রবিবার, ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩রা ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

যথাযথ মর্যাদায় অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন

পোস্ট হয়েছে: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২০ 

news-image

ভাষার জন্য যারা দিয়েছেন প্রাণ, যাদের বুকের তাজা রক্ত রাঙিয়েছিল রাজপথ- সেই সব ভাষা শহীদকে শুক্রবার বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছে জাতি। যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করেছে মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ ফুলে ফুলে ভরে ওঠে দেশের সব প্রান্তের প্রতিটি শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। গান, কবিতা আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক ও আলোচনা অনুষ্ঠানসহ মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে দিনব্যাপী চলে নানা আয়োজন। বাংলাদেশের সাথে সাথে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রভাতফেরিতে হাতে হাতে রক্তরঙা গোলাপ, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসিসহ দেশি-বিদেশি ফুল নিয়ে চেতনা, দ্রোহ আর শ্রদ্ধাবোধকে সঙ্গী করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যান স্মৃতির মিনারগুলোতে। সেই সঙ্গে জিয়ারত, মোনাজাত, প্রার্থনাসহ নানা কর্মসূচিতে মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেন তারা।

আটষট্টি বছর আগের একুশই আমাদের জাতীয় জীবনে সব প্রেরণার উৎস। একুশের পথ ধরেই এসেছে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। একুশের চেতনা ধারণ করেই উচ্চ আদালত, নির্বাচন কমিশন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি দফতরসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে চালু হয়েছে বাংলা। তবে এখনও সব দফতরে চালু হয়নি মাতৃভাষা।

এখনও শুদ্ধ ও বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারেন না অনেকেই। তাই সর্বস্তরে ও জাতিসংঘে দাফতরিক ভাষা হিসেবে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করার সোচ্চার দাবি ছিল শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের কণ্ঠে। একুশের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তারা।

একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় রাতের নিস্তবতা ভেঙে বেজে উঠে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও শহীদ আলতাফ মাহমুদের অমর সৃষ্টি অবিনাশী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কী ভুলিতে পারি…।’ শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। রাষ্ট্রপতির পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবির ওপরে কালো মুজিব কোট এবং প্রধানমন্ত্রীর পরনে শোভা পাচ্ছিল সাদা শাড়ির ওপর কালো রঙের চাদর।

এর আগে রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান তাকে স্বাগত জানান। এছাড়া শহীদ বেদিতে ফুল দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া। এরপর শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

এ সময়ে তার সঙ্গে ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ। এরপর সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গার নেতৃত্বে দলটির নেতারা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

এরপর পর্যায়ক্রমে শ্রদ্ধা জানান- সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল আওরঙ্গজেব চৌধুরী ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত, পুলিশ বাহিনীর প্রধান জাবেদ পাটোয়ারী, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধি, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রোভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। রাত সাড়ে ১২টার পর শ্রদ্ধা জানাতে সর্বস্তরের জনগণের জন্য শহীদ মিনার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

এরপর রাজধানীর সব সড়কের জনস্রোত এসে মিশে শহীদ মিনারের পথে। শিশু থেকে বৃদ্ধ- কেউ ব্যক্তিগতভাবে, কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে, কেউবা সংগঠনের সহকর্মীদের নিয়ে। প্রথম প্রহরের পর রাত শেষে ফোটে ভোরের আলো। সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়ায়। তবু মানুষের সেই ঢল যেন থামার নয়। শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বহু বিদেশি নাগরিকও। সবমিলিয়ে শহীদ মিনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা একসময়ে পরিণত হয় জনসমুদ্রে। এ সমুদ্রের তরঙ্গ ছুঁয়েছিল অমর একুশে স্মরণে আয়োজিত বইমেলাকেও।

শুধু কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারই নয়, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিবেদন করা ফুলে ভরে ওঠে দেশের হাজারও শহীদ মিনারের বেদি। এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠা অস্থায়ী স্মৃতির মিনারও এদিন ভরেছে শ্রদ্ধার ফুলে। নগ্ন পায়ে সারি সারি মানুষ হেঁটেছেন এক পথে কাঁধে কাঁধ, কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে। অন্যান্য দেশেও বহু নাগরিক জানিয়েছেন ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

গৌরবের মিনারে শ্রদ্ধা জানানো ছাড়াও দিনটি পালনে ছিল নানা আয়োজন। ছিল ফাতেহা পাঠ, কোরআনখানি, বিশেষ প্রার্থনা, আলোচনা সভা, সেমিনার, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খাবার বিতরণ ইত্যাদি।

বৃহস্পতিবার রাত ১০টার পর থেকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আশপাশে লাখো মানুষ জড়ো হতে থাকেন। কারও পরনে কালো পোশাক, কারও বুকে কালো ব্যাজ। কী শাড়ি আর পাঞ্জাবি- কোনোটিতে বর্ণমালা খচিত আবার কোনোটিতে ভাষা শহীদদের নাম-ছবি।

কোনোটিতে ভাষার প্রতি ভালোবাসা উজ্জীবিত করা নানা স্লোগান, শহীদ মিনার ও কালোর বুকে রক্তরঙের ছটা। শাহবাগ, দোয়েল চত্বর, পলাশী, আজিমপুর, নীলক্ষেত, চানখাঁরপুলসহ শহীদ মিনারে যাওয়ার প্রবেশপথে শুধুই মানুষের মিছিল, গান আর কবিতা। যারা রাতে শ্রদ্ধা জানাতে পারেননি তারা সকাল থেকেই সারি বাঁধেন শহীদ মিনারের পথে।

এদিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ইডেন মহিলা কলেজ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল, নবাব ফয়জুন্নেসা হল, শামসুন্নাহার হল, রোকেয়া হল। সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, বাংলা একাডেমি, জাতীয় প্রেস ক্লাব, নার্সিং ও মিডওয়াইফারির কর্মকর্তারা, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিল, শিল্পকলা একাডেমি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান আজিমপুর, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, গণতন্ত্রী পার্টি, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন শ্রদ্ধা জানিয়েছে ।