শুক্রবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

শিল্পকলায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ভূমিকা

পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ৬, ২০১৪ 

news-image

ইরানে শিল্পকলার উদ্ভব কবে যে প্রথম ঘটেছিল তা সুস্পষ্টভাবে বলা কঠিন। কেননা, ইরান মানব সভ্যতার একটি প্রাচীনতম দেশ। অতীত অনুসন্ধান করে প্রাচীন সভ্যতার যে সমস্ত ভগ্নাংশ মানুষের দৃষ্টিতে পড়েছে তাতে দেখা যায় গুহাগাত্রে এবং প্রস্তর ও মৃৎপাত্রের গায়ে এক সময়কার মানুষ রেখাঙ্কনের চিহ্ন রেখে গিয়েছিল। এসব চিহ্ন পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার শিল্প নিদর্শনের মতোই।

0.249915001320310678_taknaz_irপারসিক শিল্পে, বিশেষ করে পারসিক চিত্রকলার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অনবদ্য সৌন্দর্য সৃষ্টি। এ সৌন্দর্য সৃষ্টি তাঁরা করেছেন অত্যন্ত দীপ্ত উজ্জ্বল রংয়ের সাহায্যে এবং পেলব দ্রুতগতি রেখাঙ্কনের সাহায্যে। এভাবে শিল্পীরা তাঁদের অনুভূতিকে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দক্ষতায় প্রকাশ করেছেন। বহুদিনের পরিচর্যা এবং অনুশীলনের ফলে শিল্পীরা তাদের হাতের ব্যবহার এবং করাঙ্গুলির প্রয়োগকে একটি দক্ষ ভঙ্গিতে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন।

ইসলাম পারসিক শিল্পের সর্ববৃহৎ চালিকা শক্তি। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীকে নানা অপূর্ব সাজে সজ্জিত করেছেন। ঘাস-লতাপাতা, বৃক্ষের শাখা, বনাঞ্চলের প্রাণী এবং আকাশের পাখি সবকিছু সৃষ্টিতে বিধাতার অনন্যসাধারণ পরিপূর্ণতা আমরা লক্ষ্য করি। পারস্যের শিল্পিগণ বিধাতার এ রূপ দক্ষতাকে অত্যন্ত অভিনিবেশ এবং আন্তরিকতার সঙ্গে প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছেন। যে কোন একটি পারসিক মিনিয়েচার ছবির দিকে তাকালে আমরা শিল্পীর এই অভিনিবেশ লক্ষ্য করব। আমরা লক্ষ্য করব যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিশেষ করে প্রস্ফুটিত পুষ্প এবং সবুজ লতাপাতা অত্যন্ত সুন্দর বর্ণ বিভায় প্রকাশ পেয়েছে। এসব শিল্প মূলত অলঙ্করণের বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। যার রেখা-রংয়ের পুনরাবৃত্তির সাহায্যে সুন্দর ভারসাম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তাঁরা প্রাকৃতিক বস্তু, প্রাণী এবং বৃক্ষলতার যথার্থ স্বভাব রং ও রেখায় তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। এ কারণে সমালোচকরা বলে থাকেন যে, পারসিক শিল্পীরা যখন হাতে তুলি ধরেন তখন সে তুলিকে পরিচালিত করেন যুক্তির সাহায্যে, কিন্তু সে যুক্তির পিছনে আবার আবেগ থাকে।

downloadএই শিল্পকর্মে ফর্ম বা আকৃতি এবং বিষয় উভয়ই একই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু আকৃতি নিয়ে শিল্পীরা কখনও ব্যতিব্যস্ত থাকেন না। আকৃতি বিষয়কে অবলম্বন করে রূপলাভ করে। ভারতবর্ষের সম্রাট হুমায়ুন শের শাহের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পারস্যে এক সময় আশ্রয় নিয়েছিলেন। পারস্যে অবস্থানকালে তিনি বিশ্রামে এবং অবকাশে সময় কাটাননি। তিনি পারসিকদের কাছে বিস্ময়কর চিত্রকর্মের রীতি প্রকরণ শিখেছিলেন এবং স্থাপত্যের নতুন নির্দেশনা পেয়েছিলেন। তিনি যখন পুনরায় ভারতবর্ষে ফিরে গেলেন তখন এদেশে নতুন শিল্প প্রক্রিয়ার জন্ম হয় যাকে আমরা ‘মোঘল চিত্রকলা’ বলে থাকি। মূলত পারসিক চিত্রকলার ওপর ভিত্তি করেই ভারতে মোঘল চিত্রকলার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।

images (2)পারসিক চিত্রকলায় রংয়ের ব্যবহারটি বিশেষভাবে লক্ষ্যযোগ্য। শিল্পীরা দুই বা ততোধিক রংয়ের মিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন বিভা নির্মাণ করে থাকেন। আবার কখনও পরস্পর বিরোধী দু’টি রংয়ের সংঘর্ষ সৃষ্টি করে একটি নতুন তাৎপর্যের জন্ম দেন। লক্ষ্য করা যায় যে, তাঁরা সচরাচর এমন রং বেছে নিয়ে থাকেন যা দৃষ্টিতে খুব স্নিগ্ধ মনে হয়। এই রংগুলো হচ্ছে লাল, হলুদ, নীল ও সবুজ। এই সব ক’টি রং-ই অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং দৃষ্টিমুগ্ধকর। প্রথম থেকেই পারসিকরা গাছ থেকে, মাটি থেকে এবং পাথর থেকে রং সন্ধান করেছেন। এগুলো বিচূর্ণিত করে ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এর ফলে শিল্পীদের ব্যবহৃত রংগুলো স্থায়িত্ব পেয়েছে।

Farnet-Alighapu-02এটা বলা হয়ে থাকে যে, পারসিক শিল্পীরা তাঁদের চিত্রকলার সাহায্যে আল্লাহর অনন্ত শক্তিকে অনুভব করবার চেষ্টা করেছেন এবং কৌশলগতভাবে এ অনুভবকে তাঁরা প্রকাশ করেছেন রং ও রেখার সাহায্যে। প্রাচীন চীন অথবা জাপানের চিত্রকলায় যেখানে চিত্রকর্মের পরিপূর্ণ রেখাঙ্কনটি একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, পারসিক চিত্রকলায় সেখানে সেই রেখাঙ্কনকে যেন অতিক্রম করবার চেষ্টা করা হয়েছে।

Untitled3আধুনিককালে ইরানের শিল্পীরা তাঁদের ঐতিহ্যকে অবলম্বন করেই নতুন নতুন শিল্পভঙ্গিতে হাত দিচ্ছেন। পাশ্চাত্যের ছাপচিত্র, তৈল চিত্র, জল চিত্র এগুলো সবই বর্তমানে ইরানের শিল্পীদের আয়ত্তে। তাঁরা তাঁদের এই আধুনিক জ্ঞানকে বর্তমান সময়ের উপযোগী করবার চেষ্টা করছেন। দীর্ঘকাল শাহের আমলে এক প্রকার নির্যাতনের মধ্যে শিল্পীরা ছিলেন। সেসব শিল্পীই পাহলভী শাসনের আনুকূল্য পেয়েছে যাঁদের কাছে চিত্রকলা ছিল এক প্রকার অর্থহীন কারুকার্য মাত্র। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পীরা নতুন একটি প্রেরণা লাভ করেন। এই প্রেরণাকে ‘ইসলামী জীবন প্রেরণা’ বলা যেতে পারে। এই নতুন প্রেরণায় শিল্পীরা একতাকে, ত্যাগকে, সাহসিকতাকে এবং আল্লাহর পথে আত্মসমর্পণকে শিল্পের বিষয়বস্তু করেছেন। শিল্প তাঁদের কাছে হয়েছে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার একটি উপায়। ইসলামী বিপ্লব ইরানের শিল্পকলায় একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। শিল্পীরা বিপ্লবের অংশীদার হবার চেষ্টা করছেন এবং অংশীদারিত্বের জন্য যে শিল্পকর্মের জন্ম দিচ্ছেন তা পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে প্রচারমুখীন মনে হলেও এগুলো বর্তমান ইরানের বিশ্বাসের প্রতিবিম্বস্বরূপ এবং মৌলিক জীবন-সত্য। বর্তমানে পাশ্চাত্যের বিষয়বস্তুকে শিল্পীরা অস্বীকার করবার চেষ্টা করেছেন, যার ফলে শিল্পীদের শিল্প চেতনায় একটি প্রতিবাদের ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে একদিন ইরানে একটি নতুন শিল্প প্রক্রিয়ার জন্ম হবে।