শুক্রবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

লেখক গবেষক মরহুম ফরিদ উদ্দিন খান : জীবন ও কর্ম

পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ১০, ২০১৭ 

news-image

আমিন আল আসাদ: বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও অধ্যাপক জনাব মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান গত ১৩ জুন ২০১৭ ভোর বেলায় ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক, অনুবাদক, সংগঠক এবং সুবক্তা। তিনি ছিলেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার (আইআরআইবি) বিশ্বকার্যক্রমের বাংলা বিভাগ রেডিও তেহরানের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল অ্যান্ড রিচার্স ইন্সটিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। UITS ক্যাম্পাসে প্রথম জানাযা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে তাঁর দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার আজিমপুর গোরস্তানে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত।

জনাব ফরিদ উদ্দিন খান ১৯৫০ সালে ব্রাহ্মণরাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার বিটঘর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে ঢাকার আবুজর গিফারী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেন। ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (বিএসএস) ও অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান সাংবাদিকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই তিনি লেখালেখি ও শিক্ষানবিস হিসেবে সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হন। মাওলানা ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত ‘হক্ব কথা’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ‘দি পিপ্ল’ পত্রিকার উপসম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। জনাব ফরিদ উদ্দিন খান ১৯৭৭ সালে ইরানে যান এবং সেখানে কয়েকটি পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৭৯ সালে সংঘটিত ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সময় তিনি ইরানে ছিলেন এবং তিনি সে বিপ্লব স্বচক্ষে দেখেছেন বলে তাঁর স্মৃতিকথায় প্রকাশ করেন। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর তিনি ‘দি তেহরান টাইম্স’, ‘দি তেহরান ইকনমিস্ট’সহ বেশ কয়েকটি ইরানি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন।

ইরানে অবস্থানকালে তিনি ইসলামি ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ও ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (র)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন। ১৯৮২ সালের ১৭ এপ্রিল রেডিও তেহরানের বাংলা বিভাগের কার্যক্রম তাঁর অধীনেই শুরু হয় এবং তিনি ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি মরহুম ইমাম খোমেইনী (র)-এর কবিতাসহ বিখ্যাত সুফিসাধক জালাল উদ্দীন রুমী (র),  ফরিদ উদ্দীন আত্তার (র), আল্লামা জামী (র)-এর অনেক লেখা বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি মোট ৩৯টি গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ইমাম খোমেইনী (র)-এর কবিতা’, ‘উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞা’, ‘রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে সম্পর্ক’, ‘চোখের জলে প্রেমের হজ্জ্ব’ ‘হাজার মাজারের জনপদ’, ‘শাহ সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (র)-এর দিওয়ানে ওয়াইসী’, ‘ইসলামী বিশ্বদর্শনের রূপরেখা’, ‘আল্লাহতত্ত্বের শেকড় সন্ধানে’, ‘পরিসংখ্যান প্রথম পত্র’ প্রভৃতি। শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন, ‘ছোটদের মহানবী (সা)’, ‘আজব শিশু’, ‘পশু-পাখিদের গল্প’, ‘কালিলা ও দিমনা’, ‘সাধু ও শয়তান’, ‘শিয়াল ও কাক’, ‘সুলতান মাহমুদের দাড়ি’, ‘সওদাগরের তোতা পাখি’, ‘ইদুর ছানাদের স্কুলযাত্রা’ প্রভৃতি মূল্যবান বই। এছাড়াও ইরান এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বাংলা, ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় তাঁর অনেক গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ হওয়া দরকার।

জনাব ফরিদ উদ্দিন খান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রাথমিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয়া সংগঠন তমদ্দুন মজলিশের মহাসচিব ছিলেন। অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান একজন ত্যাগী সংগঠক ছিলেন। তথাকথিত রাজনীতি দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়া কেন সম্ভব নয় এ সত্য কথাটি তাঁর বহু বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। তিনি বলতেন ‘দর্শন, আমল, আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ ও প্রেম ছাড়া ইসলাম হয় না।’ তাই তিনি ছাত্র জীবন থেকে তমুদ্দুন মজলিশ, মাওলানা ভাষানীর খেলাফতে রাব্বানীর দর্শন, দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফের দার্শনিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বেশ কয়েকটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেগুলো হলো ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জর্ডানের রয়েল অ্যাকাডেমি, বাংলাদেশ পলিসি ফোরাম, বাংলাদেশ দর্শনশাস্ত্র সমিতি, আল্লামা রুমী সোসাইটি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি (বিইটিএ), আবুজর গিফারী সোসাইটি এবং আল কুদ্স কমিটি, বাংলাদেশ প্রভৃতি।

ইরান থেকে বাংলাদেশে ফিরে তিনি অধ্যাপনার সাথে যুক্ত হন। তিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, দারুল এহসান বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সাইন্সেস এর অতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনা করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ইউআইটিএস রিসার্স সেন্টারের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, উর্দু, আরবি ও হিন্দি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।

তিনি ইরান, ভারত, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, কাতার, সিরিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ করেন।

তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও ইরান-গবেষক। দেশে ও দেশের বাইরে তিনি অনেক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছেন।

তিনি একজন তাসাউফবাদী ইসলামি গবেষক ছিলেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন নবী, রাসূল (আ), আহলে বাইতের মাসুম ইমামগণ, সুপথপ্রাপ্ত সাহাবী (রা) এবং আল্লাহর অলিদের জীবনের পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটেছিল আল্লাহর সাথে তাঁদের সুগভীর প্রেম ও পরম নৈকট্য লাভের মাধ্যমে। ইবনে আরাবী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর ‘ফুসুসুল হেকাম’, ‘আল ফাতুহাতুল মাক্কীয়া’, ইমাম খোমেইনীর ‘প্রেম কবিতা’, মাওলানা রুমীর ‘মসনবী শরীফের গল্প’, খাজা হাফিজের ‘দিওয়ানে হাফিজ’, খাজা ওয়াইসী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর ‘দিওয়ানে ওয়াইসী’র কবিতার অনুবাদ, বিশেষ করে বিখ্যাত দার্শনিক মোল্লা ছাদরার ‘আল আসফার’ গ্রন্থের আধ্যাত্মিক নির্যাস উদ্ঘাটনে তিনি সফল হয়েছেন। সেটিই মূলত তাসাউফের শিক্ষা। এসব বিষয়ের পরিপূর্ণ বিশ্লেষণের লক্ষ্যে অধ্যাপক ফরিদ ্উদ্দিন খান যেমন অবিরল লিখতেন ও বক্তৃতা দিতেন তেমনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘সুফি সাধকের বাংলাদেশ’ নামে একটি অনুষ্ঠানেরও পরিচালক এবং সঞ্চালক ছিলেন তিনি। সুফিবাদ ও আধ্যাত্মিকতার শেকড় সন্ধানে এ অনুষ্ঠানটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি সুফিবাদ ও  আধ্যাত্মিকতার আলোকে ধর্মের মানবিক রূপের বিশ্লেষক ছিলেন। তিনি অধ্যাত্ম্যবাদকে মানুষের আত্মিক সমস্যার মারাত্মক ব্যাধির মর্মমূলে প্রশান্তিকর প্রতিষেধক হিসেবে তাঁর রচনাসমূহে প্রকাশ করেছেন।

তিনি ইসলামি নীতি-নৈতিকতা ও বিশ্ব মানবিক মূল্যবোধের আলোকে মুসলমানদের মধ্যে আন্তঃমাজহাবীয় ঐক্য ও সম্প্রীতির সাথে সাথে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতিরও একজন নিরলস চিন্তানায়ক ছিলেন। বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি সন্ত্রাসবাদ, ইহুদিবাদ, সা¤্রাজ্যবাদ, সাম্প্রাদায়িক ভেদবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সোচ্চার বক্তব্য তাঁর লেখাতে আমরা পাই। বিশেষ করে পুঁজিবাদ, সা¤্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদের পক্ষ থেকে মানবতার বিপক্ষে যে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, এমনকি শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের ভেতর কতিপয় ভারসাম্যহীন মতবাদের মাধ্যমে বিদ্বেষপ্রবণতার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বিভিন্ন মত, মাজহাব ও তরীকার মুসলমানদের মধ্যে যে অন্তর্ঘাত তৈরি করা হয়েছে এবং যুগে যুগে সত্যকে পদপিষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে এর সত্যিকার চিত্র তুলে ধরেছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে।

এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে নীতিবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘ ১ যুগ তাঁর সাহচর্যে থেকে তাঁর উদারতা, রাসূল ও আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা, দীনের প্রচার ও প্রসারে সক্রিয়তা আমাদের চেতনার উৎস হিসেবে কাজ করত।

তিনি সাদামাটা পোশাক ব্যবহার করতেন, স্বল্পভোজী ছিলেন তিনি। লাল টুপি মাথায় দিতে তিনি পছন্দ করতেন।

তিনি মৃত্যুর সময় স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা, আত্মীয়-স্বজন ও বহু গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। আমরা তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।