যাকারিয়া রাযি- একজন ইরানি অগ্রণী পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব
পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৮
Houchang D. Modanlou MD*
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া আল-রাযি ছিলেন বহু বিষয়ে একজন পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব এবং সেই সাথে একজন দার্শনিক ও চিকিৎসক। তিনি ৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে সামানি রাজবংশের তৎকালীন প্রাদেশিক রাজধানী ও বর্তমান ইরানের তেহরান শহরের নিকটস্থ ঐতিহাসিক রেই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন, যদিও কেউ কেউ ধারণা করে থাকেন যে, তিনি ৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ ও ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। রসায়ন, চিকিৎসা, দর্শন ও চিকিৎসাবিদ্যার নীতিশাস্ত্র ও অধিবিদ্যা বিষয়ে অবদানের জন্য তিনি সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি উল্লিখিত বিষয়সমূহে ১৮৪টি গ্রন্থ ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেন।
যাকারিয়া রাযি প্রাচীন গ্রিক ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন এবং গ্রিক চিকিৎসক ও দার্শনিক গ্যালেনের একজন প্রশংসাকারী ও সমালোচকও ছিলেন। রাযির প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না, তবে এটি লিখিত রয়েছে যে, তিনি যুবক বয়সে বীণাজাতীয় যন্ত্র বাজাতেন এবং গানের একটি বিশ্বকোষ রচনা করেছিলেন। গানের মাধ্যমে স্বচ্ছন্দ জীবন যাপনের পথ রচনায় ব্যর্থ হন। এরপর তিনি তাঁর মনোযোগ রসায়নবিদ্যার দিকে নিবদ্ধ করেন।
একজন প্রকৃত রসায়নবিদ ও পদার্থবিদ হওয়ার কারণে তিনি এ দুই বিষয়ে গবেষণায় অতুলনীয় অবদান রাখেন এবং রসায়নবিদ্যার ওপরে বেশ কিছু গ্রন্থ ও প্রবন্ধের মাধ্যমে মধ্যযুগীয় রসায়নবিদ্যার স্থলে আধুনিক রসায়নবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি অ্যালকোহল (ইথানল) আবিষ্কার ও পরিশুদ্ধ করেন এবং ঔষধশাস্ত্রে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। এছাড়াও আধুনিক রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশলের চালিকাশক্তি সালফিউরিক এসিড আবিষ্কারের কৃতিত্বও তাঁর বলে উল্লেখ করা হয়। অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ও অন্যান্য এসিডের আবিষ্কারের কৃতিত্বও রাযির। রাসায়নিক উপাদানসমূহের নিয়মানুগ শ্রেণিবিন্যাস, রাসায়নিক বিক্রিয়া ও পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে তাঁর অর্জনসমূহ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
‘কিতাব আল-আসরার (রহস্যসমূহের বই) এবং সির আল-আসরার (রহস্যসমূহের রহস্য) নামক দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে তিনি বস্তুকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলো হলো : উদ্ভিদ, প্রাণী ও খনিজ মূল। যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, তিনি লোহা এবং তামাকে স্বর্ণে রূপান্তরিত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পেরেছেন কিনা, তখন তিনি রসায়নের সীমাবদ্ধতার উপলব্ধি থেকে বলেন : ‘আমি রসায়ন বুঝি এবং আমি দীর্ঘ সময় ধরে ধাতুর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু এটি আমার কাছে এখনো স্পষ্ট হয় নি যে, কীভাবে একজন তামাকে স্বর্ণে রূপান্তরিত করবে। গত কয়েক শতকে প্রাচীন বৈজ্ঞানিকগণের গবেষণা সত্ত্বেও সেখানে কোন উত্তর পাওয়া যায় নি। আমার খুবই সন্দেহ আছে, এটি আদৌ সম্ভব কিনা।’
তবে তিনি সংকর ধাতু তৈরির কৌশল বর্ণনা করেন। ফারসি ভাষায় রসায়ন বিষয়ে বিশটি গ্রন্থ ও প্রবন্ধ যাকারিয়া রাযির রচনা হিসেবে প্রসিদ্ধ।
আল-বিরুনির সূত্রে নায়েরনাওরী উল্লেখ করেছেন যে, রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে রাযির চক্ষুরোগ হয়েছিল। আর একারণেই তিনি রসায়নচর্চা বন্ধ করে দেন।
ত্রিশ বছর বয়সে রাযি পশ্চিম ইরানের মার্ভ শহরের আলি ইবনে রব্বান আল-তাবারী নামক একজন দার্শনিক ও চিকিৎসকের অধীনে দর্শন ও ঔষধ সম্পর্কিত পড়াশোনা শুরু করেন। আল তাবারী যে ঔষধশাস্ত্রে রাযির শিক্ষক ছিলেন নায়েরনাওরী এই তথ্যের সঠিকতা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, রাযি সম্ভবত তাবারীর ঔষধশাস্ত্রের ওপর লিখিত তথ্যকে কাজে লাগিয়েছেন, কেননা, রাযির জন্মের পূর্বেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
রেই শহরের রয়েল হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময় যাকারিয়া রাযি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তাঁর ঔষধশাস্ত্রের শিক্ষকদের মধ্যে আরেকজন হলেন প্রসিদ্ধ চিকিৎসক আলি ইবনে সাহল (একজন ইহুদি, যিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং হায়েরকানিয়া বা তাবারিস্তানের বিখ্যাত মেডিকেল স্কুলে কর্মরত ছিলেন।) অচিরেই তিনি চিকিৎসাবিদ্যা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার দিক থেকে তাঁর শিক্ষকদেরকে অতিক্রম করে যান। পরবর্তীকালে তৎকালীন মুসলিম শাসকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি মুক্তাদারি হাসপাতালের প্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। বর্ণিত হয়েছে যে, খলিফা তাঁর নিকট একটি হাসপাতাল তৈরি করার প্রস্তাব দেন। রাযি হাসপাতালের স্থান নির্বাচনে অভিনব পদ্ধতির আশ্রয় নেন। তিনি কিছু তরতাজা মাংসের টুকরা ইরাকের বাগদাদ শহরের বিভিন্ন স্থানে রেখে আসেন। কিছু দিন পর তিনি মাংসের টুকরাগুলো পরিদর্শন করেন। অবশেষে সবচেয়ে কম নষ্ট হওয়া মাংসটি যে স্থানে রেখে এসেছিলেন সেই স্থানটিকে হাসপাতালের স্থান হিসেবে নির্বাচন করেন।
একজন দার্শনিক, চিকিৎসক ও শিক্ষক হিসেবে উচ্চ মর্যাদার কারণে মুসলিম অঞ্চলগুলো থেকে ছাত্ররা তাঁর কাছে ভীড় জমাতো।
‘শুকুক আলা গ্যালেনাস’ (গ্যালেন সম্পর্কে সন্দেহ) নামক পুস্তকে তিনি ঔষধশাস্ত্রে প্রশংসনীয় অবদানের জন্য গ্যালেনের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তিনি গ্যালেনের গ্রিক ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের দাবি এবং তাঁর বেশ কিছু চিকিৎসাগত দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করেন নি। কারণ, গ্যালেনের কিছু কিছু রোগের বর্ণনা স্বয়ং রাযির রোগসংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ থেকে আলাদা ছিল, যেমন : জ্বর ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি। কোন কোন ক্ষেত্রে রাযি বিশ্বাস করতেন, তাঁর রোগ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা গ্যালেনকেও অতিক্রম করেছে। এছাড়াও তিনি সক্রেটিস ও অ্যারিস্টোটলের মন ও শরীরের বৈপরীত্য সংক্রান্ত চিন্তাধারাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি রোগীর কল্যাণের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মমর্যাদার মতবাদের চিন্তার অগ্রপথিক ছিলেন।
‘সুস্থ মন ও সুস্বাস্থ্য ’ বিষয়টি তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর রোগীদের সাথে অনায়াসে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে। তিনি আরোগ্য লাভের উপায় হিসেবে রোগীদেরকে তাঁর নির্দেশনা মেনে চলার জন্য বলতেন এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তাদের মানসিক শক্তিকে উজ্জীবিত করতেন যা দ্রুত আরোগ্য লাভের ক্ষেত্রে সহায়ক হতো। আত্মিক বা আধ্যাত্মিক ঔষধ সম্পর্কিত গ্রন্থে রাযি চিকিৎসক-বিজ্ঞানীদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন। তিনি রোগীর আধ্যাত্মিক গুণের উৎকর্ষের গুরুত্বের বিষয়ে আলোচনা করেন। ক্যাসিমভ বলেন যে, রাযির আধ্যাত্মিক ঔষধকে ‘চিকিৎসা নীতিবিজ্ঞান’ এর ধারণার সমার্থক হিসেবে দেখা হয়।
রাযির চিকিৎসা দৃষ্টিভঙ্গি হিপোক্রিটাস ও গ্যালেন দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তাত্ত্বিকভাবে রাযি একজন গ্যালেনিস্ট, কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তিনি স্পষ্টতই হিপোক্রিটাসের নীতি দ্বারা অধিকতর পরিচালিত, কিন্তু রাযির পাণ্ডিত্য ছিল আরো ব্যাপক ও গভীর এবং তাঁর যথেষ্ট পরিমাণে স্বকীয়তাও ছিল।
রাযি মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি ও শরীরবৃত্তীয় ব্যাখ্যার মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছিলেন। তিনি সাইকোথেরাপিকে প্রাথমিক পর্যায়ে, কিন্তু গতিশীল উপায়ে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি চিকিৎসকদের পেশাগত প্র্যাকটিসের একটি স্পষ্ট মানদ- স্থাপন করেছিলেন। তিনি ঔষধ বিষয়ক একজন শ্রান্তিহীন লেখক ছিলেন। চিকিৎসা সংক্রান্ত তাঁর প্রায় ৪০টি গ্রন্থ ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইরান, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি ও জাদুঘরগুলোতে সংরক্ষিত আছে।
জর্জ সার্টন তাঁর ‘Introduction to the History of Science’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘রাযি ছিলেন ইসলাম ও মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৭০ সালের মে মাসের বুলেটিনটি রাযিকে উৎসর্গ করা হয়। এতে বলা হয়, গুটিবসন্ত ও হামের ওপর তাঁর লেখাগুলো তাঁর মৌলিকতা ও সঠিকতার বিষয় নির্দেশ করে এবং সংক্রামক ব্যাধির ওপর তাঁর রচনা এ বিষয়ের ওপর লিখিত সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক রচনা। রাযিকে ঔষধবিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রের অগ্রপথিক বলা হয়, বিশেষ করে শিশুরোগবিদ্যা ও সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে।
তিনি ঔষধের ওপর ২৩ খণ্ডের বিশাল মেডিকেল এনসাইক্লোপিডিয়া রচনা করেন; গ্রন্থটির নাম ‘কিতাব আল-হাওয়ী ফীত তিব’। এতে গ্রিক ও ভারতীয় লেখকদের লেখা ও তাঁর নিজের গবেষণালব্ধ বিষয়াদি রয়েছে।
অন্যান্য চিকিৎসাগত অবদান
রাযি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি চোখের পিউপিলারী রিফ্লেক্স সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি ছানির অপারেশনের বর্ণনা দিয়ে বলেন : ‘আমি অক্ষিগোলকের নিম্ন অংশকে উন্মুক্ত করেছি এবং ছানিকে বহির্মুখ করে দিয়েছি।’ তিনি হলেন প্রথম চিকিৎসক যিনি সম্পূর্ণরূপে সুনির্দিষ্ট করে গনোরিয়ার লক্ষণগুলো বর্ণনা করেন। তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি মায়ের গর্ভে শিশুর মেরুদণ্ডের গঠন সংক্রান্ত রোগ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে মৃগীরোগের ব্যাপারে আলোচনা করেন। তিনি বংশগত বা জন্মের পরপরই নবজাতকের মস্তিষ্কের অসুস্থতা hydrocephalus সম্পর্কে বর্ণনার পাশাপাশি microcephalyসম্পর্কেও বর্ণনা দেন এবং পরবর্তী অসুখটিকে তিনি নিরাময়ের অযোগ্য বলে মনে করেন। বসন্তকালে গোলাপের ঘ্রাণ নেয়ার পর যুবরাজ আবু যায়েদ বালখীর নাকের অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণ নিয়ে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যেখানে তিনি allergic rhinitis সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন।
রাযিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন যে, জ্বরের ক্ষেত্রে একটি প্রকৃতিগত প্রতিরোধ পদ্ধতি রয়েছে, যেটি রোগের মোকাবিলায় শরীরের নিজস্ব পদ্ধতি। তাঁর লেখায় রাযি বাতজ্বরকে গেঁটেবাত থেকে আলাদা করেন। তিনি তাঁর রোগীদের ওপর নতুন ঔষধ প্রয়োগের পূর্বে পশুর ওপর নতুন ঔষধের পরীক্ষা চালাতেন এবং সেগুলোর ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করতেন। তাঁর ‘কিতাব আল-হাওয়ী ফীত তিব’ গ্রন্থের একটি খ- ফার্মাকোলজি নিয়ে লেখা। নিশ্চিতভাবেই ফার্মেসী এর ঐতিহাসিক ভিত্তির অনেক বিষয়ের জন্য এককভাবে যাকারিয়া রাযির ওপর নির্ভরশীল। ২৭ আগস্ট রাযির জন্মদিনটিকে ইরানে ফার্মাকোলজি দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে।
উপসংহার
খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে ইসলামের উত্থান এবং ৮ম শতাব্দীতে বাগদাদে আব্বাসী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে পারস্যের গান্দীশাপুর অ্যাকাডেমি থেকে চিকিৎসক-দার্শনিকদের একটি মাইগ্রেশন হয় বাগদাদে; যাতে ইসলামের স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। ইসলামি চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগের ভিত্তিস্থাপনকারীদের অন্যতম ছিলেন পারস্যের রসায়নবিদ-চিকিৎসক-দার্শনিক যাকারিয়া রাযি। যে কোন ব্যক্তি পত্র-পত্রিকায় ছাপানো চিকিৎসা বিষয়ক নানা সূত্র থেকে যাকারিয়া রাযির যে অবদানসমূহ খুঁজে পাবেন তা হলো- তিনি সর্বপ্রথম শিশুরোগবিদ্যা বিষয়ক নীতিমালা (The Practica Puerorum) রচনা করেন। তিনি একজন যুক্তিবাদী ব্যক্তি ছিলেন এবং যুক্তির ওপর ভীষণভাবে আস্থাশীল ছিলেন। তিনি ছিলেন সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে মুক্ত এবং নিজের চিন্তাধারা প্রকাশে অকুতোভয়। মহানুভবতায় তিনি ছিলেন অসাধারণ এবং সর্বদা দরিদ্রদের সাহায্যের ব্যাপারে আকাঙক্ষী। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় চিকিৎসক। যেহেতু তিনি একজন পণ্ডিত ব্যক্তি ও ধীসম্পন্ন শিক্ষক ছিলেন সেহেতু শিক্ষার্থী ও চিকিৎসাশাস্ত্রের চর্চাকারীরা তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য ভীড় জমাতেন। তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনকে সম্মান করতেন। তাঁর জ্ঞান পূর্ববর্তী লেখকদের গ্রহণযোগ্য ও স্বনামধন্য গ্রন্থসমূহের ওপর ভিত্তিশীল হলেও তিনি স্বাধীন চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন এবং যখন তাঁর নিজের পর্যবেক্ষণকৃত বিষয় পূর্ববর্তীদের বক্তব্যের বিপরীত প্রতিপন্ন হতো তখন তিনি নিজের পর্যবেক্ষণলব্ধ বিষয়ের ওপর অটল থাকার ব্যাপারে কখনই ভীত হতেন না। তিনি অন্যদেরকে এই বলে পরামর্শ দিতেন যে, একটি গ্রন্থে যা লিপিবদ্ধ রয়েছে, তা একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অভিজ্ঞতার তুলনায় কম মূল্য রাখে।
অসুস্থতার কারণ সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বিবরণ দান, মৌলিক পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে গতিশীল ও বাস্তবধর্মী পদ্ধতি ব্যবহারের কারণে রাযি বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন। তিনিই সর্বপ্রথম গুটি বসন্ত ও হাম সম্পর্কে নিখুঁত বর্ণনা দেন; তিনি চিকিৎসার ক্ষেত্রে ওষুধের তুলনায় যথাযথ খাদ্য গ্রহণের বিষয়ে অগ্রাধিকার দান করেন এবং অপেক্ষাকৃত জটিল ব্যবস্থাপত্রের পরিবর্তে সহজ সরল ব্যবস্থাপত্র দেন। বিপুল পরিমাণ সম্মানি পাওয়ার পরও হতদরিদ্রদের প্রতি মহানুভবতার কারণে তিনি সম্পদহীন অবস্থায় মারা যান। কয়েক শতাব্দী যাবত ইবনে সীনার চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ ‘কানুন’ এর পাশাপাশি তাঁর বইও ইউরোপের প্রধান প্রধান মেডিকেল কলেজে প্রাথমিক পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হতো। বিশ্বের অনেক দেশ তাঁর স্মরণে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করেছে। যাকারিয়া রাযির একটি পোট্রেট প্যারিসের স্কুল অব মেডিসিন-এর দেয়ালে টাঙানো রয়েছে।
লেখক :
: Department of Pediatrics
University of California, U.S.A.
অনুবাদ : সরকার ওয়াসি আহম্মেদ