সোমবার, ৩রা মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে আমরা : এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ৯, ২০২১ 

সিরাজুল ইসলাম –

আর ক’দিন পরেই বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা রাখবে। আমরা এমন একটি ধাপে পৌঁছাব যার নাম ‘সুবর্ণজয়ন্তী’। বড় কাক্সিক্ষত সময় বটে। স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী! এ এক ইতিহাস, একটি মাইল ফলক। সুবর্ণজয়ন্তীতে জেগে উঠবে পুরো দেশ। উদ্যাপিত হবে নানা কর্মসূচি। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বছরব্যাপী নানা আয়োজনে উদ্যাপন করবে আমাদের এ সুবর্ণজয়ন্তী।
৫০ বছর মানে বেশ একটা লম্বা সময়। আমরা যখন সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করব তার মানে হবে বাংলাদেশ পেছনে ফেলে এসেছে ৫০টি বছর। অর্থাৎ তখন আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছরে। স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে পদার্পণ করার মধ্য দিয়ে আমরা একটি বিশেষ মাইল ফলক পার করব। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আরো পরিপক্ব হয়ে উঠবে। আমরা জাতি হিসেবে নিজেদেরকে আরো গুছিয়ে নেব। আমাদের হিসাবের খাতায় কত যোগ-বিয়োগ হবে। কত কাটাকাটি হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের হাত ধরে আমরা এই যে দীর্ঘ সময় পার করে এলাম, এ সময়ে আমরা কী পেয়েছি আর কী পাই নি, সঙ্গত কারণেই সে হিসাবও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় অর্জন কী? নির্দ্বিধায়, নিঃশঙ্কচিত্তে আমি বলব স্বাধীনতা প্রাপ্তিই আমার সবচেয়ে বড় অর্জন। এই অর্জনের মধ্য দিয়ে আজ আমি ও আমরা স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে বেড়ে উঠেছি, আমরা স্বাধীন ভূখ- পেয়েছি, পেয়েছি লাল-সুবজের প্রিয় পতাকা। এর চেয়ে আর কী চাই? তবু প্রাপ্তির হিসাব আসবেই। বেশ, তবে আসুন স্বাধীনতার প্রাপ্তির খাতগুলোতে নজর বুলাই।
যে পাকিস্তানের বৈষ্যমের অসহায় শিকার হয়ে আমরা স্বাধীনতার পথ বেছে নিয়েছিলাম সেই পাকিস্তান এখন প্রায় সমস্ত উন্নয়ন সূচকে আমাদের পেছনে। বাংলাদেশের গড় আয়ু (৭৩.৪) ছাড়াও অন্যান্য সামাজিক খাতে দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটির অর্জন রীতিমত ঈর্ষণীয়। শুধু কী তাই? দেখুন না আমাদের বিজ্ঞানী মেয়ে তনিমা তাসনিম অনন্যা এখন বিশ্বের সেরা ১০ বিজ্ঞানীর একজন। এটা কী কম পাওয়া? স্বাধীনতা না এলে এই অর্জনে কী আমরা এতটা বুক ফুলিয়ে বলতে পারতামÑ তনিমা আমাদের গর্বের ধন? তনিমার কথা যখন চলেই এলো তাহলে একটু সামান্য বিস্তারিত জানা যাক তার সম্পর্কে।
কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। কৃষ্ণগহ্বরগুলো কীভাবে বেড়ে ওঠে এবং পরিবেশে কী প্রভাব রাখে তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র এঁকে দেখিয়েছেন তিনি। ইতোমধ্যে এ কাজের জন্য বিশ্বের সেরা ১০ বিজ্ঞানীর তালিকায় তাঁর নাম উঠেছে। তিনি একজন বাংলাদেশি তরুণী। নাম তনিমা তাসনিম অনন্যা।
২৯ বছর বয়সী এই তরুণী আমেরিকার ডার্টমাউথ কলেজের সঙ্গে যুক্ত। ওয়াশিংটনভিত্তিক সায়েন্স নিউজ নামের একটি গণমাধ্যম সম্প্রতি তনিমা তাসনিমের এ সফলতার কথা জানায়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ‘এসএন টেন : সায়েন্টিস্ট টু ওয়াচ’ নামের একটি তালিকা প্রকাশ করে গণমাধ্যমটি। যেখানে তাসনিমের কাজকে ‘অসাধারণ গবেষণা’ বলে উল্লেখ করা হয়।
এ তো গেল একজন তনিমার কথা। এবার জানা যাক আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা। দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য আমাদের সামনে রয়েছে এলএনজি টার্মিনাল, স্পেশাল ইকোনমিক জোন, মাতারবাড়ি এনার্জি হাব, গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম ইকোনমিক করিডোরের জন্য হাইস্পিড রেল, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের জন্য চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন, উপকূলীয় মহাসড়ক নির্মাণ, আইসিটি সেক্টরে উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টির পরিকল্পনা। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন হাব গড়ে তোলার মাধ্যমে অন্যরকম এক বাংলাদেশ উপহার দিতেও কাজ করছে সরকার। এরই মধ্যে অনেক স্বপ্নের পদ্মাসেতু দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ঢাকার বুকে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে মেট্রোরেল।
উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ : স্বল্পোন্নত বা এলডিসি থেকে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতি সংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোন দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদ-েই উন্নীত হয়েছে।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদ- অনুযায়ী এক্ষেত্রে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২০৬৪ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ প্রয়োজনের চেয়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় অনেক বেশি। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দমমিক ৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ ভাগ।
‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণÑ যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার ইতিহাস’। সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের এটি একটি বড় অর্জন।
বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় যোগ হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের সফলতাও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পগুলো।
দারিদ্র দূরীকরণ : ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র দূরীকরণে তার ভূমিকা, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেয়া এই বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে আসতে অতিক্রম করতে হয়েছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮টি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা, শিশুমৃত্যুহার কমানো এবং দারিদ্র হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের করা মন্তব্য এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। তাঁর মতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেয়ার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। বিশেষত শিক্ষা সুবিধা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার ও জন্মহার কমানো, গরিব মানুষের জন্য শৌচাগার ও স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান এবং শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম অন্যতম।
শিক্ষাখাতে অর্জন : শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলোর অন্যতম হলো শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম। নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি ব্যবস্থা। বর্তমান ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা ৯৭.৭ ভাগে। শিক্ষার সুবিধাবঞ্চিত গরিব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট আইন প্রণয়ন করা হয়েছে; গঠন করা হয়েছে ‘শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট’।
স্বাস্থ্যসেবায় সাফল্য : শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে তার স্থান করে নিয়েছে। স্বাস্থ্যখাতকে যুগোপযোগী করতে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা-২০১১’। তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে ১২ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক। ৩১২টি উপজেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে ৫০ শয্যায়। মেডিক্যাল কলেজ ও জেলা হাসপাতালগুলোতে ২ হাজার শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার এবং জন্মহার হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৯০ সালে নবজাতক মৃত্যুর হার ১৪৯ থেকে নেমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৫৩-তে। স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ১২টি মেডিক্যাল কলেজ, নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৪৭ হাজারেও বেশি জনশক্তি।
নারী ও শিশু উন্নয়ন : নারীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১’। নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি কার্যক্রম। সমাজের প্রতিটি স্তরে নারী অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে নেয়া হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। প্রযুক্তি জগতে নারীদের প্রবেশকে সহজ করতে ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রের মতো ইউনিয়নভিত্তিক তথ্যসেবায় উদ্যোক্তা হিসেবে একজন পুরুষের পাশাপাশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে একজন নারী উদ্যোক্তাকেও। ‘জাতীয় শিশু নীতি-২০১১’ প্রণয়নের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে শিশুদের সার্বিক অধিকারকে। দেশের ৪০টি জেলার সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপন করা হয়েছে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল। দুঃস্থ্, এতিম, অসহায় পথ-শিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের নারী ও শিশুর উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভূষিত করা হয়েছে জাতিসংঘের ‘সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ডে’।
নারীর ক্ষমতায়ন : নারী বঞ্চনার তিক্ত অতীত পেরিয়েছে বাংলাদেশ। নারীর ক্ষমতায়নে দেশ এখন অনেক দূর এগিয়েছে। পোশাকশিল্পে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ। আর এই শিল্পের সিংহভাগ কর্মী হচ্ছে নারী। ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশে গ্রামীণ উন্নয়নে ও নারীর ক্ষমতায়নে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছে। আর ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে ৮০% এর ওপর নারী। শুধু কী তাই? এনজিওগুলো যে ঋণ বিতরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে তার অগ্রভাগে রয়েছেন নারী কর্মী; ঋণ বিতরণকারীদের বড় অংশই নারী। মোট কথা বাংলাদেশ সরকার নানাভাবে নারী উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন : ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিতে বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব পদক্ষেপ। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেয়ার অভিপ্রায়ে দেশের ৪,৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫,০০০। দেশের সবক’টি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়। টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা ১২ কোটি ৩৭ লাখ এবং ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ৪ কোটি ৪৬ লাখে উন্নীত হয়েছে। সেবাপ্রদান প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করতে চালু করা হয়েছে ই-পেমেন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিং। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া অনলাইনে সম্পাদন করার বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। ৪-জি প্রযুক্তির মোবাইল নেটওয়ার্কের বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে; দেশ এখন ৫-জি’র নেটওয়ার্ক গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের সব প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয় নি তবে দেশ সে পথে এগিয়ে যাচ্ছে বেশ ভালোভাবেই।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা : কৃষিখাতে অভূতপূর্ব কিছু সাফল্যের জন্য বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ বারবার আলোচিত হয়েছে। প্রায় ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক টন। প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম আবিষ্কার করেছেন পাটের জিনোম সিকুয়েন্সিং। সারা বিশ্বে আজ পর্যন্ত মাত্র ১৭টি উদ্ভিদের জিনোম সিকুয়েন্সিং হয়েছে, তার মধ্যে ড. মাকসুদ করেছেন ৩টা। তাঁর এই অনন্য অর্জন বাংলাদেশের মানুষকে করেছে গর্বিত।
জনশক্তি রপ্তানি খাতে উন্নয়নে অর্জন : বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৮৬ লাখেরও অধিক শ্রমিক কর্মরত আছে। বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ স্থাপন করেছে অনন্য দৃষ্টান্ত। স্বল্প সুদে অভিবাসন ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক স্থাপন করে দেশের ৭টি বিভাগীয় শহরে এর শাখা স্থাপন করা হয়েছে। এই ব্যাংকের মাধ্যমে এপ্রিল ২০১৪ পর্যন্ত ২০ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা অভিবাসন ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারাদেশে তৃণমূল পর্যায় থেকে বিদেশ গমনেচ্ছু জনগণকে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণকেও এ সেবা গ্রহণের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের হয়রানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ : ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগদানের পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের ৩৯টি দেশের ৬৪টি শান্তি মিশনে খ্যাতি ও সফলতার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এ যাবৎকালে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ১১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বাগ্রে। এ অর্জন বাংলাদেশকে বিরাটভাবে সম্মানিত করেছে।
বিদ্যুৎখাতে সাফল্য : বিদ্যুৎখাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে রয়েছে জাতীয় গ্রিডে অতিরিক্ত ৬ হাজার ৩২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোজন যার ফলে বিদ্যুতের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৭ শতাংশ থেকে ৬২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একই সাথে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা থেকে বেড়ে ৩৪৮ কিলোওয়াট ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে ৩৫ লাখ গ্রাহককে। নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ৬৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিশাল জনগোষ্ঠীর বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে যদিও এখনো পুরোপুরি সম্ভব হয় নি তবে দেশ এ খাতে অনেক এগিয়েছে। সাফল্যের এই ধারা অব্যাহত থাকলে শিগগিরিই দেশ বিদ্যুতের অভাবমুক্ত হবে।
শিল্প ও বাণিজ্য খাতে অর্জন : বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের পাশাপাশি প্রসার ঘটেছে আবাসন, জাহাজ, ওষুধ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য শিল্পের। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যোগ হয়েছে জাহাজ, ওষুধ এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী। বাংলাদেশের আইটি শিল্প বহির্বিশ্বে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। বাংলাদেশের আইটি শিল্প এখন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অর্জন : হতদরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করা হয়েছে। এজন্য বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত ও দুঃস্থ মহিলা ভাতা, অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃকালীন ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সময়ের ব্যবধানে এসব ভাতার হার ও আওতা ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। ২০০৮-২০০৯ সালে এই খাতে মোট বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এটি বাজেটের ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আগের অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৮১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। খানা আয়-ব্যয় জরিপের সমীক্ষায় দেখা যায় মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ ভাগের কাছাকাছি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতাভুক্ত হয়েছে।
ভূমি ব্যবস্থাপনায় অর্জন : ভূমি ব্যবস্থাপনাকে আধুনিকায়ন করতে ৫৫টি জেলায় বিদ্যমান মৌজা ম্যাপ ও খতিয়ান কম্পিউটারাইজেশনের কাজ সম্পন্ন করার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। ভূমির পরিকল্পিত ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে মোট ২১টি জেলার ১৫২টি উপজেলায় ডিজিটাল ল্যান্ড জোনিং ম্যাপ সম্বলিত প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রণীত হয়েছে ‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন, ২০১২ এর খসড়া’। এখন ইচ্ছা করলেই আর ভূমির যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারবে না।
মন্দা মোকাবেলায় সাফল্য : মন্দার প্রকোপে বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত ছিল বাংলাদেশ তখন বিভিন্ন উপয্ক্তু প্রণোদনা প্যাকেজ ও নীতি সহায়তার মাধ্যমে মন্দা মোকাবেলায় শুধু সক্ষমই হয় নি; বরং জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ শতাংশের বেশি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির শ্লথ ধারার বিপরীতে আমদানি-রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে রেমিট্যান্সের পরিমাণ। ঋণ পরিশোধে সক্ষমতার মানদ-ে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের সমকক্ষতা অর্জিত হয়েছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মহামারিতে বিশ্ব যখন দারুনভাবে বিপর্যন্ত তখনো আমাদের গার্মেন্টস খাত লাভজনক অবস্থানে রয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। এ বছরই বাংলাদেশ বিশ্বে মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে।
শেষ কথা : স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ ধীরে ধীরে যেসব সাফল্য অর্জন করেছে তার পেছনে সরকারের যেমন অবদান রয়েছে তেমনি অবদান আছে সাধারণ মানুষেরও। দেশের উন্নতির বিরাট অংশেই রয়েছে বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ। সেক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ যদি আরো বেশি কার্যকর করা যায় তবে দেশের উন্নয়ন কাক্সিক্ষত মাত্রা স্পর্শ করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতি, অনিয়ম ও সম্পদের অপব্যবহার রোধ করা গেলে উন্নয়নের গতি যেমন বাড়বে তেমনি টেকসই উন্নয়নও নিশ্চিত হবে। সুশাসন ও গণতন্ত্রায়নে যেসব সংকট আছে সেগুলো দূর করারও উদ্যোগ অনেক বেশি জরুরি। এতে দেশ ও দেশের মানুষ লাভবান হবে; তাতে সরকারের নেয়া নানা প্রকল্প ও রূপকল্প বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে আর আমরা বিশ্ব দরবারে আরো শক্তভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।