বুধবার, ১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৯শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইসলামে সামাজিক ন্যায়বিচার

পোস্ট হয়েছে: মে ২২, ২০১৩ 

news-image

উত্তম ইসলামি সমাজে নারী-পুরুষ সবাই কাজ করে

(হুজ্জাতুল ইসলাম হাশেমী রাফসানজানির শুক্রবারের জুমার নামাজের খুতবা থেকে)

 মহিলাদের চাকরি

মহিলাদের আর্থিক নিরাপত্তার একটি উৎস হচ্ছে চাকরি। আমাদের এই যুগে মহিলাদের চাকরির ব্যাপারটি একটি সমস্যা হয়ে উঠেছে। প্রাথমিক প্রশ্ন হচ্ছে : মহিলাদের কাজ করা উচিত, না উচিত নয়? ইসলাম বলে, মহিলারা কাজ করতে পারে এবং তাদের কাজ করা উচিত। ইসলামে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই শ্রমবিমুখতা ও আলস্য নিষিদ্ধ। বেশ কিছুসংখ্যক হাদিসে স্পষ্টই বলা হয়েছে যে, মহিলাদেরও কাজ করা উচিত। আমি এমন কয়েকটি হাদীসের উল্লেখ করছি যা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘সত্তর ধরনের ইবাদতের মধ্যে সর্বোত্তম ইবাদত হচ্ছে সৎভাবে জীবনযাপনের জন্য পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা।’

এখানে নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি। আবার রাসুলুল্লাহ বলেছেন : ‘যারা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তারা আল্লাহর ক্ষমা লাভের যোগ্যতা অর্জন করে।’ এখানেও নারী বা পুরুষ কারো জন্যই বিশেষভাবে কথাটি বলা হয়নি- উভয়ের ক্ষেত্রেই সাধারণভাবে কথাটি প্রযোজ্য।

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : আল্লাহ সৎ, পরিশ্রমী মানুষকে ভালোবাসেন। এখানেও মানুষ কথাটি দ্বারা নারী ও পুরুষ উভয়কেই বোঝানো হয়েছে। হযরত শুয়াইব (আ.)-এর কন্যারা মেষ পালন করতেন। একদিন তাঁরা যখন মেষগুলোর জন্য একটি কূপ থেকে পানি আনতে যান তখনই হযরত মূসার সঙ্গে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ইমাম কাযেম (আ.) বলেছেন : আল্লাহ তাঁর নিদ্রাকাতর ও আলস্যপরায়ণ বান্দাদের অপছন্দ করেন। এখানে বান্দা বলতে নারী-পুরুষ উভয়কেই বোঝানো হয়েছে।

নিশ্চিতই এমন অনেক হাদীস রয়েছে যেখানে শুধু পুরুষদের কথাই বলা হয়েছে। তবে তা এই কারণে যে, যে সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নির্দেশগুলো এসেছে সে সময়ে পুরুষদের ওপরই পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল এবং এখনও পুরুষরাই সে দায়িত্ব পালন করে আসছে। সাধারণভাবে, স্মরণ রাখা দরকার যে, সময় নষ্ট করাকে ইসলাম অত্যন্ত ঘৃণা করে। প্রতিদিনের সময়কে আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা নিদ্রা ও বাকি আট ঘণ্টা ইবাদত, বিনোদন ও বিশ্রামের জন্য বিভক্ত করা একটি উত্তম ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য। কিন্তু যারা কেবল আলসেমি করে সময় কাটায় তারা আল্লাহর সৎ বান্দা নয়।

এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, একটি উৎকৃষ্ট মুসলিম সমাজ হচ্ছে এমন একটি সমাজ যেখানে নারী-পুরুষ সবাই কাজ করে। তবে, উভয়ের মধ্যে যথাযথ শ্রমবিভাগের একটি প্রশ্ন রয়েছে। নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই দৈহিক, মানসিক, হৃদয়বৃত্তিমূলক ও সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ বেছে নিতে হবে।

যেসব ক্ষেত্রে মহিলাদের নিয়োগ নিষিদ্ধ

আমি যতটা জানি, দুই বা তিন ধরনের কাজে যোগদানের পথ মহিলাদের জন্য বন্ধ করা হয়েছে। তবে, এগুলো চাকরির ক্ষেত্রে নয়। এগুলো হচ্ছে, কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে- যেখানে পারিশ্রমিকের কোনো ব্যবস্থা নেই। এই ধরনের একটি ক্ষেত্র হচ্ছে বিচারকের কাজ। ইসলাম একে একটি পালনীয় কর্তব্য হিসেবে গণ্য করে, গ্রহণযোগ্য পেশা হিসেবে বিবেচনা করে না। যারা বিচার করেন এবং লোকজনদের মধ্যে বিরোধের মীমাংসা করেন তাঁদের এই দায়িত্ব পালনের জন্য কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করা উচিত নয়। এ কাজের জন্য তাঁদের যে অর্থ ব্যয় হবে তা মুসলিম ট্রেজারি (বায়তুল মাল) থেকে দেওয়া হবে। কিন্তু অ্যাটর্নী ও আইন উপদেষ্টা হতে মহিলাদের কোনো বাধা নেই।

দ্বিতীয় যে ক্ষেত্রটিতে মহিলাদের প্রবেশে বাধা রয়েছে তা হচ্ছে, মৌলিক জেহাদে অংশগ্রহণ (অস্ত্রধারণ করা এবং যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেওয়া)। এটাও একটা ধর্মীয় কর্তব্য, কোনো পেশা নয়। তবে, আত্মরক্ষামূলক জেহাদে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ নয়। কারণ, পুরুষের মতো মহিলাদেরও আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। সমরকৌশল আয়ত্ত করাতেও মহিলাদের বাধা নেই, কিন্তু আত্মরক্ষামূলক না হলে মহিলাদের যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ অনুমোদিত নয়। ইসলাম মহিলাদেরকে এই গুরুদায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে।

মহিলাদের প্রবেশের অনুমতিহীন তৃতীয় ক্ষেত্রটি হচ্ছে ধর্মীয় বিধান জারির (ফতোয়া) অধিকার। এটি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে সিদ্ধান্ত দিতে হলে ধর্মীয় অনুশাসন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হতে হয়। কেননা, তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং অবশ্যপালনীয় বলে গণ্য হয়। এ কাজটিও একটি ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের কাজ মাত্র, পেশা বা বৃত্তি নয়। ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা করে মহিলারা ধর্মতত্ত্ববিদ হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর মতামত শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করা হবে, কিন্তু তিনি ধর্মীয় অনুশাসনের উৎস হতে পারেন না।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, মহিলাদের কয়েকটি মাত্র দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা কাজের অধিকার হরণ নয়- অন্য বিষয়। এছাড়া অন্য সকল ক্ষেত্রেই মহিলাদের কাজে নিযুক্তির অধিকার রয়েছে। তাঁরা উকিল হতে পারেন, অ্যাটর্নী হতে পারেন, মন্ত্রী হতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা হতে পারেন, মেকানিক হতে পারেন অথবা অপর যেকোনো পেশা বা ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করতে পারেন। মহিলাদের কাজের ব্যাপারে ইসলাম গত ১৪০০ বছর ধরেই এই অভিমত ব্যক্ত করে আসছে।

সমাজে মহিলাদের কাজের আওতা

কাজ বণ্টনের ক্ষেত্রে কিছু যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত ইসলামি নীতিমালা অবশ্যই বিবেচনা করা প্রয়োজন। এসব নীতির ভিত্তি হচ্ছে নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক স্বার্থ এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি ও সামর্থ্য সম্পর্কিত প্রশ্ন। এসব বিষয়ের ওপর ইসলাম যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছে। ইসলাম মনে করে, প্রতিটি পরিবারেরই নিরাপত্তা থাকতে হবে, পরিবারের প্রতিটি ছেলেমেয়েকেই আল্লাহর নির্দেশিত পরিবেশে গড়ে তুলতে হবে এবং স্বামী-স্ত্রীকে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।

সমাজে এমন কিছু অবস্থা বিদ্যমান থাকে যাতে মহিলাদেরকে কোনো কোনো কাজে নিয়োগ করা যায় এবং কোনো কোনো কাজে নিয়োগ করা যায় না। তাছাড়া নৈতিকতা ও সতীত্বের প্রশ্নও বিবেচনা করতে হবে।

আমি দেশের বাইরে অনেকের সঙ্গেই মেয়েদের কাজের ব্যাপারে আলোচনা করেছি। আমি তাদের বলেছি যে, আমাদের পথ ও তাদের পথের মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে, তাদের পরিবেশে মেয়েদের জন্যে নৈতিকতা বর্জনের প্ররোচনা থাকে, যেখানে পুরুষরা মহিলাদের সঙ্গে অসঙ্গত আচরণ করে। কিন্তু আমরা মনে করি, মহিলাদের মর্যাদার নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। ইসলাম মেয়েদের জন্য কাজের সকল দরজাই খোলা রেখেছে। কিন্তু কিছু শর্ত অবশ্যই পালন করতে হবে এবং কিছু নীতিমালা অবশ্যই মেনে চলতে হবে।

পাশ্চাত্যের পরিবার-কাঠামো

আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন যে, পরিবারের অস্থিতিশীল অবস্থা ও বন্ধনহীন সম্পর্কের জন্য প্রতি বছর দশ লক্ষাধিক আমেরিকান যুবক-যুবতী বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। মাত্র সেদিন আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি যে, জার্মানিতে পায় পাঁচ লাখ পরিত্যক্ত ছেলে-মেয়েকে সরকারি হেফাযতে রাখা হয়েছে। তাছাড়া সে দেশে প্রায় ত্রিশ লাখ মহিলাকে পৌরসভাগুলোর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। পাশ্চাত্য সমাজে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং ইসলামি সমাজের পারিবারিক বন্ধনের তুলনা করলেই ইসলামি জীবনপদ্ধতির যৌক্তিকতা উপলব্ধি করা যায়।

ঘৃণ্য পাহলভী শাসনামলে পাশ্চাত্যের অনুকরণে আমাদের মহিলাদেরও কাজের নামে এমন এক পরিবেশে টেনে আনা হয়েছিল যেখানে তাদের জন্য শুধু পাপ আর অনাচারই অপেক্ষা করছিল। সৌভাগ্যক্রমে, ইসলামি বিপ্লবের সাথে সাথে এই প্রবণতা বন্ধ হয়েছে। ইসলামি উপদেষ্টা পরিষদ পার্টটাইম কাজের যে বিল প্রণয়ন করেছেন তার ফলে মহিলারা এখন পরিবারের প্রতি তাঁদের প্রাথমিক দায়িত্ব পালনের পরে চাকরি করে অর্থ উপার্জন করতে পারবেন।

সম্প্রতি বিবিসি’র একজন আমেরিকান মহিলা রিপোর্টার আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। এর আগে তিনি শুক্রবারের এক জুমা সমাবেশে আমার খুতবা শুনেছিলেন। তাতে আমি আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজে মহিলাদের দুরবস্থার কথা বলেছিলাম। মহিলা রিপোর্টার আমাকে বললেন : ‘আমি তো চাদর পরি না। তাই বলে কি আমি একজন দুর্দশাগ্রস্ত মহিলা?’ জবাবে আমি বলেছি : ‘আমি আপনার ব্যক্তিগত অবস্থার কথা জানি না। আমি লাখ লাখ আশ্রয়হীনা জার্মান মহিলার কথাই বলেছি যারা রাষ্ট্রীয় আশ্রয়ে রয়েছে। তাদের এমন কেউ নেই যার কাছে তারা আশ্রয় পেতে পারে। এরা কি ভাগ্যহত নয়? এরা কি সুখী? আমি আপনার নিজের দেশের কথাও বলতে পারি। মাত্র কয়েকদিন আগে আমি আপনাদের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরেই দেখেছি, সেখানে হাইস্কুলে অধ্যয়নরত প্রায় পাঁচ লাখ ছেলেমেয়ে মাদকাশক্তির মতো অস্বাস্থ্যকর ও নৈতিকতাহীন কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে। পাশ্চাত্যের সব দেশেই এখন এই ধরনের পরিস্থিতি বিদ্যমান। আমরা মনে করি, এটা সমাজের সামগ্রিক অবক্ষয়েরই দঃখজনক পরিণতি। ইসলামি সমাজে মহিলাদেরকে এমন দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয় না।’

ঐ খুতবার উপসংহারে আমি মহিলাদের সতীত্বের প্রশ্ন তুলে বলেছিলাম যে, চাকরিরত মহিলাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্নটি এভাবে পেশ করা যেতে পারে : চাকরি করেও কি মহিলাদের পক্ষে শালীনতা ও সতীত্ব রক্ষা করা সম্ভব? এ প্রশ্নের জবাবে আমি বলব, হ্যাঁ, অবশ্যই। আমাদের নারী ও পুরুষ- উভয় শ্রেণির লোকেই যদি শালীনতা ও সতীত্বের শর্তগুলো পালন করে চলতে পারেন তাহলে মেয়েদের মাঠে কাজ করতে কোনো বাধা থাকতে পারে না।

শালীনতা ও সতীত্ব রক্ষার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করা আমাদের কর্তৃপক্ষের জন্য একটি গুরুদায়িত্ব। যে পরিবারে সতীত্বের কোনো মূল্য নেই, সে পরিবার থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না। সতীত্বের প্রতি শ্রদ্ধাহীন কঠোর আইন-কানুন সমাজ সংস্কারের সহায়ক হতে পারে না। আইন-কানুনের শিথিলতা নিয়েও সৎ ও পুণ্যবান সমাজ অনায়াসে এগিয়ে যেতে পারে। কাজেই, মহিলাদের সতীত্বের প্রতি দৃষ্টি রেখেই মহিলাদের কাজের ব্যাপারে আমাদের নীতি নির্ধারণ করতে হবে এবং নারী ও পুরুষের মধ্যে কাজ বণ্টন করতে হবে।

(নিউজলেটার, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬)