সুফিবাদের উৎস সন্ধান ও বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
পোস্ট হয়েছে: এপ্রিল ৩০, ২০২৫

ড. সাইফুল ইসলাম খান : ইসলামের আধ্যাত্মিক জগতের অতিপরিচিত বিষয় এলমে তাসাওউফ বা সুফিবাদ। বাইরের কোনো চিন্তাধারা থেকে কিংবা অন্য কোনো ধর্মের সংমিশ্রণে এর আবির্ভাব ঘটেনি। পবিত্র কুরআনের মর্মবাণী এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মহান বাণী ও পবিত্র জীবন আচরণ থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে। পবিত্র কুরআন মানবজাতির শুধু জীবন-বিধান নয়, জীবন-দর্শনও বটে। তাই এ জীবন-দর্শনের সূক্ষ্ম তত্ত্ব থাকাটাই স্বাভাবিক এবং প্রত্যেক ব্যক্তিই তা অনুধাবন করতে পারেন। আর এজন্যই পবিত্র কুরআনে বহুবার এসেছে ‘তত্ত্বজ্ঞানীদের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন’ (সূরা আররা’দ, আয়াত, ১৯)। সূরা আলহিজর এর ৭৫ নম্বর আয়াতে একটি বিশেষ ঘটনা উল্লেখের পর আল্লাহ বলছেন, ‘নিশ্চয়ই এতে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন-চিন্তাশীল মানুষদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ সুফিবাদের নির্যাস হলো একত্ববাদকে দেখা, একত্ববাদকে জানা এবং একত্ববাদের হাকিকতের উপর বেঁচে থাকা। হিজরি ৮ম শতকের পারস্যের বিখ্যাত সাধক ও সুফি শেখ মাহমুদ শাবেস্তারি তাঁর বহুল পরিচিত ‘গুলশানে রায’ (রহস্যের বাগান) গ্রন্থে বলেন, ‘এককেই দেখো, এককেই বলো, এককেই জানো, এভাবেই অর্জন হবে তোমার ঈমানের মূল ও শাখা।’
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন প্রজ্ঞার আধার। জগৎ, জীবন ও সৃষ্টিকৌশল নিয়ে তিনি নির্জন নিশিথে আত্মবিভোর হয়ে যেতেন। তাঁর বহু হাদিস শরীফ রয়েছে যা নিগুঢ় তত্ত্বজ্ঞান ছাড়া সাধারণভাবে বুঝা প্রায় অসম্ভব। তিনি এরশাদ করেন : ‘আমলসমূহের মধ্যে আল্লাহর পরিচয় জ্ঞান জানা উত্তম আমল। কেননা, আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কের জ্ঞান তোমার আমল কম বা বেশি যাই হোক তাতে বরকত দান করে। বিপরীতে আল্লাহ তাআলার পরিচয় জ্ঞানের অজ্ঞতা, না তোমাকে অল্প আমলে, না তোমাকে বেশি আমলে বরকত ও কল্যাণ দান করে। (কানযুল উম্মাল, ১০ম খ-, পৃষ্ঠা ১৪৩)
সুফিবাদে ইসলামের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অবস্থার সমন্বয়ে গঠিত এবং মানবচরিত্র ঘনিষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ম ও রীতি আবশ্যিকভাবে পালনীয় ও অনুসরণীয়। এর মধ্যে রয়েছে আত্মসমর্পণ, তওবা, আনুগত্য, ঐকান্তিকতা ও অনুরাগ, ধৈর্য, উদারতা, যিকির, সংগীত, আধ্যাত্মিক জ্ঞান, আধ্যাত্মিক রহস্য সন্ধান, তাকওয়া, এখলাস, তাওয়াক্কুল, এশকে এলাহি, কাশফ, হাল, ফানা ও বাক্বা ইত্যাদি। এই নীতিমালার অনুশীলনের মাধ্যমে আল্লাহ পাকের সান্নিধ্য লাভ করা সহজ হয়।
তাই সুফিবাদ ইসলামের নিজস্ব সম্পদ এবং ইসলামি শরিয়তের আওতায় আপন স্বকীয়তায় উদ্ভাসিত হয়ে যুগে যুগে উন্নতির শিখরে আরোহণ করে মুসলিম দর্শনকে সারা বিশ্বের কাছে হৃদয়গ্রাহী ও অনুকরণীয় করে তুলেছে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত অনেক রহস্যাবৃত ঘটনা ও আয়াতে সুফি দর্শনের বীজ প্রোথিত।
সৃষ্টিগতভাবে মানুষ এক একক ও অভিন্ন বৈশিষ্ট্যম-িত এক মহান অস্তিত্ব। তার এই অস্তিত্বে বহু অস্তিত্বের অবস্থান ও দিক বিদ্যমান। আমরা যখন বলি, ‘আমি একজন মানুষ’, সাথে সাথে আমার সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে আমার চিন্তার জগৎ, আমার আশা-প্রত্যাশার জগৎ, আমার ভয়-ভীতির জগৎ, আমার ভালোলাগা না-লাগার জগৎ, আমার ভালোবাসা ভালো না-বাসার জগৎ ইত্যাদি। এসব মানব অস্তিত্বের বিষয়াদি যেন হাজারো নদী ও জল প্রবাহ হয়ে অসীম এক মোহনায় মিলিত হয় এবং এক মহাসমুদ্রের জন্ম দেয়। এ মহাসমুদ্রের গভীরতার তথ্য ও তত্ত্ব নিয়ে আজো কোনো মানবসন্তান দাবি করতে পারেননি যে, এ সম্পর্কে তিনি কোনো পূর্ণতা লাভ করেছেন। দার্শনিক, আধ্যাত্মিক সাধক ও মনোবিজ্ঞানীর মতো ধ্যানী, জ্ঞানী ও বিজ্ঞানী সাধক শ্রেণি তাঁদের নিজ নিজ জ্ঞান ও প্রতিভা নিয়োগে এই গভীর মহাসমুদ্রের ডুবুরি হয়ে এর সীমিত রহস্যই উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে আরেফ ও আল্লাহ তাআলার ওলি-আউলিয়াগণ এক্ষেত্রে অধিকতর সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
পবিত্র কুরআনুল কারীমে ‘ক্বালব’ বলতে যা বোঝানো হয়েছে মানব দেহের অস্তিত্বে লুক্কায়িত সেই মহাসমুদ্রকে আমরা পবিত্র কুরআনুল হাকীমে বর্ণিত রূহ হিসেবে অনুধাবন করি। আল্লাহ তাআলা সূরা আল-হিজরের ২৯ নম্বর আয়াতে বলেন : ‘যখন আমি তাকে সুগঠিত পূর্ণ আকৃতি দান করব এবং তাতে আমার রূহ থেকে ফুঁক দেব, তখন তোমরা তার সামনে সেজদায় পড়ে যেও।’ সূরা বনী ইসরাইলের ৮৫ নম্নর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘(হে নবী!) তারা তো আপনাকে রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। আপনি বলে দিন, রূহ হলো আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে একটি নির্দেশ (মহাশক্তি)। আর (এ সম্পর্কিত) জ্ঞানের খুব সামান্য অংশই তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছে।’ মানব অস্তিত্বে আল্লাহ তায়ালার মহাপবিত্র যাত থেকে এটি এক মহাশক্তি ও মহাবিস্ময়। মহাজ্ঞান, অসীম প্রজ্ঞা ও গুণের মহান ধারক এই আদম সন্তান। আমরা মানব অস্তিত্বের বাহ্যিক রূপ ও সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হই, অনেক সময় নিজেকে হারিয়ে ফেলি। অথচ এই ক্ষণস্থায়ী ও ক্ষণভঙ্গুর দৃশ্যমান মানবকাঠামোর ভেতরে যে মহাশক্তি ও মহাপবিত্রের বসবাস এবং সেটি যে প্রতিক্ষণে প্রতি মুহূর্তে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পাকের সাথে সংযুক্ত, দুনিয়ার মোহ আর শয়তানের নানাবিধ প্রলোভন-প্ররোচনায় মানুষ তা বেমালুম ভুলে থাকেন। হযরত জালালুদ্দিন রুমি মানুষের এই বেদনার্ত ও করুণ পরিণতিকেই ভয়ানক বন্দিশালা হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ইসলামে এলমে তাসাউফ ও এলমে মারেফাত চর্চা ও অনুশীলনে আল্লাহ তাআলার বাণী- ‘আল্লাহর রঙে রঙিন হও। আল্লাহর রঙের চেয়ে সুন্দর রঙ আর কার হতে পারে? আমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করি’ (সূরা আল-বাক্বারাহ, আয়াত ১৩৮), অনুধাবন করে বুঝতে পারি আল্লাহ তাআলার সাথে বান্দার সম্পর্ক ও বান্দার উপর তাঁর প্রভাব কত গভীর, কত নিবিড় ও কত অকল্পনীয়। এ প্রকৃতির বান্দাগণ আল্লাহ তাআলার ওলি বা আপন বন্ধুতে পরিণত হন। এদের সম্পর্কেই পবিত্র কুরআনুল কারীমের সূরা ইউনূসের ৬২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ‘জেনে রেখো! আল্লাহর ওলিগণের কোনো ভয় নেই এবং কখনো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হবে না।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসে কুদসিতে আল্লাহর ওলিগণের শান ও মর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন : ‘যে আমার ওলি বা বন্ধুর সাথে শত্রুতা করে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি।’ (বুখারি শরীফ, হাদিস নং ৬৫০২)
তাই একজন মানুষ পবিত্র শরিয়তের বিধিবিধান পূর্ণ প্রতিপালনের পরও প্রশ্ন থেকে যায় মানুষটি সার্বিক দিক বিবেচনায় পরিশুদ্ধ, পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হতে পেরেছেন কিনা। এ প্রশ্ন ও প্রত্যাশার আলোকেই নবী-রাসূলগণের নিকট প্রেরিত ঐশী বাণী ওহীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে উম্মত হয়েছেন সাহাবী হয়েছেন অনুসারী হয়েছেন। এসব হেদায়েতপ্রাপ্ত লোকদের মধ্যে সবকালেই এমনসব তাপস ধ্যানী জ্ঞানী সাধক বুজুর্গ আলেম ও পবিত্র কুরআনের পরিভাষা অনুযায়ী ওলি-আউলিয়ার আবির্ভাব ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। যাঁদেরকে আল্লাহ ও রাসূলের পর ‘সাদেক্বীন’, ‘উলুল আমর’ এবং ‘সালিহ’গণের দলভুক্ত করা হয়েছে সূরা আল ফাতিহায় এরাই হচ্ছেন নেয়ামতপ্রাপ্ত শ্রেণির একটি শ্রেণি। দুনিয়ার সকল প্রকার দায়িত্ব ও কর্ম প্রতিপালনে একজন আত্মশুদ্ধিপ্রাপ্ত ব্যক্তি যে পরিমাণ সততা ও পবিত্রতা নিয়ে মানবসেবায় সমৃদ্ধি দান করতে পারেন, অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য মানুষকে সে স্তরে নিয়ে যেতে পারে না। একজন মানুষের চিন্তার পরিশুদ্ধি ও আত্মশুদ্ধির মাত্রার অনুপাতই নির্ধারণ করে যে, তিনি কতটা দুর্নীতিমুক্ত ও সততানির্ভর কর্মজীবন পরিচালনা করতে পারবেন। পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে বহু রাজা-বাদশা তাঁদের কর্ম পরিচালনা ও রাজ্য শাসনে এসব ধ্যানী-জ্ঞানী ও ওলি-আউলিয়ার দ্বারস্থ ও শরণাপন্ন হয়েছেন। তাঁদের উপদেশ ও পরামর্শে অনেক ভুল কর্ম ও অকল্যাণ পদক্ষেপ থেকে জনগণ ও জনপদ রক্ষা পেয়েছে।
কালে কালে ও দেশে দেশে এই পথ পরিক্রমার যাঁরা সাথি হয়েছেন, মানবসভ্যতার ইতিহাসে তাঁরাই ওলি-আউলিয়া, সুফি-দরবেশ, গাউছ-কুতুব, পীর-মাশায়েখ ও মুরশিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে শুরু করে এই শ্রেণির মহান সাধকগণই শান্তির দ্বীন ও ধর্ম ইসলামের শিক্ষা, ইসলাম গ্রহণ এবং এর প্রচার ও প্রসারে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছেন।
আরবে সুফিবাদের উৎপত্তি ঘটলেও এর উৎকর্ষ সাধনে শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছেন পারস্যবাসিগণ। সেখানে অগণিত সুফি-দরবেশের আগমন ঘটেছে। সুফিবাদের ভিত্তি ছিল দারিদ্র ও নির্জনতা। অনুতাপ ও সাধনাকে অন্তর পরিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার প্রবেশ দ্বার হিসেবে বিবেচনা করা হতো, যাকে সুফিগণ সত্যজ্ঞানের উৎস বলে মনে করতেন। যিকির, বিশেষ করে সুপ্ত যিকির ছিল সত্যের সাথে স্থায়ীভাবে সংযুক্ত হওয়ার মাধ্যম, আর তাতে অবহেলা করাকে আত্মপ্রবঞ্চনা ও অমর্যাদাকর হিসেবে গণ্য করা হতো। যিকিরের বিষয়ে সতর্কতা, বিশেষ করে খানকাসমূহের গোপনীয়তায়, যিকিরকারীকে সত্যের পথ দেখাতো, যিনি একজন পীর বা মুরশিদের নেতৃত্ব সেই আলোর পথে প্রবেশ করতেন এবং তাঁর সুফি ভাবধারামূলক আচরণের পুনরাবৃত্তি ও অনুশীলন দ্বারা নিজেকে সেই উচ্চ মাকামের দিকে এগিয়ে নিতেন, যতক্ষণ না তাঁর সমগ্র অস্তিত্ব সত্যের প্রকাশে পরিপূর্ণ হতো। একজন মনীষী চিন্তা ও যুক্তির মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জন করেন, একজন সুফি নির্জনতার তপস্যা ও সাধনার মাধ্যমে সেই একই জ্ঞান লাভ করতে পারেন। জ্ঞানচর্চা ও যুক্তিবিদ্যার প্রতি এহেন অবজ্ঞা সুফিগণকে ফকিহ ও ধর্মতত্ত্ববিদদের দৃষ্টিতে তিরস্কারের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। সুফি ও মুসলিম প-িতদের মধ্যকার বিরোধিতা ও প্রত্যাখ্যানের সীমা এমনকি হত্যা পর্যন্ত গড়িয়েছিল, যার অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো হযরত মনসুর হাল্লাজ ও হযরত আইনুল ক্বুযাত হামেদানির শাহাদাত। তাঁরা উভয়েই মারাত্মক সংঘর্ষের শিকার হয়েছিলেন। সুফিগণ দার্শনিক যুক্তিকে অবজ্ঞা করেন, ‘অন্য’ ও ‘অদেখা’ সত্যের অস্তিত্বকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন এবং সেই সত্যকে পথপ্রদর্শক হিসেবে তুলে ধরে বাকি সবকিছুকে বিভ্রান্তিকর হিসেবে আখ্যা দেন। তাই সুফিদের ‘তরিকত’ এর সূচনা ‘শরিয়ত’ থেকে হলেও সেই সম্পর্ক কখনো কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না এবং সেই ‘পরম সত্য’ ব্যতীত আর কিছুর সাথেই এটি পুরোপুরি মিলে নাÑ না যুক্তি, না দর্শন। একজন সুফির মতে, প্রকৃত জ্ঞান হক্ব বা মহাসত্য, যা সত্য দিয়ে শুরু হয় সত্যের সাথেই শেষ হয়ে যায়। (যাররিন কূব, পৃ. ১৫৭)
বাংলাদেশে ‘সুফিবাদ’ ও ‘মরমিবাদ’ সুফিকেন্দ্রিক বহুল প্রচলিত দুটি শব্দ। অধিকাংশ মুসলমানের ধারণা যে, ইসলাম ধর্ম শরিয়ত ও তরিকতের মধ্যে নিহিত। সুফিবাদ শুধু তরিকতের মধ্যে নিহিত এবং সুফিবাদ শুধু তরিকতের সাথে সম্পৃক্ততা রাখেÑ শরিয়তের সাথে নয়। এটি সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা। বস্তুত সুফিবাদের প্রথম সোপান হলো শরিয়ত। শরিয়ত পালন না করে এলে সুফিবাদে প্রবেশ করা যায় না। (গনি : ২০১০, ৫৩)। ইসলামের সুফিদর্শনের প্রবর্তক হলেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনিই প্রথম ক্বলব বা আত্মার পরিশুদ্ধির কথা বলেছেন। এই শিক্ষা তিনি নিজ জামাতা হযরত আলী (রা.)-কে দিয়েছিলেন। যে কারণে হযরত আলী (রা.)-কে সুফিবাদের শেকড় বলা হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে হযরত ইমাম হাসান (রা.), ইমাম হোসাইন (রা.), হযরত হাসান বসরী (রা.) ও হযরত ওয়ায়েস করনি (রা.) তাসাউফশাস্ত্রের দায়িত্ব লাভ করেন। আরবে সুফিবাদের উৎপত্তি ঘটলেও এর উৎকর্ষ সাধনে শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছেন পারস্যবাসী। সেখানে অগণিত সুফি-দরবেশের আগমন ঘটেছে। এছাড়া পারস্যের কবি-সাহিত্যিক, ধর্মবিদ, দার্শনিক ও আলেমগণ এ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। বস্তুত এলমে তাসাওউফকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য পদ্য ও গদ্য সাহিত্যে পারস্যবাসীর অবদান বিরল। এসবের দুয়েকটি রচনা ব্যতীত সকল গ্রন্থই ফারসি ভাষায় রচিত। উদাহরণ হিসেবে গদ্য গ্রন্থের মধ্যে শেহাব উদ্দিন ইয়াহইয়া সোহরাওয়ার্দী রচিত ‘হিকমাতুল ইশরাক’, আবু সাঈদ আবুল খায়ের রচিত ‘আসরারুত তাওহীদ’, হাকীম সানায়ি রচিত ‘হাদীকাতুল হাকীকা’ ও হযরত খাজা আবদুল্লাহ আনসারী রচিত ‘কাশফুল আসরার’, ‘মোনাজাতে খাজা আবদুল্লাহ আনসারী’, হযরত ওসমান বিন আলী হুজবেরির ‘কাশফুল মাহজূব’, হযরত ফরিদ উদ্দিন আত্তারের ‘তাযকেরাতুল আউলিয়া’, হযরত জালালুদ্দিন রুমির ‘ফীহে মা ফীহে’ এবং হযরত শেখ সাদির ‘গুলিস্তানে সাদি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কাব্যগ্রন্থের মধ্যে হযরত বাবা তাহের ওরইয়ান রচিত ‘দিওয়ানে শে’রে বাবা তাহের’, হযরত ওমর খৈয়্যাম এর ‘রূবাইয়াত’, হযরত সানায়ি গযনবির ‘দিওয়ানে আশআরে সানায়ি’, হযরত ফরিদ উদ্দিন আত্তারের ‘মানতেক্বুত তায়ের’, হযরত জালালুদ্দিন রুমির ‘মসনভিয়ে মা’নাভী’ ও ‘দীওয়ানে শামস তাবরিযী’, হযরত শামসুদ্দিন মোহাম্মদ হাফিযের ‘দীওয়ানে হাফিয’, হযরত শেখ সাদির ‘বূস্তান’ ও ‘দীওয়ানে আশআরে সাদি’ এবং হযরত আব্দুর রহমান জামির ‘দীওয়ানে জামি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ভারত ও বাংলাদেশে সুফিবাদ
সুফিবাদ ব্যাপক অর্থে ইসলামের এলমে মারেফাত বা আল্লাহ তাআলার গভীর গুণবাচক ও প্রেমময় পরিচয় অনুধাবন ও এর শিক্ষার প্রচারের মাধ্যমে গত চৌদ্দশ’ বছরের অধিককাল ধরে আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর এবং মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত শান্তিময় ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটে। এছাড়া হিজরি দ্বিতীয় শতক বা আটশত খ্রিস্টাব্দ থেকে পৃথিবীর সকল মুসলিম জনপদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক, এমনকি রাজনৈতিক জীবনেও আধ্যাত্মিক এই দর্শনের প্রভাব ও গ্রহণীয়তা ইতিহাস স্বীকৃত। ইসলামের এই অন্তর্নিহিত ও মানবিক দর্শনের প্রভাব একদিকে যেমন ইসলামের সকল ভাবধারা ও সংস্কৃতিতে পড়েছে। অন্যদিকে শিল্প-সাহিত্য, দর্শন, স্থাপত্য ও সংগীতেও আপন মহিমায় প্রভাবিত হয়েছে। এলমে মা’রেফাতের গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক সাধনা হয়েছে আরবি, ফারসি, তুর্কি ও উর্দু ভাষায়। এক্ষেত্রে খ্রিস্টীয় সতেরো শতক থেকে ইংরেজি ভাষায় ইউরোপীয় চিন্তক, দার্শনিক ও কবি-সাহিত্যিক প্রাচ্যদেশীয় এ আধ্যাত্মিক দর্শন নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। যদিও এ সংশ্লিষ্ট অ্যারিস্টটলীয় দর্শনের সাথে তাঁদের পরিচয় ছিল অনেক প্রাচীন। কিন্তু এলমে তাসাওউফ এ আত্মশুদ্ধির গভীরতা ও এর সৌন্দর্য-রূপ তাঁদেরকে প্রভাবিত ও ভাবিত করেছে।
পবিত্র ইসলামের আবির্ভাবকালে যদিও ইরান ও পরবর্তীকালে যেসব দেশ আরব্য জনপদ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সেসব দেশে আরব সেনাপতিদের মাধ্যমে বিজয় অর্জিত হয়েছে, কিন্তু পরবর্তীকালে পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলে সেনাপতি নয়, বরং এলমে তাসাওউফ ও এলমে মা’রেফাত শিক্ষা, সুফিগণের জীবনাচরণ ও তাঁদের ইবাদতখানা ও খানকাসমূহের মাধ্যমে শান্তির ও মানবিক ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটেছে। এর ধারাবাহিকতায় ভারত উপমহাদেশ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম চীন, তুর্কি জাতিসমূহ, পূর্ব ইউরোপ ও পুরো আফ্রিকা মহাদেশে এই পথ ও পদ্ধতিতে ইসলাম প্রচার ও এর গ্রহণযোগ্যতার বিস্তার ঘটে। বর্তমানকালেও পশ্চিমা জগতে বিশেষ করে সেখানকার শিক্ষিত সমাজে সুফি দর্শনের প্রভাবে একদিকে যেমন ইসলাম সম্পর্কে ইতিবাচক সাড়া জেগেছে অন্যদিকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে সুফিবাদের চর্চা ও এর বিস্তার নিয়ে আলোচনা করার প্রেক্ষাপটে একটি বিষয় স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, প্রসঙ্গটি বর্তমান বাংলাদেশ এবং গত চুয়ান্ন বছরের স্বাধীন বাংলাদেশের তাসাউফ চর্চার গতি প্রকৃতি ও এর প্রভাব ও বিস্তৃতি বিষয়কে অবলম্বন করলে ঐতিহাসিকভাবে বিষয়ের প্রতি সুবিচার করা হবে না। কেননা, পূর্বেই বলেছি যে, ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবকালে সুফি ধারার উৎপত্তি ঘটেছে। বংগে সুফি ধারণাটিও নতুন রূপে আবির্ভূত হয়নি। আমরা যখন বংগ শব্দ বলছি তখন ভারত উপমহাদেশের তৎকালীন একটি বাংলা ভাষাভাষী বিশাল অঞ্চলকে বুঝি। বিশেষ করে বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম নিয়ে ছিল এর অবস্থান। তাই সুফিবাদের ধারাটি বংগে আসার পূর্বে আরব, পারস্য, বুখারা ও সমরকন্দে এ ভাবধারার পুষ্টি সাধিত হয় (হক, ২০০৬:১৯)। এরপর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিস্তার লাভ করে। অনেকেই মনে করেন, ভারতে ইসলামের এই সুফি ধারাটি অষ্টম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত উদ্ভব ও বিকাশ লাভ করে। ইতিহাসের সুদীর্ঘকালের পরম্পরায় পারস্যের প্রভাব ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান ছিল। তুর্কি-আফগান ও মোগল আমলে ভারতের সকল অঞ্চলের ন্যায় বংগীয় অঞ্চলে এর প্রভাব শক্তিশালী রূপ লাভ করে।
তাই বাংলাদেশে সুফিবাদ চর্চা ও এর বিস্তার পুরো ভারত উপমহাদেশের মতোই। ইতিহাসবিদগণের মতে ভারত হলো সুফিবাদের পাঁচটি প্রধান কেন্দ্রের একটি। বাকি চারটি হলো পারস্য বা ইরান, এখানে মধ্য এশিয়াও অন্তর্ভুক্ত, বাগদাদ, সিরিয়া ও উত্তর আফ্রিকা। বাংলাদেশে সুফিগণের ব্যাপক প্রভাব ছিল। ওলি-আউলিয়া ও পীর বুজুর্গগণের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে আজকের বাংলাদেশের মানুষের পূর্বপুরুষগণ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। একারণেই বাংলাদেশের প্রায় সকল মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রমালয়ের মহান দর্শন সুফিজম দ্বারা প্রভাবিত।
তথ্যসূত্র
১. পবিত্র কুরআনুল কারীম
২. হাদিস শরীফ, আল-বুখারী, ইমাম ইসমাইল বুখারী
৩. কানযুল উম্মাল, ইমাম আলাউদ্দিন আলী মুত্তাকী
৪. কা’রনা’মেয়ে ইসলাম, আবুল হাসান যাররীন কূব
৫. দিওয়ানে খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী, জেহাদুল ইসলাম
৬. ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক সম্পর্ক, শহীদ মোরতাযা মোতাহহারি।