শুক্রবার, ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

মুসলমানদের মধ্যে চরমপন্থী চিন্তাধারার বিস্তার

পোস্ট হয়েছে: এপ্রিল ১৯, ২০১৬ 

সংকলন : সেলিনা পারভীন

ইসলামী দুনিয়া আজ তার ইতিহাসের সবচেয়ে জটিলতম সময় অতিক্রম করছে। একদিকে ইসলামী জাগরণের ঢেউ বহমান, অন্যদিকে এই প্রাণ-সঞ্জীবনী ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োজিত করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে ইসলামের চরমতম শত্রুমহল। তারা ইসলামের শান্তিকামী চেহারা ও সৌন্দর্যকে ধ্বংস করার জন্য বিভিন্নমুখী প্রয়াসে লিপ্ত। এ সময় আমরা এমনসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি যে সম্পর্কে আমাদের চিন্তাশক্তি বা কল্পনাশক্তিও হার মেনে যায়। সারাবিশ্বে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে যা ঘটছে তা অবিশ্বাস্য, মানুষের সাধ্য নেই তা অনুধাবন করার। কারণ, ঘটনাগুলো ঘটছে অতি দ্রুত। বাস্তবতা হচ্ছে বিভিন্ন উগ্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটিয়ে, ইসলামের নামে ভ্রান্ত বিশ্বাসের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে মুসলমানদের মধ্যে তারা বিভেদের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।
ইসলামের শত্রুরা বুঝতে পেরেছে ইসলামের প্রকৃত ও মহান শিক্ষা মুসলমানদের মধ্যে বিস্তার লাভ করলে উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্ব বরবাদ হয়ে যাবে। মুসলমানরা ইসলামের এ বিশেষত্ব অনুধাবনের সাথে সাথে ইসলাম বৈশ্বিক রূপ ধারণ করবে, গ্লোবালাইজ্ড হয়ে যাবে। ইসলামের এ জাগরণকে কোনক্রমেই রুখে দেয়া যাবে না।
ইসলামী জাগরণের বিরুদ্ধে শত্রুদের কার্যক্রমের পাশাপাশি যে বিষয়টি ইসলামী সমাজের অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো ‘তাকফিরি ফেতনা’ (কথায় কথায় মুসলমানদেরকে কাফির ঘোষণা দেয়া)। বিভ্রান্তিকর মিথ্যা ফতোয়ার ভিত্তিতে এই তাকফিরি গোষ্ঠী খারেজীদের অনুরূপ মুসলমানদের রক্ত ঝরাচ্ছে, তাদের সম্পদসমূহ নষ্ট করছে, মুসলমানদের ধর্মীয় ও পবিত্র স্থাপনাগুলো ধ্বংস করছে। দেশে দেশে বিভিন্ন নামে মুসলমানদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে প্রতিদিন। এমন একটি দিনও অতিবাহিত হচ্ছে না যেদিন এই চরমপন্থী গোষ্ঠী মুসলমানদের রক্তপাত ঘটাচ্ছে না। বিপজ্জনক বিষয় হলো দেশগুলোর রাজনৈতিক মতপার্থক্যে অহেতুকভাবে ধর্মকে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। এই অন্যায় প্রবণতার কারণে অধিকাংশ সংঘাত ঘটছে। সমস্যা হলো তাদের এসব কর্মকাণ্ডকে তারা যুক্তিসিদ্ধ করছে আল-কোরআনের শিক্ষাকে বিভ্রান্তিমূলকভাবে ব্যাখ্যা করে।
দুঃখজনকভাবে দেখা যায়, তাকফিরি গোষ্ঠী হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। আর পাশ্চাত্য মিডিয়া এগুলোকে ইসলামী কর্মকাণ্ড হিসেবে চালিয়ে দিয়ে মানুষকে প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এই গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পাশ্চাত্য মিডিয়াসমূহ ওয়াকেবহাল হলেও তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। এই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে কাজে লাগিয়ে ইসলামের শত্রুরা নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এভাবে এই সমস্ত গোষ্ঠীর কার্যকলাপ ইসলাম ও ইসলামী সমাজের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে।
ইতিহাসের নিরিখে চরমপন্থী ধারা
চরমপন্থী গোষ্ঠীসমূহের এই সমস্ত কর্মকাণ্ড আমাদেরকে খারিজীদের কথা মনে করিয়ে দেয়। খারিজীরা ছিল কঠোরহৃদয় এবং স্বেচ্ছাচারী চিন্তার একটা জনগোষ্ঠী। সিফফিন যুদ্ধে সালিশীর বিষয়টি আসলে তাদের গোঁয়ার্তুমি ও আমিত্বের নিকৃষ্ট স্বেচ্ছাচারিতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। খারেজীরা ঈমান ও কর্মের ক্ষেত্রে সদা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকত। ইসলামের ইতিহাসের ঐ খারিজী গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডই নতুনভাবে মনে করিয়ে দেয় আজকের তাকফিরিদের কর্মকাণ্ড। তৎকালীন তাকফিরিরা নিরীহ মুসলমানদের নৃশংসভাবে হত্যা করত, তাদের সহায়সম্পদ লুট করত। তাদের এ সমস্ত নৃশংসতাকে ইসলাম ও কোরআনের রেফারেন্সে যুক্তি সিদ্ধ করার চেষ্টা করত। ইমাম আলী (আ.) এই অজ্ঞ তাকফিরি গোষ্ঠীর ব্যাপারে বলেছেন, ‘তারা সত্য সন্ধান করে, কিন্তু কোন না কোন কারণে তা ভ্রান্ত পথে চলে যায়। তারা মিথ্যাকে সত্যের মতো করে উপস্থাপন করে।’ ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়াদির ক্ষেত্রে তারা নিজেদের বিভ্রান্তিকর ও নব উদ্ভাবিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে ইসলামের সুষুমামণ্ডিত জীবন বিধানকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে এবং বিকৃত অবস্থাকে বৈধতা দান করে। খারিজীরা মুসলমানদের মূূল ¯্রােতের সাথে অসমীহ ও অবাধ্যচারিতার প্রকাশ ঘটায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই দলটি সম্পর্কে বলেছেন, ‘ধনুক থেকে তীর যেভাবে নিক্ষিপ্ত হয় তদ্রƒপ তারা দ্বীন থেকে নিক্ষিপ্ত হবে।’(১) খারিজী গোষ্ঠীটি তাদের বক্র উপলব্ধি ও বিচ্যুত বোধের কারণে দ্বীনের মূল ¯্রােত থেকে দূরে চলে যায়। ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে নিজেদের ধ্বংসের বিনিময়ে হলেও তারা ঐশী হেদায়াতের আলো নিভিয়ে দিতে চাইত। ইতিহাসের ক্রমধারায় খারেজী গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন ধারা উপধারায় বিভক্ত হয়ে তাদের এ জঘন্য কাজগুলো চালিয়ে যায়। তাদের একটা দল গুনাহের কাজ থেকে মানুষকে দূরে রাখার জন্য তাদের ঘরে আক্রমণ করত। নারীদের সাথে একত্রে কোন পুরুষকে দেখলেই তারা তাদের জিজ্ঞাসা করার জন্য দাঁড় করিয়ে রাখত; যদি তারা পরস্পরের আত্মীয় না হতো তবে তাদেরকে বন্দি করত। এইভাবে এই তাকফিরি গোষ্ঠীগুলো সাধারণ মুসলমানদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। খলিফাদের হস্তক্ষেপের কারণে আপতত নির্মূল হলেও ভিন্ন নামে ঐ চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠে।
তাকফিরি চিন্তা পুনরায় ফিরে আসে ইবনে তাইমিয়ার মাধ্যমে। তিনি মনে করতেন, ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস একমাত্র কোরআন ও হাদীসের আক্ষরিক অর্থের অনুগামী হবে। বিকৃত এ চিন্তাধারার গোষ্ঠীগুলো অন্য মুসলমানদের ব্যাপক হারে হত্যা করেছে। এমনকি নামাযরত অবস্থায় মুসল্লিদের হত্যা করেছে। নির্দোষ অসহায় নারী-শিশুদের তারা অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করছে। নিজেদের ভ্রান্ত বিশ্বাস দ্বারা তারা অন্যা মুসলমানদের কাফির-মুশরিক ঘোষণা দিয়ে তাদের সহায়-সম্পদ, এমনকি নারীদেরকে নিজেদের জন্য হালাল ঘোষণা করেছে। ইবনে তাইমিয়ার চিন্তাধারার অনুসারীরা আজকের মুসলিম বিশ্বে চরমপন্থী কর্মকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী।
ইসলামের আলোকে পর্যালোচনা
ক. মানবিক মূল্যবোধের প্রতি ইসলামের সম্মান : ইসলাম মানবিক মূল্যবোধকে সম্মান করে। পবিত্র কোরআন ঘোষণা করছে, ‘এই কারণেই বনী ইসরাঈলের প্রতি এই বিধান দিলাম যে, নর হত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করা হেতু ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যে দুনিয়ার সকল মানুষকে হত্যা করল, আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করল সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।’Ñ সূরা মায়িদা : ৩২।
উপরিউক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ্ মানুষের জীবন ও সম্পদের হেফাজতকে পবিত্র কর্তব্য হিসেবে মুসলমানদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। মানুষের জান-মালের সুরক্ষা ইসলামী শিক্ষার অপরিহার্য অংশ। অকারণে কোন মুসলমান অন্য মানুষের জান-মালের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
খ. মুসলমানদের মর্যাদা : পবিত্র কোরআন ইরশাদ করছে : ‘কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন; তাকে লা’নত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।’Ñ সূরা নিসা : ৯৩
এই আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ মুমিনের জীবন ও সম্মানকে এক অনন্য সুরক্ষা দান করেছেন। কোন মানুষের এ অধিকার নেই যে সে স্বীয় ইচ্ছা বিবেচনায় কোন মুমিনের প্রাণ সংহার করবে। উপরন্তু ভিন্ন গোত্রের বা গোষ্ঠীর কেউ যদি মুসলমানদের সালাম প্রদান করে তবে সেই ব্যক্তির জান ও মাল মুসলমানদের হাতে নিরাপদ থাকবে। ইসলামের শিক্ষা হলো সালাম দেয়াটাই ঐ ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট। অযথা তাকে হয়রানি করা যাবে না। অন্যান্য মুসলমানে মতো সমাজে সেও নিরাপত্তা লাভ করবে। সম্পদের লোভে অথবা অন্য কোন কারণে তাকে হত্যা করা মুসলমানদের জন্য নিন্দনীয় অপরাধ। ইরশাদ হচ্ছে : “হে মুমিনগণ! তোমরা যখন আল্লাহর পথে যাত্রা করবে তখন পরীক্ষা করে নেবে এবং কেউ তোমাদেরকে সালাম করলে ইহ জীবনের সম্পদের আকাক্সক্ষায় তাকে বল না, ‘তুমি মুমিন নও’, কারণ, অনায়াসলভ্য সম্পদ আল্লাহ নিকট প্রচুর রয়েছে।”Ñ সূরা নিসা : ৯৪। এই আয়াতের প্রেক্ষাপট হলো : খায়বর যুদ্ধ শেষে নবীজি উসামা বিন যাইদকে কিছু সংখ্যক সঙ্গীসহ এক ইহুদি গোত্রের কাছে ইসলাম প্রচারের জন্য প্রেরণ করেন। ইহুদি গোত্রটি ফাদাক বাগানের পাশেই বসবাস করত। মারদাস বিন নাহিদ নামের একজন ইহুদি উসামার আগমন বুঝতে পেরে তার সহায়-সম্পদ ও পরিবারের সদস্যদেরকে কাছাকাছি একটা পাহাড়ে লুকিয়ে রাখে। অতঃপর সে উসামার কাছে আসে এবং ঘোষণা করেÑ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। এ ঘোষণা শোনার পরও উসামা ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করে এবং রাসূল (সা.)-এর কাছে এসে ঐ ঘটনার বর্ণনা দেয়। নবীজি উসামাকে জিজ্ঞেস করেন : ‘সত্যিই কি তুমি ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করেছ, যে তোমার কাছে মহান আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর রাসূলের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছে?’ উসামা উত্তর দিলেন : ‘হে আল্লাহর রাসূল! সে নিজেকে রক্ষা করার জন্য উক্ত সাক্ষ্য প্রদান করেছে।’ উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন : ‘তুমি কি তার অন্তরের খবর নিয়ে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছ?’২
এ রকম অনেক হাদীস আছে যেখানে নবীজি কাউকে মুসলমানদের সমাজ থেকে বহিষ্কার করার ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এমনকি তিনি বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের মাঝে সীমারেখা টেনে দিয়েছেন। আর তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে সে ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : ‘আমি আল্লাহর নির্দেশে ইসলাম প্রচারের জন্য কোন মিশন প্রেরণকালে তাদেরকে এইভাবে নির্দেশ দিতামÑ তারা যদি বলে, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই’, অতঃপর তারা নামায আদায় করে এবং কেবলা মেনে চলে, তাদের পশুগুলোকে আমাদের মতো জবাই করে তবে তাদের জান ও মাল সুরক্ষিত থাকবে।”৩
অন্য আর একটি ঘটনা হলো : রাসূলুল্লাহ (সা.) ইমাম আলী (আ.)-কে খায়বরের যুদ্ধে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তিনি খায়বরের সুরক্ষিত দুর্গ জয় করার নির্দেশ দেন। ইমাম আলী রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন : ‘আমি কতক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে যুদ্ধ করব?’ উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন : ‘তুমি তাদের সাথে ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা মুখে মহান আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দেয় এবং আমাকে আল্লাহর প্রেরিত নবী হিসেবে মেনে না নেয়। তারা এ ঘোষণা দিলে তুমি তাদের জান-মালের উপর আর আক্রমণ করবে না। এতদসত্ত্বেও তারা যদি কোন মন্দ কাজ করে তবে সে ভার মহান আল্লাহ উপর ন্যস্ত করবে।’৪
একই রকম আর একটি হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন : ‘তাদেরকে ক্ষমা করে দাও যারা মহান আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর প্রেরিত রাসূলের সপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। কখনও তাদেরকে কাফের বল নাÑ তারা পাপ কাজে লিপ্ত হলেও। যে আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দেয় কেউ তাকে মুসলমান সমাজ থেকে বহিষ্কার করলে প্রকৃতপক্ষে ঐ ব্যক্তি নিজেই অবিশ্বাসীদের মধ্যে গণ্য হবে।’
সামাহ বিন মেহরান ইমাম জাফর সাদেক (আ.) থেকে বর্ণনা করেন। ইমাম বলেছেন : ‘ইসলাম এই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিতÑ যে মহান আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর প্রেরিত রাসূলের (সা.) ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে তার জীবন সুরক্ষিত থাকবে, বিয়ে-শাদী ও উত্তরাধিকারের ব্যাপারে সকল মুসলমানের মতো সমান অধিকার ভোগ করবে।’৫
গ অন্য মুসলমানদের কাফের আখ্যায়িত করার ব্যাপারে মুসলিম পণ্ডিতগণের দৃষ্টিভঙ্গি : মুসলমানদের কাউকে কাফের হিসেবে আখ্যায়িত করার ব্যাপারে মুসলিম পণ্ডিতগণ সদা সতর্ক ছিলেন। তাঁদের সর্বসম্মত রায় হলো একাজ পবিত্র কোরআন ও হাদীসের পরিপন্থী এবং তা মুসলিম সমাজে অহেতুক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে আলেমগণ কাফের ফতোয়া দেওয়ার ব্যাপারে বিরোধী ভূমিকা পালন করেন। শিয়া আলেমদের মধ্যে শেখ সাদুক, শেখ হাসান নাজাদী, গ্রান্ড আয়াতুল্লাহ হাকিম, গ্রান্ড আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমোলী প্রমুখ এসব ফতোয়া দেওয়ার ঘোর বিরোধী। অন্যদিকে সুন্নি আলেমগণও এ ব্যাপারে সোচ্চার।
শেখ সাদুক এ ব্যাপারে বলেন : “ইসলাম ঘোষণা করেÑ ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল’; যে কেউ এ সাক্ষ্য প্রদান করলে তার জীবন ও সম্পদের উপর কেউ আক্রমণ করতে পারবে না। এই সাক্ষ্য দ্বারা তার জীবন ও সম্মান সুরক্ষিত হয়ে যায়।”৬
সুন্নি আলেমদের মধ্যে ইবনে হাজ্ম তাকফিরি বিশ্বাসসমূহ পৃথক পৃথকভাবে চিহ্নিত করে গ্রন্থবদ্ধ করেছেন। তাঁর গ্রন্থে ‘আল-কালাম ফি মান ইউকাফ্ফির ওয়া লা ইয়াকাফ্্ফার’ শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি বলেন : ‘এ ব্যাপারে জনসাধারণের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে :
প্রথমত, কেউ কেউ তাদের আদর্শিক ও ফতোয়াগত পার্থক্যের কারণে অন্যকে কাফের হিসেবে আখ্যায়িত করে;
দ্বিতীয়ত, কেউ কেউ তাদের বিপরীত চিন্তাধারার কোন একটি অংশকে এবং কেউ কেউ অপর অংশকে নিজেদের বিশ্বাসের আলোকে মূল্যায়ন করে অশ্রদ্ধাভরে প্রত্যাখান করেছে;
তৃতীয় দলটি হলো তারা যারা ফতোয়া ও আমলের ক্ষেত্রে তাদের থেকে ভিন্ন মতাদর্শ অনুসরণ করলেও তাদেরকে কাফের বা পাúী গণ্য করে না, বরং তাদেরকে সেই মুজতাহিদের ন্যায় বিবেচনা করে যিনি তাঁর কাজে ভুল করলেও নিয়তের কারণে ক্ষমার্হ;
চতুর্থত, সর্বশেষ দল হলো তারা যারা তৃতীয় দলের মতাদর্শ ধর্মীয় আমলের দিক থেকে গ্রহণযোগ্য গণ্য করে। কিন্তু আকিদাগতভাবে তাদের বক্তব্য হলো, ঐশী বিষয়ে মতভিন্নতার পরিণাম হলো কুফ্র এবং অন্যান্য বিষয়ে ত্রুটিপূর্ণ চিন্তাধারা হলো ফাসেকী কাজ।’৭
আবুল হাসান আশআরীর শিষ্য যাহের সারাখ্শি বলেন : “আবুল হাসান আশআরী আমার বাড়িতে মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিলেন। মৃত্যু ঘনিয়ে এলে তিনি তাঁর সকল ভক্ত ও সঙ্গীকে কাছে ডাকার নির্দেশ দিলেন। সবাই তাঁর সামনে এলে তিনি ঘোষণা করেন : ‘তোমরা সকলে সাক্ষী থেক, আমি কখনও কোন মুসলমানকে কাফের ঘোষণা করিনি, যদিও তারা পাপ কাজ করেছে। কারণ, তারা ইসলামী ইবাদত-বন্দেগি করেছে ও মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করেছে। ইসলাম তাদের সবাইকে নিজের মধ্যে একীভূত করে রেখেছে।”৮
একই রকম মনোভাব পোষণ করেন শাফেয়ী মাযহাবের ইমাম শাফেয়ী। তাঁর বিশ্বাসÑ ‘বাতিকগ্রস্ত মানুষের পাপের কারণে আমি তাদেরকে কাফের আখ্যায়িত করি না। যারা পবিত্র কেবলা মেনে চলে তারা কোন কাজ করলেও আমি তাদেরকে মুসলমান হিসাবে গণ্য করিÑ কিতাবিয়াদের ছাড়া।’৯
‘আকিদায়ে তাহাভীয়্যা’ নামক গ্রন্থে এ সংক্রান্ত বহু সংখ্যক টীকা সংযোজিত হয়েছে সুন্নি মনীষিগণের দ্বারা। তন্মধ্যে আবু জাফর তাহাভী বলেন : ‘আমরা তাদেরকে মুমিন হিসেবে জানি যারা কেবলা (কেবলার দিকে মুখ করে নামায পড়ে) মেনে চলে। আমরা ততক্ষণ তাকে মুসলিম হিসেবে মেনে চলব যতক্ষণ তারা ইসলামের মহান নবীর শিক্ষাকে মেনে চলবে। আমরা মুসলমানদের কাউকে অমুসলিম বলি না, যদিও সে গোনাহের কাজ করে, কিন্তু ঐ গোনাহের কাজকে নাজায়েয মনে করি।’
কাজী আয়াজ ছিলেন ১৬ হিজরির মালেকী মাযহাবের একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত। তিনি বলেন : ‘যদি কেউ আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও পবিত্রতার বিপক্ষে এমন কোন উক্তি করে যা মহান আল্লাহর প্রতি কটাক্ষপূর্ণ নয় তবে তারা ব্যক্তিগতভাবে অবিশ্বাসীদের মতো কার্যকলাপে লিপ্ত বলা যাবে। এবং তারা বিদআত সৃষ্টিকারী হিসেবে বিবেচিত হবে। এসব বিষয়ে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। অতীতের মতো বর্তমানেও তাদের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে যে, এই সমস্ত কার্যসম্পাদনকারীকে অবিশ্বাসী বলা হবে কি না?’১০
১১ হিজরির প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব হানাফী মাযহাবের অনুসারী মোল্লা কারি ইবনে হাজার সম্পর্কে বলেন : ‘এ কথা সত্য যে, বর্তমান এবং অতীতের আমাদের প্রখ্যাত পণ্ডিতগণ সর্বসম্মতভাবে একমত হয়েছেন যে, তাঁরা কাউকে কাফের আখ্যায়িত করবেন নাÑ যারা সমাজে নতুন কিছু প্রচলন করে (বিদআত সৃষ্টি) বা গোনাহের কাজ করে। এদের কথা বা কাজগুলোকে ধর্ম বিষয়ে প্রচলিত মতের বিপক্ষে সাদামাটা হিসেবে গণ্য করা হয়, যতক্ষণ না তারা তাদের চিন্তাধারাকে প্রায়োগিকভাবে অনুশীলন করে। সেই কারণে মুসলমানগণ তাদের সাথে সকল সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকবে, সাধারণ মুসলমানদের জানাযায় তারা শরীক হবে, একই রীতি অনুযায়ী গোরস্তানে সমাহিত হবে। এটা এ কারণে যে, ভুল পথে চালিত হওয়ার কারণে তারা খারাপ ও পাপ কাজগুলো করেছে। তারা ধর্ম সম্পর্কিত যে কথাগুলো বলেছে তা উদ্দেশ্যমূলক ছিল না।’১১
তাকি আলদীন সুবুকি (শাফয়ী মাযহাবের মনীষী) কাউকে কাফের ফতোয়া দেওয়ার ব্যাপারে বলেন : “ভাই সকল! কাউকে কাফের সাব্যস্ত করা খুবই কঠিন কাজ। কারো অন্তরে মহান আল্লাহর ব্যাপারে বিশ্বাস থাকলে তাকে কাফের বলা গোনাহের কাজ, বিপজ্জনক বিদআতী কাজ। কেননা, যারা মুখে স্বীকার করে ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর প্রেরিত রাসূল’, এমন ব্যক্তিকে কাফের বলা ভয়ঙ্কর অন্যায়।”১২
সুন্নি মাজহাবের পণ্ডিতগণ কাউকে কাফের আখ্যায়িত করার ব্যাপারে আরও সতর্কতা ব্যক্ত করেছেন। খারেজীদের কাফের ফতোয়া দেওয়ার ব্যাপারে তাঁরা বিরত থেকেছেন। উদাহরণ হিসেবে সহীহ মুসলিমের টীকা লেখক নাহওয়ায়ীর কথা বলা যায়। তিনি বলেছেন : ‘এটা এক ধরনের বিশ্বাস যে, যারা সত্যপথ অনুসরণ করে এমন মুসলমান যদি কখনও পাপ, খারাপ কাজ বা বিদআতে লিপ্ত হয় তবে তাকে কাফের বলা যাবে না। যেমন খারিজী ও মুতাযিলী সম্প্রদায়। তাদেরকেই শুধু কাফের বলা যাবে যারা ইসলামের বুনিয়াদি বিষয়কে অস্বীকার করবে।’১৩
মহান আল্লাহ ইসলামকে মানুষের ইহকাল ও পরকালের সার্বিক কল্যাণের জন্য প্রেরণ করেছেন। ইসলামের সুষমা তখনই সৌরভ ছড়াবে যখন তা পূর্ণাঙ্গভাবে মেনে চলা হবে। খাদ্য এবং ওষুধ মানুষের জীবন বাঁচায় এবং জীবনকে বিকশিত করে। খাদ্য ও ওষুধে ভেজাল মিশিয়ে যারা বিক্রি করে তাদেরকে শাস্তি দানের ব্যাপারে যেমন কেউ সন্দেহ পোষণ করে না, তদ্রƒপ যারা মুসলমানদের আকিদা-বিশ্বাস হরণ করে বিভ্রান্তিকর ও ধ্বংসাত্মক আকিদা-বিশ্বাসের প্রচার ও প্রসার করে তাদের শাস্তি দানের ব্যাপারে কারো দ্বিধাদ্বন্দ্ব করা উচিত না। সমাজের সকল মানুষের পার্থিব, পারলৌকিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ ও সৌভাগ্যকে কেউ যেন হুমকিতে ফেলে না দেয় সে ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। ইসলাম আকিদা-বিশ্বাস ব্যক্ত ও প্রচার করার স্বাধীনতা ততটুকুই অনুমোদন করে।
ইসলামী ঐক্যের অনন্য আহ্বান
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ২০০৯ সালে (১২ মে) কুর্দিস্থান প্রদেশে সফরকালে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য সম্পর্কে অত্যন্ত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি এ বক্তব্যের মাধ্যমে অন্য মাযহারের নিকট পবিত্র বিষয়াদি সম্পর্কে অসম্মানজনক মন্তব্যকে গর্হিত বলে চিহ্নিত করেন। ইরানের রাহবার বলেন : ‘আল্লাহর কসম! যারা শিয়াদের অন্তরে সুন্নিদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারের বীজ বপন করে এবং অপরপক্ষে যারা শিয়াদের বিরুদ্ধে সুন্নিদের অন্তরে ঘৃণার উন্মেষ ঘটায় তারা আসলে কেউই শিয়া অথবা সুন্নি নয়। তারা প্রকৃতপক্ষে ইসলামের শত্রু। অবশ্যই তাদের অধিকাংশই অজ্ঞ। তারা বুঝতে পারে না তাদের এ কর্মকাণ্ডের পরিণতি কী হবে? এদের জন্য দুঃখ হয়।’
‘এধরনের ভুল ধারণার উদ্ভব কিভাবে হলো? সারা বিশ্বের শিয়া, উত্তর আফ্রিকার শাফেয়ী জনগোষ্ঠী এবং মধ্য আফ্রিকার মালেকী মাযহাবের লোকজন সকলেই নবীর আহলে বাইতকে ভালোবাসেন। তাঁরা কি সবাই কাফের যাঁরা কায়রোর ইমাম হোসাইনের মাযার অথবা তাঁর নামে উৎসর্গিত মসজিদকে পবিত্র মনে করেন? শুধু একারণেই তাঁরা কাফের আখ্যায়িত হবেন! শিয়ারা কাফের হলে সুন্নিদের মধ্যে যারা কাদেরিয়া বা নক্শবন্দী সম্প্রদায়ের অথবা যারা সাগেজ, সান্দাজ ও মারভিয়ান এলাকার অধিবাসী তারা সবাই কি কাফের? এভাবে ভ্রান্ত আকিদার মাধ্যমে মুসলমানদের পর¯পরের সম্প্রীতি নষ্ট করা হচ্ছে কেন?’
‘শিয়া মাযহাবের অজ্ঞ ও বিদ্বেষপরায়ণ কিছু লোক শিয়া-সুন্নি জনগোষ্ঠীর মাঝে বিভেদের কারণ হয়েছে, যারা সুন্নিদের পবিত্র বিষয়কে অপমানের চোখে দেখে। আমি সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, এই ধরনের আচরণ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অথবা যৌক্তিকতার নিরিখে দুভাবেই অন্যায় (শরীয়ত পরিপন্থী)।’
ইসলামী ইরানের রাহবার ঐক্য সম্মেলনে প্রদত্ত অন্য একটি খুতবায় বলেন : ‘ইসলামী উম্মাহর জন্য আজ ঐক্য ও অভিন্ন হৃদয়ের বড় প্রয়োজন।’ তিনি ঐক্য সৃষ্টিকারী দায়িত্ব পালনের জন্য মুসলিম দেশসমূহের সরকার, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি বলেন : ‘ইসলামী জাগরণ যদি ব্যাপকতর ও গভীর হয় এবং মুসলমানদের হৃদয়গুলো পরস্পর ঘনিষ্ঠতর হয় তাহলে আন্তঃসম্পর্ক, সহযোগিতা ও সর্বজনীন অগ্রগ্রতির দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবে…।’
ইরাকের গ্রান্ড আয়তুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী সিস্তানী ও গ্রান্ড আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ সা’য়িদ আল-হাকিমকে ঐক্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হয় । প্রশ্নটি হলো কেউ যদি মহান আল্লাহর একত্ববাদ এবং মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াতে বিশ্বাসী হয়, কেবলামুখী হয়ে নামায আদায় করে, আটটি মাযহাবের (হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী, জাফরী, যায়েদী, ইবাদী ও যাহেরী) কোন একটিতে বিশ্বাসী হয় তাহলে তারা কি মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে? তাদের সম্মান-মর্যাদা, সম্পদ কি সুরক্ষিত থাকবে?
গ্রান্ড আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী সিস্তানী জবাব দেন : বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম। কেউ যখন এ দুটি ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে (শাহাদাতাইন) এবং এই সাক্ষ্যের বিপরীতে কোন কথা সে বলবে না এবং মহান নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি ঘৃণা বা শত্রুতামূলক কোন কথা বলবে না, তাহলে সে মুসলমান হিসেবে গণ্য হবে।
গ্র্যান্ড আয়তুল্লাহ সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ সা’য়িদ আল-হাকিম এ ব্যাপারে বলেন : সাহাবীদের গালাগাল করা বা অন্য কোন মুসলমানÑ তা তিনি যে মাযহাবেরই হোন না কেন তাঁকে কাফের বা রাফেজী বলা শিয়াদের আকিদা নয়। এটা ইসলামের মৌল নীতি ও চেতনার পরিপন্থী কাজ।
তিনি বলেন : যে মহান আল্লাহর একত্ববাদ এবং নবী মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াতের ঘোষণা দেয়, ধর্মীয় অনুশাসন, যেমন নামায, রোযা ইত্যাদি আবশ্যকীয় বিষয় মেনে চলে, কারো মুসলমান হিসেবে বিবেচিত হবার জন্য এগুলোই যথেষ্ট। এভাবে তার জীবন, সম্পদ ইত্যাদি সম্পর্কিত সকল ধর্মীয় অনুশাসন তার জন্য প্রয়োগযোগ্য হবে।
২০১৫ সালের জুলাই মাসে মিশরের আল-আযহার মসজিদের গ্রান্ড ইমাম আল-তায়িব রাজধানী কায়রোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিয়া-সুন্নি ধর্মীয় আলেম ও চিন্তাবিদদের নিয়ে একটি সম্মেলনের ডাক দেন। শিয়া মুসলমানদের হত্যার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতে আল-তায়িব সুন্নি ধর্মীয় আলেমদের প্রতি আহ্বান জানান। অন্যদিকে, সুন্নি মুসলমানদের হত্যার বিরুদ্ধে একই ধরনের ফতোয়া দিতে তিনি শিয়া ধর্মীয় আলেমদের প্রতিও আহ্বান জানান। মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও শত্রুতা সৃষ্টির পাশাপাশি মুসলিম দেশগুলোর ভিতর যেসব নৃশংস এবং বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চলছে এটি ইহুদিবাদীদের পরিকল্পনার অংশ বলেও অভিযোগ করেন আল-তায়িব।
উপসংহার
চরমপন্থীদের ভয়াবহ কর্মকাণ্ড থেকে সাধারণ মুসলমানদের হেফাজত করা দরকার। সকল মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া সেটা কখনও সম্ভব নয়। তাই সবার আগে দরকার পারস্পরিক দূরত্ব পরিহার করে ইসলামের মূলনীতির আলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়ের সঠিক জ্ঞান এক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। মাযহাবসমূহের পণ্ডিতদের এ ব্যাপারে আরও আন্তরিক ও তৎপর হতে হবে। আর যত তাড়াতাড়ি একাজ সম্পন্ন করা যাবে ততই মুসলিম উম্মাহ্র মুক্তি ত্বরান্বিত হবে।
সূত্র
(১) আল-শাহরেস্তানী, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩৪।
(২) মাজলিশী, বিহারুল আনওয়ার, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৯২।
(৩) সহীহ আল-বুখারী, নামায অধ্যায়, অধ্যায় ২৮, পৃ. ১০৮, নম্বর ৩৯২।
(৪) নিশাবুরী, সহীহ মুসলিম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৮৭২, ‘ফাজায়েল সাহাবা’, নম্বর ৩৩।
(৫) কুলাইনী, উসূলে কাফী, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী অধ্যায়, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯।
(৬) শেখ সাদুক, আল হেদায়া, পৃ. ৪৭।
(৭) ইবনে হাজাম, আল-ফাসাহ ফি আল-মিলাল ওয়াল-আহওয়া ওয়া নিহাল, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৯১, আল-কালাম-ফি মান ইয়া কাফির ওয়ালা ইয়া কাফির।
(৮) শারাফউদ্দিন, আল-ফাযল আল-মুহিম্মা ফি তাঅলিফ আল-উম্মাহ, পৃ. ৩৮।
(৯) ঐ, পৃ. ৩২।
(১০) আল-হিয়াসী, আল-শিফা বিতাআরিফ হুকুক আল-মুস্তাফা, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৭২।
(১১) আল-গওহারী, বিন সুলতান, মানাহ আল-রাওয়া আল-আজহার ফি শারহে আল-ফিকাহ আল-আকবার, পৃ. ৪২৫।
(১২) শারাফউদ্দিন, আল-ফাযল আল-মুহিম্মা ফি তাঅলিফ আল উম্মাহ, পৃ. ২৮।
(১৩) আল-নাহওয়ায়ী, শারহে সহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১৩।