যেসব ইতিহাস-ঐতিহ্যে ইরানে পালিত হয় জাতীয় শিরাজ দিবস
পোস্ট হয়েছে: মে ৫, ২০২২

ফারসি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রতীক জাতীয় শিরাজ দিবস। ইরানি বছরের ১৫ অরদিবেহেশত দেশব্যাপী দিবসটি পালন করা হয়। সে হিসেবে দিবসটি এবার পড়ে ৫ মে। শিরাজ অঞ্চলের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্বের পাশাপাশি অনন্য সৌন্দর্যের কারণে দিবসটি পালন করে থাকে ইরান।
ফারসি দুই মহাকবি সাদি ও হাফিজের জন্মস্থান ফারস প্রদেশের এই রাজধানী শিরাজে। দিবসটি উপলক্ষ্যে প্রতি বছরই কবিপ্রেমীদের ভিড় জমে দুই মহানায়কের জন্মস্থানে। পারস্য সংস্কৃতি, ইতিহাস ও সাহিত্যপ্রেমীরা শিরাজ দিবসের কর্মসূচিতে অংশ নেন।
একদিকে সাদি ও হাফিজের শহর হিসেবে প্রসিদ্ধ। অন্যদিকে এই ভূখণ্ডের ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি মহান পটভূমিতে শিরাজ ইরানিদের মধ্যে একটি বিশেষ স্থান লাভ করেছে। শিরাজ শহরে রয়েছে ইরাম গার্ডেন, আফিফ-আবাদ গার্ডেন, হাফিজের সমাধি, সাদির সমাধি, আতিগের জামে মসজিদ এবং পার্সেপোলিসের মতো বহু ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান। শিরাজের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাচীন এসব স্থাপনা দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে পছন্দের দর্শনীয় স্থান। দিবসটিতে শিরাজের নানা বাগান, মাজার, বাজার ও মসজিদে মানুষের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো।
শিরাজ ইরানের সবচেয়ে ঐতিহাসিক শহরগুলোর অন্যতম। দৃষ্টিনন্দন অনেক বাগান এবং ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে দর্শনীয় শহরটি গড়ে উঠেছে। বছরজুড়ে হাজার হাজার পর্যটকের পদচারণায় মুখর থাকে গোটা শহর। দৃষ্টিনন্দন শহর
শিরাজ কবিতার শহর হিসেবে সুপরিচিত। সেই সাথে কমলা এবং বার্গামটের শহর হিসেবেও এটি সুপরিচিত। বিশ্ব কারুশিল্প কাউন্সিল ‘হস্তশিল্পের বিশ্ব শহর’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই সূত্র ধরে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী শহরের তালিকায় স্থান পেয়েছে ঐতিহাসিক শহরটি।
জাতীয় শিরাজ দিবসে প্রতিবছর এই দিনে শিরাজ পৌরসভার পক্ষ থেকে বিশেষ কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। স্থানীয় কিছু সঙ্গীতশিল্পী কনসার্টের আয়োজন করেন। তারা ঐতিহ্যবাহী ও লোকগান গেয়ে দর্শকদের মাতিয়ে তোলেন। যদিও আজকাল মানুষ এসব গান ভুলতে বসেছে। গ্রামীণ এলাকার নারীরা বিশেষ পোশাক পরে দর্শনার্থীদের রান্না করা ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং রুটি পরিবেশন করেন।
শিরাজের অবস্থান
শিরাজ ইরানের বৃহত্তম শহরগুলোর মধ্যে একটি। ফারস প্রদেশের কেন্দ্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শহরটির অবস্থান। ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমে জাগ্রোস পাহাড়ি এলাকা নিয়ে শহরটি গড়ে উঠেছে। কৌশলগত অবস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষিত একটি অঞ্চল শিরাজ।
ইতিহাস
৭ম শতাব্দীর শেষের দিকে শিরাজ শহরের অস্তিত্বের কোনও নির্দিষ্ট রেকর্ড পাওয়া যায় না। তবে ১৯৩৩ সাল এবং তারও পরে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারে ইঙ্গিত পাওয়া পাওয়া যায়, শিরাজ বা আশেপাশের স্থানটিতে সম্ভবত প্রাক-ইসলামি যুগে খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বসতি গড়ে ওঠে।
আধুনিক শহরটি ৬৯৩ সালে উমাইয়ারা প্রতিষ্ঠা বা পুনরুদ্ধার করে। পরবর্তীতে ৯ম এবং ১০ম থেকে ১১ শতাব্দীতে যথাক্রমে ইরানি সাফাভি এবং বুয়িদ রাজবংশের অধীনে শহরটি প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। ১৭৫০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত জান্দ রাজবংশের সময় এটি পারস্যের রাজধানী ছিল।
জলবায়ু
শিরাজের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৩৩৭ মিলিমিটার।অঞ্চলটি গ্রীষ্মকালে উষ্ণ থাকে। তবে শরৎ ও শীতকালে তেমন ঠান্ডা থাকে না।
সংস্কৃতি
শিরাজের একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। এটি ইরানের কবি, সাহিত্য, ফুল এবং বাগানের শহর হিসেবে সুপরিচিত।
শিরাজ হল প্রেম ও সাহিত্যের শহর এবং পারস্য বাগানের প্রথম নমুনার উৎপত্তি। সেখানকার মানুষের আতিথেয়তা ও উষ্ণতার এক অনন্য উদাহরণ।
অনেক বিখ্যাত ইরানি কবি ও দার্শনিক শিরাজে জন্মগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে সাদি, হাফিজ এবং মোল্লা সদর উল্লেখযোগ্য। ফারসি এই মহানায়করা শিরাজকে বিখ্যাত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৩ শতকে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং শিল্পের সমৃদ্ধির কারণে শিরাজ বিজ্ঞানের শহর (দার-উল-ইলম) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
শিরাজের হস্তশিল্পের বিশ্বব্যাপী সুনাম রয়েছে। অন্যান্য সকল হস্তশিল্প পণ্যের চেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়ে ওঠে কাঠের হস্তশিল্প পণ্য ‘ইনলে’। এছাড়াও এখানকার বিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী আইটেমগুলোর মধ্যে রয়েছে- কাঠের খোদাই, মার্কেট্রি, মৃৎশিল্প এবং সিরামিক হস্তশিল্প যেমন মৃৎশিল্প তৈরি, মোজাইক ফ্যায়েন্স, কুয়ের্দা সেকা, ধাতুর কাজ যেমন সিলভার ওয়ার্ক এবং চেজিং, কিলিমের মতো হাতে বোনা পণ্য এবং গাবেহ ও মাদুর বুনন। এসবের কারণে ইরানের আরও তিনটি শহর ও গ্রামের সাথে শিরাজ ২০২০ সালে হস্তশিল্পের বিশ্ব নগরীতে ভূষিত হয়।
ঐতিহ্যবাহী খাবার
ইরানের অন্যান্য শহরের মতোই শিরাজের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী খাবার রয়েছে।
‘শিরাজি সালাদ’ তার মধ্যে অন্যতম। শসা, টমেটো, পেঁয়াজ এবং সাধারণ লেবুর রস ও জলপাই তেল দিয়ে সুস্বাদু এবং বিখ্যাত সালাদটি বানানো হয়।
ইরান জুড়েই এটি পাওয়া যায়। ‘কালাম পোলাও’ একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। শিরাজেই কেবল এই ধরনের পোলাও রান্না করা হয়। এটি চাল, মিটবল, কাটা বাঁধাকপি এবং অন্যান্য কিছু শাকসবজি ও মশলা দিয়ে তৈরি করা হয়।‘আশে সবজি’ সবজি ও মাংস দিয়ে তৈরি এক ধরনের স্যুপ।
‘শিরাজি ফালুদা’ শরবতের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী ইরানি ঠাণ্ডা মিষ্টি। এতে চিনি এবং গোলাপজল যুক্ত আধা-হিমায়িত সিরাপেরে স্টার্চ থেকে তৈরি পাতলা ভার্মিসেলি আকারের নুডলস থাকে। ফালুদা প্রায়ই চুনের রস দিয়ে পরিবেশন করা হয়।
শিরাজ ভ্রমণের সেরা সময়
শিরাজে যাওয়ার সেরা সময় মে মাস। এসময় রাস্তাগুলো কমলা ফুলের সুগন্ধিতে ভরে থাকে। এই মাসে শিরাজের জলবায়ু সাধারণত মনোরম থাকে। ইরানের সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলোর একটি এটি। শহরের সব ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখতে কমপক্ষে তিন বা চার দিন সময় লাগবে।
আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান
শিরাজকে ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অঞ্চলের সুন্দর এবং মনোরম রূপ বহু দেশি-বিদেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করে। ঐতিহাসিক শহর শিরাজের সবচেয়ে জনপ্রিয় আকর্ষণগুলোর একটি তালিকা নিচে দেয়া হলো।
শাহ চেরাঘ:
শাহ চেরাঘ শিরাজের একটি পবিত্র স্মৃতিস্তম্ভ। এটি আহমদ এবং মুহাম্মাদের সমাধি। তারা হলেন ইমাম মুসা কাজিমের (শিয়াদের ৭ম ইমাম) ছেলে এবং ইমাম রেজার (শিয়াদের ৪র্থ ইমাম) ভাই।
১২শতকে ফারসের আতাবাকানের শাসনামলে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়।
নরেনজেস্তান বা কাভাম গার্ডেন:
এটি শিরাজের একটি ঐতিহ্যবাহী এবং ঐতিহাসিক বাড়ি। কাজার যুগে এটি নির্মাণ করা হয়। টক কমলা গাছের আধিক্যের কারণে একে নরেনজেস্তান বলা হয়।
সাদি শিরাজির মাজার
:
মহাকবি সাদি শিরাজির সমাধি দক্ষিণ শিরাজে অবস্থিত। তার সমাধিকে সাদিয়েহও বলা হয়। সমাধিক্ষেত্রটি ইরানের অন্যতম প্রধান পর্যটক আকর্ষণ। এটি প্রথম ১৩ শতকে নির্মিত হয়। যাইহোক, ১৭ শতকে ধ্বংস হওয়ার পর ১৯৫০ এর দশকে বর্তমান ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এর আগ পর্যন্ত এটি অস্পৃশ্য ছিল বললেই চলে।
সমাধিটির স্থাপত্যে অনেক পারস্য উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। এটি একটি জাতীয় ঐতিহ্যবাহী স্থানও বটে।
প্রতি বছর ২০ এপ্রিল মহান এই পারস্যকে স্মরণ করার জন্য সারা বিশ্ব থেকে বহুসংখ্যক সাহিত্যিক এবং পণ্ডিত সমাধিতে সমবেত হন।
ইরাম গার্ডেন:
এটি একটি ঐতিহাসিক পারস্য বাগান। কেন্দ্রীয় সরকার বাজেয়াপ্ত করার আগে বাগানটি কাশকাই উপজাতীয় নেতাদের মালিকানায় ছিল। বাগানটি এবং এর ভিতরের ভবনটি ফারস প্রদেশের খোশক নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত।
তারা ঐতিহাসিক দর্শনীয় বাগান হিসেবে জনসাধারণের জন্য এটি উন্মুক্ত করে দেন। বাগানটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী একটি স্থান। ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংস্থা এটির দেখভাল করে।
হাফিজের কবর:
হাফিজের সমাধি সাধারণত হাফেজিয়েহ নামে পরিচিত। দুটি স্মারক কাঠামো দিয়ে বিখ্যাত পারস্য কবি হাফিজের স্মরণে নির্মিত সমাধিটি শিরাজের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত।সমাধি ও এর বাগান এবং অন্যান্য এই মহান ব্যক্তিত্বের আশেপাশের স্মৃতিচিহ্নগুলো বর্তমানে শিরাজের পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু।
করিম খানের আর্গ:
করিম খানের আর্গ বা করিম খান সিটাডেল শিরাজ শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি দুর্গ। এটি জান্দ রাজবংশের সময় একটি কমপ্লেক্সের অংশ হিসেবে নির্মিত হয়। এটির করিম খানের নামানুসারে নামকরণ করা হয়। এখানে তিনি বসবাস করতেন। দুর্গটি আকারে আয়তাকার এবং দেখতে মধ্যযুগীয় দুর্গের মতো।
নাসির উল মোলক মসজিদ:
এটি শিরাজের সবচেয়ে সুন্দর এবং ছবি তোলার মতো একটি স্থাপত্য। ১৯ শতকের শেষের দিকে কাজার রাজবংশের সময় এটি নির্মিত হয়। ধর্মীয় স্থাপনাটি ইরানের অন্যতম অনন্য এবং ভিন্ন রকমের একটি মসজিদ। মসজিদটি রঙিন কাচের জন্য বিখ্যাত এবং টাইলসের ধরনও অনন্য।
আফিফ-আবাদ গার্ডেন:
এটি ১৮৬৩ সালে গড়ে ওঠা একটি জাদুঘর কমপ্লেক্স। এতে একটি সাবেক রাজকীয় প্রাসাদ, একটি ঐতিহাসিক অস্ত্র জাদুঘর এবং একটি পারস্য বাগান রয়েছে। এগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
ভাকিল মসজিদ:
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শৈল্পিক এবং ঐতিহাসিক ভবনগুলোর মধ্যে একটি ভাকিল মসজিদ। জান্দের সময় থেকে স্থাপনাটি রয়ে গেছে। কয়েক বছর আগেও এটি জুমার নামাজের জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই ভবনের টাইলের কাজগুলো অন্যতম সেরা মানের। হিজরি ১২ শতকে ইরানের টাইল শ্রমিক এবং চিত্রশিল্পীদের কৃতিত্ব এতে ফুটে উঠেছে।
ভাকিল বাজার:
এটি শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রে অবস্থিত শিরাজের প্রধান বাজার। প্রায় ২০০ বছর আগে করিম খান জান্দের (ইরানি রাজা) আদেশে এই বাজারটি নির্মাণ করা হয়।
এটিতে সুন্দর উঠোন, ক্যারাভানসারিস, গোসলখানা এবং পুরানো দোকান রয়েছে। বাজারটি শিরাজের সব ধরনের পারস্য কম্বল, মশলা, তামার হস্তশিল্প এবং প্রাচীন জিনিস কেনার জন্য সেরা জায়গাগুলোর মধ্যে একটি বলে বিবেচিত হয়।
কোরআন গেট:
ঐতিহাসিক গেটটি শহরের উত্তর-পূর্ব প্রবেশপথে মারভদশত এবং ইসফাহান যাওয়ার পথে অবস্থিত।
জান্দ রাজবংশের সময় পর্যন্ত এটির উপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা যায়। ফলে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে এটি পুনরুদ্ধার করা হয় এবং উপরে একটি ছোট কক্ষ যুক্ত করা হয়েছে। এই স্থানে সুলতান ইব্রাহিম বিন শাহরুখ গুরেকানির হাতে লেখা কোরআনের একটি কপি রাখা আছে। সূত্র: মেহর নিউজ এজেন্সি।