তথ্য প্রযুক্তির যুগে মানবিক বিদ্যার গুরুত্ব
পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৭, ২০২০
ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহাত
বর্তমানে যেসব উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় বিশ্বের চিন্তাশীল মানুষদের ভাবিয়ে তুলেছে তা দূর করতে আমার কিছু দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে চাই। প্রথমত, এই পৃথিবী ও মহাবিশ্বের অন্যান্য সৃষ্টিজগৎÑ যে সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছুই এখনও অজানা, এসবকিছুরই প্রকৌশলী (পরিকল্পনাকারী ও সৃষ্টিকর্তা) হলেন মহান আল্লাহ। আমরা মানুষেরা যদি প্রকৌশলবিদ্যা বিষয়ে পড়ালেখা করি তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর অধ্যয়নের পরেই নামের সাথে ‘প্রকৌশলী’ উপাধি জুড়িয়ে দেই। এটি সঠিক নয়। কেননা, আমাদের প্রকৌশলীরা প্রকৃত ইঞ্জিনিয়ারিং করেন না। তাঁরা যা করেন তা হচ্ছে রি-ইঞ্জিনিয়ারিং। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডানায় ভর করে পাখির উড্ডয়ন অনুকরণ করে উড়োজাহাজ তৈরি হয়েছে নাকি উড়োজাহাজের উড্ডয়ন দেখে পাখি তৈরি হয়েছে? অথবা হোভারক্র্যাফ্টÑ যা জলে ও স্থলে দুটিতেই চলাচল করতে পারে, এমন সামরিক যানের নকশা ও নির্মাণ কাজ ঐসব প্রাণীÑ যা জলে ও স্থলে চলাচল করতে পারে তার অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে নাকি উল্টো এসব সামরিক যানের অনুকরণে উভচর প্রাণী সৃষ্টি হয়েছে? এমন হাজারটা নয়, বরং লক্ষ লক্ষ উদাহরণ রয়েছে যা প্রমাণ করে মানুষ প্রকৃতির অনুপ্রেরণায় রি-ইঞ্জিনিয়ারিং করে থাকেÑ ইঞ্জিনিয়ারিং নয়। কেননা, এই বিশ্বজগতে যাকিছু আছে এসবকিছু যিনি অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিমাপের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে তৈরি করেছেন সেই ইঞ্জিনিয়ার একমাত্র আল্লাহ।
পবিত্র কুরআনের সূরা আরাফের ৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ইন্না রাব্বাকুমুল্লাযী খালাকাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা ফি সিত্তাতি আইয়্যামিন সুম্মাসতাওয়া ‘আলাল ‘আরশ।’ এই আয়াত থেকে এমন প্রশ্নই উঠে আসে যে, মানব প্রকৌশলীদের দেহ-কাঠামো ও চিন্তাশক্তিকে কে ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন? আমরা যদি একটু নেতিবাচক প্রশ্নের মাধ্যমে জানতে চাই, এখন পর্যন্ত যাকিছুর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তৈরি করা হয়েছে তা ধ্বংস করব তাহলে অন্য প্রকৌশলীর সৃষ্টিগুলোকে ধ্বংস করার শক্তি কোন্ প্রকৌশলীর বেশি?
যদি মহান আল্লাহ একটি ঝড় বা ভূমিকম্পের মাধ্যমে চোখের পলকে দুনিয়ার প্রকৌশলীদের নির্মাণসমূহকে উলটপালট বা ধ্বংস করে দিতে চান তাহলে এই দুনিয়ার এই প্রকৌশলীরা কি এই ঝড়, আগ্নেয়গিরি ও ভূমিকম্পকে চোখের পলকে সরিয়ে দিতে পারবেন?
অতএব, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা যেসব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা শিখছি তা মূলত রি-ইঞ্জিনিয়ারিং, ইঞ্জিনিয়ারিং নয়। এটি মানুষের বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দ্য ও সমৃদ্ধির একটি চেষ্টা। তাদের মানসিক ও আত্মিক প্রশান্তির জন্য নয়।
কিন্তু সংস্কৃতি ও মানবিক বিদ্যা এবং সাহিত্য কেমন বিষয়? আল্লাহ তা‘আলা যখন মানুষের জন্য নবী ও রাসূল নির্বাচন করেছেন তখন তাঁদের কাছে কী চেয়েছেন? তাঁদের কাছে চেয়েছেন নৈতিকতার পরিপূর্ণতাÑ প্রকৌশলবিদ্যায় পারদর্শিতা নয়। তাঁদের কাছে কি চেয়েছেন যে, তাঁরা মানুষের শারীরিক চিকিৎসক হবেন নাকি তাঁরা মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধি ঘটাবেন?
কেন ‘এগ্রিকালচার’ ও ‘কালচার’ শব্দ দুটির উৎস একই। এর অর্থ কি এটি নয় যে, সংস্কৃতিবানরা মানুষ ও মানবমনের সাথে যে কাজটি করে, কৃষি-প্রকৌশলীরা মাটির সাথে একই কাজ করে? সংস্কৃতির অনেক সংজ্ঞা রয়েছে এবং সম্ভবত তা পাঁচশ’তে পৌঁছতে পারে। তবে ১৯৭২ সালে ইউনেস্কোর সম্মেলনে সংস্কৃতির যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তাতে বলা হযেছে, ‘সংস্কৃতি হলো চিন্তা, আবেগ-অনুভূতি, বৈষয়িক, আধ্যাত্মিক ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের একটি সামষ্টিক রূপ যা একটি দল বা সমাজকে চিহ্নিত করে। সংস্কৃতি কেবল কোনো সমাজের শিল্পকলা ও লিখিত রচনা নয়, বরং জীবনযাত্রার ধরণ, ব্যক্তির মৌলিক অধিকার, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও সেই সমাজের বিশ্বাসকেও অন্তর্ভুক্ত করে। এটিই সংস্কৃতি যা মানুষকে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে দেয়। এটি এমন একটি বিষয় যা আমাদেরকে মানবজীবন সম্পর্কে সচেতন করে এবং আমাদের বৃদ্ধিবৃত্তিক জীবন, গুরুত্বপূর্ণ বিচার-বিশ্লেষণ ও নৈতিক প্রতিশ্রুতির অনুভূতি তৈরি করে।’
সংস্কৃতির মাধ্যমেই মানুষ নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে, নিজের সচেতনতায় পৌঁছায়, নিজের দুর্বলতাগুলোকে গ্রহণ করে ও পুনঃপ্রকৌশলের মাধ্যমে নতুন কিছু উদ্ভাবন করে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিকবিজ্ঞান বিভাগÑ যেখানে সংস্কৃতি ও সংস্কৃতির ব্যবস্থাপনা শিক্ষা দেয়া হয় তা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়Ñ যেখানে কেবল পণ্যের রি-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শিক্ষা দেয়া হয় তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সংস্কৃতি হলো সমুদ্রের পানিতে মাছ ধরার জালের মতো। যা জালের ভিতরের মাছকে সমুদ্রের বাইরের মাছ থেকে আলাদা করে। সংস্কৃতি হলো সমাজের আঠার মতো। সংস্কৃতি আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের বাতাস, আমাদের জীবনের সফ্্টওয়্যার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য ও মানবিক বিদ্যা বিভাগ সাংস্কৃতিক বিনির্মাণ ও সাংস্কৃতিক মানুষ গড়ার দায়িত্ব পালন করে। অতএব, আমরা যদিও আধুনিক দুনিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগের ভূমিকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেননা, সংস্কৃতিবিহীন মানুষ ত্রুটিúূর্ণ। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে পণ্যটিই তৈরি হয় তার পেছনে একটি সংস্কৃতি রয়েছে। এজন্যই একটি দেশের হস্তশিল্প অন্যদেশের হস্তশিল্পের চেয়ে ভিন্ন। সুতরাং সংস্কৃতির ভূমিকা সমস্ত মানব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ভিত্তি। অপর দিকে প্রতিটি দেশের সাহিত্যও ঐদেশের সংস্কৃতির মধ্যেই গড়ে ওঠে। কেননা, সাহিত্য সংস্কৃতিরই অংশ এবং যেকোনোভাবে সংস্কৃতিকেই সমৃদ্ধ করে।