শুক্রবার, ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইরানি রূপকথা ‘সী-মোরগ’ (প্রথম পর্ব)

পোস্ট হয়েছে: জুলাই ১৪, ২০১৬ 

news-image

এক গরীব লোক তার বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে বাস করতো। কাজকর্ম ছিল না তার। ভবঘুরে জীবনযাপন করতো। কিন্তু এভাবে তো আর জীবন চলে না। অবশেষে তার স্ত্রী ক্লান্ত বিরক্ত হয়ে গিয়ে একদিন তাকে বললো: “অনেক তো হলো! বেকার ঘুরে আর কতদিন কাটাবে। ভবঘুরে হয়ে কাটালে তো জীবন চলবে না। এভাবে কোনো ফায়দা নেই। বরং যাও! কাজকর্ম খুঁজে বেড়াও”! লোকটা ভাবলো কথা তো মন্দ না। বৌ তো ঠিকই বলেছে। বেচারা অগত্যা বেরিয়ে পড়লো কাজের খোঁজে। এখানে সেখানে কতখানে যে গেল, কোনো লাভ হল না। কাজের সন্ধান পেল না। কী করা যায়! এই বেকারমূর্তি কিংবা নিলাজ চেহারা কী করে বৌকে দেখানো যায়! ছি ছি করবে বৌ! বৌয়ের মুখের তিরস্কার কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না। শুনতে চায় না তার মুখনিসৃত পবিত্র সুখহানিকর বাণী।

বিষন্ন মনে লোকটা গেল সমুদ্রের দিকে। তীরে দাঁড়িয়ে ভাবলো এই অপয়া জীবনের কোনো মূল্য নেই। মূল্যহীন জীবন না রেখে বরং ওই সমুদ্রের পানিতে আত্মাহুতি দেয়াই শ্রেয়। বৌয়ের যন্ত্রণা আর তিরস্কার শুনতে হবে না। কাজের খোঁজে বেকার ঘুরে ঘুরে হতাশার সাগরে ডুবতে হবে না। এই সাগরে একবার ডুবে মরলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। এই ভেবেই সে সোজা নেমে গেল সমুদ্রের তরঙ্গময় পানিতে। কিন্তু ডুবে মরা কি এতই সহজ! না। ডুবতে গিয়েও ডুবতে পারলো না। কেবলি ভেসে উঠছিল তার শরীর। এমন সময় সমুদ্রের উপর থেকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল একটি সী-মোর্‌গ। সী-মোর্‌গ দেখছিল একটা লোক ডুবে মরার চেষ্টা করছে। সে দ্রুত নীচে নেমে এলো এবং তার নখের পাঞ্জায় লোকটাকে আটকে তুলে নিয়ে গেল পানি থেকে।

সী-মোর্‌গ আশ্চর্য এক পাখি। ইরানি রূপকথার জগতে বহুকাল ধরে বিচরণকারী এই পাখিটি অদ্ভুতরকমভাবে কথা বলতে জানে এবং মানুষের অবস্থাও বুঝতে পারে। আমরা তাই রূপকথার অন্যতম উপাদান এই পাখিটির নাম পাল্টাবো না, সী-মোর্‌গই বলবো। তো পাখিটি লোকটাকে ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখলো তার আপাদমস্তক হতভাগ্যে পরিপূর্ণ। সী-মোর্‌গ দ্রুত উড়ে গিয়ে সমুদ্র থেকে একটা বড় মাছ ধরে নিয়ে এলো এবং মাছটা লোকটার হাতে দিলো। লোকটা খুশি হয়ে মাছটা নিয়ে ফিরে যেতে মনস্থির করল নিজ শহরের দিকে। সেখান থেকে বাসার দিকে যেতে পথে দেখা হলো বদমাশ ধরনের এক লোকের সাথে। দুষ্ট লোকটার নজর পড়লো সুন্দর ওই মাছের ওপর। সে দশ সির আটার বিনিময়ে মাছটা নিয়ে নিতে চাইলো। প্রাচীন পরিমাপে দশ সির এখনকার এক কেজি’র চেয়ে কিছু কম,পৌনে এক কেজির মতো হয়। কিন্তু হতভাগ্য লোকটা তাতেই খুশি হয়ে মাছটার বিনিময়ে ওই দশ সির আটা নিয়ে নিলো।

আটা নিয়ে বাসায় ফেরার পর তার বৌ বললো: “এই কাজটা আরও আগে করলে কী হতো! প্রতিদিন এই পরিমাণ আটা নিয়ে এলেই তো চলে। বাচ্চাদেরও খিদে মিটে যায় আর কান্নাকাটি করে না”। বৌয়ের কথা শুনে লোকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভালোভাবেই ঘুমিয়ে কাটালো রাতটা। পরদিন আবার সে গেল বাজারের দিকে কাজের সন্ধানে। কিন্তু আজও কোনো কাজ তার ভাগ্যে জুটলো না। অবশেষে আবারও সে অভিশপ্ত এই জীবন ধ্বংস করার জন্য মানে আত্মহত্যা করার উদ্দেশে সমুদ্রের দিকে গেল এবং গতকালের মতোই পানিতে যুবে মরতে চেষ্টা করলো। কিন্তু আজও সৌভাগ্যক্রমে ওই সী-মোর্‌গ এসে তাকে উদ্ধার করলো। গতকালের মতো আজও একটা মাছ ধরে এনে দিলো তাকে।

কিন্তু আজও একই ঘটনা ঘটলো। দুষ্ট লোকটা পথের মোড়ে বসে ছিল এবং সামান্য আটার বিনিময়ে মাছটা নিয়ে গেল। বাসায় ফেরার পর আজও তার স্ত্রী যখন দেখলো স্বামি তার খালি হাতে ফেরে নি তখন তাকে বললো: একেই বলে পুরুষ! প্রতিদিন সন্ধ্যায় এতটুকু আটা এনে দিলেই তো বাচ্চাদের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়,আর কোনো চিন্তা থাকে না। লোকটা মানে মহিলার স্বামী কোনো উত্তর দিলো না। বললো না কোত্থেকে কীভাবে এই আটার ব্যবস্থা হচ্ছে। রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালে আবারও এক বুক আশা নিয়ে শহরের দিকে গেল। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বাজারের অলিগলি দোকানপাট সর্বত্র ঘুরেও একটা ছোটোখাটো কাজও জোটাতে পারলো না। অগত্যা চলে গেল সেই আগের দিনের মতো সমুদ্রের দিকে। গভীর পানিতে নেমে ডুবে মরতে চাইলো।

ঘটনাক্রমে আজও সেই সী-মোর্‌গ এসে দেখলো সেই লোকটাই ডুবে মরতে চাচ্ছে। সী-মোর্‌গ ভাবলো এই লোক মনে হয় তার জীবনের ভার সহ্য করতে পারছে না। সুতরাং তার মরে যাওয়াই ভালো। যে বারবার মরে যেতে চায় তাকে উদ্ধার করার কী দরকার। এটা বোধ হয় লোকটার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই মরতে আসে। যাক মরুক গে,আমার কী! কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবলো: যদি সত্যি সত্যিই লোকটা মরে যায়! তাহলে কী হবে। এই ভেবে লোকটার দিকে তাকাতেই দেখলো লোকটা সত্যিই আত্মহত্যাই করতে চাচ্ছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! এভাবে তার চোখের সামনে যদি কেউ মরে যায় আর সে যদি তাকে না বাঁচায় তাহলে তো তার মৃত্যুর জন্য সে-ই দায়ী থেকে যাবে! কারো মৃত্যুর দায়ভার সী-মোর্‌গ নিতে চায় না,তাই লোকটাকে আজও পানি থেকে তুলে নিয়ে বাঁচালো এবং আগের দিনগুলোর মতোই একটি মাছ তুলে এনে তার হাতে দিলো।

কিন্তু সী-মোর্‌গের মনে হলো এই হতভাগ্য বোধ হয় জানে না এই মাছের কী মাহাত্ম্য। সেজন্য বললো: নিজেকে কেন পানিতে ডুবিয়ে মারতে চাও? তোমাকে যে প্রথম মাছটি আমি দিয়েছিলাম ওই একটা মাছই তো তোমার সাত প্রজন্মের জন্য যথেষ্ট ছিল! তারপরও কেন মরতে আসো ?

সূত্র: পার্সটুডে