শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার ও তাঁর সী-মোরগ কাহিনী
পোস্ট হয়েছে: জুন ১৫, ২০১৬
মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান
বিশ্বের অত্যন্ত খ্যাতিমান আধ্যাত্মিক কবি, সাধক ও পীর-মুর্শিদগণের অন্যতম হলেন শেখ ফরিদ উদ্দিন মুহাম্মদ আত্তার নিশাপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহ্। বর্তমান ইরানের খোরাসান প্রদেশস্থ’ নিশাপুর শহরে ৫৪০ হিজরি মুতাবিক ১১৪৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ এবং ৬১৮ হিজরি মুতাবিক ১২২১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর আসল নাম আবু হামিদ মুহাম্মদ বিন আবি বকর ইবরাহীম। আত্তার ও ফরিদ উদ্দিন তাঁর কলমী নাম।
মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী রহমাতুল্লাহি আলাইহ্ কিশোর বয়েসে বয়োবৃদ্ধ শেখ আত্তারের সাক্ষাৎ ও দোয়া লাভ করেন। তিনি শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার সম্পর্কে লিখেছেন :
‘আত্তার করেছেন সফর প্রেমের সপ্তনগর
আমরা এখনও ঘুরছি এক
কানা গলির ভেতর।’
সাধারণ মুসলমানদের কাছে শেখ ফরিদ উদ্দিন মুহাম্মদ আত্তার নিশাপুরী তাঁর জগদ্বিখ্যাত গদ্য গ্রন্থ ‘তাযকিরাতুল আউলিয়া’র জন্য বিশেষভাবে পরিচিত হলেও তাঁর রচিত কাব্যসমূহ আধ্যাত্মিক মনীষীবৃন্দ ও গবেষক সাধকদের মননকে সবিশেষ সমৃদ্ধ করেছে এবং অনেক গ্রন্থ বিভিন্ন ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে।
শেখ আত্তারের গ্রন্থসমূহের অন্যতম হচ্ছে ‘মানতেকুত্তায়ির’, ‘দিওয়ান’, ‘পান্দ নামা’, ‘খসরু নামা’, ‘মুখতার নামা’, ‘মসিবত নামা’, ‘ইলাহী নামা’, ‘জাওয়াহির নামা’, ‘শারহুল কাল্্ব্’, ‘আসরার নামা’, ‘হিলাজ নামা’, ‘মনসুর নামা’, ‘বিসার নামা’, ‘অশতুর নামা’ প্রভৃতি। গবেষকদের মতে তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ১১৪টি যা আল-কুরআনের সূরাসমূহের সংখ্যা। আমরা আজকের আলোচনায় শেখ আত্তারের ‘মানতেকুত্তায়ির’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
শেখ ফরিদ উদ্দিন মুহাম্মদ আত্তারের রচনাবলির ভেতর ‘মানতেকুত্তায়ির’ বা পাখিদের ভাষা, যুক্তি ও প্রজ্ঞাগ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে আল-কুরআনে বর্ণিত হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের কাহিনীতে ব্যবহৃত পরিভাষা তথা মানতেকুত্তায়ির থেকে যাতে প্রাসঙ্গিকভাবে হুদহুদ নামের এক জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান পাখির সাথে হযরত সুলায়মানের আলোচনা উদ্ধৃত হয়েছে।
শেখ আত্তারের ‘মানতেকুত্তায়ির’ কাব্যগ্রন্থ এক বিস্ময়কর আধ্যাত্মিক পথনির্দেশনার গ্রন্থ যা রূপক হিসেবে পাখিদের ভাষা ও আচরণে বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে লাখো পাখির সমাবেশ মানুষেরই সমাবেশ। মানুষের স্বভাব-চরিত্র ও আচার-ব্যবহার পাখিদের জবানে ও আচরণে তুলে ধরা হয়েছে। প্রায় আটচল্লিশ হাজার শব্দের এ গ্রন্থে রয়েছে মানবমনের হাজার হাজার পর্দার কাহিনী এবং তা বিদীর্ণ করে মাশুকে মুতলাক আল্লাহ তা‘আলার দীদারে গমনের পথ পরিক্রমার অনন্য এক দিকনির্দেশনা। পাখিদের সমাবেশ ও অভিযাত্রার এ গ্রন্থ শুরু হয়েছে রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা বাক্য দিয়েÑ
‘আফরিন জান আফরিনে পাক রা
অন্কে জান বাখ্শিদ ও ঈমান খাক রা’
অর্থাৎ ‘প্রশংসা পবিত্র সেই সত্তার যিনি জীবন সৃষ্টি করেছেন-
যিনি মাটির মাঝে প্রাণ ও জীবন দান করেছেন।’
‘মানতেকুত্তায়ির’ এর ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে কন্ফারেন্স অব দ্য বার্ডস, অ্যাসেম্ব্লি অব দ্য বার্ডস, পার্লামেন্ট অব দ্য বাড্র্স্ প্রভৃতি পরিভাষায়। স্বনামধন্য ইংরেজ কবি ফিট্জিরাল্ড পুরো গ্রন্থটাই ইংরেজি কাব্যে অনুবাদ করেছেন। তিনি ছাড়াও আরো কয়েকজন এর অনুবাদ করেছেন।
এ গ্রন্থের শুরুতে হাম্দ, না’ত ও প্রচলিত দোয়া-দরূদের পর মূল কাহিনীতে বলা হয়েছে :
চন্দ্রবিহীন এক মধ্যরাতে চিন দেশে সী-মোরগ তার রূপের বাহার মেলে ধরল। সী-মোরগের পাখা থেকে একটি পালক ছুটে পড়ল জমিনে। পালকের রূপের আলোতে চমক লাগল দেশ-বিদেশ ও সারা জাহানে। এত রূপ দেখে দেশের পাখিরা জমা হলো বিশাল ময়দানে। সবার এক কথাÑ পৃথিবীর সব দেশেই রাজা-বাদশাহ রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে বাদশাহ নেই। এ কারণে সবখানে অরাজকতা, অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, অশান্তি, যুদ্ধ, হত্যাকা-, বৈষম্য, হিংসা, বিদ্বেষ ইত্যাদি চলছে। আমাদের প্রয়োজন একজন ন্যায়বিচারক দরদি বাদশাহ। কিন্তু কোথায় পাব তাকে? কে নিয়ে আসবে এমন একজন প্রজ্ঞাবান প্রজাবৎসল বাদশাহ। পাখিদের এমনসব কথাবার্তা ও কোলাহলে উপস্থিত হলো হুদহুদ। হুদহুদ অত্যন্ত জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, প্রজ্ঞাবান ও কষ্টসহিষ্ণু পাখি। সব পাখিই তার গুণাবলিতে মুগ্ধ। সবাই মিলে তাকে ধরল এবং তাদের দাবির কথা জানালো। হুদহুদ পাখিদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল এবং তাদের মনের কথা বুঝে নিল। সমবেত পাখিরা তাকেই নেতা ও মুখপাত্র হিসেবে মনোনীত করলো। কেননা, হুদহুদ হযরত সুলায়মানেরও ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত পাখি। সবার কথা ও দাবি শোনার পর হুদহুদ বলল : ‘আমাদের জন্য একজন যোগ্যতম বাদশাহ বা স¤্রাট হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে কেবল সী-মোরগের।’ সী-মোরগ এক আধ্যাত্মিক কল্পিত পাখির নাম। ফারসি সাহিত্যে সী-মোরগ বলা হয় ইনসানে কামেল ও পীরে কামেলকে যিনি রাব্বুল আলামীন আল্লাহ পাকেরই খাঁটি প্রতিনিধি।
হুদহুদ পাখিদের বলল : ‘সী-মোরগের সন্ধান ও সাক্ষাৎ পাওয়া এত সহজ নয়। সী-মোরগের আবাসে যেতে হলে অত্যন্ত কঠিন ও সংগ্রামময় অভিযান জরুরি। সী-মোরগ থাকে ‘কুহে কাফে’। কুহে কাফে যেতে হলে আমাদের এদেশ ও এ বেশ ছাড়তে হবে। আমাদের নফসানি লেবাস ও রেশ থাকা অবস্থায় কুহে কাফে যাওয়া সম্ভব নয়। আর সেখানে যেতে না পারলে সী-মোরগের দীদার লাভও অসম্ভব।’
এ অভিযান ও অভিযাত্রা নিয়ে পাখিদের মাঝে শুরু হলো নানা তর্ক-বিতর্ক ও বাদানুবাদ। প্রত্যেকেই যার যার স্বার্থ, যুক্তি ও অবস্থানের আলোকে নিজেকে এ অভিযান থেকে দূরে রাখার চেষ্টা চালাল। বুলবুল, ময়ূর, চড়–ই, কবুতর, ঘুঘু, দোয়েল, হাঁস, কাক, শুকুন, বাজ, ঈগল প্রভৃতি হাজার হাজার নামের পাখি সাত মরু-বিয়াবান পাড়ি দেয়ার নাম শুনেই ছিটকে পড়তে ও সটকে পড়তে যুক্তি দেখাতে লাগল। হুদহুদ সবাইকে তার প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালালো। বলল : ‘আমাদের মুক্তির একমাত্র পথই এ সংগ্রামী অভিযানে জীবনপণ করে নামা। নইলে এই অরাজকতাপূর্ণ, অশান্তির ও ধ্বংসাত্মক পৃথিবীর কারাগার থেকে আমাদের মুক্তি নেই। আত্মত্যাগ ও সংগ্রামই একমাত্র উপায়। লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ, স্বাধীনতা ইত্যাদির সাত ভয়াবহ ময়দান পাড়ি দিতেই হবে। তবেই আমরা চিরন্তন শান্তিময় জীবন পাব এবং সী-মোরগের পরশ লাভে ধন্য হব।’
শেখ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন আত্তার তাঁর চিত্তাকর্ষক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ এ গ্রন্থে উল্লেখ করেন-
অবশেষে পাখিদের সমাবেশ থেকে হাজার হাজার পাখি রওয়ানা হলো কুহে কাফের দিকে হুদহুদের নেতৃত্বে। ভয়াবহ সাত মরু পাড়ি দিতে গিয়ে হাজার হাজার পাখি মারা গেল, হারিয়ে গেল এবং নানা আকর্ষণ ও ফাঁদে আটকে পড়ল।
শত শত মঞ্জিলে হুদহুদ সঙ্গী-সাথিদের উপদেশ ও পথনির্দেশ দিয়ে প্রাণ সঞ্চার করতে লাগল। সাহসী এ বীর পাখিরা দীর্ঘ কঠিনতম পথ পরিক্রমা শেষে যখন কুহে কাফে পৌঁছল তখন তাদের সংখ্যা দাঁড়ালো মাত্র তিরিশে। ফারসিতে তিরিশকে বলা হয় ‘সী’। তিরিশ পাখি অর্থাৎ সী-মোরগ! সী-মোরগ বা তিরিশ পাখি যখন কুহে কাফে মহান বাদশাহ সী-মোরগের আবাসে পৌঁছল তখন তাদের অবস্থা কাহিল, প্রাণ যায় যায়। পথে পথে হাজার হাজার সাথি পাখি বিদায় নিয়েছে বা ধ্বংস হয়েছে। কত হৃদয়বিদারক এ কাহিনী! কিন্তু সবাই ঠিকানাবিহীন গহীন অন্ধকার যুলুমাতের দেশে ও দীনহীন বেশে ঘুরপাক খাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত সী-মোরগ বা তিরিশ বীরবিক্রম পাখি অধীর চিত্তে অপেক্ষা করতে লাগল অন্তরের আরাধ্য সী-মোরগের দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের জন্য। সেখানে ছিল এক বিশাল অতি স্বচ্ছ হ্রদ। অপেক্ষমাণ সী-মোরগরা হ্রদের স্বচ্ছ সলিলের দিকে এগিয়ে গেল। একি! সী-মোরগের সবার চেহারাই হ্রদের পানিতে ফুটে উঠেছে। প্রত্যেকেই নিজের ছবিতে দেখল মহামান্য ন্যায় বিচারক অতিশয় দরদি সী-মোরগের হুবহু চেহারা। তারা তো বিস্ময়ে হতবাক! তখন ছবি-প্রতিচ্ছবি থেকে চোখ ফিরিয়ে যার যার দেহের দিকে তাকিয়ে দেখে তারাই এখন সী-মোরগ! সী-মোরগের সন্ধানে, ধ্যানে, স্মরণে ও অভিযানে গিয়ে তারাই হয়ে গেছে সী-মোরগ। কুহে কাফের সী-মোরগ। চিরশান্তির সী-মোরগ। একত্ব ও একাকারের তাওহিদী হৃদয়ের প্রশান্তি, দরদ ও ইশকে তারা মাতোয়ারা।
তাদের চোখে-মুখে, কানে ও সর্বাঙ্গে এবং রুহে সর্বত্র বাজছে এক মধুর তান-
‘আমি এক আহাদ, অদ্বিতীয় সামাদ-
আমাকেই বানাও তোমার একক লক্ষ্য ও প্রেমময় প্রাসাদ-
আমার উপস্থিতিই যথেষ্ট হোক তোমার মনে-
আমিই তোমাদের মাওলা-মাবুদ বরণ কর অনিবার্য জেনে-
দমে দমে জপ আমার নাম
বিভোর থাক হু আর আল্লাহু স্মরণে।
(১৪ এপ্রিল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে পালিত হয়েছে শেখ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন আত্তার নিশাপুরী দিবস।)
(লেখক পরিচিতি: অধ্যাপক ও পরিচালক, ইউআইটিএস রিসার্চ সেন্টার,
ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস)