বুধবার, ৯ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

শহীদ সম্রাটের শাশ্বত মহাবিপ্লব-৭ (মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াই অনিবার্য)

পোস্ট হয়েছে: জুলাই ২৭, ২০২৩ 

news-image

ইমাম হুসাইন (আ) জানতেন যে, হয় তাঁকে নিহত হতে হবে, নতুবা বাইআত করতে হবে; এই দু’টি ভিন্ন অন্য কোন পথ তাঁর সামনে খোলা ছিল না। যদি তিনি বাইআত না করতেন তবে ইয়াজিদের ‘খিলাফত’ অনিশ্চিত হয়ে যেত এবং তাঁকে হত্যা না করা পর্যন্ত ইয়াজিদের দলবল ক্ষান্ত হত না।

তাই বাইআত না করলে তাঁর শাহাদাত হত অবশ্যম্ভাবী, এমনকি যদি তিনি ইয়াজিদের প্রতি বাইআত না করে পবিত্র কাবার গিলাফের নিচেও আত্মগোপন করতেন তবুও তাকে সেখানেও শহীদ করা হত। আর তিনি মহাপাপিষ্ট ও কুলাঙ্গার ইয়াজিদের প্রতি বাইআত করলে, মুসলমানদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মাত যে, কথিত ‘খলীফা’ ইয়াজিদ যা বলবে তা-ই হচ্ছে ধর্ম। তাহলে ইসলামের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকত না। তাই তাঁর বাইআত করাও উচিত নয়। ইমাম ইয়াজিদের প্রতি বাইআত করলে, মুসলমানদের এ কথা বলার অধিকার ছিল যে, রাসূলের (সা.) নাতিই তো ইয়াজিদের কাছে বাইআত করেছেন! মুসলমানদের ও ইয়াজিদের সমস্ত পাপ তখন ইমাম হুসাইনের কাঁধের উপর বর্তাত। আর এইটি, রাসূলের (সা.) ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ যা, মুসলমানদেরকে এই বিদ্রোহের জন্যে প্রস্তুতের প্রেরণা যোগাত তার পরিপন্থী হত।

ইমাম হুসাইন যেসব কারণে ইয়াজিদি শাসন মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন তার যুক্তি ছিল সূর্যালোকের মতই সুস্পষ্ট। একজন মুসলমান কখনও কুফরিতে বিশ্বাস বা চরম তাগুতি বা ফাসেক তথা খোদাদ্রোহী শাসককে মেনে নিতে পারে না। ঠিক যেভাবে আদম (আ)’র পুত্র হাবিল কাবিলের অন্যায়কে মেনে নিতে পারেননি, যেভাবে হযরত ইব্রাহিম নমরুদের কথিত খোদায়িত্বকে মেনে নেননি ও যেভাবে হযরত মুসা ফেরাউনের প্রভুত্ব বা সামেরির প্রবর্তিত বাছুর পূজা মেনে নেননি এবং মহানবী (সা) মক্কার কাফিরদের মূর্তিপূজা মেনে নেননি তেমনি ইমাম হুসাইনের পক্ষেও খোদাদ্রোহী ও চরম ফাসেক ইয়াজিদকে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। তাই ইমাম হুসাইন (আ) নবীদের সুন্নাতেরই অনুসরণ করেছেন। ইয়াজিদ আশুরার ঘটনার পর বলেছিল যে মুহাম্মাদের কাছে ওহি বলতে কিছুই আসেনি বনি হাশিম ক্ষমতা নিয়ে শুধু খেলা করেছিল, এখন ক্ষমতা এসেছে উমাইয়াদের হাতে!- তাই এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইনের প্রতিরোধ ছিল বাতিল বা মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের অনিবার্য লড়াই!

ইয়াজিদের মোকাবেলায় ইমাম হুসাইনের লড়াই কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা বা ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা বংশীয় লড়াই ছিল না। এটা ছিল ইসলামকে পুরোপুরি নির্মূল হওয়ার হাত থেকে রক্ষার লড়াই। তাই ইমাম এই দায়িত্ব পালনে নিজের জীবন ও নিজের পরিবারের তথা পুত্র স্বজনদের ও এমনকি শিশু সন্তানদের জীবন এবং পরিবারের নারীদের সম্মানকেও বিপদাপন্ন করতে কুণ্ঠিত হননি। ইমামের এমন আত্মত্যাগের  উদ্দেশ্য ছিল ইমানি দায়িত্ব পালনের জন্য ঘুমন্ত ও অসচেতন জাতিকে জাগিয়ে তোলা।

তৎকালে রেডিও-টিভির মত কোনো মাধ্যম না থাকা সত্ত্বেও হযরত সায়্যিদুশ শুহাদার (আ.) গৃহীত পদক্ষেপগুলির মাধ্যমে তাঁর বিদ্রোহ ও ইরাকের দিকে রওয়ানা হবার সংবাদটি, সে যুগে বিশ্বের সমস্ত মুসলমানের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। কারবালায় পৌঁছার আগেই ইমাম মুসলিম ইবনে আক্বীল এর নিহত হওয়া ও কুফার লোকদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের খবর পান। ইমাম তখন সঙ্গী সাথিদেরকে উক্ত সংবাদটি জানিয়ে দেন এবং বলেন : “এরা  কুফার অধিবাসীরা  আমাদেরকে পরিত্যাগ করেছে এবং আমাদেরকে সাহায্য করবে না। তোমাদের কেউ যেতে চাইলে চলে যাও।”ফলে মুষ্টিমেয় একদল ছাড়া দুর্বলমনা লোকেরা ইমামকে ত্যাগ করেন।

ইবনে জিয়াদের অনুগত হুর ইবনে রিয়াহীর বাহিনী কারবালার কাছাকাছি অঞ্চলে ইমাম হুসাইনের কাফেলাকে বাধা দিলে  তিনি সেখানে বলেছিলেন : “হে লোকসকল ! আল্লাহর রাসূল (সা). বলেন : কোনো ব্যক্তি যদি উদ্ধত কোনো শাসককে এই অবস্থায় দেখে যে, আল্লাহর কৃত হারামকে হালাল করে, আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতিকে ভঙ্গ করে, আল্লাহর রাসূলের সুন্নতের সাথে বিরোধিতা করে এবং আল্লাহর বান্দাগণের মাঝে পাপ ও অন্যায়ের সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করে; আর তার সাথে কথা ও আচরণ কোনো কিছুর দ্বারাই কোনরূপ বিরোধিতা না করে, আল্লাহর অধিকার হল,তাকে কিয়ামতের দিন সেই অত্যাচারী শাসকের সাথে তার প্রবেশের স্থানে তথা জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।”

ইমাম হুসাইনের এসব বক্তব্য থেকে বোঝা যায় সে সময় ইয়াজিদের মত লম্পট, চরিত্রহীন এবং ধর্মদ্রোহী ও খোদাদ্রোহী শাসকের বিরোধিতা না করলে ইমান বা মুসলমানিত্বই টিকিয়ে রাখা যেতো না। তাই বর্তমান যুগে অনেক মুসলিম নেতাই যেমনটি বলেন যে আগে নিজের জান বাঁচাই, পরে শক্তি সঞ্চয় করে বা মুমিনদের সুসংগঠিত করে ইমান রক্ষার সংগ্রামে নামবো- এমন আপোসকামিতা ইমাম হুসাইনের জন্য মোটেই যৌক্তিক ও শোভনীয় ছিল না। ওই পরিবেশে মহানবীর আহলে বাইতভুক্ত অন্য ইমামরাও একই কাজ করতেন। ইসলামের জন্য আরও কম বিপজ্জনক ও লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে হযরত আলী ও ইমাম হাসান জিহাদ করেছেন।

অবশ্য তাঁদের প্রতিপক্ষরাও ইসলামের শ্লোগান দিত বলে সঙ্গীদের দুর্বলতা ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ওই মুনাফিক প্রতিপক্ষদের সঙ্গে কখনও তাঁদেরকে যুদ্ধবিরতিও করতে হয়েছে। কিন্তু ইয়াজিদ প্রকাশ্যেই ইসলামের সব কিছু ত্যাগ বা বিলুপ্ত করেছিল ও নিজেই ইমামের শিবিরের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ায় তার সঙ্গে আপোষ করার বা আপাতত পিছু হটে বা পালিয়ে গিয়ে ও সময় নিয়ে পরবর্তীতে শক্তি সঞ্চয় করারও কোনো সুযোগ ছিল না। অন্য কথায় মহান আল্লাহও চাইছিলেন ইমাম ও তাঁর সঙ্গীরা মহা-বীরত্বের সঙ্গে শহীদ হয়ে এক অনন্য ইতিহাসের জন্ম দিক। #

পার্সটুডে