ইমাম খোমেইনীর অসিয়তনামা : মুসলিম উম্মাহর দৃষ্টি আকর্ষণী বিষয়সমূহ
পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ৩১, ২০১৬
ডা. খিজির হায়াত খান
মানব সভ্যতার ইতিহাসে যুগে যুগে যেসব সমাজ সংস্কারক বিভ্রান্ত মানুষকে পথের দিশা দিতে পৃথিবীতে এসেছেন ইমাম রুহুল্লাহ মুসাভী খোমেইনী তাঁদের অন্যতম। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের সফল সংগঠক, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের অবিসংবাদিত নেতা হযরত ইমাম রুহুল্লাহ মুসাভী খোমেইনী (রহ.) ১৯০১ সালে ইরানের কোম শহরের খোমেইন নামক স্থানে জন্মগ্রহন করেন। সারাটি জীবন ধরে তিনি ইসলামি উম্মাহর ইহ-পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। এ জন্য জীবনের এক উল্লেখযোগ্য সময় তাঁকে কারাগারে এবং নির্বাসিত হয়ে কাটাতে হয়েছে। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ইমাম খোমেইনীর সুযোগ্য নেতৃত্বেই ১৯৭৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ইরানের বুকে ইসলামি বিপ্লব সফলতা লাভ করে এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্ম সূচিত হয়। তাই ইরানের বিপ্লবী জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে নেতৃত্বে বরণ করে নেয়। ১৯৮৯ সালের ৩ জুন তিনি ইরানের রাজধানী তেহরানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব সফল হবার পর ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ইমাম খোমেইনী ইসলামি বিপ্লবের হেফাযত, বিকাশ এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মুক্তি ও কল্যাণের জন্য কথা, লেখা ও চিন্তার মাধ্যমে সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেগেছেন। এমনকি তাঁর ইন্তেকালের পরে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ বিশেষত ইরানের বিপ্লবী জনগণ কিভাবে পথ চলবে সে ব্যাপারে পথনির্দেশনা দানের জন্য তিনি তাঁর অন্তিম বাণী লিখে রেখে যান। অন্তিম বাণীসহ তাঁর এ সমগ্র তৎপরতার একটিই মাত্র লক্ষ্য ছিল, তা হচ্ছে, মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একজন মুমিন বান্দার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে প্রশান্ত চিত্তে তাঁর সমীপে হাজির হওয়া।
ইন্তেকালের সাড়ে ছয় বছর পূর্বে তিনি তাঁর অন্তিমবাণী রচনা করেন এবং রচনার সমাপ্তিতে হিজরি ১৪০৩ সালের পহেলা জমাদিউল আওয়াল (মোতাবেক ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩) স্বহস্তে লিখিত এ বাণীতে সমাপ্তি স্বাক্ষর ও তারিখ লিপিবদ্ধ করেন। এ অন্তিমবাণীর প্রতিটি পৃষ্ঠার শেষে তিনি স্বাক্ষর করেন এবং তাঁর সীলমোহর সহকারে তা ধর্মীয় নগরী মাশহাদে আহলে বাইতের অষ্টম ইমাম হযরত রেযা (আ.)-এর মাযারে হেফাযতের ব্যবস্থা করা হয়। এর একটি অনুলিপি তিনি নিজের কাছে সংরক্ষণ করেন। ইন্তেকালের বছর দুই পূর্বে তিনি তাঁর এ অন্তিমবাণীর মূল কপি মাশহাদ থেকে আনিয়ে নেন এবং কিছুটা সংশাধন করে পুনরায় সীলমোহর করে মাশহাদে পাঠিয়ে দেন।
তাঁর এ অন্তিমবাণী জনসাধারণের উদ্দেশে পড়ে শুনানোর বিষয়েও তিনি এই বলে নির্দেশনা দেন- ‘মৃত্যুর পর এই অসিয়তনামা আহমদ খোমেইনী জনগণকে পড়ে শোনাবেন। যদি তিনি না পারেন তাহলে সম্মানিত রাষ্ট্রপতি অথবা সম্মানিত মজলিশ ¯িপকার অথবা সুপ্রিম কোর্টের সম্মানিত প্রধান বিচারপতি এই কষ্টটুকু বরণ করবেন। আর তাঁরাও যদি অক্ষম হন তাহলে সম্মানিত অভিভাবক পরিষদের কোনো ফকিহ এই কষ্টটুকু কবুল করবেন।’
এ নির্দেশনার আলোকে ইমাম খোমেইনীর ইন্তেকালের পরদিন ৪ঠা জুন (১৯৮৯) সকাল ৯টা ১০ মিনিটে মজলিশে শুরায়ে ইসলামি ভবনে অনুষ্ঠিত নেতা নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যগণ, মজলিশে শুরায়ে ইসলামির সদস্যগণ, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণ এবং দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিত্বের যৌথ সমাবেশে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট (বর্তমান রাহবার) হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী কর্তৃক এ অসিয়তনামা পঠিত হয়। এরপর জাতীয় প্রচারমাধ্যমসমূহে তা প্রচারিত হয়। হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী কর্তৃক হযরত ইমামের অন্তিম বাণীটি মরহুমের সংরক্ষিত অনুলিপি থেকে পঠিত হয়; পরে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাশহাদে সংরক্ষিত মূল কপিটি খোলা হয়। হযরত ইমামের স্বহস্তলিখিত এ অসিয়তনামার মূল অংশটি ২৯ পৃষ্ঠা, ৬ পৃষ্ঠা ভূমিকা ও ১ পৃষ্ঠা পরিশিষ্টসহ মোট ৩৬ পৃষ্ঠা।
ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রায় সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের জন্য তিনি তাঁর অসিয়তনামায় কিছু কিছু উপদেশ দিয়েছেন। এতে যেমন উপদেশ রয়েছে আলেম, শিক্ষাবিদ, প্রশাসক, প্রচারমাধ্যম, সশস্ত্রবাহিনী, বিচারবিভাগ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের জন্য, তেমনি উপদেশ রয়েছে তরুণ, যুবসমাজ, বক্তা, লেখক, শিল্পী, এমনকি সাধারণ জনগণের জন্য। শুধু তাই নয়; তাঁর অসিয়তনামার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর প্রতি হৃদয়গ্রাহী কিছু আবেদন। ইমাম খোমেইনী এ বিষয়টি ¯পষ্ট করেছেন এভাবে- ‘এখানে প্রত্যেককে যা স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি তা হলো, আমার ধর্মীয়, রাজনৈতিক এই অসিয়ত শুধু ইরানের মহান জনগণের জন্য লিখিত নয়; বরং এটা সকল মুসলমান তথা জাতিধর্ম নির্বিশেষে দুনিয়ার তাবৎ মযলুম জনগণের জন্য এক উপদেশ হিসেবেও পরিগণিত।’
এখানে আমি একটি বিষয় বলে রাখতে চাই যে, আলোচনার শিরোনামের ধরনের কারণে আমি সবক্ষেত্রেই ইমাম খোমেইনীর অসিয়তনামার ঞবীঃ থেকে সরাসরি ছঁড়ঃব করছি যেন আপনারা ইমাম খোমেইনী যে ঝবহপব এ যে কথাটি বলতে চেয়েছেন তা উপলব্ধি করতে পারেন।
হযরত ইমাম খোমেইনীর অসিয়তনামাটি দুটি বৃহৎ অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশটি ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যাতে অনেক বিষয়ের মাঝে তিনি ইসলাম, কোরআন, মহানবী (সা.)-এর অনুসরণ ও কারবালার শাহাদাতের অনুপ্রেরণার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, তিনি মহানবী (সা.)-এর একটি হাদীস উল্লেখ করে তাঁর অসিয়তনামাটি শুরু করেছেন- ‘আমি তোমাদের কাছে অতীব মূল্যবান ও সম্মানিত দু’টি জিনিস (সাকালাইন) রেখে যাচ্ছি : আল্লাহর কিতাব এবং আমার আহলে বাইত। অতঃপর নিশ্চয়ই এ দুটি জিনিস হাউজে (কাউসারে) আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনও পর¯পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।’ এই হাদীস স¤পর্কে তিনি বলেন : ‘এটা উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক যে, ‘হাদীসে সাকালাইন’ রাসূলে পাক (সা.) থেকে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে (মুতাওয়াতির) বর্ণিত হয়ে এসেছে। সিহাহ সিত্তার হাদীস গ্রন্থাবলি সহ আহলে সুন্নাতের অন্যান্য কিতাবের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেওয়ায়সমূহের অন্তর্নিহিত শাব্দিক তারতম্য সহকারে এই হাদীসের বর্ণনা এসেছে। এই মহান হাদীস সমগ্র মানবজাতির জন্য বিশেষভাবে মুসলমানদের সকল মাযহাবের জন্য এক অকাট্য দলিল (হুজ্জাতে কাতে)।’
মানবজাতির ওপর পবিত্র কুরআনের বৈশ্বিক আবেদনকে ইমাম দেখেছেন এভাবেÑ ‘পাক কোরআন- যে পবিত্র গ্রন্থ মহানবী মুস্তাফা (সা.)-এর ওপর পূর্ণাঙ্গভাবে ও ওহীর সমাপ্তি হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিল দুনিয়ার মানবজাতিকে সমুন্নত করতে, মুসলমানদের ঐক্য, এমনকি গোটা মানবজাতির ঐক্যের উৎস হিসেবে, যাতে মানবতার যথার্থ উন্নয়ন সাধিত হয়।’
শাহের আমলে সমাজজীবনে পবিত্র কোরআনের শিক্ষার বাস্তবায়নে অবহেলাকে তিনি তুলে ধরেছেনÑ ‘প্রকৃতপক্ষে যে কোরআন মানবজাতির জন্য নিয়ে এসেছে সর্বোৎকৃষ্ট জাগতিক ও আধ্যাত্মিক পথনির্দেশনা সেইদিন পর্যন্ত যেদিন হাউজে কাওসারে নবীর সাথে মিলন ঘটবে, সেই কোরআনুল কারিমকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল।’
কারবালার ময়দানে নবীবংশের ও তাঁদের সাথিদের মহান শাহাদাতের চিরন্তন আবেদনের কথা উল্লেখ করে ইমাম খোমেইনী বলেনÑ ‘জনগণের স্মরণ রাখা উচিত কারবালার প্রেরণাদায়ক ঐতিহাসিক মহাঘটনার স্মৃতিচারণের জন্য ইমামদের নির্দেশনাবলি। নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের দুশমনদের ওপর যেসব ধিক্কার ও অভিশাপ আপতিত হয়েছে তা আসলে যুগে যুগে স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিসমূহের বীরত্বপূর্ণ প্রতিবাদ।’
মানবজাতির জন্য মহান ইসলামের নেয়ামত ও গুরুত্বকে ইমাম এভাবে ফুটিয়ে তুলেছেনÑ ‘হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে খাতামুন নাবিয়্যীন রাসূলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল এই ইসলামের হেফাজতের জন্যই কোন বাধাবিপত্তিকে প্রশ্রয় না দিয়ে অবিচল নিষ্ঠা ও সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের জান কুরবান করেছিলেন, আর কোন বাধাবিপত্তিই তাঁদেরকে এই সুমহান ফারিযা (ফরয কাজ) থেকে পিছু হটাতে পারেনি এবং তাঁদের এই সংগ্রামের দায়িত্ব পরবর্তীকালে নিজেদের কাঁধে তুলে নেন তাঁদের সুযোগ্য সাহাবা ও অনুসারীবৃন্দ এবং পবিত্র ইমাম (আ.) গণ যাঁরা এর হেফাজত ও উন্নয়নের জন্য সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছিলেন, এমনকি নিজেদের রক্ত দান করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি।’
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে শোষক ও সুবিধাবাদী শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা ইসলামের সমকালীন আবেদন স¤পর্কে অপব্যাখ্যা দিয়ে আসছিল। ইমাম তাদের অপব্যাখ্যার বিষয়টি সামনে রেখে বলেছেনÑ ‘যুক্তি দেখায় যে, চৌদ্দশ’ বছরের পুরোনো ইসলামি অনুশাসনগুলো বর্তমান শতাব্দীর দেশগুলোর প্রশাসন পরিচালনায় অপারগ। কেননা, ইসলাম আধুনিক সভ্যতার প্রতিটি উদ্ভাবন ও প্রগতিবিরোধী পশ্চাৎপদ ধর্ম। তাছাড়া বর্তমান যুগের দেশগুলো দুনিয়ার আধুনিক সভ্যতা এবং আত্মপ্রকাশকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে না। আর একই রকম মূর্খতাপূর্ণ এবং অনেক সময় অসৎ ও বিদ্বেষপূর্ণ শয়তানি প্রচারণাকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ইসলামি কথাবার্তার মোড়কে সাজিয়ে ইসলামপন্থী প্রচারণারূপে উপস্থাপন করে এরূপ ধারণাকে সমর্থনের ছুতা তোলা হয় যে, ইসলাম এবং অন্যান্য ঐশী ধর্ম আসলে আধ্যাত্মিক ব্যাপার স¤পর্কিত, মানবজাতির নৈতিক পরিশুদ্ধির সাথে স¤পর্কিতÑ (এগুলো) পার্থিব কোন কার্যক্রমের সাথে স¤পর্কিত নয়, বরং দুনিয়াকে ত্যাগ করতে আহ্বান জানায়।’
তিনি অসিয়তনামায় আরো লিখেছেনÑ ‘নির্জলা মিথ্যা একটা দাবি যে, ইসলাম নব নব কারিগরি উদ্ভাবনের বিরোধী।… এটা একটা নেহায়েতই আহাম্মকি অভিযোগ ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, তারা যদি সভ্যতার নিদর্শন ও নতুন কিছুর উদ্ভাবনকে এবং মানুষ ও তার সভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান রাখতে সক্ষম কোন আবিষ্কার, নতুন দ্রব্যসামগ্রী ও উন্নতমানের প্রকৌশলকেই বুঝায়, তাহলে তাদের এই ধারণাকে কখনো ইসলাম বা অন্য কোন তাওহীদী ধর্ম বিরোধিতা করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না। উপরন্তু ইসলাম এবং পাক কিতাব কোরআনুল হাকিম বিজ্ঞানশিক্ষা এবং প্রকৌশল শিল্পের ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে।’
ইসলামের সার্বিক বাস্তবায়নের কথা উঠলেই আমরা ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে থাকি। এই ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ও এর আবেদন প্রসঙ্গে ইমাম খোমেইনী তাঁর অসিয়তনামায় ¯পষ্ট করেছেন। ‘ইসলামের মহান নবী (সা.) পৃথিবীর অন্য সরকারগুলোর মতোই একটা সরকার গঠন করেছিলেন, কিন্তু তফাতটা ছিল এই যে, নবী করিম (সা.)-এর সরকার গঠনের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রসার ঘটানো।’
‘ইসলাম এবং ইসলামি সরকার হলো খোদায়ী সত্তার প্রকাশ। এর বাস্তব রূপায়ন তোমাদের সন্তানদের জন্য এই জগতের সমৃদ্ধি ও পরজগতের নাজাতের একমাত্র সর্বোত্তম নিশ্চয়তা। ইসলাম অন্যায়, অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এবং দুর্নীতিসমূহের মূলোৎপাটনে সক্ষম। এটা মানবতার সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য হাসিলের সহায়ক।’
এ প্রসঙ্গে ইমাম আরো লিখেছেনÑ ‘আপনাদের প্রতি আমার জোরালো নসিহত, কখনো ইসলামের এবং মহান ইসলামি প্রজাতন্ত্রের দুশমনদের বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণায় কর্ণপাত করবেন না। কারণ, ইসলামকে ময়দান থেকে বিতাড়িত করাই এদের মূল উদ্দেশ্য যাতে পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।’
ইমাম খোমেইনীর অসিয়তনামা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন মহানবী (সা.)-এর অন্তিম নির্দেশনা অনুসরণের প্রতি। মুসলিম উম্মাহর স্বকীয় পরিচয় উপলব্ধি, ইসলামি উম্মাহর সর্বক্ষেত্রে কার্যকরী ঐক্য প্রতিষ্ঠা, শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে উম্মাহর সচেতনতাকে শাণিত করা, পরাশক্তির দাসত্ব থেকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ও বাস্তব জীবনে স্বাধীনতা অর্জনের প্রতি ছিল তাঁর প্রধান আবেদন। তিনি বলেনÑ ‘আমাদের স্বকীয়তাকে পরখ করার মতো আমাদের আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে দিয়েছে যেন আমাদের যা কিছু আছে তা ওদের হাতে তুলে দিয়ে আমরা চুপচাপ অন্ধের মতো বসে থাকি এবং আমাদের দেশ, আমাদের ভাগ্য ওদের হাতে ছেড়ে দেই। এই অন্তঃসারশূন্যতা এবং জড় অনুভূতি বৃহৎ শক্তিগুলো আমাদের মনে গেঁথে দিয়েছে। এই কারণে সকল ক্ষেত্রে আমরা আমাদের নিজস্ব জ্ঞান গরিমা ও ক্ষমতাকে অবিশ্বাস করছি এবং অন্ধের মতো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অনুসরণ করে চলেছি।’
তিনি আরো লিখেছেনÑ ‘একটা চক্রান্ত হলো উপনিবেশ কবলিত দেশগুলোকে স্ববিরোধিতায় ঠেলে দিয়ে পরমুখাপেক্ষী করা। তাদেরকে পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যঘেঁষা করে তোলা। এই হীন চক্রান্ত এত বেশি পরিমাণে প্রভাব বিস্তার করেছে যে, ঐসব দেশ এমনকি তাদের নিজেদের আত্মসম্মানবোধ ও আত্মবিশ্বাসটুকুও হারিয়ে বসেছে। নিজেরা উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তম প্রজন্মের অধিকারী হয়েও এখন তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুই শিবিরকে দুই মূল শক্তিকেন্দ্র বলে বিশ্বাস করেছে এবং স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, তাদের দেশ এই দুই শক্তির যে কোন একটির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে থাকতে পারবে না।’
কিছুটা কঠিন ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ইমাম লিখেছেনÑ ‘হে বিশ্বের নির্যাতিত (মুস্তাযাফ) জনগণ! হে মুসলিম দেশসমূহ!! হে বিশ্বের মুসলমানগণ!!! উঠে দাঁড়ান, সত্যকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরুন এবং পরাশক্তিবর্গ ও তাদের পদলেহী দালালদের প্রচারণামূলক হৈ-চৈ এ ভীতসন্ত্রস্ত হবেন না।’ সমকালীন বিশ্বে ইমাম খোমেইনীর মতো আল্লাহর ওলীর পক্ষেই কেবল এমন ভাষায় কথা বলা সম্ভব হয়েছে।
বিশ্ব ইহুদিবাদী চক্র ও আলআকসা মসজিদ ও ফিলিস্তিন জবরদখলকারী ইসরাইল স¤পর্কে ইমাম খোমেইনী তাঁর অসিয়তনামায় লেখেনÑ ‘আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদ, যে নিজের শয়তানি খায়েশ পুরো করার মানসে যে কোন অপকর্ম করতে তৎপর, যার হিসাব লিখতে গেলে কলম থেমে যায়, বর্ণনা দিতে গেলে কণ্ঠ লজ্জায় রুদ্ধ হয়ে আসে। বৃহত্তর ইসরাইল গঠনের ঘৃণ্য দুরাশা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে সব রকমের ইবলিসি তৎপরতায়।’
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের সংঘটনের মধ্য দিয়ে ইমাম খোমেইনী যে স্বাধীনতা, স্বনির্ভরতার পথ দেখিয়েছেন সে অনুপ্রেরণা নিয়ে ইরান আজকে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ইমাম খোমেইনী ১৯৮৯ সালে ইন্তেকালের আগেও সেই অনুপ্রেরণাই দিয়ে গেছেন। ইমাম তাঁর অসিয়তনামায় লিখেছেনÑ ‘আমি তাঁদেরকে এই নিশ্চয়তা প্রদান করছি যে, একবার যদি তাঁরা নিজেদের স্বরূপ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, হতাশার চিহ্নটুকু ছুঁড়ে ফেলে দেন, আর অন্যের সাহায্য পাবার প্রত্যাশা পরিত্যাগ করেন, তাহলে অবশেষে আপনারা আপনাদের কর্মক্ষমতা ও সকল কিছুর উৎপাদন ক্ষমতার জ্বলন্ত প্রমাণ রাখতে সক্ষম হবেন। এদের মতো অন্যদের সমপর্যায়েও আপনারা যেতে সক্ষম হবেন, কিন্তু তার শর্ত হলো যে, আপনারা মহাপ্রভু রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তাআলার প্রতি পরির্পূণ আস্থা আনবেন।’
ইমাম তাঁর অসিয়তনামায় আরো লিখেছেনÑ ‘আমরা এখন যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঐসব ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়েছি, আমরা দেখতে পাচ্ছি, বর্তমানের বঞ্চিত জনগণের নবীন বংশধররা আমাদের দেশের শিল্পোন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নতিতে অবদান রাখার জন্য জেগে উঠেছে।’
ইমাম খোমেইনীর এই প্রাণ¯পর্শী আবেদন পরাশক্তির দাসত্বমুক্ত হয়ে ইরানকে একটি উন্নত ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে যা মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি প্রেরণাদায়ী মডেল হতে পারে।
পরিশেষে আমি ইমাম খোমেইনীর অসিয়তনামার একেবারে শেষের দিকের অংশ থেকে পাঠ করে আমার বক্তব্য শেষ করব যেখানে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি ইমাম তাঁর অন্তিম আবেদনে উল্লেখ করেনÑ ‘সকলের প্রতি আমার অন্তিম আবেদন, সদাসর্বদা আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ রেখে নিজকে চেনা এবং সকল ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা ও স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যান। নিশ্চয় এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা আপনাদের সহায়ক হবেন।’
‘আপনারা শক্তিমত্তা ও দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি সহকারে সম্মুখপানে এগিয়ে যান। সবাই যেন মনে রাখেন, একজন খাদেমের প্রস্থানের ফলে এ জাতির ই¯পাতকঠিন দৃঢ়তায় কোনো ফাটল দেখা দেবে না। কেননা, মহা সম্মানিত খাদেমগণ এ জনগণের সেবায় নিয়োজিত আছেন। আল্লাহই এ জাতি ও বিশ্ব মযলুমদের রক্ষাকর্তা।’
লেখক: পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
[প্রবন্ধটি হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গত ৩ জুন, ২০১৬ বিএমএ মিলনায়তনে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায় পঠিত হয়।]