শুক্রবার, ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

চিরায়ত ধারার উৎসব নওরোজ

পোস্ট হয়েছে: মে ১১, ২০১৭ 

ড. তারিক সিরাজী

ইরানের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব হলো নওরোজ। এ উৎসব বহুকাল ধরে চলে আসছে। ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা পট পরিবর্তন ঘটলেও এ উৎসব উদ্যাপনে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় নি। নওরোজ ইরানের ঐতিহ্যবাহী নববর্ষের উৎসব। নওরোজকে শাব্দিকভাবে ‘নতুন দিন’ বলা হয়। নওরোজ শব্দটি ‘নও’ ও ‘রোজ’ এই দু’টি ফারসি শব্দ যোগে গঠিত। এটি ইরানি সৌরবর্ষের প্রথম মাসের প্রথম দিনকে গণ্য করা হয়। এই উৎসব ব্যাপক ও বিস্তৃতভাবে ইরানের সর্বত্র পালিত হয়। এটি মার্চ মাসের ২০ অথবা ২১ তারিখে উদ্যাপিত হয়ে থাকে। তবে নববর্ষের প্রথম দিনটি মার্চের ২০ না ২১ তারিখে হবে তা নির্ভর করে পৃথিবী সূর্যের চারিপাশে পরিপূর্ণভাবে ঘুরে আসার ওপর। এছাড়া জ্যোতির্বিদদের মত অনুযায়ী সূর্যের রাশিচক্রে প্রবেশের ওপর ভিত্তি করেই নববর্ষের প্রথম দিনটির সূচনা ঘটে- যাকে বর্ষবরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নওরোজের শুরুতেই নব বসন্ত আরম্ভ হয়। আর এই নব বসন্ত প্রকৃতিকে এমনি নতুন ও সুন্দররূপে সাজায় যাতে নববর্ষ তথা নওরোজকে ভালোভাবে উদ্যাপনের একটি আবহ সৃষ্টি হয়।

বিজ্ঞানী আবু রাইহান বিরুনির মতে প্রাচীন পারসিকদের প্রথাগত অনুষ্ঠানাদির অন্যতম উৎসব হলো নওরোজ- যা ইরানি সৌরবর্ষের প্রথম মাস ফারভারদিনের প্রথম দিন। এ কারণে একে নতুন দিন বা নওরোজ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে যেহেতু এটি নতুন বছরের নতুন ভাগ্য হিসেবে পরিগণিত হয়।

নওরোজ শব্দটি আরবি ভাষায়ও ফারসির ন্যায় প্রচলিত রীতিতেই জের-জবর বসিয়ে তথা ‘নেইরোজ’ উচ্চারণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

হাকিম ওমর খৈয়াম নওরোজনামে শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, নওরোজ নামকরণের অন্যতম কারণ হলো সূর্য ৩৬৫ দিবারাত্রি ঘুরে প্রথম মুহূর্তে পূর্ণতা লাভ করা এবং ইরানের প্রাচীন বাদশাহ জামশিদ কর্তৃক ঐ দিন ও মুহূর্তটিকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা। বাদশাহ জামশিদ এই উৎসবের সাথে কতগুলো বিধিবিধানও যুক্ত করেছিলেন এবং এই উৎসব উদ্যাপনে তাঁর পরবর্তী রাজাবাদশাহগণ ও অন্য ব্যক্তিত্ববর্গ তাঁর অনুকরণ করেছিল। পারসিক বাদশাহগণ সূর্যের পালাবদলের মুহূর্তটিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার কারণে এটিকে উৎসবে পরিণত করা হলো এবং বিশ^বাসীকে জানিয়ে দেয়া হলো যাতে এই উৎসবকে তারা চিনতে ও বুঝতে পারে এবং এই সময়টিকে গুরুত্বসহকারে সংরক্ষণ করে। রাজ্যের এই ধরনের প্রচলিত প্রথা ও নিয়ম-কানুন বাস্তবায়ন করা তৎকালীন রাজাবাদশাহদের ওপর অত্যাবশ্যক ছিল; যাতে বছরের প্রথম সময়টা মহিমান্বিত, ঐতিহাসিক ও আনন্দময় হয়ে ওঠে। তাদের মতে যে-কেউ এই নওরোজের উৎসব পালন করবে এবং আনন্দে যুক্ত থাকবে সে পরবর্তী নওরোজ পর্যন্ত আনন্দময় জীবন কাটাবে।

অন্য একটি সূত্রে জানা যায় যে, নওরোজ উৎসবের প্রচলন মূলত হাখামানশিদের (অপযধবসবহরফং) যুগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরা এ উৎসবটি জ্যোতিষ বিদ্যায় অগ্রগণ্য ও প্রসিদ্ধ ব্যাবিলনীয়দের অনুকরণে পারস্যকরণ করে- যা আধুনিক যুগে এসেও এর শাশ্বত ঐতিহ্য নিয়ে টিকে আছে।

অনেকের মতে এর ইতিহাস প্রাচীন হাখামানশীয় রাজাদের যুগের বা তারও আগের বলে অনুমিত হয়। ইসলামোত্তর যুগে পাহলাভি ভাষায় রচিত প্রাচীন গ্রন্থ বোন্দাহেশান্-এ (بُنْدَهِشَن) নওরোজ বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। সাসানি আমলের শেষ দিকে প্রণীত এ গ্রন্থের শিরোনামের অর্থ হলো মূল বা শিকড় সৃষ্টি অথবা প্রথম সৃষ্টি। যেহেতু নওরোজ পরিভাষাটি বোন্দাহেশান্ গ্রন্থে উল্লেখ আছে এবং বিশ^জগতের বিভিন্ন বস্তুর সৃষ্টি সম্পর্কিত বিষয়বস্তু গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, সে কারণে নওরোজ উৎসবেরও জগৎসৃষ্টির সাথে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে পারে। ইরানে নওরোজ উৎসব শুরু হয় বসন্ত ঋতু শুরু হবার সাথে সাথে। তাই নওরোজ হচ্ছে বিশেষ সংস্কৃতি ও রসম-রেওয়াজেরই অভিজ্ঞান। এর প্রত্যেকটি রীতিনীতিই ইরানি জাতির গভীর সাংস্কৃতিক চেতনার মাঝে প্রোথিত।

যে সময় নওরোজ উৎসবের সূচনা ঘটে তখন অধিকাংশ লোক ‘আলোকে খোদার প্রতীক আর অন্ধকারকে শয়তানের প্রতীক’ হিসেবে গণ্য করত। অতএব, পর্যায়ক্রমে নওরোজে শয়তানের ওপর খোদার বিজয় এবং পৃথিবীর পুনর্জন্মের সূচনা ঘটে। আরব খলিফাদের শাসনামলেও ইরানে নওরোজ উৎসব পালিত হত। কারণ, বলা হয় নবী-রাসূলদের সাথে সম্পর্কিত এমন কতিপয় ঘটনার উৎপত্তি লাভ করে যেগুলো মূলত বসন্তকালেই সংঘটিত হয়েছিল। যেমন হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে খোদাদ্রোহী নমরুদ কর্তৃক অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ ও এর থেকে মুক্তি লাভ, ফেরাউনের ওপর হযরত মূসা (আ.)-এর সমুদ্র পথে বিজয় এবং হযরত নূহ (আ.)-এর প্লাবন থেকে মুক্তির ঘটনা। যখন মহানবী (সা.) দশম হিজরির জিলহজ মাসের ১৮ তারিখে গাদীরে খুম নামক স্থানে হযরত আলী (আ.)-কে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করেন, সেদিনটিও ছিল এই নওরোজের দিন। এমনিভাবে নবম শতাব্দীতে ইরানি রাজ বংশগুলোর উত্থানকালে এটি একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়।

যুগ যুগ ধরে ইরানি জনগণ উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে নওরোজের এ চেতনাকে অন্ধকারের বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে। বিশেষত নওরোজ বা ফারভারদিনকে (সৌর সনের প্রথম মাস) ইরানিরা ন্যায় ও ইনসাফ, মানবাধিকার এবং ইরানি সভ্যতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। ইরানিরা অতিশয় উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে ইসলামকে গ্রহণ করেছিল। কারণ, ইসলামের মাঝেই সামাজিক ন্যায়বিচার, ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যমৈত্রীর আদর্শ বিদ্যমান রয়েছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অনেক গবেষক, পারস্য ও আরবের বিপুল সংখ্যক প-িত ও মনীষী এ উৎসবকে ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন তাঁদের গবেষণায়।

এ ক্ষেত্রে নওরোজ সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। বর্ণনা মতে জানা যায় যে, একদল ইরানি, যাঁরা সবেমাত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছেন, একবার তাঁরা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। তাঁরা রাসূল (সা.)-এর সাথে ইরানিদের ঐতিহ্যবাহী নওরোজ উৎসব সম্পর্কে আলোচনা করলেন। তাঁরা বললেন, ‘আমরা বসন্তের প্রথম দিন তথা সৌরবর্ষের শুরুতে একটি উৎসব পালন করি, যার নাম হলো নওরোজ। এই উৎসবটি আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যগত ধারা অনুযায়ী পালন করে আসছি। আমরা আপনার কাছে জানতে চাই, এই উৎসব সম্পর্কে আপনার কী অভিমত?’ হযরত মুহাম্মাদ (সা.) জিজ্ঞাস করলেন, ‘এই উৎসবে আপনার কী কী করেন?’ প্রতিউত্তরে তাঁরা বললেন, ‘এই উৎসব উপলক্ষে আমরা আমাদের বাড়ি-ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে থাকি- যাকে আমরা ‘খ’নে তেকুনি’ বলি এবং বর্ষবরণের সময় আদ্যাক্ষর সিন যুক্ত সাতটি বস্তুর সমন্বয়ে ‘সুফরেয়ে হাফ্ত সিন’ নামক সুন্দর একটি দস্তরখান (সুফরে) বিছাই। আমরা পরিবারের সকল সদস্য এ দস্তরখানের চারিদেকে বসি এবং এই প্রার্থনা করি যে, বছরটি যেন বেশ সুখকর ও স্বাচ্ছন্দময় হয়। হিংসা, দ্বেষ ও অসন্তুষ্টিগুলো হৃদয় থেকে বের করে দেই। নতুন পোশাক পরিধান করি এবং পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে দেখা করে কুশল বিনিময় করি। পরস্পরকে বিশেষ করে ছোটদেরকে এই উৎসবে উপহার দিয়ে থাকি। এই উৎসবের ১৩তম দিবসে পার্ক কিংবা মরুদ্যানে বেড়াতে যাই।’ এরপর হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বললেন, ‘কতইনা উত্তম উৎসব! যে উৎসব মনের প্রশান্তি ও আনন্দ যোগায় তা মূল্যবান বলে গণ্য করতে পার।

নওরোজ উৎসবের দিনগুলোতে ঐতিহ্যগতভাবেই অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যবসাকেন্দ্রসমূহ বন্ধ থাকে। জনগণ এ উৎসবটিকে একে অন্যের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে পালন করে থাকে। শুধু তাই নয়, তারা একে অপরকে সম্ভাষণ জানায়, উপহার বিনিময় করে কয়েক সপ্তাহব্যাপী। নওরোজের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই লোকেরা নতুন নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ ক্রয় করে, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। উৎসবের সেদিনগুলোতে তারা আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে এবং টিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নববর্ষকে স্বাগত জানায় এবং আড়ম্বরের সাথে তা উদ্যাপন করে। এই নওরোজের সময়েই চূড়ান্তভাবে শীতের অবসান ও বসন্তের সূচনা ঘটে এবং মানুষের মাঝে উদ্দীপনা দেখা যায়।
এটি স্মর্তব্য যে, এই পারস্য সংস্কৃতি হিসেবে নওরোজ শুধু ইরানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এই উৎসব মধ্য এশিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশ, তুরস্ক, ইরাক, এমনকি দক্ষিণপূর্ব ইউরোপের সীমানা ছাড়িয়েও এর বিস্তৃতি ঘটেছে। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও এর বিস্তার লাভ করেছে। এই উৎসবের প্রেরণার মধ্যে আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং জাতীয় মূল্যবোধ যুগ যুগ ধরে প্রথিত রয়েছে।
বিশেষভাবে এর একটি স্থায়ী মূল্যবোধ ইরানের ইতিহাস-সাহিত্য, যেমন ফেরদৌসির মহাকাব্য শাহনামা, হাফিজের গজল, সাদীর কবিতা, রুমির মাসনাভি, বাবা তাহের হামেদানির কাসিদা, নিযামি গাঞ্জাভি, খৈয়াম এবং বিশেষ করে ইরানি গযল ও সংগীতে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। নওরোজের এই উৎসব বাণীতে ইরানি সমাজের সংহতি, সামাজিক ন্যায় বিচার, আনন্দ, উৎসব, বন্ধুত্ব, সুখ, সমৃদ্ধি, স্বাধীনতা এবং মানবতার জয়গান প্রত্যক্ষ করা যায়।

উদাহরণ হিসেবে ইরানের বিখ্যাত কয়েকজন কবির কয়েকটি শ্লোক তুলে ধরা হলো। ফেরদৌসি তাঁর শাহনামা কাব্যে নওরোজ ও নব বসন্তের বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন :
از ابـــر بــهــاران بــبـاريـد نـم ز روي زمـين رنگ بـزدود غم
جهان گشت پر سبزه و رود آب سر غمكنان اندر آمد به خواب
زميـن چـون بهشـتي شد آراسته ز داد و ز بخشش پر از خواسته
বসন্তের মেঘমালা হতে নেমে আসে বৃষ্টির ফোঁটা,
মাটির বুক থেকে ধুয়ে নেয় দুঃখ ও দুশ্চিন্তা।
পৃথিবী ভরে যায় সবুজের সমারোহে আর নদী পানিতে,
দুঃখীর জীবনে থাকে না উদ্বেগ আর মনস্তাপ।
জমিন সজ্জিত হয় যেন এক বেহশত রূপে
ইনসাফ ও দানের মহিমায় পরিপূর্ণ হয় প্রত্যাশা।
নওরোজ তথা বসন্ত যেন স্রষ্টা প্রদত্ত প্রকৃতির পরিবর্তনের অন্যতম নিদর্শন। শেখ সা’দী খোদা প্রদত্ত প্রকৃতির পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে বলেন :
برگ درختان سبز در نظر هوشيار هر ورقش دفتري است معرفت کردگار
বিচক্ষণদের দৃষ্টিতে সবুজ বৃক্ষের পত্র-পল্লবগুলো
যেন এর প্রতিটিই ¯্রষ্টার পরিচিতি লাভের নিদর্শন।

এই নওরোজে আধ্যাত্মিক কবি রুমি ঋতুচক্রের পরিবর্তনের জরাজীর্ণ অবস্থা থেকে নতুন করে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়ে বলেন:
باز آمدم چون عيد نو تا قفل زندان بشکنم وين چرخ مردم خوار را چنگال و دندان بشکنم
যেহেতু নতুন উৎসবের দিন, তাই কারাগারের তালা ভাঙতে পুনরায় ফিরে এসেছি
আর এসেছি এই মানুষখেকো কালচক্রের দাঁত ও থাবা চূর্ণ করতে।
হাফিজ তাঁর কবিতায় উল্লেখ করেন :
سخن در پرده می‌گویم چو گل از غنچه بیرون آی
که بیش از پنج روزی نیست حکم میر نوروزی
পর্দার আড়াল থেকে বলছি, ফুলের মতো কলি থেকে বেরিয়ে এস
কারণ, মিরে নওরোজির আদেশ পাঁচ দিনের বেশি থাকে না ।

কবি নাসের খসরু কোবাদিয়ানি তাঁর কবিতায় নওরোজ সম্পর্কে বলেন :
چون به نقطه¬ي اعتدالي راست گردد روز و شب
روزگار اين عالم فرتوت را برنا کند
نرگس و گل را که نابينا شوند از جور دي
عدل پروردين نگر تا چون همي بينا کند
সত্যিই যখন দিন ও রাত একটি ভারসাম্যের ভিত্তিতে আবর্তিত হয়,
তখন জীর্ণ এই পৃথিবীর জীবনটা যৌবন লাভ করে।
দেই মাসের নিষ্পেষণে যখন নার্গিস ও ফুল নিষ্প্রভ হয়
তখন দেখ, ফারভারদিনের ন্যায়-নিষ্ঠা তা দৃষ্টিমান করে তোলে।
এমনিভাবে অনেক কবিই নওরোজ ও নববসন্ত নিয়ে তাঁদের কবিতা সাজিয়েছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে- যা নওরোজের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতারই প্রমাণ বহন করে।
নওরোজের আনুষ্ঠানিকতার একটি হচ্ছে সাবজে। যা কোনো একটি গামলা বা পাত্রের মধ্যে গমের চারা উৎপন্ন করে নওরোজের দিন উপস্থাপন করা হয়। ইরানিরা যেহেতু ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত তাই তাঁরা ঐ দিন এই ধরনের অনুষ্ঠানে ইসলাম ধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং নওরোজের দস্তরখানে একখানা পবিত্র কুরআন উপস্থাপন করেন।
মূলত নওরোজ হচ্ছে তাদের নতুন করে জীবন লাভের প্রতীকী উৎসব। এ দিন তারা নব জাগরণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে নতুন জীবন লাভ করে। ইরানের সর্বত্রই নওরোজের এই উৎসব একটা ঐতিহ্যম-িত উৎসব হিসেবে পালিত হয়Ñ যাকে বসন্তকালের সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ইরানি পরিবারগুলো এ উপলক্ষে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘর-বাড়ি, তৈজষপত্র, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য গৃহ সামগ্রী নতুন করে সুসজ্জিত করে।
প্রতিটি পরিবার এ উপলক্ষে কমপক্ষে এক সেট করে নতুন পোশাক ক্রয় করে। তারা নববর্ষের প্রথম দিনে তথা ফারভারদিন মাসের ১ তারিখে (২০ অথবা ২১ মার্চ) বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে নতুন পোশাক পড়ে দেখা-সাক্ষাৎ করে।
নওরোজ উপলক্ষে ইরানি পরিবারগুলো বিভিন্ন ভোজ অনুষ্ঠানে একত্র হয় যেখানে হাফ্ত সিন তথা আদ্যাক্ষরে ফারসি সিন বর্ণ সম্বলিত সাতটি বস্তুর সমাহারে সে দিন দস্তরখান সুসজ্জিত করা হয়। সাতটি বস্তু হচ্ছে সাবজে যা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে। সামানু (এক ধরনের মিষ্টান্ন), সিব (আপেল), সেরকে (ভিনেগার), সেনজেদ (এক ধরনের শুষ্ক ফল), সির (রসুন), সেক্কে (মুদ্রা) ও সোমমাক (ক্ষুদ্রাকৃতির লাল রঙের ফলবিশেষ) আদ্যাক্ষর ফারসি সিন বর্ণ দ্বারা সূচিত এই সাতটি বস্তু ছাড়াও তারা আরো কিছু জিনিস সাজিয়ে রাখে; তার মধ্যে হলো অ্যাকুরিয়ামে রাখা গোল্ড ফিশ, চিত্রিত ডিম, স্বর্ণমুদ্রা, আয়না ও মোমবাতি।

এর প্রতিটি উপকরণই বিশেষ কতগুলো জিনিসের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, সাবজে হলো নব জীবনের প্রতীক, সামানু হলো অফুরন্ত নেয়ামতের নিদর্শন, সিব তথা আপেল হলো সৌন্দর্য ও সুস্থতার প্রতীক, সেরকে দীর্ঘ জীবন ও সহিষ্ণুতার প্রতীক, সির বা রসুন হলো ঔষধ, রোগ নিরাময় ও সুস্বাস্থ্যের প্রতীক, সোম্মাক হলো প্রভাতের লাল সূর্যের প্রতীক, সেক্কে বা মুদ্রা হলো সম্পদ, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের প্রতীক, সেনজেদ হলো প্রেম-ভালোবাসার প্রতীক, সোম্বল হলো বসন্তের নবাগমনের প্রতীক, মোমবাতি হলো আলো ও কল্যাণের প্রতীক আর সোনালি মাছ হলো জীবন ও যৌবনের প্রতীক। আর প্রথাগতভাবে নববর্ষের দিনগুলো হলো আপ্যায়ন এবং উৎসবের দিন।

এদিন পরিবারের সকল সদস্য নতুন পোশাকে সজ্জিত হয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যোগদান করে। তারা সকলে একত্রে বসে টিভি, রেডিও প্রভৃতি গণমাধ্যমে বর্ষবরণের ঘোষণা শোনার অপেক্ষায় থাকে। ঘোষণা হওয়া মাত্রই তারা সকলে সমস্বরে নিচের দোয়াটি পাঠ করে :
يا مُقلب القلوب و الابصار يا مدبر اليل و النهار
يا مُحوِّلَ الحولِ والاحوال حوِّل حالنا الي احسنِ الحال
ইয়া মুকাল্লেবাল কুলুবি ওয়াল আবছার ইয়া মুদাব্বেরাল লাইলি ওয়ান নাহার
ইয়া মুহাভ্ভেলাল হাওলে ওয়াল আহওয়াল হাভ্ভেল হালানা ইলা আহসানিল হাল
(হে অন্তর ও দৃষ্টিসমূহের বিবর্তনকারী
হে রাত ও দিনের বিবর্তনকারী
হে অবস্থা ও অবস্থাসমূহের বিবর্তনকারী
আমাদের অবস্থাকে তুমি উত্তম অবস্থায় পরিবর্তন কর।)

এ উৎসবে ইরানিরা পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করে এবং শিশুদের হাতে উপহার তুলে দেয়। নওরোযের ত্রয়োদশ দিবস হচ্ছে আরেকটি সরকারি ছুটির দিন যাকে ইরানি পরিভাষায় বলা হয় সিযদা বেদার। সে দিন তারা দলবদ্ধ হয়ে ঘরের বাইরে কোনো এক ময়দানে বা পার্কে বেড়াতে যায় এবং নৈস্বর্গিক শোভা উপভোগ করে। এছাড়া তারা বিভিন্ন ভোজ অনুষ্ঠানে পরস্পরে মিলিত হয়। এই নববর্ষের প্রথম দিনে তাদের মধ্যে যে প্রেরণা সঞ্চারিত হয় তা সত্যিই প্রত্যক্ষ করার মতো।

নওরোজ এখন ইরান ভূখণ্ডের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইরান ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশে এ নওরোজ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্যাপিত হয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি ও সংহতি, পরিবারিক সৌহার্দ, সামাজিক ন্যায় বিচার, আনন্দ-উৎসব, সুখ-সমৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, মানবতার জয়গান ও পরস্পরের মাঝে বন্ধুত্বের যে ধারা নওরোজের মাধ্যমে সুদৃঢ় হয়ে থাকে সে বিষয়টি বিবেচনা করে ২০০৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক ইরানি নববর্ষের প্রথম দিন (১ ফারভারদিন) তথা নওরোজকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয় এবং নওরোজ উৎসবকে ইউনেস্কোর Intangible Cultural Heritage of Humanity-এর তালিকাভুক্ত করা হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর ২০ অথবা ২১ মাচ আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই প্রাচীন উৎসবটি উদ্যাপিত হচ্ছে। ইউনেস্কো কর্তৃক এই ঘোষণা ইরানের জন্য গৌরব বয়ে আনে।

তথ্যসূত্র:
আহমেদ তামিমদারী (১৩৯০ সৌরবর্ষ): ফারহাঙ্গে অ’ম্মে, মাহকামে পাবলিকেশন্স, ইরান।
তারিক জিয়াউর রহমান সিরাজী (২০১৪ খ্রি.): ফারসি সাহিত্যেরই ইতিবৃত্ত, বাড পাবলিকেশন্স, ঢাকা।
মাহমুদ বাশিরী, নওরোজ উৎসবের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ও ইরানী সমাজ, নিউজ লেটার (ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরের মুখপত্র), মার্চ-এপ্রিল, ২০০৪ সংখ্যা।
সিরাজুল হক, ইরানী নওরোজ ও বাংলা নববর্ষ শাশ^ত ঐতিহ্যের ধারা, নিউজ লেটার (ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরের মুখপত্র), মার্চ-এপ্রিল, ২০১৫ সংখ্যা।
সাজেমানে ফারহাঙ্গ ওয়া এরতেবাতাতে ইসলামি, ইরান কর্তৃক প্রকাশিত ১৩৮৬ সৌবর্ষের বর্ষপঞ্জি (সালনুমা)
ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর থেকে প্রকাশিত শিশু-কিশোরদের ম্যাগাজিন কিশোর নিউজলেটার, মার্চ-এপ্রিল, ২০১১ সংখ্যা।