শনিবার, ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

শহীদ সম্রাটের শাশ্বত মহাবিপ্লব-৩ 

পোস্ট হয়েছে: জুলাই ২৭, ২০২৩ 

news-image

ফিরে এলো আবারও সেই মহররম মহিয়ান! যে মহররম জাগায় পবিত্র রক্তের মহা-উত্থান! ত্রাসে কাঁপে জালিমের খড়গ-কৃপাণ ভীরু কুলাঙ্গারের দল ইয়াজিদ, জিয়াদ, ওমর সাদ, সীমার, সিনান!

বোঝে না যুগে যুগে হুসাইনি চেতনার শাশ্বত আহ্বান

মিথ্যার শক্তি হোক যতই প্রবল, শত্রু সেনা হোক যতই অগণন শক্তিমান!

শহীদের রক্ত-স্রোত ভাসিয়ে দেয় জরাজীর্ণতা, লোভ ও ভীরুতার সব পিছুটান!

ঘুমন্ত বিভ্রান্ত জাতি যুগে যুগে পায় অমৃতসম পদদলিত সত্য ও মুক্তির বিধান!

স্বাগতম সে শহীদী মৃত্যু! প্রিয়তম মধুরতম সে মৃত্যু যা দেয় মৃত জাতিকে প্রকৃত প্রাণ অফুরান!

অশেষ প্রেমময় প্রাণবন্ত অনন্ত জীবনের সন্ধান!

কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ)’র বিপ্লব দু’টি বড় কারণে স্থান ও কালের সীমানা ছাড়িয়ে চিরন্তন আদর্শের মর্যাদা পেয়েছে। এ দু’টি বড় কারণ হল: নজিরবিহীন আত্মত্যাগ ও বীরত্ব এবং ইয়াজিদি বাহিনীর নজিরবিহীন নৃশংসতা। খোদাদ্রোহী ইয়াজিদের অন্যায় আবদারের কাছে মাথা নত করেননি বলে ইমামের কাফেলা ও সঙ্গীদেরকে ফোরাতের পানি থেকেও বঞ্চিত করেছিল নির্দয় ও নৃশংস পাশবিক চিত্তের ইয়াজিদ বাহিনী। ইমাম হুসাইন (আ) ও তাঁর পরিবারের অনেক সদস্য পিপাসার্ত অবস্থায় এমন নৃশংসভাবে শহীদ হন যে বিশ্বের ইতিহাসে এমনসব নিষ্ঠুরতা তুলনাহীন। তাই ইমাম হুসাইনের শাহাদতের ঘটনা সবচেয়ে কঠিন হৃদয়ের অধিকারী পাঠকের মনেও মহাবীর ইমাম ও তাঁর একনিষ্ঠ অনুগত বীর সঙ্গীদের জন্য সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে।–

একদিকে মহান ইমাম হুসাইনের নেতৃত্বে নবী-পরিবারের তরুণ ও যুব বয়সী বিশিষ্ট সদস্যবর্গ ও নবী-পরিবারের বাইরে তাঁর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গীদের  অতুলনীয় বীরত্ব, সাহসিকতা ও আপোসহীনতা এবং চরম আত্মত্যাগ আর অন্যদিকে ইয়াজিদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন তাগুতি বাহিনীর চরম নৃশংসতা ও পাশবিকতার ফলে সৃষ্ট মর্মান্তিক নানা ঘটনা ও দৃশ্যপট কারবালার মহাবিপ্লবকে করেছে মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়-বিদারক ও বীরত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাই মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই এ বিপ্লবের মহানায়ক ও তার বীর সঙ্গীদের জন্য অশ্রু বিসর্জন করে আসছে গর্বভরে। মানবজাতির শোকের এই অশ্রুকে জমা করা হলে তা হবে হয়ত একটি সাগরের সমান।

মহররম: তরবারির ওপর রক্তের বিজয়ের মাস
মহাপাপিষ্ঠ ইয়াজিদ এবং তার সঙ্গী ও দলবল বা পৃষ্ঠপোষকদের প্রতি মানুষের মনে যে ঘৃণা জমে আছে তাও সর্বোচ্চ পর্যায়ের। তাই কারবালার মহাবিপ্লব ও এর চেতনা হচ্ছে শোককে শক্তিতে পরিণত করার ও জুলুম আর খোদাদ্রোহীতাকে মোকাবেলার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। সবচেয়ে বড় খোদাদ্রোহী শক্তিগুলোও এই অস্ত্রের কাছে হার মানতে বাধ্য। আধুনিক যুগে ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনগুলোর সাফল্যই এর প্রমাণ।

ইমাম হুসাইনের (আ) আন্দোলন ছিল সব নবী-রাসুলদের দেখানো আন্দোলনের ধারাবাহিকতা। কোনো সমাজে যদি শাসকদের জুলুম, অন্যায়, অবিচার এবং নানা দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের তৎপরতা জরুরি হয়ে পড়ে। পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত এই দায়িত্ব পালন করতেই যুগে যুগে মহান আল্লাহ নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। নবী-রাসুলদের অনুপস্থিতিতে নেতৃস্থানীয় আলেম বা ইমামদের ওপর এই দায়িত্ব বর্তায় সর্বাগ্রে।  ইমাম হুসাইন (আ) তৎকালীন মুসলিম সমাজের জনগণের মধ্যে প্রায় স্তিমিত হয়ে পড়া বা ভুলে যেতে বসা এই দায়িত্ববোধ আবারও চাঙ্গা করতে চেয়েছেন যদিও তিনি নিজে ও নবী-পরিবার সব সময়ই এই মহান দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। জনগণ সত্যিকারের জিহাদ ও সংগ্রামের নীতি থেকে দূরে সরে গিয়েছিল কেবল ধন-সম্পদ লাভের নেশায় শুরু হওয়া কথিত জিহাদের প্রলোভন ও জিহাদের অপব্যবহারের কারণে। মুসলমানদের মধ্যে এ জাতীয় বিচ্যুতি যে আসবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন মহানবী (সা)।

অন্যদিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যে জিহাদ সেই সত্যিকারের জিহাদের প্রতি সুবিধাবাদী হয়ে পড়া বেশিরভাগ সাধারণ জনগণের তেমন কোনো আকর্ষণ ছিল না ! এই শ্রেণীর মানুষ যখন বুঝতে পারতো যে এ ধরনের জিহাদে বিজয়ের সম্ভাবনা নেই তখন তারা ওই আন্দোলন থেকেই সরে পড়ত। তাই আমরা দেখতে পাই যখন ইমাম হুসাইন (আ) তাঁর আন্দোলনের শুরুর দিকে পবিত্র মক্কা থেকে কুফার দিকে যাত্রা শুরু করেন তখন গণিমত তথা যুদ্ধ-লব্ধ ধন-সম্পদ এবং সম্ভাব্য পদ-পদবীর আশায় প্রায় তিন হাজার ব্যক্তি ইমাম হুসাইনের কাফেলার সঙ্গী হয়েছিল। কিন্তু যখন তারা ইমামের কাছেই জানতে পারলেন যে এ আন্দোলন আসলে শাহাদাতের মাধ্যমে জাতিকে জাগিয়ে তোলার ও প্রতিবাদ তীব্র করার আন্দোলন এবং এতে নিশ্চিত বাহ্যিক বিজয়ের গ্যারান্টি বা সম্ভাবনা খুবই কম তখন তারা ইমামকে ত্যাগ করে। ইমাম হুসাইন (আ.) তৎকালীন জনগণের নৈতিক অধঃপতনের প্রতি ইশারা করেছেন এভাবে :‘আল্লাহ্‌র কসম! হে জনগণ! যা কিছু উত্তম ও সঙ্গত তা তোমাদের মাঝে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হয়েছে, আর তোমাদের জীবনের শিকড় গেড়েছে সেই লাঞ্ছনার ভূমিতলে।’

পার্সটুডে