শনিবার, ৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৫শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

পোস্ট হয়েছে: জুলাই ২৭, ২০২৩ 

news-image

শহীদ সম্রাটের শাশ্বত মহাবিপ্লব-৪ (নেতৃত্ব ও জিহাদ সম্পর্কে ভুল ধারণা)

কারবালায় মহানবীর (সা) একদল বিভ্রান্ত উম্মতের হাতে নবীজির প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ) ও নবী পরিবারের সদস্যসহ তাঁর অনুগত প্রায় ৭২ জনের বীরত্বপূর্ণ ও করুণ শাহাদাত চিন্তাশীল মহলে সব যুগেই সৃষ্টি করেছে নানা প্রশ্ন ও মহাবিস্ময়।

কথিত মুসলমানদের হাতে বা বিভ্রান্ত মুসলমানদের হাতে এমন ঘটনা কিভাবে ঘটতে পারলো তার রহস্যের নানা শেকড় অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিশ্লেষকরা দেখেন যে সত্যিকারের ইসলামী চিন্তা, ইসলামী নেতৃত্ব ও জিহাদ সম্পর্কে উম্মতের এক বিশাল বা বেশিরভাগ অংশের মধ্যেই নানা ভুল ধারণা বদ্ধমূল হয়ে পড়েছিল। দামেস্ক-কেন্দ্রিক কথিত ইসলামী খেলাফত হয়ে পড়েছিল অনাচার, বৈষম্য ও জাহেলি যুগের মত গোত্রবাদী প্রাধান্যে পরিপূর্ণ এক ভারসাম্যহীন সমাজ। এ সমাজে জাহেলি যুগের সব বাতিল প্রথা ও অনৈসলামী রীতির কর্তৃত্ব আবারও ফিরে আসে।

এ ছাড়াও সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ সংক্রান্ত ইসলামী নীতির বিষয়টি মানুষ পুরোপুরি ভুলে না গেলেও ব্যাপক মিথ্যাচার বা মিথ্যার বেসাতির কারণে সত্য ও মিথ্যা বোঝা অনেকের জন্যই কঠিন হয়ে পড়েছিল। কারণ উমাইয়া শাসকরা নবী বংশের প্রতি গালিগালাজ ও লা’নত বর্ষণ করাকে অন্যতম ফরজ কাজে পরিণত করেছিল।

এভাবে মহানবীর ওফাত-পরবর্তী যুগে শাসকগোষ্ঠীর এক শ্রেণীর উদাসীনতা ও উমাইয়া শাসকদের মিথ্যা প্রচারণার কারণে জনগণের ও সরকারি কর্মী বাহিনীর এক বড় অংশের মধ্যেই সঠিক নেতৃত্বের ধারণা বিলুপ্ত হয়। অবস্থা এতটা শোচনীয় হয়েছিল যে, যখন উমাইয়্যা শাসনের পতন ঘটে ও আব্বাসীয় খলিফা আবুল আব্বাস সাফফাহ্ শামের ক্ষমতা দখল করে, তখন আবদুল্লাহ্ ইবনে আলী, শাম বাহিনীর নেতৃস্থানীয়দের ধরে সাফফাহ্‌র কাছে নিয়ে যায়। সে সময়ে তারা সবাই কসম করে বলতে থাকে যে, তারা বনি উমাইয়্যা ছাড়া কাউকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)- এর পরিবারের সদস্য তথা তাঁর আহলে বাইত  হিসেবে চিনত না! রাসূলের (সা.) নামের ব্যাপক প্রসিদ্ধি মুয়াবিয়ার অন্তরকে অগ্নি অপেক্ষা বেশী দগ্ধ করত ! কারণ রাসুলের কারণেই বদর যুদ্ধে তার ভাই, মামা, দাদা এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজন নিহত হয়েছিল।

কারবালায় দুই পক্ষের রণসজ্জার আর্ট ছবি

উমাইয়া শাসক মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান কুরাইশ হাশিমি বংশ ও ইসলামের প্রতি নিজের বংশগত বা গোত্রীয় বিদ্বেষের ধারাবাহিকতায় মহানবীর অনন্য সম্মানিত নামটিকে দাফন করতে চেয়েছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্যে দু’টি পরিকল্পনা করেছিলেন ! মুয়াবিয়ার প্রথম পরিকল্পনাটির লক্ষ্য ছিল “বনি হাশিম বংশের একজন লোকও যেন জীবিত না থাকেন !” এ সম্পর্কে আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আ.) স্বয়ং বলেছেন : “আল্লাহর কসম ! মুয়াবিয়ার কামনা বাসনা হচ্ছে এই যে, বনি হাশিম বংশের একজন লোকও যেন জীবিত না থাকেন ! সে এর মাধ্যমে আল্লাহর নূরকে নিভাতে চায় ! কিন্তু মহান আল্লাহ্ নিজ নূরের পরিপূর্ণতা দান ব্যতীত কখনই সন্তুষ্ট হবেন না, যদিও কাফিররা তাঁর ইচ্ছার বাস্তবায়নে সন্তুষ্ট হবে না।!

মুয়াবিয়া মহানবীর (সা) প্রতি বিদ্বেষের কারণেই তাঁর নামে নানা জাল হাদিস বানিয়ে রাসুলের মর্যাদাকে এক সময় নানা পাপাচারে লিপ্ত ও পরবর্তীকালে সাহাবায় পরিণত হওয়া অনেক বিতর্কিত নেতার সমপর্যায়ে নামিয়ে আনার চক্রান্ত করেছিল। একই ধরনের বিদ্বেষ নিয়ে মুয়াবিয়া হযরত আলীর উপর অভিসম্পাত করাকে জুমা’আর নামাযের খুৎবার আবশ্যিক অংশ হিসেবে মুসলমানদের মাঝে প্রচলন করে !মুয়াবিয়া মুসলমানদেরকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলেন যে, ধার্মিকতা হচ্ছে যে কোনো পন্থায় তথা অবৈধ পন্থায় খেলাফত দখল-কারী শাসকদের অন্ধ আনুগত্য করা, আর এই কারণেই মুয়াবিয়া ও পরবর্তী কথিত খলীফারা যা কিছু আদেশ দিতেন, মুসলমানরা তারই আনুগত্য করত। শুধু এই কারণেই মুয়াবিয়া প্রকাশ্য পাপী ও মদ্যপায়ী ইয়াজিদের প্রতি মুসলমানদের বেশিরভাগের কাছ হতেই বাইআত ও তার খেলাফতের পক্ষে আগাম স্বীকারোক্তি নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুসলমানদের এমন মহাবিচ্যুতির বিষয়ে রাসূল (সা.) আগেই সংবাদ দিয়েছিলেন।  তিনি বলেছিলেন : আমার উম্মতের মধ্যে এমন একটি সময় আসবে যে, তখন নাম ছাড়া ইসলামের এবং কাগজের পৃষ্ঠায় লিখিত রূপ ছাড়া কুরআনের কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।” হ্যাঁ, ইসলামী সমাজ ও মুসলিম জনগণ এমন অবস্থার মধ্যেই জীবনযাপন করছিল, ফলে ষাট হিজরিতে মুয়াবিয়া মারা গেলে মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার সুযোগ পায়।

উমাইয়া শাসনের প্রভাবে মুসলমানদের বেশিরভাগেরই আক্বীদা বিশ্বাস এমনই বিকৃত হয়েছিল যে, তারা ভাবতো ধর্ম হলো তা-ই যা ক্ষমতাসীন শাসক বলবেন। তাহলে এই অবস্থায় ইসলামের কী কিছু অবশিষ্ট থাকবে?! এই অবস্থার বর্ণনা, হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) বক্তব্যে কতকটা ফুটে উঠেছে: মদিনায় তিনি তাঁর ভাই মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়্যাকে তাঁর স্বহস্তে লিখিত যে অসিয়ত নামাটি দিয়েছিলেন, তার প্রারম্ভে বলেন : নিশ্চয়ই হুসাইন এই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই ও মুহাম্মাদ হচ্ছেন আল্লাহর দাস ও রাসুল।  তাঁর অসিয়তনামার শুরুতে তিনি এইটি বলেন যাতে তাঁর মৃত্যুর পর লোকেরা না বলে যে, আলীর পুত্র হুসাইন একজন বিদ্রোহী ছিলেন এবং তিনি মুসলমানদের খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দ্বীন হতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন! তাই তিনি আরও লিখেনঃ আমি নিছক বিদ্রোহের উদ্দেশ্যে, শখের বশে বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির লক্ষ্যে বের হই নি। বরং আমি আমার নানাজানের উম্মতকে সংশোধনের জন্যে বের হয়েছি।  “আমি আমার নানাজান (সা.) এবং আমার পিতা আলীর (আ.) পথের অনুসরণ করতে চাই।” #

পার্সটুডে