আল কুদস দিবসের লক্ষ্যÑ বায়তুল মুকাদ্দাসের মুক্তি ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা
পোস্ট হয়েছে: জুন ১২, ২০২০
মুহাম্মদ শওকাত হোসেন
পবিত্র মাহে রমজানের শেষ শুক্রবার ‘জুমাতুল বিদা’ এর দিনটি বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। আমরা অনেকেই জানি না আল-কুদস দিবস কী? কেন? কখন থেকে? কোন্ লক্ষে পালিত হচ্ছে? তাই এ দিবসটির লক্ষ ও তাৎপর্য স¤পর্কে মৌলিক ধারণা আমাদের সকলের প্রয়োজন।
মূলত ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ এর মুক্তি ও পবিত্র ভূখ- ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী জনমত সৃষ্টি করা , বিশেষত মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক ও সচেতন করার লক্ষ্যে এ দিবসটি প্রতিবছর পালিত হচ্ছে। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পরপরই বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনী (র.) পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেন। বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালনের জন্য তিনি আহ্বান জানান। উদ্দেশ্য একটাই, বিশ্ব মুসলিমের প্রাণের চেয়ে প্রিয় মসজিদুল আকসাকে মুক্ত করা এবং ‘ইসরাইল’ নামের অবৈধ রাষ্ট্রের কবল থেকে পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বব্যাপী মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করা। দীর্ঘ ৪১ বছর যাবত সে লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী রমজানের শেষ শুক্রবারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে র্যালি, সমাবেশ, সেমিনার, আলোচনা সভা ইত্যাদির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয় এবং অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলেরর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের মুক্তি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে ঐকমত্য পোষণ করা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চলতি বছর করোনা মহামারির কারণে লোক সমাগমের মাধ্যমে দিবসটি পালন সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ও মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের কাছে এই মেসেজ পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। আমরা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও বায়তুল মুকাদ্দাস এর মুক্তির পক্ষে এবং অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল নামের অপশক্তির বিপক্ষে। এ মেসেজটি আমাদের সকলের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন।
প্রসঙ্গক্রমে আমাদের পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাসের গুরুত্ব উপলব্ধি করা প্রয়োজন। কারণ, বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা মুসলিম উম্মার প্রথম কিবলা। প্রায় ১৪ বছর ৫ মাস রাসূলে করীম (সা.)-এর নেতৃত্বে মুসলমানরা বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেছেন। নবীজি (সা.)-এর মাদানী জীবনে আল্লাহর নির্দেশে কাবা শরীফের দিকে কেবলা পরিবর্তিত হয়। পবিত্র কুরআনে এই মসজিদের কথা ২ বার উল্লেখ হয়েছে। মহানবী (সা.) মেরাজের সময় বায়তুল মোকাদ্দাসে যাত্রাবিরতি করে সেখানে সকল নবীর সঙ্গে তিনি ইমাম হয়ে নামাজ আদায় করেছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে যে তিনটি মসজিদ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা সওয়াবের কাজ, তার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘মসজিদুল আকসা’। এই তিনটি মসজিদ হচ্ছে মসজিদুল হারাম, মদীনার মসজিদে নববী এবং জেরুসালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস। কাজেই মুসলিম উম্মাহর কাছে এই মসজিদের গুরুত্ব অপরিসীম।
ইতিহাসের আলোকে হযরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক কাবা ঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম মসজিদুল আকসা নির্মাণ করেন। যদিও পরবর্তীকালে হযরত সুলাইমান (আ.) এই মসজিদটিকে পুনঃনির্মাণ করেছেন। এক লক্ষ ৪৪ হাজার বর্গমিটার এলাকার উপর বায়তুল মুকাদ্দাস বা আল-কুদস শহর অবস্থিত। এখানে মসজিদ আকারে ২টি স্থাপনা রয়েছে। প্রধান মসজিদ মসজিদে কিবালি ও মসজিদে কুব্বাতুহ ছাখরা। মুছাল্লাহ (মসজিদ) হিসেবে রয়েছে আরও পাঁচটি স্থাপনা। ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি গম্বুজ, বারটি মাদ্রাসা, ২৫টি কূপ, তেইশটি মাসতাবা (খালি মাঠে বর্গাকৃতির উঁচু জায়গা), ৮টি বায়েকা (গেটসদৃশ একাধিক স্তম্ভের স্থাপনা) চারটি আজান খানা সহ বিভিন্ন ধরনের ১৯০টি স্থাপনা রয়েছে। মসজিদে আকসার পনেরটি গেট এর দশটি ব্যবহৃত হচ্ছে, এর উপরে রয়েছে সীসার গম্বুজ, এটা ১৫ হিজরিতে খলিফা ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু নির্মাণের নির্দেশ দেন। ওখানে দাঁড়িয়ে খতীব ইমামতি করেন। কুব্বাতুস সাখরা পাথর গম্বুজ মসজিদ ইসলামি স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান ৬৬ থেকে ৭২ হিজরিতে এর নির্মাণ স¤পন্ন করেন। এর অভ্যন্তরে বৃত্তের মাঝখানে পাথর রয়েছে যার উপর দাঁড়িয়ে বোরাকে আরোহণ করে মহানবী (সা.) মেরাজে গেছেন।
ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুরা বিগত শতাব্দীর শুরু থেকেই মুসলিম উম্মাহকে ধ্বংস ও দুর্বল করার লক্ষ্যে ফিলিস্তিনে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেয়। এর নেতৃত্বে ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ এবং তাকে সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপের আরো কিছু রাষ্ট্র এবং মক্কা-মদিনার দখলদার সৌদি আরবের ৩য় বারের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ বিন সৌদ। একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র করে ব্রিটেন আমেরিকা এবং ইহুদীবাদের প্রবক্তারা মুসলিম বিশ্বের হৃদয়ের মাঝখানে একটি বিষফোঁড়ার মতো কৃত্রিম রাষ্ট্র ইসরাইলকে সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইহুদিদেরকে নিয়ে এসে ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে তাদেরকে পুনর্বাসিত করেছে। একদিকে এইসব ইহুদিকে সশস্ত্র এবং বেপরোয়া হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে ওই অঞ্চলের বাসিন্দা মুসলমানদেরকে নির্মমভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে এলাকা থেকে বের করে দিয়েছে।
লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি শরণার্থী প্রতিবেশী জর্ডান, সিরিয়া, মিশরসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে যুগের পর যুগ ধরে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছে। ১৯৪৮, ৫৬, ৬৭ ও ৭৩-এ চার চারবার আরব-ইসরাইল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আরবরা সবাই মিলেও এই বায়বীয় রাষ্ট্র বিষাক্ত বিষফোঁড়া ইসরাইলের সঙ্গে পেরে উঠেনি। ওরা ওদের জন্মদাতা ব্রিটেন আমেরিকার শক্তিতে সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন এবং মিশরের বিস্তীর্ণ ভূমি দখল করে নিয়েছে। তেল আবিবকে রাজধানী করে ওরা প্রথম অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরবর্তীকালে তারা জেরুসালেমকে রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ১৯৬৭ সালে ওরা মসজিদুল আকসা দখল করে ওদের আয়ত্তে নিয়ে নেয়।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের চৌদ্দ পুরুষের জায়গার উপরে অবৈধভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়ার আগ থেকেই সেখানকার মুসলিম অধিবাসীদের উপর হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়ন চলেছে। এর পেছনে ছিল ব্রিটিশ হানাদার বাহিনী। মুসলিম অধিবাসীরা বাধ্য হয়ে সপরিবারে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এবং তাদের মধ্য থেকেই বিভিন্ন গ্রুপ ওদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম তখনই শুরু করেছে। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য সংগ্রাম চলতে থাকে। এদের মধ্যে আলফাতাহ গ্রুপ ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে পরবর্তীকালে এই গ্রুপগুলোর সমন্বয়ে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা পিএলও গঠন করা হয়। দীর্ঘকাল ইয়াসির আরাফাত এর নেতৃত্বে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলাফল ছিল শূন্য। ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের নেতৃত্বে ‘ক্যা¤প ডেভিড চুক্তি’ হয়েছিল পিএলও, মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে। কিন্তু তাতে কোন ফলোদয় হয়নি, বরং পিএলও ও কিছু আরব রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল মাত্র ।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর বিশ্বরাজনীতি বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসে। ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) শুরুতেই বাইতুল মুকাদ্দাসের মুক্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয় তিনি ‘তারিকুল কুদস’ অভিযান চালানোর ঘোষণা দেন। এরই ফলশ্রুতিতে ফিলিস্তিন বিষয়ে বিশ্বব্যাপী নতুন চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘটিত হয় ফিলিস্তিনের সত্যিকারের মুক্তিবাহিনী ‘হামাস’। যাদের লক্ষ্য একটাই, অবৈধ ইসরাইলকে নির্মূল করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তৈরি করা এবং বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত করা। ফিলিস্তিনের সাথে স¤পৃক্ত রয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ লেবানন। সেখানে রয়েছে ফিলিস্তিনের লক্ষ লক্ষ শরণার্থী, যারা বহুযুগ ধরে সে দেশে অবস্থান করছে। এ সময়ে লেবাননে সংগঠিত হয় বিপ্লবী নেতা হাসান নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে ‘হিজবুল্লাহ’। যাদের লক্ষ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনে সহযোগিতা করা এবং ইসরাইলকে ধ্বংস করা। বিগত ৭২ বছরের ইতিহাসে আমরা দেখেছি অভিশপ্ত ইসরাইলিরা হামাস ও হিজবুল্লার কাছে একাধিকবার মার খেয়েছে, পরাজিত হয়েছে এবং তাদের অগ্রযাত্রা সীমিত হয়ে গেছে । শুধু সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা এবং তার দোসররা আর কিছু সংখ্যক রাজতান্ত্রিক আরব রাষ্ট্র ওদেরকে অক্সিজেন দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে মাত্র। ইসরাইলের নতুন প্রজন্মের মধ্যেও তাদের অস্তিত্ব এবং কার্যক্রম নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে শত প্রতিকূলতা ও অবরোধের মধ্যেও ফিলিস্তিনের একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সফলতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। সেদিন বেশি দূরে নয় বিশ্ব মুসলিমের সহায়তায় হামাস ও হিজবুল্লাহ সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট অবৈধ বায়োবীয় রাষ্ট্র ইসরাইলকে ধ্বংস করে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করবে এবং আমাদের প্রথম কেবলা পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করবে ইনশাআল্লাহ।
সে লক্ষ্যে বিশ্বের প্রতিটি তাওহিদী মুসলিম এর দায়িত্ব হচ্ছে ফিলিস্তিনের এই মুক্তি সংগ্রামে হামাসকে সমর্থন দেয়া, হিজবুল্লাহকে সমর্থন দেয়া। পাশাপাশি ওই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে মিলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ ইসরাইলের বন্ধু ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। আল-কুদস দিবসের আহ্বান হচ্ছে এই ঘোষণাকে সমস্ত মুসলমানের কানে পৌঁছে দেয়া।
আল-কুদস দিবসের প্রাক্কালে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ইরানের তারিকুল কুদস ফোর্স এর কমান্ডার বীর মুজাহিদ শহীদ কাশেম সোলাইমানিকে। হিজবুল্লাহ ও হামাস সংগঠন এবং এদের অগ্রযাত্রায় যিনি নেপথ্যে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।
আল কুদস দিবস জিন্দাবাদ, ফিলিস্তিন স্বাধীন হোক, বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত হোক।
সাবেক অধ্যক্ষ ও স¤পাদক, দৈনিক আজকের ভোলা
ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশ