শুক্রবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইরান পরিচিতি : উরুমিয়েহ

পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ৬, ২০১৬ 

-কামাল মাহমুদ

অবস্থান ও জনসংখ্যা : ইরানের পশ্চিম আজারবাইযান প্রদেশের প্রসিদ্ধ শহর উরুমিয়েহ। ২০১২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী উরুমিয়েহ’র লোকসংখ্যা ৬,৮০,২২৮ জন এবং পরিবার সংখ্যা ১,৯৭,৭৪৯টি। এর মধ্যে ৪,৮৬,,৪৪৫ জন পুরুষ, এবং ৪,৭৭,২৯৩ জন নারী। জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ইরানের ১০ম স্থানের অধিকারী। আজারবাইজানি উচ্চারণে এটি ‘উরমু’, ‘উরামিয়ে’, ফারসি উচ্চারণে ‘উরুমিয়েহ’ এবং কুর্দি উচ্চারণে ‘উর্মি’ বলে অভিহিত হয়ে থাকে। এটি পশ্চিম আজারবাইজানের রাজধানী শহর। এটি সমুদ্র উপকূল থেকে ১,৩৩০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এখানকার অধিকাংশ অধিবাসী আজারবাইজানি আঞ্চলিক ফারসি উচ্চারণে কথা বলে। এ শহর মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্রিক। এখানকার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। এখানে বিখ্যাত সব আপেল ও আঙুরের চাষ হয়ে থাকে। এছাড়া আখরোট, হোলু, নাশপতি, কমলা, মালটা প্রভৃতি ফলের ব্যাপক আবাদ হয়ে থাকে। সবুজ বন-বনানীতে ভরা একটি নয়নাভিরাম শহরের নাম উরুমিয়েহ। তেহরান থেকে এ শহরের দূরত্ব প্রায় ৭৮০ কিলোমিটার এবং তাবরীয় থেকে ১৩৫ কিলোমিটার।
পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তর সল্টলেক এখানে অবস্থিত- যা উরামিয়েহ লেক নামে সুপরিচিত। শহরের পশ্চিম দিকে এ লেকের অবস্থান। পশ্চিমে তুরস্ক সীমানা ঘেঁষা এ লেক। এ লেকের দৈর্ঘ্য ১৪০ কিলোমিটার, প্রস্থ ৫৫ কিলোমিটার, গভীরতা ১৬ মিটার বা ৫২ ফুট। এটি ইরানের পশ্চিম ও পূর্ব আজারবাইজানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এবং কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। এটি মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় এবং পৃথিবীর ৬ষ্ঠ বৃহত্তম লবনাক্ত জলাধার। এ লেকে প্রায় ১০২টি দ্বীপ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দ্বীপের নাম ‘শাহী আইল্যান্ড’। হালাকু খান ও তার পুত্র আবাকা-কে এখানে সমাধিস্থ করা হয়েছে। এ দ্বীপগুলোর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব রয়েছে ইরানের পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর। বর্তমানে এটি উরুমিয়েহ লেক হিসেবে পরিচিত হলেও এর পূর্ব নাম ছিল ‘লেকে রেযায়িয়ে’। মধ্যযুগে এর নাম ছিল ‘লেকে কাবুদা’। এর ল্যাটিন নাম ছিল ‘লাকুস মাটিয়ানাস’। ২০০০ সালে এ লেকের ওপর একটি ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং ২০০৮ সালে এটি সম্পন্ন হয়। প্রায় ১.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু। ২০০৪ সালে এ সেতুতে রেল প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ইরান সরকার এ লেকে একটি টানেল নির্মাণের পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে। এ লেক থেকে ১৩টি শাখা নদী প্রবাহিত হয়েছে। যথা: আজি চাই, আলামলু রিভার, বারান্দুজ রিভার, গাদার রিভার, ঘায়ী রিভার, লেলান রিভার, মাহাবাদ রিভার, নাজলু রিভার, রোযে রিভার, শাহার রিভার, সীমীনে রিভার, যারীনে রিভার, যাররীনে রুদ, জোলা রিভার প্রভৃতি। এ লেক নিয়ে একাধিক ফিল্মও সম্প্রচারিত হয়েছে। যেমন ‘হোয়াইট মেডুস’ (২০০৯)। এ লেক নিয়ে রয়েছে অনেক জনপ্রিয় সংগীত। যেমন ‘উরমু গোলু লে লে’।
ইতিহাস : ভøাদিমির মিনরস্কি এর বর্ণনা মতে খ্রিস্টপূর্ব থেকেই এখানে জনবসতি ছিল। তাদের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল ভান সা¤্রাজ্যকে ঘিরে। উরুমিয়ের পশ্চিম দিকের ‘গিলজান’ নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে নবম শতাব্দীতে স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে। যা পরবর্তীকালে উরারতু বা মান সা¤্রাজ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীতে আরুস সা¤্রাজের অন্তর্ভুক্ত হয়। অটোমানদের দ্বারা উরুমিয়েহ বিভিন্ন সময়ে আক্রান্ত হয়। পরবর্তীকালে সাফাবীরা এ অঞ্চলের শাসনভার গ্রহণ করে। সর্বপ্রথম সার্বভৌম সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন কাজাররা। আগা মোহাম্মাদ খান ১৭৯৫ সালে এখানকার শাসনভার গ্রহণ করেন।
নবম শতাব্দী থেকে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর। ১০৮৪ সালে এটি সালজুকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। পরবর্তী সময়ে অটোমানরা উরুমিয়ের শাসনভার গ্রহণ করে। এ শহরের বৈচিত্র্য হলো এখানে নানা ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, গোত্রের লোকেরা বসবাস করে। এখানে মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, বাহায়ী এবং সুফি সম্প্রদায়ের লোকেরা মিলেমিশে একত্রে বসবাস করে। অধিকাংশ অধিবাসীর ভাষা ফারসি, তবে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় কথা বলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানকার জনসংখ্যা ছিল ৩০,০০০ (ত্রিশ হাজার)। এ সময় হাজার হাজার আসেরিয়ান ও আর্মেনিয়ান আনাতোলিয়া থেকে উরুমিয়েহতে আসে। এ শহর রাশিয়া ও কুর্দীদের দ্বারা বেশ কয়েকবার আক্রান্ত হয়।
নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে এখানে অনেক জাতি-গোষ্ঠীর বসবাস ছিল। ইসলাম-পূর্ব সময়ে উরুমিয়ের অধিকাংশ লোক ছিল খ্রিস্টান। বর্তমানে জনসংখ্যার অধিকাংশই মুসলিম।

বিনোদন : পর্যটকদের কাছে উরুমিয়েহ অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত। বিনোদনের জন্য কী নেই উরুমিয়েহয়। এখানে রয়েছে পার্ক, নদী, পর্যটন পল্লি প্রভৃতি। উরুমিয়ের সবচেয়ে প্রাচীন পার্ক হলো ‘পার্কে সাত’, যার গোড়াপত্তন হয় পাহলভী আমলে। অন্যান্য পার্কের মধ্যে ‘ইলার বাগী পার্ক’, শাহর সায়ী, সিটি রিভার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া পার্কে জাঙ্গালি, পার্কে শাহর, পার্কে সাহেলি, পার্কে সাগহাইয়ে, আল-গাদীর পার্ক, তোখমে মোরগ পার্ক, গায়ীম পার্ক প্রভৃতি। পর্যটন পল্লির মধ্যে রয়েছে চিচেস্ট, বারী, সিয়ের, বান্দ, খোশাকো প্রভৃতি। জনপ্রিয়

খাবার : স্থানীয়দের জনপ্রিয় খাবরের মধ্যে রয়েছে পোলাও, অবগুশত, চেলো কাবাব, বিভিন্ন ধরনের স্যুপ, কোপ্তা, দোলমা, ভাত, লাপ্পে ও বিভিন্ন প্রকৃতির সবজি।
দর্শনীয় স্থান : দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে কাশেম লু ভ্যালী, কাজেম দাশী, কাশতীবান ভিলেজ, ইমামযাদে ভিলেজ, সিলভানা, রাশেখান থেকে দাশআকল, নাজলু, দালামপার, কাবদান আইল্যান্ড প্রভৃতি। জাদুঘরসমূহের মধ্যে রয়েছে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, উরুমিয়েহ চারু ও কারুকলা মিউজিয়াম, উরুমিয়েহ মিউজিয়াম অব অ্যানথ্রোপোলজি প্রভৃতি। এছাড়া উরুমিয়েহ নৃতাত্ত্বিক মিউজিয়াম যা শহীদ বেহেশতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত।

আবহাওয়া : উরুমিয়েহর আবহাওয়া নানা প্রকৃতির। এখানে শীতকালে প্রচন্ড ঠান্ডা, বসন্তকালে নাতিশীতোষ্ণ, গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড উষ্ণতা এবং শরৎকালে সামান্য উষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে উরুমিয়েহর খ্যাতি শত বছরেরও বেশি সময় ধরে। আমেরিকার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ জোসেফ কোরবান্দ ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মেডিকেল ফ্যাকাল্টি অব উরুমিয়েহ’। এটি ইরানের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে সরকারি, বেসরকারি অনেক স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে রয়েছে উরুমিয়েহ বিশ্ববিদ্যালয়, মালেক আশতার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, উরুমিয়েহ ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সাইন্সেস, উরুমিয়েহ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, ইসলামিক আযাদ ইউনিভার্সিটি অব উরুমিয়েহ, পায়ামে নূর ইউনিভার্সিটি অব উরুমিয়েহ, ইলমে কারবোরদি ইউনিভার্সিটি অব উরুমিয়েহ, ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সাবা, ইউনিভার্সিটি কলেজ অব আজারবাইযান, ইউনিভার্সিটি কলেজ অব ইল্ম ও ফান্ন, ইউনিভার্সিটি অব কামাল, ইউনিভার্সিটি কলেজ অব আফাগ প্রভৃতি। বিখ্যাত স্কুলসমূহের মধ্যে রয়েছে শহীদ বেহেশতী টেকনিক্যাল স্কুল, গাজী তাবাতাবায়ী টেকনিক্যাল স্কুল অব উরুমিয়েহ, নাজান্দ ইন্সটিটিউট অব হায়ার এডুকেশন প্রভৃতি। গ্রন্থাগারসমূহের মধ্যে রয়েছে আল্লামা তাবাতাবায়ী লাইব্রেরি, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি অব উরুমিয়েহ, লাইব্রেরি অব গায়ীম, লাইব্রেরি অব ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান এডুকেশন মিনিস্ট্রি, লাইব্রেরি অব কানুন পারভারেস ফেকরি, লাইব্রেরি অব খানে-ই-জাভান, লাইব্রেরি অব শহীদ মোতাহহারী, লাইব্রেরি অব শহীদ বাহোনার, লাইব্রেরি অব উরুমিয়েহ কালচারাল অ্যান্ড আরটিসটিক সেন্টার প্রভৃতি।

মিডিয়া : মিডিয়ার ক্ষেত্রে উরুমিয়েহ অঞ্চলের নিজস্ব রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। টিভি চ্যানেলের নাম আজারবাইযান টিভি। এটি আন্তর্জাতিকভাবে সম্প্রচারিত হয়ে থাকে। এটি আজারবাইযানি এবং ফারসি দু’ভাষাতে সম্প্রচারিত হয়ে থাকে। এর স্যাটেলাইট ইনটেলসেট নম্বর ৯০২। রেডিও চ্যানেলের নাম চিকেস্ট। এটিও আজারবাইযানি ও ফারসি দু’ভাষাতে সম্প্রচারিত হয়ে থাকে।

যাতায়াত : যাতায়াতের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বা ভাড়ায় প্রাইভেট কার ও ট্যাক্সি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে অনেক পাবলিক বাসও রয়েছে। এখানে ‘ফোন-ট্যাক্সি’ নামে অনেকগুলো সার্ভিস আছে। যাদেরকে ফোন করলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই যাত্রীর কাক্সিক্ষত স্থানে এসে হাজির হয়। এখানে মেট্রো রেল স্থাপন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তুরস্কের মধ্য হয়ে ইউরোপের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে উরুমিয়েহর। ১৯৬৪ সালে উরুমিয়েহ বিমান বন্দর চালু হয়। দক্ষিণ আজারবাইযান অঞ্চলে এটি প্রথম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও বটে। ২০১৫ সাল থেকে এখানে অভ্যন্তরীণ রুটে যাতায়াতের জন্য ভিন্ন বিমানবন্দর চালু করা হয়েছে।

চিকিৎসালয় : স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় উরুমিয়েহ বেশ অগ্রসর। এখানে সরকারি বেসরকারি অনেকগুলো হাসপাতাল ও মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। বিখ্যাত হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে ইমাম রেযা হাসপাতাল, ইমাম খোমেইনী হাসপাতাল, মোতাহহারী হাসপাতাল, বেহেশতী হাসপাতাল, তেলেগানী হাসপাতাল, ফাতেমিয়া প্রো মেডিকেল ক্লিনিক, সাফা হাসপাতাল, সোলাতি হাসপাতাল, সাইয়্যেদোশ শোহাদা হার্ট প্রো-হাসপাতাল, গোলিপুর চিলড্রেন প্রো হাসপাতাল, রাজি সাইক্রিয়াট্রিক প্রো হাসপাতাল, ৫০৪ আরতেশ হাসপাতাল, আরেফিয়ান হাসপাতাল, আজারবাইযান হাসপাতাল, মিলাদ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল, অমিদ ক্যান্সার প্রো-ক্লিনিক প্রভৃতি।

খেলাধুলা : খেলাধুলার ক্ষেত্রে উরুমিয়েহর ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে। এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হচ্ছে ভলিবল। উরুমিয়েহকে ইরানে ‘ভলিবলের রাজধানী’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এখানকার ‘শাহরদারী উরুমিয়েহ ভলিবল ক্লাব’ বেশ কয়েকবার ‘ইরান সুপার লীগ’ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। উরুমিয়েহর অনেক খেলোয়াড় ইরানের জাতীয় ভলিবল দলে খেলে থাকেন। যেমন সাইয়্যেদ মারুফ, আবদুর রেযা আলীযাদে, মিলাদী এবাদীপুর প্রমুখ। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ভলিবল ফেডারেশন এর অফিসিয়াল ওয়েব সাইটে উরুমিয়েহকে ‘ভলিবল প্রেমিকের শহর’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। ২০১০ সালে পুরুষ ভলিবল চ্যাম্পিয়ানশীপ এবং ২০১২ সালে জুনিয়র পুরুষ ভলিবল চ্যাম্পিয়নশীপ উরুমিয়েতে অনুষ্ঠিত হয়।