সন্তান জন্মে অস্ত্রোপচারের ৭০% অপ্রয়োজনীয়: সেভ দ্য চিলড্রেন
পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ১৬, ২০১৭

আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন নতুন বিশ্লেষণে বলেছে, বাংলাদেশে সন্তান জন্মে অস্ত্রোপচারের ৭০ শতাংশই অপ্রয়োজীয়। গত বছর এমন অস্ত্রোপচারের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৭১ হাজারের বেশি। এ জন্য ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা।
গতকাল সোমবার গভীর রাতে সেভ দ্য চিলড্রেন লন্ডন থেকে বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারবিষয়ক এই বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। অন্যদিকে প্রয়োজনের সময় অনেক দরিদ্র পরিবারের নারী এই জীবন রক্ষাকারী সেবা পাচ্ছেন না। ২০০৪ সালে সন্তান প্রসবে অস্ত্রোপচার ছিল ৪ শতাংশ, ২০১৪ সালে তা বেড়ে ২৩ শতাংশে দাঁড়ায়। বিশেষজ্ঞদের বরাতে সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে ৩০ শতাংশ প্রসব হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য অনুযায়ী, একটি দেশে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসবে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে।
কয়েক বছর ধরে শিশু জন্মে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক চললেও এটা কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃস্বাস্থ্য কর্মসূচির ব্যবস্থাপক পবিত্র কুমার শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সঙ্গে আমরা একাধিক সভা করেছি। এ ছাড়া স্বাভাবিক প্রসব বাড়াতে প্রতিটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পার্টোগ্রাফ (প্রসব প্রক্রিয়া শুরুর পর প্রসূতির শারীরিক অবস্থা, জরায়ুর সংকোচন ও সন্তানের অবস্থান জানার প্রযুক্তি) ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
সেভ দ্য চিলড্রেন ইতিমধ্যে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে বাংলাদেশের সমমনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ শুরু করেছে।
সংস্থাটির বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং নবজাতক ও মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক মান্নান এ পরিস্থিতিকে গভীর উদ্বেগের উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসাশাস্ত্রের বিবেচনায় প্রয়োজন নেই এমন ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করা হলে মা ও নবজাতক দুজনই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। এতে প্রসব–পরবর্তী সংক্রমণ বাড়ে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়, অঙ্গহানি ঘটে। প্রসূতির সুস্থ হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগে।’
সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, ২০১৬ সালে দেশে ৩৫ লাখ ৫২ হাজার শিশুর জন্ম হয়। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে দেশে ২৩ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় অস্ত্রোপচারে। এই হিসাবের ভিত্তিতে সংস্থাটি বলছে, গত বছর দেশে ৮ লাখ ২০ হাজার ৫১২টি শিশুর জন্ম অস্ত্রোপচারে হয়েছে।
ইশতিয়াক মান্নান বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশ এবং আন্তর্জাতিক নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তথ্য সমন্বয় করে দেখেছি, ২৩ শতাংশের মধ্যে ৭ শতাংশের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন ছিল। অর্থাৎ বাকি ১৬ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল না। এই অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের সংখ্যা ৫ লাখ ৭১ হাজার ৮৭২টি। এই সংখ্যাটি মোট অস্ত্রোপচারের ৭০ শতাংশ।’
অন্যদিকে প্রয়োজনের সময় অনেক নারী অস্ত্রোপচার করাতে পারছেন না। এরা মূলত দরিদ্র শ্রেণির। এরা জরুরি প্রসূতিসেবা পায় না। কারণ, আর্থিক সংকট, অস্ত্রোপচারে ভয়, সেবা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় সিদ্ধান্তহীনতা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দূরত্ব, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা না পাওয়ার অভিজ্ঞতা ইত্যাদি।
এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) মাতৃস্বাস্থ্য বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক শামস-এল-আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রসবে অস্ত্রোপচার নিয়ে যে পরিবেশ দেশে তৈরি হয়েছে, তা এক দিনে বদলানো যাবে না। পেশাজীবী, নারী সংগঠন, সরকার সবাই মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’
সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, অস্ত্রোপচারে রোগীকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ করতে হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে রক্ষণশীল হিসাব ব্যবহার করা হয়েছে। হাসপাতালে অবস্থানের সময় ধরা হয়েছে সাত দিন।
প্রত্যক্ষ খরচের মধ্যে আছে ওষুধ, চিকিৎসক, হাসপাতালে থাকা, খাবার, হাসপাতালে যাওয়া-আসা। পরোক্ষ খরচের মধ্যে ধরা হয়েছে উপার্জনে ক্ষতি (এই বয়সী নারীদের বড় অংশ উপার্জনক্ষম), স্বামীর উপার্জনে ক্ষতি এবং পরিবারের অন্যদের উপার্জনে ক্ষতি।
এ ছাড়া ২৫ শতাংশ রোগীকে অস্ত্রোপচার–পরবর্তী জটিলতায় ভুগতে হয়, এর কারণে বাড়তি খরচ হয় (১২ দিন ধরা হয়েছে)। এদের ওষুধ, চিকিৎসক, হাসপাতালে থাকা, খাবার এবং আত্মীয়দের হাসপাতালে যাওয়া-আসার জন্য বাড়তি খরচ হয়। সব মিলে একটি অস্ত্রোপচারে গড়ে ৫৫২ মার্কিন ডলার বা ৪৪ হাজার ১৬০ টাকা (১ ডলার=৮০ টাকা) ব্যয় হয় (উপার্জনের ক্ষতিসহ)।
৫ লাখ ৭১ হাজার ৮৭২টি অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে ব্যয় হচ্ছে ২ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এই অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যক্তি তাঁর নিজের পকেট থেকে করছেন।
এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদুল কাইয়ূম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অপ্রয়োজনীয় এই খরচ মানুষ অন্য জায়গায় খরচ করতে পারে বা স্বাস্থ্যের অন্য প্রয়োজনে খরচ করতে পারে। তা ছাড়া, এত অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার স্বাস্থ্য খাতের ওপরও চাপ ফেলে।’ তিনি বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করার জন্য বিভিন্ন দেশে কাজ হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।
সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার যেমন হচ্ছে, তেমনি প্রয়োজনে এই সেবা পাচ্ছে না এমন নারীও অনেক। সেবার ক্ষেত্রে এই বৈষম্য যেমন আছে, তেমনি চিকিৎসাসেবা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও দুর্বলতা আছে। দিন দিন বেশিসংখ্যক চিকিৎসক স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অস্ত্রোপচারের জন্য সুপারিশ করছেন, স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অস্ত্রোপচারে আট গুণ বেশি আর্থিক লাভ।
করণীয় বিষয়ে ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক লতিফা শামসউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যা সমাধানে আন্তরিক উদ্যোগটা দরকার। স্বাভাবিক প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল এক দিনে তৈরি করা যাবে না। তত দিনে সফল উদাহরণ যা আছে তার ব্যবহার বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গের কয়েকটি হাসপাতালে পার্টোগ্রাফ ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গেছে। এটার ব্যবহার বাড়াতে হবে।- প্রথম আলো।