মহাকবি হাফিজের কাব্যে পবিত্র কুরআনের প্রতিফলন
পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ৯, ২০২১
ড. মোঃ মুহসীন উদ্দীন মিয়া –
পবিত্র কুরআন সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক মহান আল্লাহর বাণী। এর ভাষা ও বক্তব্য শাশ্বত, চিরন্তন। এটি মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুওয়াতি জীবনের সবচাইতে বড় মুজিযা। ইসলাম তথা আসমানি জীবন ব্যবস্থার প্রজ্ঞাময় অবিকৃত সর্বশেষ গ্রন্থও এটি। এর সাহিত্যশৈলি ও মুজিযার কথা সর্বজনবিদিত।
কুরআনে বর্ণনার বিভিন্ন ঢং, হেকমত, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারাসহ অতি উঁচু মানের সাহিত্যালংকারের সমাবেশ ঘটেছে। এর অভ্রভেদী বাণী অনিন্দ্য সুন্দর ও বাক্সময় বর্ণনাশৈলীর কাছে মাথানত করেছেন বড় বড় কবি ও সাহিত্যিক। ‘আমরা আল্লাহর রং গ্রহণ করেছি। আল্লাহর রং এর চাইতে উত্তম রং আর কার হতে পারে?’ [২/১৩৮, অনুবাদ মারেফুল কুরআন] আল কুরআনের এই অমোঘ বাণীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে মুসলিম বিশ্বের অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক তাঁদের সাহিত্যকর্মে কুরআনশৈলী গ্রহণ করেছেন।
ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকও কুরআনের অলংকরণ অনুসরণ করে তাঁদের সাহিত্যকর্ম সাজিয়েছেন। এ ভাষার যে সকল সাহিত্যিক পবিত্র কুরআনকে মন ও মননে ধারণ করে নিজ অভিব্যক্তি বর্ণনায় এর শৈলীবিদ্যার সংযোগ ও সংমিশ্রণে সফল হয়েছেন তাঁদের পুরোধা পুরুষ হিসেবে হাফিজের নাম সবিশেষে উল্লেখযোগ্য।
পরিচিতি : তাঁর প্রকৃত নাম খাজা শামসুদ্দিন মোহাম্মদ বিন বাহাউদ্দিন সুলগারি মোহাম্মাদ হাফিজ শিরাজী। জন্মের সময় তাঁর চেহারা সূর্যের ন্যায় উদ্ভাসিত ছিল বলে বাবা-মা তাঁর নাম রাখেন শামসুদ্দিন বা দ্বীনের সূর্য। শিরাজ নগরে জন্ম নেন বিধায় শিরাজী। শৈশবে পবিত্র কুরআন হেফ্য বা মুখস্ত করেছিলেন বলে তিনি হাফিজ নামে সর্বাধিক পরিচিতি পান।
তাঁর জন্মসাল জানা যায় নি। তবে গবেষকগণের ধারণা মতে তিনি অষ্টম হিজরি মোতাবেক খ্রিস্টিয় চর্তুদশ শতাব্দীতে (১৩১০ থেকে ১৩৩০ সালের ভিতর) ইরানের শিরাজ নগরীর রুকনাবাদের মোসাল্লা নামক স্থানের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বিশিষ্ট গবেষক এ. জে. আর বারীসহ অনেক গবেষক তাঁর জন্মসাল ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দ বলে উল্লেখ করেছেন। [শাহনেওয়াজ, ইনকিলাব, ২৬ জুন ২০২০]
হাফিজের মৃত্যুসন নিয়েও মতভেদ বিদ্যমান। ‘শারহে গাযালহায়ে হাফেজ’ প্রণেতা হোসাইন আলি হারুভি তাঁর মৃত্যুসাল ৭৯২ হিজরি মোতাবেক ১৩৯০ সাল এবং বয়স ৭২ বছর ছিল বলে উল্লেখ করেছেন [হারুভি : ১৩৯২ : ১৮] দৌলত শাহের মতে তিনি ৭৯৪ হিজরি মোতাবেক ১৩৯১ সাল এবং হাফিজের বন্ধু ও তাঁর কবিতার সর্বপ্রথম সংগ্রাহক ‘গুল আন্দাম’ বলেন, তাঁর মৃত্যুসাল ছিল ৭৯১ হিজরি মোতাবেক ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দ।
আবার গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের (রাজত্বকাল ১৩৮৯-১৪০৯ খ্রি.) সাথে হাফিজের পত্র বিনিময় হয়েছিল। এর থেকে অনুমিত হয় হাফিজ অন্তত ১৩৯০ সাল পর্যন্ত বেচেছিলেন। তাই দৌলত শাহের মতামতই তাঁর মৃত্যুসালের যথার্থ কাছাকাছি মতামত বলে বলে বিবেচিত হয়। [বরকত উল্লাহ : ২০১০ : ২৩৬]
পিতা বাহাউদ্দিন সুলগারির কাছেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। বাবার মুখে পবিত্র কুরআনের বাণী শুনেই তিনি কুরআনের প্রতি অনুরক্ত হন। কিন্তু পিতৃবিয়োগ ঘটলে এ সময়ে তাঁর জীবনের ছন্দপতন ঘটে। সংসারের সকল দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়লেও বিদ্যার্জনে তা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ‘মেইযানে’ গ্রন্থ প্রণেতা আবদুন্নবির বর্ণনা মতে তখন তিনি একটি রুটির দোকানে কাজ নেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিকটস্থ বিদ্যালয়ের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন কাওয়ামুদ্দিন আবদুল্লাহর (মৃত্যু ৭৭২ হি.) কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের সাথে সাথে পবিত্র কুরআন মুখস্ত করতে শুরু করেন। তাঁর কাছে থেকেই হাফিজ ইলমে কালাম, ইলমে তাফসির, ইলমে কিরআত ও দর্শনশাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেন।
এছাড়াও তিনি যুগের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ শামসুদ্দিন আবদুল্লাহ শিরাজী, কাজী এযদুদ্দিন আবদুর রহমানসহ নাম না-জানা আরো অনেকের কাছে তাফসির, হাদিস, কালামশাস্ত্র, আরবি ও ফারসি সাহিত্য এবং ধর্মতত্ত্বে অসাধারণ পা-িত্য অর্জনে সমর্থ হন। (তারিক, ২০১৮ পৃ.) পবিত্র কুরআন বিশ্লেষণ বিদ্যায় তিনি তখন এতটাই পারদর্শী হয়ে ওঠেন যে, আল্লামা জামখসারি প্রণীত ‘তাফসিরে কাশশাফ’ গ্রন্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাশিয়া গ্রন্থও লিখেছিলেন। একই সাথে ইলমে কিরআত তথা পবিত্র কুরআনের পঠন রীতির ভিন্ন ভিন্ন চৌদ্দটি পদ্ধতি করায়ত্ব করতে সমর্থ হন। (হুমায়ী : ১৩৭৩ : ১১৩)
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
عشقت رسد به فرياد ارخود به سان حافظ
قران زبر بخوانى درچها رده روايت
(গজল ৯৪ গানজুর)
তোমার প্রেম চিৎকার দিয়ে উঠবে যদি হাফিযের মতো
কুরআন মুখস্ত পড় চৌদ্দ প্রকার রেওয়ায়েত সহকারে।
(সেহাত, অক্টোবর-নভেম্বর : ২০১৮)
তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ও অসামান্য কৃতিত্বের কারণে স্বদেশবাসীরা তাঁকে অসংখ্য উপাধিতে বিভূষিত করেন। যেমন : ‘লিসানুল গায়েব’ বা অজ্ঞাতের বাণী এবং ‘তরজুমানুল আসরার’ বা রহস্যের মর্মসন্ধানী ছিল তাঁর প্রসিদ্ধ উপাধি। এছাড়াও ‘মুলুকুল ফুজালা’, ‘কাশেফুল হাকায়েক’, ‘মাযদুবে সালেক’, ‘বুলবুলে শিরাজ’, ‘খাজা হাফিজ’, ‘ফাখরুল মুতাকাল্লেমিন’ তাঁর উল্লেখযোগ্য উপাধি ছিল।
সাহিত্য সাধনা : হাফিজ যৌবনে প্রায় ২১ বছর বয়সেই কাব্যসাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। মরমি ধারার সাহিত্য রচনায় তখন তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। অতি অল্প সময়ে তাঁর দর্শন ও কাব্যখ্যাতি দেশের গ-ি পেরিয়ে বহিঃবিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়ে মুযাফফারীয় রাজবংশের আবু ইসহাক ইনযু, আমির মুবারেযুদ্দিন মুহাম্মদ এবং তাঁর পুত্র শাহশুজা ও শাহ মনসুরের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তাঁর সাহিত্যকর্মে গতির সঞ্চার হয়। হাফিজ তাঁর কোন কোন গজলে এই বাদশাদের প্রশংসা করেছেন।
‘দিভান’ বা কাব্য সমগ্র হলো তাঁর অন্যতম সাহিত্য নিদর্শন। এতে রয়েছে প্রেম ও মরমি ভাবধারাসম্বলিত অসংখ্য (৪৯৫) গজল। সমসাময়িক বাদশাগণের প্রশংসায় রচিত কয়েকটি কাসিদা। কিছু রুবায়ী ও দুটি মাসনাভী, যার একটি ‘সাকীনামে’ খ্যাত; অপরটি হলো প্রেম বিষয়ক। [হোমায়ী : ১৩৭৩ : ১১৩]
কুরআনের প্রতিফলন : বহুমুখি জ্ঞানের অতুলনীয় রত্মভা-ার হিসেবে বিবেচিত হাফিজ-কাব্যে ফুটে উঠেছে বিশ্বপ্রকৃতি ও মানব জীবনের গভীর রহস্য। শেখ সাদির পরে হাফিজকেই শ্রেষ্ঠ ফারসি গজল বা গীতিকাব্য রচয়িতা বলে ভাবা হয়। প্রগাঢ় প্রেম ও গভীর আধ্যাত্মিকতায় সিক্ত তাঁর কবিতায় মুগ্ধ হয়েছেন বিশ্ববাসী। শরাব-সাকী, প্রেম-মদিরা, বসন্ত গোলাপ, প্রেমাস্পদের রূপমুগ্ধতা তাঁর মরমি সাধনার রূপক বর্ণনা হিসেবে ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতায়। আত্তার ও রুমির অধ্যাত্মবাদ, সাদির মানবতাবোধ, সানায়ীর আত্মসমালোচনা ও সামাজিক মূল্যবোধের নির্যাসকে ধারণ করে আছে হাফিজের গজল।
হাফিজ-গবেষকগণের ভাষ্যমতে তিনি তাঁর জীবনের প্রায় চল্লিশ বছর কাটিয়েছেন মহাগ্রন্থ আল কুরআনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে। হাফিজ বলেন :
علم وفضلى كه به چهل سال دلم جمع آورد
ترسم آن نرگس مستانه به يغما ببرد.
(গজল ১২৮, গানজুর)
দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সাধনায় আমার অন্তরে যে জ্ঞানবৈশিষ্ট্য সঞ্চিত হয়েছে,
ভয় হয়, না জানি প্রেয়সীর চোখের চাহনি তা হরণ করে নিয়ে যায়। (তারিক)
পবিত্র কুরআনে তাঁর এই অগাধ পা-িত্বের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কাব্যের প্রতিটি ছত্রে। কুরআনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণেই তিনি ‘খাজা হাফিজ’ অভিধায় বিভূষিত হয়েছিলেন। তাঁর কাব্যসৌধের প্রতিটি ছত্রেই ঝংকৃত হয়েছে পবিত্র কুরআনের প্রতিধ্বনি। কবি বলেন :
نديدم خوشتر از شعر تو حافظ
كه قرانى كه اندر سينه دارى
(গজল ১৭৮ গানজুর)
হে হাফিজ! তোমার বক্ষে সংরক্ষিত কুরআনের আভায় রচিত
কবিতার চাইতে সুন্দর বাণী আর কিছু দেখিনি।
কুরআন সাধনার মাধ্যম হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন প্রেমকে। তাঁর মতে প্রেম একটি ঐশী ও এরফানি চেতনা, যা মানুষকে তার প্রেমাস্পদ মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে উদ্বুদ্ধ করে, অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেয়, সৃষ্টি রহস্যের নিগুঢ় তত্ত্ব অনুধাবনে সহায়তা করে। হৃদয়মন তখন মহাপ্রভুর রং-এ রঞ্জিত হতে ব্যাকুল হয়। এই ব্যাকুল মন নিয়েই হাফিজ তাঁর কাব্যের অবকাঠামো নির্মাণ, সৌন্দর্যবর্ধক আলংকারিক দিকনির্দেশনা গ্রহণ এবং কবিতার ভাব-রস, তাল-লয় নির্ধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মহাগ্রন্থ আল কুরআনের দ্বারস্থ হয়েছেন। কুরআনের সৌন্দর্য সুষমায় তিনি তাঁর কবিতার ক্যানভাস সাজিয়েছেন নিপুণ শিল্পীর মতো।
পবিত্র কুরআনের ছন্দরীতি অনুসরণ : সাধারণত ছন্দবদ্ধ কবিতার অন্ত্যমিলকে উচ্চারণের সুবিধার্থে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করে পড়ার নিয়ম-নীতিকে সাহিত্যের পরিভাষায় বাহার (بحر) বলেÑ যা ‘এলমে আরুয’ নামে পরিচিত। ফারসি ছন্দ বিশারদগণের মতেÑ পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহে এই ছন্দরীতি বিদ্যমান রয়েছে। বলা যায়, পবিত্র কুরআনের সেই ছন্দ ও শব্দ ব্যঞ্জনা থেকেই এই অলংকারশাস্ত্রের উৎপত্তি। ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে প্রচলিত সেই বাহার ছন্দরীতিগুলো হলোÑ رمل রামাল, مضارع মোযারে, هزز হাযায, متقارب মোতাকারের প্রভৃতি। হাফিজ কুরআনের সেই অনিন্দ্যসুন্দর بحر ছন্দরীতি অবলম্বন করেই তাঁর কবিতার কাঠামো নির্মাণ করেছেন।
যেমন বাহারে রামাল : فاعلاتن – فاعلاتى – فاعلاتن- فاعلن এ ওজনটি পবিত্র কুরআনের যে আয়াতগুচ্ছ থেকে নেয়া হয়েছে তার একটি হচ্ছেÑ ف اذكرو الله قياما و قعودا وعلى جنوبكم (অর্থ : অতঃপর যখন তোমরা নামায সম্পন্ন কর, তখন দ-ায়মান, উপবিষ্ট ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ কর।) (অনুবাদ : মারেফুল কুরআন)
এ ওজনে রচিত হাফিজের কবিতা-
شاهدان گردلبرى زين سان كنند
زاهدان را رخنه در ايمان كنند
[হাফেজ : ১৩৮৬ : ১১৬]
হৃদয়হারী প্রিয়া যদি করতে থাকে ছলচাতুরী
ক্ষণকালেই যাহেদগণের ফুটো হবে ঈমান তরী।
হাফিজের সবচাইতে প্রিয় ছন্দরীতিও এটি। তাঁর ৪৯৫টি গজলের ১৮০টিই এ রীতিতে রচিত। (সিরাজ : ১৩৬৮ : ৫৭) (জাহরা জামশিদী)
বাহারে হাযায : مفاعيل – مفاعيلن – فعولن
কুরআনের আয়াত : فان كان لكم كيد فكيدون
(অতএব, তোমাদের কোন অপকৌশল থাকলে তা প্রয়োগ কর আমার কাছে।) (অনুবাদ : মারেফুল কুরআন)
এ ওজনে হাফিজের কবিতা :
شب تاريك و بيم موز گردابى چنين هایل
كجا دانند حال ما سبكباران ساحلها .
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ উত্তাল ঢেউয়ে আঁধার রাতে মাঝ সমুদ্রে থাকা
আমাদের অবস্থা তারা কিভাবে বুঝবে, যারা সমুদ্রতটে নিরাপদে অবস্থান করছে। [হাফিজ : ১৩৮৬ : ১]
বাহারে মোতাকারেব : فعولن – فعولن – فعولن – فعولن
পবিত্র কুরআনের বাণী : اقيمو الصلوة واتوالزكاة
(অর্থ : নামাজ প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত আদায় কর)
হাফিজের কবিতা :
سلامی چوبوى خوش آشنايى
بدان مردم ديده روشنايى
(হাফিজ : ১৩৮৬; ২৯৪)
অর্থ : প্রিয় পরিচিত সেই সুগন্ধকে সালাম
যাতে মানুষ আলোর সন্ধান পায়। (জামশিদী : ১৩৯৯ : ৪৫, ৪৬, ৪৭)
কুরআনের আয়াত ও বিষয় অবতারণার পদ্ধতি অনুসরণ : তাঁর গযল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় তিনি কবিতার চরণ বা শ্লোক উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও পবিত্র কুরআনের বর্ণনারীতির অনুকরণ করেছেন। আমরা পবিত্র কুরআনের কোন সূরা বা অধ্যায় পড়ার সময় দেখতে পাই যে, কুরআন বর্ণনা বিন্যাসে আয়াতগুলো পারস্পরিকভাবে সম্পর্কিত হলেও মাঝে মধ্যে ভিন্ন ও স্বাধীন অর্থবোধক কোন কোন আয়াত চলে আসে যেগুলোর অর্থ বিচারে সূরা বা অধ্যায়ের অংশ বলে মনে না হলেও সম্পূর্ণ অধ্যায় পাঠান্তে আয়াতগুলো যে সে অধ্যায় বা সূরার অবিচ্ছেদ্য অংশ তা সহজেই অনুমিত হয়। অর্থাৎ প্রতিটি আয়াতের একটি স্বাধীন অর্থ থাকলেও তা অধ্যায় বিন্যাসের অধীন থাকে। এ আয়াত বা আয়াতাংশের আংশিক অর্থ, সামষ্টিক সূরা অধ্যায়ের সার্বিক অর্থ হিসেবে পরিগণিত হয়।
হাফিজের গজলের শ্লোকগুলোর পারস্পরিক গঠন প্রক্রিয়াও তেমনি। কখনো কখনো কবিতার শ্লোক বর্ণনার ধারাবাহিকতায় একটি শ্লোকের সাথে অপর ছত্রের বিষয়বস্তুগত বাহ্যিক কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে পূর্ণ গজল পাঠ করলেই চরণসমূহের অর্থগত অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের সেই মিল পরিষ্কার বোঝা যায়। অর্থাৎ প্রতিটি শ্লোকের একটি স্বাধীন অর্থ থাকলেও সামষ্টিকভাবে একটি গজলেরই অরিচ্ছেদ অংশ বলে প্রতীয়মান হয়। (সায়েদী : ১৩৬৯; ১৮৬-৮৭)
এ কারণেই হাফিজ দাবি করেছেনÑ
صبح خيزى و سلامت طلبى چون حافظ
هرچه كردم همه از دولت قران كردم
হে হাফিজ! যদি সুস্থতা কামনা কর তবে প্রভাতে জেগে ওঠ
যা কিছুই করেছি তা সবই পবিত্র কুরআনের সম্পদের মাধ্যমেই করেছি।
কবিতায় পবিত্র কুরআনের আয়াত ও আয়াতাংশ সংযোগ : হাফিজ ত্ার গজলে শব্দ চয়ন, বাক্য বিন্যাস মমার্থ বর্ণনা ও পরিভাষা ব্যবহারেও কুরআনশৈলি দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। পবিত্র কুরআনের শব্দ ও বাক্য বিন্যাস, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, প্রবাদ-প্রবচন, এর শৈল্পিক ও নান্দনিক সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তাঁর কাব্যসৌন্দর্য বাড়িয়েছেন। এতে যেমন বেড়েছে তার কাব্যশোভা, অর্থে এসেছে গভীরতা, কবিতা হয়েছে শ্রুতিমধুর, পাঠক মহলে এসেছে মুগ্ধতা। অবশ্য কুরআনের জ্ঞানে আলোকিত ব্যক্তিবর্গ ভিন্ন সাধারণের পক্ষে তাঁর কাব্যের এই রসবোধ আস্বাদন করা মোটেই সম্ভব নয়।
হাফিজ বলেন :
زحافظ جهان كس چو بنده جمع نكرد
لطائف حكمى با نكات قرانى
(কাছিদে : ২ গানজুর)
জগতের মাঝে এমন হাফেজ পাবে নাকো খুঁজে
আমার মত যে কুরআনের তত্ত্বে, দর্শন বুঝে। (শাহ নেওয়াজ : ০৩ জুন, ২০২০)
কুরআনের অলংকরণে সজ্জিত তাঁর গজলের কয়েকটি নমুনা নি¤েœ তুলে ধরছি যাতে তিনি কুরআনের কোনো আয়াত বা আয়াতাংশ আত্মীকরণ করেছেন শৈল্পিকভাবে।
مده خاطر نازك ملامت ازمن زود
كه حافظ تو خود اين لحظه گفت بسم الله
(গজল : ২১৬, গানজুর)
সামান্য বিরক্তিতে দ্রুতই করো না তিরস্কার আমায়
হাফিজ! শুরু কর তোমার বক্তব্য বিসমিল্লায়।
سرم به دنيى وعقبى فرونمى آيد
تبارك الله از اين فطنه¬ها كه در سرماست
(গজল : ২২, সাঞ্জুর)
দুনিয়ার কুটকৌশল যত, শক্তিপূজা ও পরকালীন ভয়,
নত করেনি আমারে কভু, মুক্তিদাতা এ ফেতনায়
তাবারাকাল্লাহ আল্লাহ বরকতময়।
شب قدر است و طى شد نامه هجر
سلام فيه حتى مطلع الفجر
[গযল ২৫১, গাঞ্জুর]
কেটে গিয়েছে যন্ত্রণা যত, কদরের মহিমায়,
ফজরেও তা রইবে বহমান রজনী প্রশান্তিময়।
عيشم مدام است از لعل دلخواه
كارم بكام است الحمد لله
চিরন্তন হয়েছে আরাম আয়েশ মোর প্রিয়ার সান্নিধ্য কামনায়,
স্বার্থক হয়েছে সকল প্রত্যাশা মোর পড় আলহামদুলিল্লাহ।
حضور خلوت انس است و دوستان جمعند
و ان يكاد بخوانيد و در فراز كنيد
(গজল ২৪৪, গাঞ্জুর)
উপস্থিতি তো সান্নিধ্যের নির্জনতা আর বন্ধুদের সমাগম,
‘ওয়া ইন ইয়াকাদু’ তেলাওয়াত কর এবং দরজা খুলে দাও।
কুরআনের আয়াতের ভাবার্থ প্রয়োগ : হাফিজ পবিত্র কুরআনের আয়াত বা আয়াতাংশের ভাবার্থ নিয়েও কবিতা রচনা করেছেন। যেমন : মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবের ৭৩ নং আয়াতে শরীয়াতের বিধান সম্পর্কে বলেন :
‘আমি আকাশ, পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে এই আমানত পেশ করেছিলাম, অতঃপর তারা একে বহন করতে অস্বীকার করল এবং এতে ভীত হলো, কিন্তু মানুষ তা বহন করা। নিশ্চয় সে জালিম ও অজ্ঞ।’ (আহযাব : ৭৩)
হাফিজ বলেন :
آسمان بارامانت نتوانست كشيد
قرعه فال به نام من ديوانه زدند .
(গজল : ১৮৪, গানজুর)
আসমান পারেনি বহন করতে এই আমানত ভার
অবশেষে আমি পাগলের নামে এল ভাগ্যফল তার। (সেহাত : ২০১৮)
একইভাবে সূরা আহযাবের ৫৬ নং আয়াতের ভাবার্থও তিনি এনেছেন তাঁর কবিতায়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর সকল ফেরেশতা তাঁর নবীর উপর দরুদ, সালাম (রহমত) প্রেরণ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ সালাম পাঠ কর।’ এই আয়াতের ভাবার্থকে উপজীব্য করে হাফিজ বলেন :
گفتم سخن توگفت حافظ گفتا
شادى لطيفه گويان صلوات ـ
(রুবায়ী-৩, গানজুর)
বললাম, হাফিজ, তোমার যা বলার ছিল সবই বলা হয়ে গেছে।
আনন্দ কর! মনোহারী কথা যারা বলেন তাদের প্রতি দরুদ সালাম।
একইভাবে সূরা আনআমের ১০৩ নং আয়াতের ভাবার্থ : ‘দৃষ্টিসমূহ তাঁকে পেতে পারে না, অবশ্য তিনি দৃষ্টিসমূহকে পেতে পারেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও সুবিজ্ঞ’ ধারণ করে হাফিজ বলেন :
ديدن روى تو را ديده جان بين بايد
وين كجا مرتبۀ چشم جهان بين من است
(গজল ৩৯৪)
তোমার (কুদরতি) মুখ দেখতে, ঐ চোখ প্রয়োজন যা রুহানি জগৎ দেখতে পায়,
আমার এ চোখ দুনিয়া দেখে যে, তোমায় দেখায় যোগ্য নয়।
কুরআনে বর্ণিত কাহিনীকেও তিনি তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায়। হারিয়ে যাওয়া হযরত ইউসুফ (আ.) পুনরায় কেনানে ফিরে আসার গল্প বর্ণনা করে হতাশার দোলাচল থেকে মুক্তি কামনা করে তিনি বলেন :
يوسف گم گشته باز ايد به كنعان غم مخور
كلبه احزان شود روزى گلستان غم مخور
(গজল ২৫৫, গানজুর)
দুঃখ করোনা হারানো য়ুসুফ
কানানে আবার আসিবে ফিরে।
দলিত শুষ্ক এমরু পুন
হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে। (নজরুল)
তাই বলা যায়, হাফিজের দিভানে অগণিত গজল ও অন্যান্য কবিতা রয়েছে যার ছত্রসমূহ পবিত্র কুরআনের আয়াত, আয়াতাংশ, ভাবধারা প্রয়োগে সমৃদ্ধ করেছেন। এটা সম্ভব হয়েছে তাঁর জীবনের চল্লিশটি বসন্তকাল এ মহাগ্রন্থের অনুশীলন ও প্রশিক্ষণে কাটিয়েছিলেন বলে। দীর্ঘদিনের সেই লব্ধ অভিজ্ঞতার স্বার্থক প্রয়োগ করেছেন তাঁর কাব্যে। এতে তাঁর কবিতা হয়েছে আরো অর্থবহ, বেড়েছে আংগিক শোভা, ছন্দের মাত্রায় যোগ হয়েছে অভিনব রসবোধ। তাই তাঁর কাব্যের আবেদন এখনো চিরন্তন। ‘লিসানুল গায়েব’ খ্যাত হাফিজ যথার্থই বলেন :
اى چنگ فروبرده به خون دل حافظ
فكرت مگر ازغيرت قران وخدا نیست
হাফিজের হৃদয় উতালা হয়েছে, সর্বগ্রাসী থাবায়,
চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটেছে কুরআন ও আল্লাহর ভাবনায়।
তথ্যসূত্র
১. কুরআনুল কারিম।
২. হাফেজ, শামসুদ্দিন মোহাম্মদ, (১৩৮৬) অসিম প্রকাশনা, তেহরান।
৩. হুমায়ী, আল্লামা জালালউদ্দিন, (১৩৭৩) তারিখে মোখতাসারে আদাবি, কোম, ইরান।
৪. হারুভী, হোসাইন আলি, (১৩৯২) শারহে গাযালহায়ে, তেহরান।
৫. সায়েদী, আব্দুল আজিজ, (১৩৬৯) বা’ হাফেজ তা কাহকেশানে এরফার ভা আখলাক, শিরাজ।
৬. খানলরী, পারভেজ নাতেল, (১৩৬৮) ভাযনে শেরে ফারসি, তেহরান।
৭. শরিফ, বাবাক, বাহমানী, ফাতেমে, (১৩৯৫) এযাযে মুসেকিহায়ে কুরআন দার আয়নেয়ে এবরাতহায়ে মাওযুনে আরুযী। ফাসল নামে পাঝুহেশহায়ে আদাবি, চতুর্থ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা।
৮. হাসান আনওয়ারী, (১৩৯২) সেদায়ে সোখানে এশক, তেহরান।
৯. জাহরা জামশিদী, (১৩৯৯) শেফায়ে দেল, ৩য় বর্ষ ৫ম সংখ্যা (৩৭-৫০)
১০. বাহাউদ্দিন খোররামশাহী, (১৩৭৩) বারগোযিদেয়ে শারহে হাফেজ, তেহরান।
১১. মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ, (২০১০) পারশ্যপ্রতিভা, সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা।
১২. অধ্যাপক মনুসর উদ্দীন, (১৯৭৮) ইরানের কবি, ঢাকা।
১৩. ড. হাসান সেহাত, (২০১৮) নিউজলেটার, ‘মানবতার উৎকর্ষ সাধনে সাধক কবি হাফিজ শিরাজী ও রবীন্দ্রনাথ’, (অক্টোবর-নভেম্বর)
১৪. ড. তারিক সিরাজী, (২০১৮) নিউজলেটার, ‘আধ্যাত্মিক কবি হাফিজ ও তাঁর কবিতা’। (অক্টোবর-নভেম্বর)
১৫. কাদের শাহনেওয়াজ, (২০২০) দৈনিক ইনকিলাব, ‘মহাকবি শামসুদ্দিন হাফিজ : জীবন ও কর্ম’, ৩রা জুলাই।
লেখক : অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়