রবিবার, ২রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইসলামি বিপ্লবের তাত্ত্বিক ভিত্তি ও ইসলামি ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থা

পোস্ট হয়েছে: জুন ১৫, ২০২১ 

ইসলামি বিপ্লবের তাত্ত্বিক ভিত্তি ও ইসলামি ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থা
নূর হোসেন মজিদী
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর ৪২ বছর পার হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তৎকালীন বিশ্বের দ্বিতীয় পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তিসহ কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের বিদায় এবং আরো বহু দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় ও শাসনপদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটা সত্ত্বেও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বলদর্পী সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও তার বশংবদদের দুশমনি উপেক্ষা করে সগৌরবে মাথা উঁচু করে টিকে আছে এবং সকল ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে। তাই অনেকের মনেই সবিস্ময় জিজ্ঞাসা : এটা কীভাবে সম্ভব হলো? এর রহস্য কী?
এক কথায় জবাব দিতে হলে বলতে হয়, এর রহস্য ইসলামি বিপ্লবের তাত্ত্বিক ভিত্তি, এ বিপ্লবের বিজয়প্রক্রিয়া ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থার অনন্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নিহিত – যে বিষয়গুলো সম্পর্কে বহির্বিশ্বে খুব কমই চিন্তা-গবেষণা করা হয়েছে।

ইসলামি হুকুমাতের সংজ্ঞা
হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশের পূর্বে ইসলামি হুকুমাতের সংজ্ঞা কী? এটা শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সকল মুসলমানের মধ্যে বিরাজমান অভিন্ন প্রশ্ন। ইতিপূর্বে এ প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক ও বাস্তবসম্মত অভিন্ন জবাব ছিল না। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) এ প্রশ্নের অকাট্য জবাব প্রদান করেন যার সাথে দ্বিমত করার অবকাশ নেই। তিনি হযরত ইমাম মাহ্দীর আত্মপ্রকাশ-পূর্ব ইসলামি হুকুমাতকে ‘বেলায়াতে ফাক্বীহ্’ (ولايت فقيه) বলে সংজ্ঞায়িত করেন। তবে তিনি প্রথম বারের মতো এ সংজ্ঞা প্রদান করলেও এটি তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত কোনো অভিনব তত্ত্ব নয়; বরং এ বিষয়টি ইসলামের অকাট্য জ্ঞানসূত্রে পূর্ব থেকেই নিহিত আছে- যার প্রতি তাঁর পূর্বে কেউ সেভাবে দৃষ্টি প্রদান করেন নি।
এ বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে, কোনো নবী-রাসূলের (আ.) উপস্থিতিতে তাঁর প্রতি ঈমানদারগণ হুকুমাতের অধিকারী হলে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে মনোনীত প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি হিসেবে তিনিই হবেন তার প্রধান এবং আইনগত মতামত প্রদান ও রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে একচ্ছত্র হকদার; তিনি অন্যদের মতামত গ্রহণ করবেন কার্যত রাষ্ট্রপরিচালনার এখতিয়ারি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুবিধার্থে, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত এখতিয়ার তাঁরই। আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-কে সম্বোধন করে এরশাদ করেন :
شَاوِرْهُمْ فِي الأمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ
‘(রাষ্ট্রীয়) কাজকর্মের ব্যাপারে তাদের সাথে পরামর্শ করুন, অতঃপর যখন আপনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন তখন আল্লাহ্র ওপর তাওয়াক্কুল করুন।’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৫৯)
অধিকন্তু যারা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইন্তেকালের পরে তাঁর স্থলাভিষিক্ততার প্রশ্নে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে মনোনীত মাসুম ইমাম (আ.)-এর ইমামতের আকিদা পোষণ করে তাদের মধ্যে এ বিষয়ে মতৈক্য রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্র নেতৃত্বাধীন হুকুমাতে তাঁর যে এখতিয়ার মাসুম ইমামের নেতৃত্বে হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে মাসুম ইমামের একই এখতিয়ার।
অন্যদিকে শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে মুসলমানরা এ মর্মে অভিন্ন আকিদা পোষণ করে যে, শেষ যামানায় হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.) আত্মপ্রকাশ করবেন ও বিশ^ব্যাপী ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করবেন, যদিও তাঁর জন্মকাল সম্বন্ধে মতপার্থক্য আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যারা ইমামতের আকিদা পোষণ করে না তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইন্তেকালের পরে ও যারা মাসুম ইমামের (আ.) ইমামতের আকিদা পোষণ করে তাদের জন্য হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনের পরে, তাঁর আত্মপ্রকাশ-পূর্ববর্তী হুকুমাতি ক্ষেত্রে করণীয় কী? এ মেয়াদে মুসলমানরা কি দীনী হুকুমাতবিহীন থাকবে ও হযরত ইমাম মাহ্দীর আত্মপ্রকাশের জন্য অপেক্ষা করবে, নাকি সম্ভব ক্ষেত্রে তারা অন্তর্বতীকালীন ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করবে? করলে তার সংজ্ঞা কী হবে তথা তার এখতিয়ার ও সীমারেখা কী হবে?
প্রকৃতপক্ষে এ প্রশ্নের জবাব ইসলামের অকাট্য জ্ঞানসূত্রেই নিহিত রয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা অত্র নিবন্ধের সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়; এখানে সংক্ষেপে এতটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, কোরআন মজীদে আলেমদের প্রশংসা করা হয়েছে, বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্র বান্দাদের মধ্যে আলেমগণই তাঁকে যথার্থভাবে ভয় করেন, যার কাছে হেদায়াত আছে তিনিই অর্থাৎ আলেমই অনুসৃত হবার হকদার। প্রশ্ন হচ্ছে সে আলেমের সংজ্ঞা কী?
কোরআন মজীদে মুসলমানদের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীনের ব্যাপারে গভীর সমঝের অধিকারী (يَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ) কতক লোক গড়ে ওঠার ওপর এতই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, তাঁদেরকে, এমনকি দীনী হুকুমাতের প্রতিরক্ষা যুদ্ধে গমনের দায়িত্ব থেকেও রেহাই দেয়া হয়েছে (সূরা আত্-তাওবাহ্ : ১২২) – যার মানে হচ্ছে সমাজে এ ধরনের আলেমের উপস্থিতি ফরযে কেফায়ী। আর ‘দীনের ব্যাপারে গভীর সমঝের অধিকারী’ কথাটি কেবল চিন্তা, কথা ও আচরণে ভারসাম্যের অধিকারী এমন যুগসচেতন দূরদর্শী আলেমদের বেলায়ই প্রযোজ্য- যাঁদেরকে পারিভাষিকভাবে মুজতাহিদ বা ফাক্বীহ্ বলা হয়।
শিয়া-সুন্নি উভয় ধারায় বর্ণিত একটি হাদিস অনুযায়ী আলেমগণ নবী-রাসূলগণের উত্তরাধিকারী। এছাড়া শিয়া সূত্রে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে মাসুম ইমামের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হলে যে কোনো বিষয়ে আলেমদের দ্বারস্থ হবার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সবকিছু মিলিয়ে হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) এ উপসংহারে উপনীত হন যে, হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশের পূর্বে মুসলমানদের পক্ষে দীনী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার জন্য যথাযথ পরিবেশ তৈরি হলে তারপরও তারা তা প্রতিষ্ঠা না করে অনৈসলামি হুকুমাত অব্যাহত থাকতে দেবে এবং তাঁর আত্মপ্রকাশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে- এটা ঠিক নয়; বরং তারা চিন্তা, কথা ও আচরণে ভারসাম্যের অধিকারী যুগসচেতন দূরদর্শী মুজতাহিদগণের নেতৃত্বে দীনী হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং উক্ত মুজতাহিদগণ তাঁদের এখতিয়ারের হুকুমাতি কর্তৃত্ব প্রতিনিধিত্বমূলকভাবে একজন মুজতাহিদগণের কাছে ন্যস্ত করবেন। এ ধরনের হুকুমাত হবে হযরত ইমাম মাহ্দীর আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী। হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) এ হুকুমাতের সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞায়ন করেন : বেলায়াতে ফাক্বীহ্ (ولايت فقيه) অর্থাৎ মুজতাহিদের শাসনকর্তৃত্ব।
ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠার পথ
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এ ধরনের হুকুমাত কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? মুজতাহিদগণ কি কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করে জনগণের মধ্যে প্রচার চালিয়ে তাঁদের হাতে হুকুমাতের ক্ষমতা অর্পণের জন্য আহ্বান জানাবেন এবং ক্ষমতালাভের জন্য অন্যান্য দলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন?
ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র্রক্ষমতা কামনা করা জায়েয নেই (সূরা আল্-ক্বাছ¡াছ¡ : ৮৩ ও সূরা আল্-গ¦াশিয়াহ্ : ২১-২২)। নবী-রাসূলগণের মূল দায়িত্ব ছিল মানুষের সামনে আল্লাহ্ তা‘আলার সঠিক পরিচয় তুলে ধরা। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন : مَا عَلَى الرَّسُولِ إِلا الْبَلاغُ – ‘রাসূলের ওপর পৌঁছে দেয়া ছাড়া কোনো দায়িত্ব নেই।’ (সূরা আল্-মায়েদাহ্ : ৯৯)
দীনী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার বিষয়টি পরিস্থিতিনির্ভর; আল্লাহ্ তা‘আলার সঠিক পরিচয় ও দীনের সঠিক রূপ মানুষের কাছে তুলে ধরার ফলে যদি যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ তা গ্রহণ করে নিজেদেরকে যথাযথভাবে দীনী আমল ও নৈতিকতায় ভূষিত করে তোলে এবং ভিতর-বাইরের পরিস্থিতি দীনী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার জন্য অনুকূল হয় কেবল তখনই দীনী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ কারণেই-যথাযথ পরিস্থিতি না পাওয়ায়-সমস্ত নবী-রাসূলের পক্ষ থেকে এবং সমস্ত মাসুম ইমামের পক্ষ থেকে দীনী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি।
যেভাবে বিপ্লব বিজয়ী হলো
নবী-রাসূলগণ (আ.) ও মাসুম ইমামগণ (আ.) অনুসৃত এ কর্মপদ্ধতি অনুসরণে ইরানি মুজতাহিদগণ, বিশেষত হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) ও তাঁর অনুসারী মুজতাহিদগণ সরকারি সংশ্লিষ্টতাবিহীন বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ের দীনী শিক্ষাকেন্দ্রসমূহে দীনী জ্ঞানগবেষণার কাজে এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য ও রাজনৈতিক দল ব্যতীত মানুষের মাঝে দীনের সঠিক শিক্ষা বিস্তারে নিয়োজিত ছিলেন। আর যেহেতু যুগজিজ্ঞাসার দীনী জবাব প্রদানের লক্ষ্যে মুজতাহিদের জন্য সমসাময়িক বিশে^র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকসহ সকল দিক সম্পর্কে অবগত থাকা অপরিহার্য সেহেতু তাঁরা সার্বিকভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সদা ওয়াকিফহাল থেকে সকল বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতেন ও দিকনির্দেশ প্রদান করতেন। তাঁরা জাতীয় ক্রান্তিকালসমূহে একদিকে যেমন জনগণকে পথনির্দেশ দিতেন অন্যদিকে সরকারকে সংশোধনের জন্য নসিহত করতেন।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইরানে যে সাংবিধানিক বিপ্লব হয়- যার ফলে নিরঙ্কুশ রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও মজলিসে মিল্লি (ন্যাশনাল পার্লামেন্টে)-এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়- তাতেও মুজতাহিদগণ নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। তখন মুজতাহিদগণ শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেন নি, তবে মজলিসের সিদ্ধান্তের শার‘ঈ বৈধাবৈধতা নির্ণয়ের জন্য মজলিসে মুজতাহিদগণের জন্য সংরক্ষিত কোটা ছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ তাঁবেদার রেযা খান ক্ষমতা দখল করে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে এবং কার্যত দেশকে ব্রিটেনের অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত করে ও সেই সাথে ইরানি জনগণের ওপর জোর করে ইসলামবিরোধী পশ্চিমা সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্ষমতাসীন তার পুত্র মোহাম্মাদ রেযা পাহ্লাভীও একই নীতি অনুসরণ অব্যাহত রাখে। মজলিসে মিল্লি তেল শিল্প জাতীয়করণের মাধ্যমে ইরানের ওপর থেকে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ খর্ব করার উদ্যোগ নিলে ১৯৫৩ সালে শাহ্ বিদেশে পালিয়ে যায় এবং সিআইএ-র মদদে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানের পর পুনরায় দেশে ফিরে আসে। তখন থেকে ইরান আমেরিকার অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত হয়।
শাহ্ ১৯৬৩-র শুরুতে আমেরিকার নির্দেশে ইরানি কৃষকদের কৃষি জমির ওপর বাধ্যতামূলক যৌথ খামার পদ্ধতি চাপিয়ে দিয়ে কার্যত শহরবাসী জমিদারদেরকে সকল কৃষি জমির মালিকে পরিণতকরণ ও সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো ব্যক্তিমালিকদের কাছে বিক্রিকরণসহ ‘শে^তবিপ্লব’ নাম দিয়ে ছয়-দফাভিত্তিক একটি কর্মসূচি চাপিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিলে হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) তার বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং তাকে ইসলামের দুুশমন হিসেবে অভিহিত করেন। এ বিষয়ে অন্য মুজতাহিদগণও হযরত ইমামের অনুসরণ করেন। এ অবস্থায় ৩রা জুন ইমাম খোমেইনীকে গ্রেফতার করা হলে ৫ই জুন দেশব্যাপী এক স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থান হয়Ñ যা নির্মমভাবে রক্তপাতের মধ্য দিয়ে দমন করা হয়। পরে ১৯৬৪-র এপ্রিলে ইমামকে মুক্তি দেয়া হয়।
ইতিমধ্যে শাহ্ ইরানে অবস্থানরত আমেরিকান সৈন্যদের কোনো অপরাধের বিচার ইরানি আদালতে করা হবে না মর্মে একটি আইন পাশ করে যা ‘ক্যাপিচুলেশন আইন’ নামে কুখ্যাত। হযরত ইমাম (র.) ২৬শে অক্টোবর ১৯৬৪ তারিখে প্রদত্ত এক ভাষণে এর বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা জানালে তাঁকে ৪ঠা নভেম্বর গ্রেফতার করে তুরস্কে নির্বাসিত করা হয়। তাঁর ওপর নযরদারির সুবিধার্থে প্রায় এক বছর পর তাঁকে সেখান থেকে ইরাকের নাজাফে এনে রাখা হয় এবং সেখানে তিনি আরো তেরো বছর থাকেন। তবে বিভিন্নভাবে ইরানে অবস্থানরত স্বীয় ভক্ত-অনুসারীদের সাথে তাঁর যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। নাজাফে থাকাকালেই তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বেলায়াতে ফাক্বীহ্’ রচনা করেন।
ইরানি জনগণের মধ্যে শাহ্বিরোধী ও ইসলামি চেতনা ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকে। যদিও ইরানে তখন পাশ্চাত্যপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট, কমিউনিস্ট তুদেহ্ পার্টি, শাহ্ সমর্থক রাস্তাখীয্ পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সক্রিয় ছিল, কিন্তু মুজতাহিদগণের কোনো দল ছিল না; বরং তাঁদের নেতৃত্বের আসন ছিল জনগণের অন্তঃকরণে এবং তার স্বরূপ ছিল কোনোরূপ আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকার ব্যতীতই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁদের অনুসরণ ও আনুগত্য এবং তাঁদের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা। এ কারণেই ১৯৭৭-এর নভেম্বরে নাজাফে শাহের গোয়েন্দা সংস্থা সাভাক কর্তৃক হযরত ইমামের পুত্র মোস্তাফা খোমেইনী নিহত হওয়ার পর সারা ইরানে লাগাতার গণবিক্ষোভ ও ধর্মঘট তথা বিপ্লব শুরু হলে মুজতাহিদগণের কোনো সংগঠন না থাকায় সিআইএ ও সাভাকের পক্ষে বিপ্লবী জনতার মধ্যে অনুপ্রবেশ তো দূরের কথা, শীর্ষস্থানীয় মুজতাহিদগণকে কারাগারে নিক্ষেপ করেও এ বিপ্লবকে দমন করা সম্ভব হয় নি। কারণ, জনগণের মধ্যে বিভিন্ন স্তরে কারা এ বিপ্লবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদেরকে হাজারো চেষ্টা করেও খুঁজে বের করা সম্ভব হয় নি। দেখা যায় যে, রাজনৈতিক ব্যাক্গ্রাউন্ডবিহীন সাধারণ লোকেরা গণমিছিলসমূহের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে; তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হলে পরদিন অন্য অখ্যাত লোকেরা নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকায় সিআইএ, সাভাক্, পুলিশ বাহিনী ও সেনাবাহিনীর লোকেরা উপর্যুপরি হত্যা নিষ্ফল প্রত্যক্ষ করে হতাশ হয়ে ময়দান ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় শাহ্ দেশের জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রধানমন্ত্রী শাপুর বাখতিয়ারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে ১৯৭৯-র ১৬ই জানুয়ারি দেশ থেকে পালিয়ে যায়।
অন্যদিকে শাহের অনুরোধে ইরাক সরকার হযরত ইমাম খোমেইনীকে ইরাক থেকে বহিষ্কার করলে তিনি কুয়েতে যাবার চেষ্টা করেন, কুয়েত সরকার তাঁকে সে দেশে প্রবেশ করতে না দিলে তিনি ১১ই অক্টোবর ১৯৭৮ তারিখে প্যারিসে চলে যান এবং সেখান থেকে ১৯৭৯-র ১লা ফেব্রুয়ারি ইরানে ফিরে আসেন।
ইমাম খোমেইনী (র.) ইরানের মাটিতে নেমেই শাহের মনোনীত সরকারকে বরখাস্তের ঘোষণা দিয়ে নতুন সরকার গঠন করেন। এরপর, দীনী চেতনায় উদ্দীপিত গোটা বিমান বাহিনী এবং কতক ব্যতিক্রম বাদে গোটা সামরিক বাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও প্রশাসন নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে- যার ফলে অনুল্লেখযোগ্য নামমাত্র সংঘর্ষের পর শাহের অনুগত সামরিক বাহিনীর লোকেরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় এবং ১১ই ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয় ঘটে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মুজতাহিদগণ কর্তৃক যুগজিজ্ঞাসার জবাব দানসহ অরাজনৈতিক পন্থায় দীনী শিক্ষা প্রচারের ফলে তার ঢেউ কেবল ইরানের সর্বস্তরের সাধারণ জনগণের মধ্যেই পৌঁছে নি, প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহেরও রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল এবং এ ব্যাপারে শাহের প্রচার কাউকে বিভ্রান্ত করতে পারে নি। অন্যথায় ইসলামি বিপ্লবের বিজয় হয়তো আদৌ সম্ভব হতো না।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থা
৩০ ও ৩১শে মার্চ (১৯৭৯) অনুষ্ঠিত গণভোটে শতকরা ৯৮ ভাগেরও বেশি ভোটার আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের পক্ষে মত দিলে হযরত ইমাম (র.) ১লা এপ্রিল ১৯৭৯ তারিখে ইরানের নাম ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ঘোষণা করেন।
এরপর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্য বিশেষজ্ঞদের তৈরি সংবিধান গণভোটে অনুমোদিত হয়Ñ যা কেবল ইসলামি সংবিধান হিসেবেই নয়, সাধারণভাবে সমগ্র বিশ^বাসীর জন্য শ্রেষ্ঠতম ভারসাম্যমূলক ও সুবিচারমূলক সংবিধানের দৃষ্টান্তও বটে।
এ সংবিধানে রাহ্বার পদ নির্ধারণের লক্ষ্যে জনগণের ভোটে প্রতি আট বছর পর পর নির্বাচিতব্য মুজ্তাহিদ্ আলেমগণের ৮৪ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ পরিষদ প্রার্থিতাবিহীনভাবে নিজেদের ভিতর বা বাইরে থেকে যাঁকে উপযুক্ত মনে করবেন এমন কাউকে রাহ্বার মনোনীত করবেন, তাঁর কাজের প্রতি দৃষ্টি রাখবেন এবং প্রয়োজনে তাঁকে অপসারণ করবেন। যেহেতু মুজ্তাহিদ্ আলেমগণ তাত্ত্বিকভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও মাসুম ইমামগণের (আ.) প্রতিনিধি এবং এ কারণে দীনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পাশাপাশি তাঁদের (আ.) হুকুমাতি এখতিয়ারেরও অধিকারী, সেহেতু এ পরিষদের সদস্যগণ হুকুমাতি এখতিয়ারের অধিকারী এবং তাঁরা স্বীয় হুকুমাতি এখতিয়ার আমানত হিসেবে রাহ্বারের কাছে অর্পণ করেন।
রাহ্বার হুকুমাতের মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে যথাযথ বিশেষজ্ঞ বা জনপ্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শ করে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং জনগণের যেসব কাজ আদর্শিক বা রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয় সেসব কাজ সরাসরি জনপ্রতিনিধিগণ আঞ্জাম দেন। তবে রাহ্বার স্বয়ং কোনো প্রকল্পে বা বাজেটে স্বাক্ষর প্রদান করেন না।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, যদিও তাত্ত্বিক বিচারে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর ও মাসুম ইমামের (আ.) প্রতিনিধি বা স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ইসলামি হুকুমাতের সমস্ত ক্ষমতাই রাহ্বারের, কিন্তু যেহেতু তিনি মাসুম নন বিধায় ভুলের ঊর্ধ্বে নন সেহেতু এবং সেই সাথে ইসলামের দুশমনরা যাতে তাঁর ব্যাপারে ভিত্তিহীন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে ও তাঁকে বিতর্কিত করতে না পারে সে লক্ষ্যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান-প্রণেতাগণ যথার্থভাবেই তাঁকে সরাসরি আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগের ঊর্ধ্বে দিকনির্দেশক হিসেবে রাখাকেই সঙ্গত গণ্য করেছেন। একইভাবে নেতা নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ পরিষদকেও একই ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগের ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে শতকরা একশ ভাগ ক্ষমতার বিভাজন করা হয়েছে এবং প্রশাসন, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনী ও জাতীয় সম্প্রচার বিভাগ (রাষ্ট্রীয় রেডিও-টিভি) পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, ফলে প্রশাসন বা সরকারের পক্ষে স্বৈরাচারী হবার কোনোই সুযোগ নেই।
রাহ্বার ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত করেন এবং তিনি হন প্রশাসনের প্রধান; মন্ত্রিগণ প্রেসিডেন্ট কর্তৃক মনোনীত এবং পার্লামেন্টের অনুমোদনসাপেক্ষ দায়িত্ব লাভ করেন, কিন্তু পার্লামেন্টের সদস্য নন। রাহ্বার সর্বোচ্চ বিচার পরিষদের সাথে পরামর্শ করে বিচার বিভাগের প্রধান ও সর্বোচ্চ বিচারালয়ের বিচারকদের মনোনীত করেন। অনুরূপভাবে তিনি সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদের সাথে পরামর্শক্রমে তিন সশস্ত্র বাহিনীর ও ইসলামি বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর তিন বিভাগের প্রধান ও গুরুত্বপুর্ণ উচ্চ পদগুলোতে এবং পুলিশ বাহিনীর প্রধান পদে নিয়োগ দেন। প্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধি সমবায়ে গঠিত জাতীয় সম্প্রচার পরিষদের প্রধান পদেও তিনি নিয়োগ দেন। এছাড়া আইন বিভাগের (মজ্লিসে শূরায়ে ইসলামি/পার্লামেন্ট)-এর অনুমোদিত বিলগুলোতে ইসলামি শারী‘আহ্ ও সংবিধান লঙ্ঘিত না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিলগুলো পরীক্ষা করে দেখার জন্য গঠিত বারো সদস্যের অভিভাবক পরিষদের ছয়জন আইন-বিশেষজ্ঞ সদস্য বিচার বিভাগ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় ও পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত হলে তাঁরা দায়িত্ব লাভ করেন এবং ছয় জন মুজ্তাহিদ্ সদস্য রাহ্বার কর্তৃক মনোনীত হন। কোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট ও অভিভাবক পরিষদের মধ্যে অচলাবস্থা দেখা দিলে তার নিরসনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় কল্যাণ নির্ধারণ পরিষদ গঠিত হয় এবং রাহ্বার সে পরিষদের প্রধানকে ও এক বা একাধিক সদস্যকে মনোনীত করেন। রাহ্বার সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদের সাথে পরামর্শক্রমে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন ও সন্ধির সিদ্ধান্ত নেবেন। পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন সাধনসহ যে কোনো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশাসন ও পার্লামেন্ট রাহ্বারের অনুমোদন ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। এছাড়াও রাহ্বার যে কোনো পরামর্শ দিলে তা মেনে চলতে হবে।
এসবের বাইরে অর্থ, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও উন্নয়নসহ জনজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের অনুমোদনক্রমে প্রশাসন কাজ করে যায় এবং কতক কাজ নির্বাচিত স্থানীয় সরকারগুলো আঞ্জাম দেয়।
এভাবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে রাহ্বার ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে কর্মবণ্টনে কোরআন মজীদের নিম্নোক্ত দু’টি আয়াতের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে :
شَاوِرْهُمْ فِي الأمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ
‘কাজকর্মের ব্যাপারে তাদের সাথে পরামর্শ করুন, অতঃপর যখন আপনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন তখন আল্লাহ্র ওপরে ভরসা করুন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯)
এবং মুসলিম জনগণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য :
أَمْرُهُمْ شُورَى بَيْنَهُمْ
‘তাদের কাজ তাদের (নিজেদের) মধ্যে পরামর্শকরণ।’ (সূরা আশ্-শূরা : ৩৮)
প্রথমোক্ত আয়াতটিতে নবী করীম (সা.)-কে তাঁর হুকুমাতি দায়িত্বের ক্ষেত্রে অন্যদের সাথে পরামর্শ করতে বলা হয়েছে, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে তাঁকেই; পরামর্শদাতাদের সংখ্যাগুরুর, এমনকি তাঁদের সকলের মত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া তাঁর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয় নি। অন্যদিকে যেসব সামষ্টিক কাজ রাসূলের হুকুমাতি দায়িত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় সেগুলোতে অধিকতর বান্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়ার ও তা থেকে উপকৃত হবার জন্য স্বভাবতঃই মুসলমানরা পরস্পর পরামর্শ করে থাকে; এসব ক্ষেত্রে রাসূলের হস্তক্ষেপ অপরিহার্য নয়, যদিও এসব ব্যাপারেও তাঁর পরামর্শ লোকদেরকে উপকৃত করতে পারে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দল ব্যবস্থা
সমিতি, সংস্থা ও রাজনৈতিক দল গঠনের স্বাধীনতাকে ব্যক্তি স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয়; যদিও রাজনৈতিক দল গঠন করা কারো জন্য অপরিহার্য নয়, তবে তা গঠনের অধিকার বা স্বাধীনতা থাকতে হবে। রাজতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক দেশ ব্যতীত সকল দেশেই এ স্বাধীনতা আছে। তাই চিন্তা ও মত পোষণ ও প্রকাশের স্বাধীনতার এবং সংঘবদ্ধতার স্বাধীনতার হেফাযতকারী দীনের অনুবর্তী ইসলামি হুকুমাত্ হিসেবে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানেও এ স্বাধীনতা আছে। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেভাবে রাজনৈতিক দলের সাংবিধানিক মর্যাদা আছে- যার দ্বারা জনপ্রতিনিধিদের স্বাধীনতাকে এবং পরোক্ষভাবে কার্যত জনগণের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়, ইরানে সেভাবে সংবিধানে দলের জন্য কোনো মর্যাদা সংরক্ষিত নেই। সেখানে যে কেউ দল ও জোট গঠন করতে পারে এবং নির্বাচনগুলোতে যে কোনো দল যে কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করতে পারে, কিন্তু সংবিধান ও আইনের দৃষ্টিতে প্রার্থিগণ ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকেন। ফলে একই প্রার্থীকে একাধিক দল সমর্থন করতে পারে, অন্যদিকে নির্বাচিত পেসিডেন্ট বা পার্লামেন্ট সদস্য স্বীয় কাজকর্মের ব্যাপারে সংবিধান, আইন ও জনগণের কাছে দায়ী থাকেন, কোনো দলের কাছে দায়ী থাকেন না। তাই একজন পার্লামেন্ট সদস্য সরকারের কোনো বিলের বিরোধিতা করার ও কোনো বিলের সমর্থন করার ব্যাপারে এবং যে কোনো বিষয়ে নিজ দলের অবস্থানের বিপরীত অবস্থান গ্রহণের ব্যাপারেও পুরোপুরি স্বাধীন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধর্ম ও মায্হাবের অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তা-ও ইসলামি বিপ্লবের স্থায়িত্বের পিছনে একটি বিরাট কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে ইহুদি, খ্রিস্টান ও জরাথুস্ত্রীদের জন্য মজ্লিসে শূরায়ে ইসলামিতে (পার্লামেন্টে) জনসংখ্যা অনুপাতে আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রতিটি সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকেরা ভোট দিয়ে তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকে। অন্যদিকে ফৌজদারি অপরাধের বিচার ও সামাজিক নৈতিকতা সম্পর্কে সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে ইসলাম রাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং গোটা জাতির সামষ্টিক কাজকর্মে তারই প্রতিফলন ঘটবে, তবে প্রত্যেক ধর্মের একান্ত নিজস্ব ব্যাপারে, যেমন : চিন্তা-বিশ্বাস ও ইবাদত্-উপাসনায় তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে, কিন্তু কোনো শহরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু কোনো গোষ্ঠী সংখ্যাগুরু হলে সেখানে দুই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যকার কোনো বিষয় সংক্রান্ত বিরোধ নিরসনে সেখানকার সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিধান প্রাধান্য লাভ করবে।
অনুরূপভাবে প্রত্যেক মায্হাবের অনুসারীরা একান্ত নিজস্ব বিষয়াদিতে নিজ নিজ মায্হাবের অনুসরণ করবে, কিন্তু কোনো শহরে দুই মায্হাবের অনুসারীদের মধ্যকার বিরোধ নিরসনে সেখানকার সংখ্যাগুরু মায্হাবের বিধান অনুসৃত হবে।
বৈশ্বিক ইসলামি হুকুমাতের দিকনির্দেশ
বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে যারাই ইসলামি হুকুমাত্ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা পোষণ করে তাদের সকলেরই একটি অভিন্ন ধারণা এই যে, শেষ পর্যন্ত বিশ্বে একটিমাত্র ইসলামি হুকুমাত্ প্রতিষ্ঠিত হতে হবে এবং অনেকেই মনে করে যে, একই সময় বিশ্বের বুকে একাধিক ইসলামি হুকুমাতের অস্তিত্ব গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু সেই সাথে একটি প্রশ্ন জাগে যে, নবী বা মাসুম ইমামের (আ.) নেতৃত্ব ব্যতীত এ ধরনের একক ইসলামি হুকুমাতে বিভিন্ন অঞ্চল ও জাতির মধ্যে ইনসাফ বজায় রাখা সম্ভব হবে কিনা।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) এ সংশয়ের নিরসন ঘটিয়ে গিয়েছেন। তিনি তাঁর অন্তিম বাণীতে (অসিয়তনামায়) মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি এই বলে আহ্বান জানিয়েছেন : ‘স্বাধীন প্রজাতন্ত্রসমূহের সমন্বয়ে একটি ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে যান।’
ইমাম খোমেইনীর এ অতি সংক্ষিপ্ত উক্তিতে এ তাৎপর্যই নিহিত রয়েছে যে, একক ইসলামি হুকুমাতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মূল কাজ হবে হুকুমাতের আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ ও দিকনির্দেশনা এবং প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াদি ‘স্বাধীন প্রজাতন্ত্র’সমূহের হাতে থাকবে, ফলে প্রতিটি জাতি ও জনগোষ্ঠী স্বীয় ন্যায্য পার্থিব স্বার্থের হেফাযত্ করতে সক্ষম হবে এবং কোনো জাতি কোনো জাতির বিরুদ্ধে অন্যায়ের আশ্রয় নিতে ও অপরকে শোষণ করতে পারবে না।
বস্তুত বৈশ্বিক ইসলামি হুকুমাতের জন্য এর চেয়ে অধিকতর ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যোপযোগী বাস্তবানুগ পরিকল্পনার কথা আদৌ চিন্তা করা সম্ভব নয়।