মঙ্গলবার, ৪ঠা মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

সাক্ষাৎকার

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৭, ২০২০ 

গত ১৪-১৬ নভেম্বর ২০১৯ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাজধানী তেহরানে ‘আল আকসা মসজিদের প্রতিরক্ষায় মুসলিম উম্মাহর ঐক্য’ শীর্ষক ৩৩তম আন্তর্জাতিক ইসলামি ঐক্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে ৯৩টি দেশের ৩৯৭ জন অতিথি অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ থেকে এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন ঢাকাস্থ মদীনাতুল উলূম মডেল ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, দার্শনিক ও আলেমে দীন মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী, ইস্টার্ন প্লাস জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন ও ইউনাইটেড মুসলিম উম্মাহ’র চীফ কোঅর্ডিনেটর জনাব মজুমদার মোহাম্মাদ আমীন। আমরা তাঁদের সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। দুটি পর্বে তাঁদের সাক্ষাৎকার উপস্থাপন করা হবে। এই পর্বে মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী ও মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন এর সাক্ষাৎকার নিউজলেটারের পক্ষ থেকে পাঠকদের উদ্দেশে পত্রস্থ হলো।

প্রশ্ন ১ : মহানবী (সা.)-এর পবিত্র জন্মদিবসÑ ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন উপলক্ষে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ পালন ও আন্তর্জাতিক ইসলামি ঐক্য সম্মেলনের আয়োজনকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : মহানবী (সা.)-এর পবিত্র জন্মদিবস শুধু নয়, তাঁর পূর্ণ জীবনাদর্শের ওপর সমানভাবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মুসলমানদের আদর্শিক অগ্রযাত্রা চালিয়ে যেতে হবে। মহানবী (সা.)-এর কর্মধারাও এমনই ছিল। ‘ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ’ ধারণাটি খুবই সুন্দর। তাছাড়া আন্তর্জাতিক ইসলামি ঐক্য সম্মেলন একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমার ধারণায় মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পর্যায়ক্রমে এর ভেন্যু বদল হতে পারে। জাকার্তা থেকে রাবাত পর্যন্ত সুবিধাজনক ৫০টিরও বেশি রাজধানীতে ক্রমান্বয়ে এ সম্মেলনের আয়োজন করা বেশি ফলপ্রদ হবে বলে মনে করি। এ পর্যন্ত ৩৩টি সম্মেলন তেহরানে হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব আরও বাড়তে পারে, আংকারা, বাগদাদ, কায়রো, তাশখন্দ, ঢাকা, কুয়ালালামপুর, ইসলামাবাদ, দোহা, আবুধাবি ইত্যাদিতে সম্মেলন করা গেলে।
মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন : বর্তমান সমস্যা জর্জিত বিশ্বে যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে টহরঃু বা ঐক্য। এই ঐক্যকে আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে ফরজ ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন- তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ করো। (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)। আজ মুসলমানদের অনৈক্যের সুযোগে পৃথিবীর দাম্ভিক শক্তি আমেরিকাসহ সমস্ত সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি বিশ্ব মুসলিমের ওপর অবর্ণনীয় ও বর্বরতম পৈশাচিক নির্যাতন চালাতে সাহস পাচ্ছে। কোটি কোটি জনতার সামনে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, মায়ানমার, চীনের উইঘুর মুসলিম, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেনসহ দুনিয়ার দেশে দেশে এই অমানবিক জুলুম চলছে। এমন একটি করুণ মুহূর্তে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এতবড় একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনের আয়োজন করে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের কাছে কৃতজ্ঞতার দাবি করতে পারে।
৩৩তম আন্তর্জাতিক ইসলামি সম্মেলন আয়োজনের ব্যাপারে আমার মূল্যায়ন হলো ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান যখন গোটা মুসলিম উম্মাহর তথা শিয়া, সুন্নি ও মুসলিম মিল্লাতের বিভিন্ন মাযহাবগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মতপার্থক্য সহনীয় পর্যায়ে এনে বিশ্বের জুলুমবাজ হায়েনাদের মুকাবিলা করা দরকার, ঠিক তখনই এই সম্মেলনের আয়োজন করে সারা দুনিয়ার নির্যাতিত মুসলমানদের ব্যথিত হৃদয়ের দরজায় আবেগময়ী করাঘাত করেছে। বিশ্ব মুসলিমের হিম্মত ফিরিয়ে দিয়েছে। আবেদন রাখতে পেরেছেÑ ‘হে বিশ্বমুসলিম! আজ তোমাদের রক্ষা কবজ, তোমাদের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের একমাত্র হাতিয়ার হলো ইসলামি ঐক্য।’ তেহরানের আন্তর্জাতিক সম্মেলন সে বার্তাই আমাদেরকে দিয়েছে।
প্রশ্ন ২ : তেহরানে আয়োজিত ৩৩তম আন্তর্জাতিক ইসলামি ঐক্য সম্মেলনের আয়োজন, ব্যবস্থাপনা, অ্যাকাডেমিক ও আনুষ্ঠানিক সেশন স¤পর্কে কিছু বলুন।
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : সম্মেলনটির আয়োজন ছিল যথেষ্ট সুন্দর। একটি পরিণত আয়োজনের সবদিক তেহরানের সম্মেলনে দেখা গেছে। উদ্বোধনী ও বিদায়ী অনুষ্ঠান, অভ্যর্থনা, আতিথেয়তা, নিরাপত্তা, স্বস্তি ও অ্যাকাডেমিক সেশন সবই ছিল উচ্চমানের। অল্প সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও লক্ষ্য পূরণ সম্মেলনটিকে অর্থবহ করেছে। আমার দেখা বহু সম্মেলনের ভেতর এটি অন্যতম সফল একটি সম্মেলন।
মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন : তেহরানের ৩৩তম আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনটি প্রথম থেকেই খুবই সুশৃঙ্খল। আমাদের দাওয়াত নামা, তেহরান থেকে ভিসা দেয়ার নির্দেশ, অতঃপর ভিসা ও টিকিটের ব্যবস্থা এবং আমাদের প্রস্তুতি, প্রবন্ধ লেখা, বিভিন্ন বিষয় ঠিক করে দেয়ার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ছিল খুবই চমৎকার। ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও দূতাবাসের টাইম টু টাইম আমাদের সাথে যোগাযোগে ছিল দারুণ আন্তরিক। অতঃপর প্রস্তুতি পর্ব শেষে শাহজালাল বিমান বন্দরে নির্ধারিত সময়ে এমিরাটস এর বিমানে প্রথমে দুবাই অতঃপর সেখান থেকে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে যখন আমরা ইসলামি ইরানের অবিসংবাদিত নেতার নামে প্রতিষ্ঠিত এয়ারপোর্ট ইমাম খোমেইনী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পড়ন্ত বিকালে পৌঁছলাম, বিমান থেকে নামতেই দেখি দরজায় দাঁড়ানো ইসলামি ইরানের স্বেচ্ছাসেবকরা। তাঁদের হাতে আমাদের নাম লেখা প্লাকার্ড। তাঁরা ইংরেজিতে আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। প্রত্যেকের পরিচয় জেনে আমাদেরকে ভিআইপি গেইট দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। গাড়িতে করে কিছু দূর গেলেই দেখি আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ ইরানি আয়াতুল্লাহগণ। দুহাত প্রসারিত করে তাঁরা আমাদের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। আমরা সুন্নি আলেম, তাঁরা শিয়া আলেম। কিন্তু এখানে যেন সবাই একাকার হয়ে গেলাম। অতঃপর গেস্ট হাউজে বিভিন্ন দেশের ইসলামিক স্কলারগণ পারস্পরিক পরিচিতির মাধ্যমে জানতে পারলাম কেউ ইরানি, কেউ পাকিস্তানি, কেউ ইরাকি। আমরা তো বাংলাদেশী। সে অভূতপূর্ব মিলন মেলা। অতঃপর নাস্তা সেরে একটি গাড়িতে স্বেচ্ছাসেবকরা আমাদের নিয়ে একবারে ইমাম খোমেইনী (র.)-এর মাজার সংলগ্ন হলরুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে পরিপাটি ব্যবস্থাপনা। বিভিন্ন দেশের উলামা-দ্বীনদার বুদ্ধিজীবিগণ সমবেত। সেখানে আমাদেরকে স্বাগত জানানো হলো। বক্তব্য রাখলেন আমাদের দাওয়াতদাতা এ সম্মেলনের সেক্রেটারি আয়াতুল্লাহ মোহসেন আরাকী এবং ইমাম খোমেইনী (র.)-এর নাতি আয়াতুল্লাহ হোসাইনী। বক্তব্যের পূর্বে মধুময় তেলাওয়াতে কালামে মজীদ সকলের হৃদয়কে জুড়িয়ে দিল। অতঃপর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকার। তারপর আমাদের থাকার জায়গা ফুন্দুকে আবাদীতে গেলাম। হোটেলের নিচতলার সিপাহি পাসদারানের সদস্যগণ আমাদেরকে একটি ফাইল, কলম, প্রোগ্রাম সূচি দিলেন। এরপর আমাদের স্বদেশী মাশহাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সালেহকে আমাদের সংগে দিলেন। আমাদের প্রতি দুজনের জন্য একটি রুম বরাদ্দ। ২৬ তলায় খাবারের ব্যবস্থা দেখে সত্যিই অভীভূত হলাম। কঠোর নিরাপত্তা, সুশৃঙ্খল উপস্থাপনা এবং জমরুদ, আলমাস, জেরীন, ব্রিলিয়ান ইত্যাদি হলগুলোতে প্রায় ১০/১৫টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোমুগ্ধকর আলোচনা। যেমন ইসলামে প্রতিরোধ আন্দোলনের গুরুত্ব, আল আকসা মসজিদ উদ্ধারের উপায়, ফিলিস্তিনী মুসলমানদের মুক্তি সংগ্রাম, মায়ানমারের মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের বীভৎস কাহিনী, ইসলামের বিচার ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মুসলমানদের গুরুত্বারোপ ইত্যাদি। আলহামদুলিল্লাহ এ ব্যাপারে ইসলামি ইরান অনেক অগ্রসর। ইসলামের শিক্ষা নীতিসহ তামাম বিশ্বের নির্যাতিত মুসলিমদের মুক্তির উপায় সম্পর্কে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিদিন বিভিন্ন হলে কখনও বিরাট সম্মেলন, কখনও গ্রুপভিত্তিক আলোচনা, পর্যালোচনা সত্যিই সমগ্র বিশ্ব ইসলামি চিন্তাবিদদের হৃদয় কেড়েছে। এ সমস্ত শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলÑ এ যেন সম্মেলন নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের ইসলামি বিপ্লবের সদর দপ্তরে বসে আছি। সত্যিই এই আয়োজন, ব্যবস্থাপনা এবং বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম উপস্থাপনা ছিল হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষণীয়।
প্রশ্ন ৩ : আপনার দৃষ্টিতে মুসলিম উম্মাহর বর্তমান প্রধান সমস্যাগুলো কী কী?
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের পারসেপশন সংকট। অপপ্রচারে ইসলামের সঠিক চিত্রটি তাদের সামনে স্পষ্ট নয়। মুসলিমরাও শিক্ষা সংস্কৃতির দিক দিয়ে স্বকীয় নয়। এর ওপর আছে ঐক্য ও উদারতার সংকট। নেতৃত্ব গড়ে না উঠলেও ছোট ছোট গ্রুপিং তৃণমূল পর্যন্ত ছেয়ে আছে। এছাড়াও আদর্শ, শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, বাণিজ্য, সংগঠন ইত্যাদি অনেক দিক দিয়েই মুসলিমরা পিছিয়ে আছে।
মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন : আমার দৃষ্টিতে বর্তমান মুসলিম বিশ্বের প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম হলো মুসলমানদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। এরপর রয়েছে শত্রু-মিত্র নিরূপণে বা পরিচয় জানতে অর্থাৎ ইসলামের দুশমন চিনতে ভুল করা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনগ্রসরতা, নিজেদের অঢেল সম্পদ থাকতেও মুসলিম নামের জালিম সরকার প্রধানগুলোর কুফরী শক্তির পায়রাবী করা, দেশে দেশে অনৈসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকা ইত্যাদি। অর্থনৈতিক সমস্যা যা পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার কারণে সৃষ্ট। আলেম সমাজের মধ্যে আদর্শিক নেতৃত্ব দানে ব্যর্থতা, যুব সমাজকে ইসলামের কল্যাণ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানদানে ব্যর্থতা, ইসলামে নারীর অধিকারের ব্যাপারে সচেতনতার অভাবগুলোই মনে হয় আজকের দুনিয়ার মুসলমানদের মৌলিক সমস্যা। আজ বড় প্রয়োজন মাযহাবী দ্বন্দ্ব মিটিয়ে মুসলিম পরিচয়ে বির্কতহীন এক উম্মাহ।
প্রশ্ন ৪ : সমস্যাগুলো উত্তরণের জন্য ইতিবাচক ও কার্যকরী কর্মসূচি স¤পর্কে আপনার মত স¤পর্কে কিছু বলুন।
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : নিঃস্বার্থ, উদার ও নিষ্ঠাবান নেতৃত্ব যদি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে অগ্রসর হয়, তাহলে মুসলিমরা বিশ্বে একটি ভালো জায়গা করে নেবে। বিচ্ছিন্ন অনেক শক্তি, জনগণ, সম্পদ ও সম্ভাবনা মুসলিম উম্মাহর রয়েছে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ সংহত না থাকায় তারা আজ নানা চক্রান্তের শিকার। বড় মানসিকতা নিয়ে দায়িত্বশীলরা গোটা উম্মাহকে এগিয়ে নেওয়ার চিন্তা করলে নানা বিভক্তি সত্ত্বেও মৌল কিছু ইস্যুতে বিশ্ব মুসলিম এক হতে পারে। এজন্য সবারই কমবেশি দায়িত্ব আছে। বিশেষ করে এ পথে বাধাগুলো খুঁজে বের করে সেসব দূর করার আন্তরিক উদ্যোগ থাকতে হবে। সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তা বাদ দিয়ে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালালে মুসলিমরা বড় শক্তিতে পরিণত হতে পারে।
মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন : সমস্যাগুলো উত্তরণ ও কার্যকরী কর্মসূচি হতে পারে দুনিয়ার দেশে দেশে ইসলামি আন্দোলনগুলোর মধ্যে তথা মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি। এরপর আলেমদের দ্বারা মাযহাবী বিরোধের প্রাচীর ভেঙ্গে যেখানে মুসলিম পরিচিতির প্রতি গুরুত্বারোপ করা। অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যে মুসলিম সরকার প্রধানদের স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক ফোরাম গঠন করে মুসলিম মিল্লাতের কল্যাণের প্রতি প্রাধান্য দেয়া। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়ে গভীর পা-িত্যের প্রয়োজন। উল্লেখ্য, এ কাজগুলোর জন্য ইসলামি ইরানই সর্বাধিক ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, তারাই পৃথিবীর একমাত্র ইসলামের সাংবিধানিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। পৃথিবীর অনৈসলামিক ও জালিম সরকারগুলোর উৎখাত সময়ের দাবি।
প্রশ্ন ৫ : ইসলামি ঐক্যের ব্যাপারে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ও অন্য নেতৃবৃন্দের ভূমিকা এবং রাষ্ট্র হিসেবে ইরানের অবস্থান স¤পর্কে কিছু বলুন।
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : ইরানের নেতৃবৃন্দ তাঁদের মতো করে এ পথে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করে যাচ্ছেন। বিপ্লব সংঘটিত করেছেন। এরপর ৪০টি বছর বহু বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করে একটি দৃষ্টান্তকে টিকিয়ে রেখেছেন। তবে এ সময়ে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারলে আরও বেশি ফল পাওয়া যেত। এরপরও তাঁরা বিশ্বব্যাপী ইরানকে কীভাবে তুলে ধরবেন, সে বিষয়ে নিরন্তন গবেষণা করে যাওয়া উচিত। এসব সম্মেলন সম্ভবত সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণে সহায়তা দিতে পারে। একটি শক্তি অন্যান্য রাষ্ট্র ও জাতির ওপর কীভাবে প্রভাব ও জনপ্রিয়তা লাভ করে, স্বতঃসিদ্ধ সে পথগুলো অবলম্বন করেই সবাইকে এগোতে হয়। বহু বাধা পাড়ি দিয়ে ইরান চলছে, তবে তাকে আরও অধিক গ্রহণযোগ্য কর্মপন্থা বাছাই করতে হবে।
মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন : ইসলামি ইরানের ধর্মীয় নেতা মুহতারাম সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর ভূমিকা যে কত বেশি ও আন্তরিক তা তেত্রিশতম আন্তর্জাতিক ঐক্য সম্মেলনে অনুভুত হলো। ইসলামি ইরানের উলামায়ে কেরামগণ অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে সম্মেলনের বিভিন্ন সেশনে যে ভূমিকা পালন করেছেন তা প্রমাণ করে তাঁরা ঐক্যের জন্য খুবই আন্তরিক। বিশেষ করে স্বচক্ষে দেখলাম যখন রাহবারের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হলো। সেই বিরাট সম্মেলনে ইসলামি ইরানের রাহবার, প্রেসিডেন্ট, স্পিকার, চীফ জাস্টিসসহ অন্য ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সরব উপস্থিতি প্রমাণ করে তাঁরা ঐক্যের জন্য গভীরভাবে আগ্রহী।
ইসলামি ইরানের রাষ্ট্র হিসাবে অবস্থানের ব্যাপারে বলব বর্তমান বিশ্বে তাবৎ কুফরী শক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রচ- অর্থনৈতিক অবরোধ মুকাবিলা করে দীর্ঘ চল্লিশ বছর টিকে প্রমাণ দিল রাষ্ট্র হিসাবে ইরান এখন মুসলিম বিশ্বের ইমামতের স্থলে রয়েছে এবং সুদৃঢ় ভাবেই আছে। কতই না ভাল হতো যদি আরও কিছু দেশে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হতো!
প্রশ্ন ৬ : তেহরানের রাস্তাঘাট, অবকাঠামো, নারী-পুরুষের বিচরণ স¤পর্কে আপনার সংক্ষিপ্ত সফরে লক্ষণীয় বিষয়ে কিছু বলবেন কি?
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : তেহরান একটি প্রাচীন শহর। শূন্য থেকে গড়ে ওঠা নতুন নগরী নয়। সে হিসাবে তেহরান ঐতিহ্যবাহী ও সুন্দর। তবে দীর্ঘ অর্থনৈতিক অবরোধের কবলে না পড়লে হয়তো তেহরান অবকাঠামোগত দিক আরও বেশি উন্নত হতে পারত। সৌন্দর্য ও শৃংখলা ভালোই। নারী-পুরুষের জীবন সংগ্রামে শরীক হওয়ার দিকটি প্রত্যাশা অনুযায়ী রয়েছে বলে মনে হয়। কিছু স্থাপনা খুবই মনোরম। সম্মেলনের ব্যস্ততায় ও স্বল্প সময়ে তেহরান ঘুরে দেখা হয় নি। নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি সরল সৌন্দর্যে অপরূপ।
মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন : আমি দুঃখিত যে, আমার সংক্ষিপ্ত সফরে ইসলামি ইরানের মতো এই বিরাট রাষ্ট্রের তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থান আমরা পরিদর্শন করতে পারি নি। তবুও তোরানের ইমাম খোমেইনী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে আমাদের আবাসিক হোটেল অর্থাৎ পার্সিয়ান আজাদী হোটেলের দূরত্ব ছিল আনুমানিক ৬০/৭০ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রম কালে আমরা মসৃণ রাস্তাঘাট দেখেছি। বিশাল প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে সাঁ সাঁ করে গাড়ি ছুটে চলেছে তাদের গন্তব্যের দিকে। কোথাও যনাজট চোখে পড়েনি। কোথাও যাত্রাপথে বিরক্তিকর কোনো বিষয় ছিল না। সবকিছু ছিমছাম সুন্দর নয়নাভিরাম।
অবকাঠামোগত অবস্থা দেখলাম। রাস্তার দুধারে সুরম্য প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। যদিও বিভিন্ন জায়গা দেখার একান্ত বাসনা থাকলেও আমার সৌভাগ্য হয় নি। তবে যা দেখেছি তাতে ইরানের বিপ্লবী জনগণ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে হেরে যায় নি। যদি ইরানের ওপর অন্যায় অর্থনৈতিক অবরোধ না থাকত তবে হয়তো অবকাঠামোসহ ইতিহাস অন্যরকম লিখা হতো।
নারী-পুরুষের বিচরণ সম্পর্কে বলব ইরানের নারীরা পুরুষের সাথে সাথে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন। তবে নিজ নিজ আঙ্গিক থেকে আমরা বিভিন্ন মিটিং-এ দেখেছি আপাদমস্তক কালো হিজাবে আবৃত ইরানের মা-বোনেরা সমান ভাবে তাঁদের জন্য নির্ধারিত অংশে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। সব থেকে বেশি যে জিনিসটি লক্ষণীয় ছিল তাহলো ইরানি জাতির অভূতপূর্ব মেহমানদারি, ভদ্রতা ও শালীনতাÑ যা সত্যিই ভুলবার নয়।
প্রশ্ন ৭ : নিউজলেটারের পাঠক ও বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশে কিছু বলুন।
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। ইসলামই আল্লাহর নিকট মনোনীত একমাত্র জীবন ব্যবস্থা। কোরআন সুন্নাহ ও মুমিনের প্রজ্ঞা বিশ্বকে মুক্তি ও শান্তির পয়গাম দিতে পারে। মুসলিমদের উচিত অন্যসব মতাদর্শ বাদ দিয়ে ইসলামকে নিয়ে অগ্রসর হওয়া। মুসলিমদের মধ্যে যত মাইনর বিরোধ সব ইগনোর করে বৃহৎ ঐক্য গড়ে তোলা। বড় বড় বিষয়েও সংলাপ ও পরস্পর মতবিনিময়ের মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব। মুসলিমরা পরস্পর ভাই ভাই। আর এই উম্মাহ এক ও ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা। এ বিষয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে কাজ করতে হবে।
মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন : নিউজলেটারের সম্মানিত পাঠক ও বাংলাদেশের বীর জনতার উদ্দেশে আমার বক্তব্য হলো আল্লাহ তা‘আলা যোগ্য জাতির কাছে ইসলামি হুকুমাত দান করছেন। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ইরানের সাহসী জনগণ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে বিশ^ব্যাপী জনগণকে দাওয়াত দিচ্ছে দিগন্তপ্লাবী এক ইসলামী বিপ্লবের। যে বিপ্লব আলেম নেতৃত্ব ও দীনদার বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়েই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।