‘শাবে ইয়ালদা’ ঐতিহ্যবাহী ইরানি উৎসব
পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ৯, ২০২১
সাইদুল ইসলাম –
‘শাবে ইয়ালদা’ বা ইয়ালদার রাত ইরানের অন্যতম প্রাচীন ও জনপ্রিয় একটি উৎসব। ইয়ালদা শব্দের অর্থ সূচনা বা জন্ম। শাবে ইয়ালদা, ‘জন্মের রাত’। ‘সূর্যের জন্মোৎসব রাত’ বা শাবে চেল্লেহ হলো ইরানিদের শীতকালীন উৎসব যা প্রাচীন কাল থেকেই বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়ে আসছে। শীত মওসুমে নিরক্ষ রেখা থেকে সূর্যের দূরতম অবস্থানকালে উত্তর গোলার্ধের দীর্ঘতম রাতে উদ্যাপিত হয় শাবে ইয়ালদা। ইরানি ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রতি বছর ডিসেম্বরের ২০ বা ২১ তারিখ রাতে উদ্যাপিত হয় এই উৎসব। ইরান ছাড়াও আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং কিছু ককেশীয় অঞ্চলের দেশ, যেমন- আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ায় বছরের একই সময় এই শাবে ইয়ালদা উদ্যাপিত হয়। এসব অঞ্চলের মানুষ যেসব কারণে শাবে ইয়ালদা উদ্যাপন করে থাকে তার মধ্যে শীতের আগমন এবং অন্ধকারের উপর আলোর বিজয় অন্যতম। তারা মনে করে অন্ধকার মন্দের প্রতীক। আর শাবে ইয়ালদার পরে প্রথম সকাল অন্ধকার ও অশুভ শক্তির উপর সূর্য এবং আলোর বিজয়ের সূচনা। অর্থাৎ এ রাতেই আলোর কাছে আঁধার পরাজিত হয় এবং এ রাত থেকেই মানবজাতির জন্য সুদিনের পালা বইতে শুরু করে।
বিশ্বখ্যাত ইরানি কবি জালালুদ্দিন রুমি রাতকে অবকাশকালে আগ্রাসনকারী ও নৈশকালে আকস্মিক হানাদার বাহিনী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ রাত হলো অশুভ বা মন্দের প্রতীক এবং দিন হলো ঔজ্জ্বল্য, শুভ্রতা, সচ্ছলতা, নির্মলতা ও পবিত্রতার প্রতীক। শাবে ইয়ালদা নিয়ে মহাকবি শেখ সাদি লিখেছেন,
ব্যথাতুর অন্তরে প্রশান্তির হাওয়া নাহি বয়
ইয়ালদার রজনী না পোহালে হয় না ভোরের উদয়
কবি শেখ সাদি অপর এক কবিতায় বলেছেন,
তোমার রূপ দেখা প্রতিটি সকাল যেন শুভ নববর্ষ
তোমার বিচ্ছেদের প্রতিটি রাত যেন অতি দীর্ঘ
কবি শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার বলেন,
নেই যদি জানা শেষ কোথায় আমার এ ব্যথাবেদনার
নেই কোন উৎসব তবে কাল শবে ইয়ালদার
কবি আল্লামা ইকবাল বলেছেন,
প্রাণচক্ষুকে যেমন অন্ধ করে দেয় তারই সুরমায়
আলোকিত দিনকে রাত পরিণত করে ইয়ালদায়
আল বিরুনী তাঁর ‘আল-বাকিয়াহ গ্রন্থে’ ইয়ালদাকে ‘মিলাদে আকবর’ বা ‘শ্রেষ্ঠতম জন্মদিন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যার উদ্দেশ্য সূর্যের জন্মদিন হিসেবে অধিক পরিচিত।
রাতটি যেন পরিবার ও বন্ধুদের একত্র হয়ে আনন্দময় মুহূর্ত উদ্যাপনের এক সোনালি রাত। সবাই মিলে ধুমধাম করে উদ্যাপন করা হয় বছরের এই দীর্ঘতম রাত। ‘শাবে ইয়ালদা’ ঘিরে ইরানে রয়েছে বেশ কিছু ঐতিহ্য। শীতের দীর্ঘতম এই রাতে পরিবারগুলো একত্রিত হয়ে কবিতা এবং উৎসবে মেতে ওঠে। সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী তরতাজা ফলমূলের সমাহার তো আছেই। করুণাময় এই রাতে ইরানিদের কাছে শীতকালীন শীতলতা যেন পরাস্ত হয়। ভালোবাসার উষ্ণতা পুরো পরিবারকে আলিঙ্গন করে। আত্মাগুলো একে অপরের আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ভালোবাসা বিনিময়ে মেতে ওঠে। ২১ই ডিসেম্বরের এই রাতে বিদেশে বসবাসরত ইরানিদের জন্য রয়েছে চমৎকার কিছু সুযোগ। তাঁরা এদিন বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মানুষদের কাছে নিজেদের অসাধারণ এই ঐতিহ্য তুলে ধরতে পারেন। প্রথা ও রীতিনীতি ভাগাভাগি করার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ পান। যা আন্তঃসংযুক্তির এই বিশ্বে পারস্পরিক উত্তম বোঝাপড়ার পথ প্রশস্ত করে।
ইরানের ব্যস্ততম রাস্তায় উঁকি দিলে দেখা যায় মুদি ও কনফেকশনারি দোকানগুলো যেন মহাউৎসবে মেতে উঠেছে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রয়োজনীয় খাবার-দাবার কিনে আনন্দ উপভোগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ইয়ালদা রাতে সাধারণত পুষ্পশোভিত বাটিতে করে তরতাজা ফলমূল ও রঙিন আজিল (শুকনো ফল, বীজ ও বাদামের সংমিশ্রণ) পরিবেশন করা হয়। ইরানিদের কাছে গ্রীষ্মকালে ফলমূল হলো প্রাচুর্যের স্মারক। এই রাতের ঐতিহ্যবাহী টাটকা ফল হচ্ছে তরমুজ এবং ডালিম। এ দু’টি ফলকে অনুগ্রহের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, শীতের আগমনের আগে তরমুজ খেলে অসুস্থতার বিরুদ্ধে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
রাতে উষ্ণ খাবার শেষে অনেকে কবিতা, গল্প ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে অসাধারণ মুহূর্ত কাটান। মধ্যরাত পর্যন্ত চলতে থাকে এই উৎসব।
লোকজন নিজেদের ভাগ্যগণনাও এই রাতেই করে থাকেন। মহাকবি হাফিজ শিরাজির কাব্য সংকলনের প্রতিটি গজলের রয়েছে আলাদা আলাদা তাৎপর্য। তাঁর কাব্য সংকলনটি সামনে রেখে পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তি শুরু করেন ভাগ্যগণনা। যার ভাগ্যগণনা করা হবে তিনি পবিত্র হয়ে চোখ বন্ধ করে ৩ বার সূরা এখলাস পড়ে মনে মনে কিছু একটা চাইবেন। অতঃপর বয়স্ক ব্যক্তি কাব্য সংকলনটি তাঁর সামনে খুলে ধরে বলবেন, ‘ডান পৃষ্ঠা নাকি বাম পৃষ্ঠা?’ চোখ বন্ধ রেখেই লোকটি কোনো এক পৃষ্ঠায় নিজের ডান হাতটি রাখবেন এবং বয়স্ক ব্যক্তি ওই পৃষ্ঠার কবিতা ও তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করবেন। এভাবেই দীর্ঘ এই রাতটি গল্পগুজবে পার করে দেন ইরানের জনগণ। তবে ইরানের কোন কোন অংশে মহাকবি ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’ থেকে সুরে সুরে আবৃত্তি করা হয়। কোথাও কোথাও সারা রাত কবিতার লড়াই অনুষ্ঠিত হয়।
শাবে ইয়ালদার ভোজ ‘শাবে চেল্লেহ’ নামেও পরিচিত। আক্ষরিক ভাবে যার অর্থ চল্লিশের রাত। অর্থাৎ ‘শাবে চেল্লেহ’ বলতে শীতকালের প্রথম চল্লিশ দিনকে বোঝায়। শীতের এই দিনগুলো সাধারণত সবচেয়ে শীতল ও কঠিন হয়ে থাকে।
প্রাচীন ইরানি ক্যালেন্ডারে শীতকাল দুভাগে বিভক্ত। ‘চেল্লেহ বোজোর্গ’ ২২ ডিসেম্বর থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত। যার আক্ষরিক অর্থ বড় চল্লিশ। আর ‘চেল্লেহ কুচাক’ ৩০ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ১০ মার্চ পর্যন্ত। যার অর্থ ছোট চল্লিশ।
ইয়ালদার রাতে মূলত শীতের সূচনা উদ্যাপন করা হয়। একইসাথে দিন বাড়তে থাকায় সূর্যের আধিপত্য বিস্তার হতে থাকে। ইয়ালদা সরকারি কোনো ছুটির দিন না হলেও এখনও প্রাচীন কিছু ঐতিহ্যকে ছাপিয়ে যায় উৎসবটি।