ইমাম খোমেইনী (র.)-এর দৃষ্টিতে কোরআন মজীদ
পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ১, ২০১৬
মাহদী হাযেরী
কোরআন নাযিলের লক্ষ্য
ইমাম খোমেইনী (র.)-এর দৃষ্টিতে নবুওয়াতি মিশন ও কোরআন নাযিলের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মানবজাতির আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি। তাঁর নিজের ভাষায় : ‘নবুওয়াতি মিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কোরআন-এর নাযিল হওয়াকে সুস¤পন্ন করা আর কোরআনকে মানুষের মাঝে পাঠ করে শোনানোর উদ্দেশ্য ছিল যাতে তারা অন্তরের কালিমা ধুয়ে ফেলে আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করতে পারে।’ (সাহিফায়ে ইমাম, ১৪তম খণ্ড, পৃ. ৩৮৮)
কোরআন আনুধাবন
ইমাম খোমেইনী (র.)-এর দৃষ্টিতে কোরআন মজীদের মৌলিক শিক্ষাগুলো সকলেই অনুধাবনে সক্ষম এবং প্রত্যেকেই তার নিজের সক্ষমতার ভিত্তিতে এর থেকে সুফল পেয়ে থাকে। কোরআনের শিক্ষা সঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য কতগুলো শর্ত মেনে চলতে হয়। আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনের পথে জিহাদ করা, নীচ ও কুৎসিত আচরণ থেকে মুক্ত থাকা, ব্যবহারিক জীবনে উচ্চমান বজায় রাখা এবং মুক্তির প্রতীক্ষায় মাসুম ইমামগণের (আ.) ধারাকে আঁকড়ে ধরে রাখা হচ্ছে সেরূপ কতিপয় শর্ত।
এছাড়া, আত্ম-অহমিকা এবং বস্তুগত জীবনের প্রতি অতিরিক্ত মায়ার মতো কতিপয় বাধা অতিক্রম করাও কোরআন থেকে সুফল লাভের পূর্বশর্ত। আর এগুলো কোরআনের প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের জন্য আবশ্যক। (সাহিফায়ে ইমাম, ১৪তম খ-, পৃ. ৩৮৮)
কোরআন অবলম্বনের তাগিদ
মরহুম ইমাম (র.) কোরআন পাঠ, কোরআন নিয়ে অনুধ্যান, কোরআনী শিক্ষার প্রয়োগ এবং কোরআনের পুনরুজ্জীবনের জন্য বার বার তাগিদ দিয়েছেন। ইমাম তাঁর পুত্রবধু ফাতেমা তাবাতাবায়ীকে এক চিঠিতে লিখেন, ‘কোরআন নিয়ে অনুধ্যান কর, কেননা, তা ঐশী সহযোগিতার উৎসমূল। আক্ষরিকভাবেই, কেবল কোরআন পাঠ করা যেন প্রিয়তমের কাছ থেকে লজ্জাবনত পাঠকের কাছে আসা চিঠি পড়ার মতোই, তবে কোরআনের আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা প্রীতিদায়ক ফলাফল বয়ে আনে এবং ব্যক্তিকে মহিমান্বিত ও সুউচ্চ মাকামে পৌঁছে দেয়। কোরআন পাকে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, ‘তারা কি কোরআন নিয়ে চিন্তা করে না, নাকি তাদের হৃদয় তালাবদ্ধ?’ তাই, কোন যথাযথ ফলাফল লাভই সম্ভব নয় যতক্ষণ না এই তালা বা শিকল থেকে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে। তাই, যে পর্যন্ত তুমি যৌবনে রয়েছ ততক্ষণ আমল ও আত্মিক পরিশুদ্ধির পথে জিহাদ করÑ যতক্ষণ না তুমি অন্তরের তালাটাকে বিচূর্ণ করতে সক্ষম হও। আর এটা এজন্যই যে, একজন বৃদ্ধ নয়, বরং ঐশী দিগন্ত এবং স্বর্গীয় রাজত্বের নিকটবর্তী তরুণরাই সফলকাম হবে।”… (সাহিফায়ে ইমাম, ১৮তম খণ্ড, পৃ. ৪৪৭)
ইমাম খোমেইনী মনে করতেন অতীতে মুসলমানদের উন্নতি এবং শ্রেষ্ঠত্ব লাভের রহস্য নিহিত রয়েছে কোরআনের শিক্ষার প্রতি আমল করার মধ্যেই এবং তাঁর মতে, এটি মুসলমানদের মুক্তির একমাত্র পথ।
তিনি বলেন, ‘কোরআনই দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী কাল ধরে মুসলমানদেরকে রক্ষা করেছে এবং ইসলাম তৎকালীন সকল সা¤্রাজ্যের উপর বিজয় লাভ করেছে। যতক্ষণ আমরা কোরআনের শিক্ষাকে আঁকড়ে থাকব ততক্ষণ শত্রুদের উপর আমাদের আধিপত্য বজায় থাকবে। আল্লাহ না করুন, যদি ইসলামের শত্রুরা আমাদেরকে কোরআন এবং ইসলাম থেকে দূরে সরাতে সক্ষম হয় তাহলে আমরা নিজেদেরকে অপমান, লাঞ্ছনা, হীন অবস্থা এবং দাসত্বের নিগড়ে আবিষ্কার করব। স্বাধীনতা ও মুক্তি নিহিত রয়েছে কোরআন ও সম্মানিত রাসূল (সা.)-এর প্রতি আমাদের আনুগত্যের মধ্যেই।’
কোরআননির্ভর বক্তৃতা দান
কোরআন হচ্ছে সেই প্রচারমূলক গ্রন্থ যা মানবজাতিকে নসিহত ও দিকনির্দেশনার জন্য মহানবী (সা.)-এর উপর নাযিল হয়েছে। কোরআন যে কোন যুগের মানুষকে হেদায়াত করতে সক্ষম। এ ব্যাপারে ইমাম বলেন, ‘মানুষ অসীম, মানুষের প্রশিক্ষক অসীম এবং হেদায়াতের পাথেয় কোরআন মজীদও অসীম… এটা শুধু অদৃশ্য কিংবা ভাবজগতের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটা সবকিছু এবং সর্বত্র। (সাহিফায়ে ইমাম, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৪২২)
কোরআনের উপদেশমালার মধ্যে একটি উপদেশ মরহুম ইমামের দৃষ্টিকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে এবং তিনি বার বার এই নির্দেশটিকে টেনে এনেছেন। প্রকৃতপক্ষে, বলা যেতে পারে যে, এটাই ছিল ইমামের আন্দোলন ও বিপ্লবের মূলমন্ত্র। যখনই কোন ব্যক্তি তাঁর কাছে উপদেশ চাইতে এসেছে তখনি তিনি সূরা সাবা’-এর ৪৬ নং আয়াতের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যাতে এরশাদ হয়েছে :
“(হে রাসূল!) বলুন : ‘আমি তোমাদের কেবল একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি, তা হলো এই যে, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে দু’ দু’জন করে বা এক-একজন করে উঠে দাঁড়াও….।”
হযরত ইমামের জিহাদের যে প্রাচীনতম (১৯৪৪) নযির পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে, তিনি জনগণকে উক্ত ঐশী নির্দেশনা মেনে সত্যের জন্য উঠে দাঁড়াতে এবং বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করছেন।
উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইমাম বলেন, ‘এ আয়াতে পাকে আল্লাহ তা‘আলা প্রকৃতির নিকষ অন্ধকার কোণ থেকে শুরু করে মানবতার পথে যাত্রার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত তোমাদের জন্য প্রয়োজনীয় সকল কিছুই বর্ণনা করে দিয়েছেন; আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অসংখ্য নির্দেশের মধ্যে এ নির্দেশটিকে মানবজাতির জন্য বিশেষভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর এটাই ইহকাল-পরকালের মুক্তির জন্য একমাত্র পাথেয়। এটাই আল্লাহর রাস্তায় ক্বিয়াম। এটাই সেই পথ যে পথে আল্লাহর বন্ধু হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর বন্ধুত্বের মাকামে পৌঁছান এবং নিজেকে প্রকৃতির বিভিন্ন প্রতিভাসের দাসত্ব থেকে মুক্ত করেন….’ (সাহিফায়ে ইমাম, ১২তম, পৃ. ২১)
কোরআনের নির্দেশনা বাস্তবায়ন
ইমাম তাঁর আন্দোলন এবং বিপ্লবকে একমাত্র ইসলামের শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্যই মনে করতেন। ইরাকের নাজাফে দেয়া ‘যোগ্যতাস¤পন্ন ন্যায়বান মুজতাহিদগণের শাসনব্যবস্থা (বেলায়াতে ফাক্বীহ্)’ শীর্ষক বক্তৃতার একাংশে ইমাম বলেন : ‘এই দর্শনের ¯্রষ্টা বর্তমানে আশা করেন যে, জনগণ ন্যায়সঙ্গত আচরণ করবে এবং ঐশী নির্দেশনা অনুযায়ী চলবে। এ দর্শনটি চিরকালের জন্যই প্রযোজ্য। এটি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত অপরিবর্তনীয় একটি বিধান। তাই আজ এবং সব সময়ের জন্যই ইসলামি ব্যবস্থা ও অনুশাসনসমূহকে বাস্তবায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য শাসক হিসেবে একজন যোগ্যতাস¤পন্ন মুজতাহিদ (ওয়ালিয়ে ফাক্বীহ্)-এর উপস্থিতি অবশ্য প্রয়োজন। এমন একজন শাসক যিনি আগ্রাসন, যুলুম ও অপরের অধিকার হরণকে প্রতিহত করবেন এবং তিনি হবেন বিশ্বস্ত, আমানতদার, আল্লাহর বান্দাদের সমর্থনকারী। তিনি মানুষকে ইসলামের শিক্ষা, বিশ্বাস, আদেশ এবং বিধানসমূহের দিকে পরিচালিত করবেন। তিনি দ্বীন, ইসলামি আইন এবং অনুশাসনের বিরুদ্ধে ইসলামের শত্রুদের অপপ্রয়াসকে নস্যাৎ করবেন। আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতের উদ্দেশ্য কি এছাড়া অন্য কিছু ছিল?…’ (বেলায়াতে ফাক্বীহ্, পৃ. ৪০-৪১)
‘ইসলামি বিধান অনুযায়ী দৈহিক সাজা প্রদান’ শীর্ষক আইনটির পক্ষাবলম্বন, উচ্চ আদালত থেকে ক্রমান্বয়ে সকল অনৈসলামি আইন অপসারণ, বিপ্লবোত্তর ইরানে ‘পূর্ব নয়, পশ্চিমও নয়’ শীর্ষক পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন, ইসলামের শত্রুদের উপরে প্রভাব বজায় রাখার নীতি গ্রহণ (‘আল্লাহ কখনোই মুসলমানদের উপরে এর শত্রুদের প্রভাবশালী করবেন না’ Ñ এই আয়াতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ইসলামি নীতি) এবং পবিত্র হজের সময় র্শিক্কে প্রত্যাখানের ও ইসলামি অনুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল ইমামের কোরআনী ঐশী নির্দেশনা বাস্তবায়নের মিশনের অন্তর্ভুক্ত।
কোরআন : মুসলমানদের ঐক্যের প্রধান অক্ষ
সম্মানিত ইমাম মনে করতেন যে, কোরআন নিজেই মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের সবচেয়ে বড় উপাদান হতে পারে।
‘তোমরা কোরআন এবং ইসলামের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করলে শত্রুরা তোমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ করতে সক্ষম হবে না। উপনিবেশিক শক্তিগুলো তোমাদের সার্বভৌমত্ব এবং সম্মান (জাতিগত) কেড়ে নিতে সক্ষম হবে না।’ (সাহিফায়ে ইমাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১১)
আরেক প্রেক্ষিতে ইমাম বিশ্বের সকল মানুষকে (মুসলিম-অমুসলিম) কোরআনের লুক্কায়িত শক্তির সাথে নিজেদের যুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হে মানুষ! তোমরা যারা কোরআন আর ইসলামের মহাসাগর থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছ, তোমরা তোমাদের বোধশক্তিকে জাগ্রত কর এবং এই মহাসাগরে পুনর্বার যুক্ত হও, এই পরমালোক থেকে ত্রাণ গ্রহণ কর যাতে বৈশ্বিক লুটেরাদের লোলুপ দৃষ্টি তোমাদের থেকে রুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং তাদের ঔদ্ধত্ব প্রদর্শন ও যুলুমের হাত খসে যায় আর তোমরা একটা সম্মানের অস্তিত্ব ও মানবিক মূল্য অর্জনে সক্ষম হও।’ (সাহিফায়ে ইমাম, ৬তম খণ্ড, পৃ. ৫১৬)
অনুবাদ : মাহদী মাহমুদ