয়ার হওয়ার জন্য অনৈক্যকে একটি মাধ্যম হিসেবেই জানে। যে সময় থেকে তারা অনুভব করেছে যে, এতদঞ্চলে নতুন বক্তব্য, নতুন ইসলামি চিন্তাধারা, জাতিসমূহের উত্থান, জাতিসমূহ পুনরুজ্জীবিত ও শির উন্নত করার তৎপরতা শুরু হয়েছে তখন থেকেই দুশমনের অনৈক্য সৃষ্টির প্রয়াস ও প্রচেষ্টা জোরদার হয়েছে। ইরানে যখন থেকে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, ইসলামের ঝা-া উড্ডীন করেছে, কোরআন মজীদকে হস্তে ধারণ করেছে এবং গর্বের সাথে ঘোষণা দিয়েছে যে, আমরা ইসলাম অনুযায়ী আমল করছি আর রাষ্ট্রক্ষমতা, রাজনীতি, সেনাবাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী ও সবকিছুই সাথে রয়েছে আর দিনের পর দিন তা আরো জোরদার করেছে তখন তারা এই অনৈক্য সৃষ্টির তৎপরতা অধিকতর জোরদার করেছে। উদ্দেশ্য হলো এই ইসলামি গণজাগরণ ও ইসলামের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মোকাবিলা করা।
ইসলাম তাদের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ, কেননা, ইসলাম মুসলমানদের জাগ্রত করেছে। তবে যে ইসলামের কাছে সরকার নেই, সেনাবাহিনী নেই, রাজনৈতিক কাঠামো নেই, সম্পদ নেই, জিহাদি জযবায় উজ্জীবিত একটি মহান জাতি নেই, এমন ইসলামের সাথে তার অনেক তফাত আছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বিশাল বিস্তৃত দেশ, জিহাদি প্রেরণায় উজ্জীবিত জাতি, তরুণ জনগোষ্ঠী মুমিন ও প্রাণচঞ্চল জনশক্তি, প্রচুর খনিজ সম্পদ, বিশে^র মাঝারি মানের চেয়ে উন্নত যোগ্যতা ও ক্ষমতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার তৎপরতা এগুলো ইরানের রয়েছে। এ ধরনের ইরান তাদের জন্য অবশ্যই বিপজ্জনক। কেননা, যদি বিশে^র মুসলমানদের সামনে একটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা এটার সাথে শত্রুতা পোষণ করে। কোন কোন সময় যদি নম্রতা ভদ্রতা দেখিয়েও থাকে তা তাদের মিথ্যাচার। তাদের ভেতরে আছে সহিংসতা। তাদের কাজের আসল চরিত্র সহিংসতা। এ ধরনের একটি দুশমনের মোকাবিলার জন্য- যে দুশমনের না চরিত্র আছে, না আছে ধর্ম, আর না আছে ন্যায়বিচারÑ এদের বাইরের সাজগোছটা পরিপাটি; কিন্তু ভেতরে পুরোদমে একটি বন্যপশু, এ অবস্থায় জাতিসমূহকে সতর্ক ও প্রস্তুত থাকতে হবে।
আমাদের মতে আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি হচ্ছে, মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা। মুসলমানদেরকে অনৈক্য সৃষ্টির ব্যাপারে সজাগ সতর্ক থাকতে হবে। সব দলমতের লোকদেরই তা দরকার। এখানে শিয়া বা সুন্নি তফাত নেই। সকল ইসলামি দলের চেষ্টা করতে হবে, যাতে পরস্পরের মধ্যে যেসব অভিন্ন বিষয় রয়েছে সেগুলোর মধ্যে তাদের চিন্তাগত অনৈক্যগুলো লুকিয়ে যায়। অনৈক্যের বিষয়গুলোর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করতে হবে।
[লাল কালি এই অংশ হাইলাইট হবে
পয়গাম্বর (আ.)-এর পবিত্র সত্তা সর্বস্তরের মুসলমানদের ভালোবাসা ও প্রবল আগ্রহের মধ্যমণি। সবাই নবীজিকে ভালোবাসে। এটিই মূলকেন্দ্রবিন্দু। কোরআন মজীদ সর্বস্তরের সব মুসলমানের প্রাণের আকর্ষণ। কাবা শরীফও সেরূপই। মুসলমানদের মধ্যে অভিন্ন সূত্র কতই না বেশি! এসব অভিন্ন সূত্রের দিকে অধিক মনোযোগ নিবদ্ধ করতে হবে।
এতদঞ্চলে দুশমনদের অনুচর কারা, বিশে^র দাম্ভিক শক্তিগুলোর অনুচর কারা তাদেরকে চিনে নিন। দুঃখজনক হলো, সেই সরাসরি দুশমনটি এসে বলছে যে, তোমরা পরস্পর শত্রু। এই দেশটি তোমাদের জন্য হুমকি। অর্থাৎ তোমরা তাদের শত্রু। আর তারাও তোমাদের শত্রু। সে তো দুশমন বলেই এসব কথা বলছে। তাতে বুঝাই যায় যে, এমন কথা কেন বলছে। যারা তার কথা শুনছে, তারা তো বাহ্যত ইসলামি এবং ইসলামের নামেই জীবন যাপন করছে, দেশ শাসন করছে। তারা কেন ওর কথা মেনে নেবে? তার কথা কেন সত্য জ্ঞান করবে? কেন এতদঞ্চলের কতিপয় সরকারের চলার পথ আর দুঃখজনকভাবে ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু ও ইসলামি উম্মাহর জঘন্য শত্রুদের চলার পথ এক হবে?
আমি যে কথাটি আমাদের স্বজাতির উদ্দেশে আরয করব, ইরানের যে প্রিয় জাতি ইসলামি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরের বছরগুলোতে এবং একইভাবে সংগ্রাম চলাকালীন বছরগুলোতে, যার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেই উত্তুঙ্গ সংগ্রামের বছরগুলোতেও বহু পরীক্ষা দিয়েছে ও কৃতকার্য হয়েছে। তাদের প্রতি আমার আরয হলো, এই রাস্তাটি যা বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনীর চলার পথ এবং বিপ্লবের পথ এই পথ আপনারা ছেড়ে যাবেন না। এই পথ ধরে চলবেন। দুনিয়ার সম্মান ও ঊর্ধ্বলোকের জগতের সম্মান এই পথ ধরে চলার ওপরই নির্ভরশীল। এই পথ কোরআনকে আঁকড়ে ধরার পথ। আহলে বাইতকে আঁকড়ে ধরার পথ। আল্লাহর হুকুম আহকাম আঁকড়ে ধরার পথ। দুশমনের মোকাবিলায় রুখে দাঁড়াবার পথ। সত্য প্রকাশে কাউকে সমীহ না করা এবং সত্যের পক্ষে সাহসের সাথে দাঁড়ানোর পথ। এটি সেই পথ যা আমাদের জাতি যদি অনুসরণ করে- আলহামদু লিল্লাহ এ পর্যন্ত তারা এ পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের অনুসরণ করে তারা অগ্রসর হয়েছে এবং এই গৌরবময় পথ ধরে চলেছে, যদি এই পথ ধরে চলা অব্যাহত রাখে, এই সংগ্রাম চালাতে থাকে তাহলে এই জাতির দুনিয়া ও আখেরাতের চাহিদা পূরণ হয়ে যাবে। দুনিয়ার অন্য মুসলমানরাও উপকৃত হতে পারবে।
আমরা সকল ইসলামি দেশ ও মুসলিম সরকারের প্রতি পারস্পরিক সহযোগিতা, সাহায্য ও সহমর্মিতা পোষণের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আর এটি এমন এক আহ্বান যার মধ্যে সবার জন্য উপকার ও কল্যাণ রয়েছে।
আশা করি মহান আল্লাহ তা‘আলা তার অপার রহমত বরকত ও কল্যাণ ইসলামি উম্মাহর সবার প্রতি অবারিত করবেন। সকল ইসলামি দেশ ও জনগণের ওপর নাযিল করবেন। আর দুশমনের অনিষ্ট এতদঞ্চল থেকে ইনশাআল্লাহ দূরীভূত করবেন।
ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
উল্লেখ্য যে, মহামান্য রাহবারের ভাষণের শুরুতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হুজ্জাতুল ইসলাম রুহানি সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করেন।
এবারের ৩০তম ইসলামি ঐক্য সম্মেলন ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬ থেকে তিনদিন ব্যাপী ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত হয়।