মঙ্গলবার, ৪ঠা মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

মওলানা জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ রূমী রহ.

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৭, ২০২০ 

 

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী –
নাম ও বংশ পরিচয়
মওলানা রূমীর আসল নাম জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ। তাঁর পিতার নাম সুলতানুল ওলামা বাহাউদ্দীন ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হুসাইন খতীবী (হিজরি ৫৪৩-৬২৮)। তিনি হিজরি ৬০৪ সালের ৬ই রবিউল আউয়াল বাল্্খে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্খ বর্তমান আফগানিস্তানের একটি প্রদেশ। তাঁর পিতা ‘বাহা ওয়ালাদ’ নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত মরমি সাধক ও বাগ্মী খতীব এবং মহান বুযর্গ শেখ নাজমুদ্দীন কুবরার মুরীদ।
দেশভ্রমণ
৬১০ হিজরিতে জালাল উদ্দীনের বয়স যখন মাত্র ৬ বছর, তখন পিতা বাহা ওয়ালাদ ইমাম ফখরুদ্দীন রাযির সাথে বিরোধ ও খারেযামশাহ এর সাথে মনোমালিন্যের কারণে পরিবার পরিজন ও কতক সহচরকে সঙ্গে নিয়ে বাল্্খ ত্যাগ করেন এবং পশ্চিম ইরান অভিমুখে রওয়ানা হন। আফলাকী ‘মান্নাকেবুল আরেফীন’ গ্রন্থে বাহা ওয়ালাদের দেশত্যাগের কারণ হিসেবে বিখ্যাত আলেম ও কালামশাস্ত্রবিদ ইমাম ফখরুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে ওমর ইবনে হুসাইন রাযির (৫৪৪-৬০৬ হিজরি) সাথে মওলানা রুমীর পিতার মতবিরোধের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে বিষয়টি ঐতিহাসিক হিসাব নিকাশের সাথে মিল খায় না। কারণ, ফখরুদ্দীন রাযির ইন্তিকাল হয়েছে ৬০৬ হিজরিতে। অথচ বাহা ওয়ালাদ দেশত্যাগ করেন ৬১০ হিজরিতে। যাইহোক তিনি প্রথমে নিশাপুর গমন করেন। বর্ণিত আছে যে, নিশাপুরে বাহা ওয়ালাদের সাথে বিখ্যাত আরেফ শেখ ফরীদ উদ্দীন আত্তারের দেখা হয়। আত্তার তাঁর দ্বিপদী কাব্য ‘আসরারনামা’টি জালাল উদ্দীনকে উপহার দেন। নিশাপুর হতে বাগদাদ হয়ে মক্কায় উপনীত হন। সেখান থেকে সিরিয়া গমন করেন। এরপর তিনি এশিয়া মাইনরের উদ্দেশে রওয়ানা হন। কিছুদিন আরযাঞ্জানে অবস্থান করেন। এরপর যান সিরিয়ার ‘মালাতিয়া’ শহরে। সেখানে চার বছরকাল বসবাসের পর লারেন্দা শহরে গমন করেন। আরযাঞ্জান, মালাতিয়া ও লারান্দা এই শহর তিনটি বর্তমানে তুরস্কে অবস্থিত। লারেন্দায় তিনি ৭ বছরকাল বসবাস করেন।
দাম্পত্য জীবন
সিরিয়ার লারেন্দা শহরেই জালাল উদ্দীনের বয়স যখন ১৮ বছর তখন পিতা সুলতানুল ওলামা, খাজা লালায়ে সমরকান্দীর মেয়ে গওহার খাতুনের সাথে তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা করেন। এই দাম্পত্যের ফসল ছিল বাহা উদ্দীন মুহাম্মদ ওরফে সুলতান ওয়ালাদ ও আলা উদ্দীন মুহাম্মদ নামক দুই পুত্রসন্তান। মওলানার জ্যেষ্ঠ সন্তান ছিলেন সুলতান ওয়ালাদ। তিনি প্রগাঢ় পা-িত্যের অধিকারী ছিলেন। মওলানার অপর সন্তান আলা উদ্দীন মুহাম্মদÑ যে শামসে তাব্রেযীকে হত্যার ঘটনায়ও জড়িত ছিল, পিতা তাকে তেমন গুরুত্ব দিতেন না। মওলানার অপর দুই সন্তান মুযাফফর উদ্দীন আমীর আলম ও মালেকা খাতুন এর মা ছিলেন গারা খাতুন কুনাভী।
তুরস্কের কুনিয়ায়
এ সময়টিতে এশিয়া মাইনরে তাকওয়া, পরহেযগারী ও জ্ঞান গরিমায় বিরাট খ্যাতির অধিকারী সুলতানুল ওলামা বাহা ওয়ালাদ সুলতান আলা উদ্দীন কায়কোবাদ সালজুকীর (৬১৬-৬৩৪) আমন্ত্রণে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কুনিয়ায় গমন করেন এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। সেখানে তিনি ওয়ায ও বাহাস (জ্ঞানের তার্কিক আলোচনা) এর মজলিস চালু করেন। সেখানে প্রতিদিন প্রচুর সংখ্যক জ্ঞানান্বেষী ফয়েয আহরণের জন্য আগমন করতেন।
কুনিয়া ছিল রোমের সালজুকী শাসকদের রাজধানী এবং জ্ঞানী মনীষী ও সুফিদের মিলনকেন্দ্র। ফখরুদ্দীন ইরাকী, সদরুদ্দীন কুনাভী, শরফ উদ্দীন মূসেলী, নাজমুদ্দীন রাযি প্রমুখ বুযুর্গ আলেমগণ সে শহরে বাস করতেন।
পিতার খেলাফত লাভ
কুনিয়ায় কিছুকাল অবস্থানকালে সুলতানুল ওলামা ওয়ায-নসিহত, দীক্ষা দান এবং সুন্দর কাব্যময় গদ্য ‘মাআরেফে বাহা ওয়ালাদ’ রচনার পর ৬২৮ সালে ইন্তিকাল করেন। এ সময় মওলানার বয়স ছিল ২৪ বছর। সুলতানুল ওলামার অসিয়ত অথবা সুলতান আলা উদ্দীন কায়কোবাদের আহ্বানে কিংবা মুরীদদের অনুরোধে বুরহান উদ্দীন মুহাক্কেক তিরমিযীর আগমন পর্যন্ত প্রায় এক বছরকাল পিতার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে মওলানা রূমী ওয়ায-নসিহত ও শিক্ষা দীক্ষার কাজে অতিবাহিত করেন। তখনো পর্যন্ত মওলানা তরীকতে প্রবেশ করেন নি; বরং শুধু ফতোয়া ও ওয়ায-নসিহতের কাজ করতেন।
বুরহান উদ্দীন মুহাক্কেক তিরমিযী ছিলেন হুসাইনী বংশধারার সৈয়দ ও তিরমিয নিবাসী। তিনি সুলতানুল ওলামা বাহা ওয়ালাদের মুরীদ ও খলিফা ছিলেন। বাহা ওয়ালাদ যখন বাল্্খ ত্যাগ করেন তখন বুরহান উদ্দীন মুহাক্কেক বাল্্খে ছিলেন না। তিনি সুলতানুল ওলামার (বাহা ওয়ালাদ) এর সন্ধানে রোম (পূর্বে রোম বা বর্তমান তুরস্ক) এর উদ্দেশে রওয়ানা হন। তিনি যে সময় সেখানে পৌঁছেন তখন তাঁর পীর ও ওস্তাদের ইন্তিকালের পর এক বছরকাল অতিবাহিত হচ্ছিল (৬২৯)।
উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যাত্রা
‘মানাকেবুল আরেফীন’ এর বর্ণনা অনুযায়ী সৈয়দ বুরহান উদ্দীন মওলানার কাছ থেকে বিভিন্ন জ্ঞানে পরীক্ষা নেন এবং সাথে সাথে তিনি তাঁকে দীক্ষা দানে ব্রতী হন। তিনি সাহিত্য ও শরীয়ত বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের জন্য মওলানাকে হালাব সফর করার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। মওলানা হালাব শহরে প্রসিদ্ধ ফকীহ কামাল উদ্দীন ইবনুল আদীম এর কাছে হানাফী ফিকাহ্শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এরপর উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য দামেস্কে অবস্থান করেন। মনে হয় সেখানেই তিনি মুহিউদ্দীন আল আরাবীর সাক্ষাৎ লাভ করেন। ‘জাওয়াহেরুল আসরার’ গ্রন্থের প্রণেতা কামাল উদ্দীন হুসাইন খারাযমী লিখেছেন যে, হযরত খোদাবান্দাগার (মওলানার উপাধি) যখন দামেস্কের মাহরুসায় ছিলেন, তখন কিছুদিন মালেকুল আরেফীন শেখ মুহিউদ্দীন আরাবীর সাহচর্য লাভ করেন এবং এমন সব হাকিকত ও রহস্যজ্ঞান পরস্পরের সাথে আলোচনা করেন যার বর্ণনা অনেক দীর্ঘ হবে।
পুনরায় কুনিয়ায় আগমন
সাত বছর ধরে সাহিত্য ও শরীয়ত বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের পর মওলানা পুনরায় কুনিয়ায় ফিরে আসেন। ওলামায়ে কেরাম ও মুরীদগণ তাঁকে ব্যাপক সম্বর্ধনা প্রদান করেন (৬৩৭ হিজরি)। এরপর সাইয়্যেদ বুরহান উদ্দীনের ইশারা অনুযায়ী তিনি কিছুকাল কৃচ্ছ্রসাধনায় কাটান। কিছুদিন না যেতেই সাইয়্যেদ বুরহান উদ্দীন মওলানাকে দেখতে পান যে, তিনি সম্পূর্ণ নিখাদ ও অকৃত্রিম। তাঁর কোনো কৃচ্ছ্রতা বা মুজাহেদার প্রয়োজন নেই। তিনি কৃতজ্ঞতায় সিজদায় পড়ে যান এবং হযরত মওলানাকে কাছে টেনে নেন। তাঁর মোবারক চেহারায় চুমোর পর চুমো দেন আর বলেন : ‘সকল বুদ্ধিবৃত্তিক, বর্ণনামূলক, কাশ্ফ(উদ্ভাসন) ও সাধনালব্ধ জ্ঞানে জগতের আলেমদের মধ্যে নজিরবিহীন হয়েছ…।’ আহমদ দাদা, সাইয়্যেদ বুরহান উদ্দীন এর তত্ত্বাবধানে মওলানার কৃচ্ছ্রসাধনা বা রেয়াযতের সমষ্টি এক হাজার একদিন বলে উল্লেখ করেছেন।১০০১ দিনের কৃচ্ছ্রতার সংখ্যাটি আবজাদের হিসাবে ‘রেযা’ এর সমান। এটি মওলভীপন্থী বা মওলানা রূমীর অনুসারীদের অনুসৃত নিয়ম ছিল।
মওলানার আধ্যাত্মিক সিলসিলা
এই বর্ণনা অনুযায়ী প্রতীয়মান হয় যে, মওলানার শিক্ষা ও দীক্ষা গ্রহণের সিলসিলাটি সাইয়্যেদ বুরহান উদ্দীন মুহাক্কেক তিরমিযীর সূত্রে সুলতানুল ওলামা বাহা ওয়ালাদ এবং তাঁর মাধ্যমে কুবরাবিয়া (শেখ নাজমুদ্দীন কুবরার সিলসিলার) মাশায়েখদের সঙ্গে যুক্ত। আফলাকী মওলানার খির্কা (আলখাল্লা) লাভের সূত্রটি শেখ পর্যন্ত মারুফ কারখির সঙ্গে যুক্ত করেন। তিনি লিখেছেন যে, মওলানা নয় বছরকাল বুরহান মুহাক্কেক সাহচর্যের সময়কালে আধ্যাত্মিক পূর্ণতার মার্গে উপনীত হন এবং বিভিন্ন দীক্ষা লাভ করেন।
সাধনার এই অধ্যায়টি ৬৩৮ হিজরি তথা সাইয়্যেদ বুরহান বুরহান উদ্দীন মুহাক্কেক তিরমিযীর ইন্তিকালের সময় পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তখন মওলানার বয়স ছিল ৩৪ বছর। এ সময় তিনি পুনরায় ওয়ায-নসিহতের দায়িত্বপান এবং শাম্সেতাবরিযীর সঙ্গে সাক্ষাতের বছর পর্যন্ত (৬৪২ হিজরি) ৫ বছর তাঁর পিতৃপুরুষের ধারায় ফিকাহ্ ও শরীয়তের জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থাকেন।অসাধারণ জ্ঞান ও পরহেযগারীর কারণে জনসাধারণের পক্ষ হতে তিনি দীনের শিরোমণি ও আহমদী শরীয়তের স্তম্ভ হিসেবে আখ্যায়িত হন। মওলানার ছেলে সুলতান ওয়ালাদের বক্তব্য অনুযায়ী তাঁর মুরীদানের সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পায়।
শাম্সের সাক্ষাতে আধ্যাত্মিক বিপ্লব
৬৪২ হিজরি ছিল কুনিয়ায় শাম্সেতাবরিযীর আগমন ও মওলানার সাথে তাঁর সাক্ষাতের বছর। এর ফলে মওলানার জীবন ও চিন্তাধারায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। আফলাকী মানাকেবুল আরেফীন এবং জামী নাফাহাতুল উন্্স্ কিতাবে আল্লাহর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত এই ভবঘুরে আরেফের নাম শাম্সউদ্দীন মুহাম্মদ ইবন মালেকদাদ তাবরিযী বলে উল্লেখ করেছেন।
শুরুতে শাম্সছিলেন শেখ আবু বকর যাম্বীলবাফ তাবফরযীর মুরীদ। কামালিয়াত অর্জনের পর তিনি দেশ ভ্রমণের পথ অবলম্বন করেন। তিনি এ শহর হতে ও শহরে গমন করতেন, তরীকতপন্থীদের সাথে দেখা-সাক্ষাতের জন্য সবখানে ঘুরে বেড়াতেন। তবে লোকদেখানো তাপস ও ছদ্মবেশী দীনদারদের থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি হাকিকত (পরম সত্যকে) লাভ করার জন্য আকাশের দিগন্ত ও আত্মার জগতে পরিভ্রমণ করতেন। প্রথম প্রথম কালো পশমি বস্ত্র পরিধান আর সফরে যাবার সময় সওদাগরের বেশ ধারণ করতেন। অথচ ঘরের মধ্যে জীর্ণশীর্ণ কম্বল আর ভাঙ্গা কলসি ছাড়া আর কিছু থাকত না।
শাম্সেতাবরিযীর সাথে মওলানা রূমীর সাক্ষাতের অধ্যায়টি রহস্যঘেরা। এ নিয়ে বহু মুখরোচক ঘটনা বর্ণনা করেছেন মওলানার জীবনীকাররা। এ সম্পর্কিত প্রসিদ্ধ একটি ঘটনা হচ্ছে,
যুগশ্রেষ্ঠ আলেম মওলানা রূমী একদিন তুরস্কের কুনিয়ায় ছাত্রদের নিয়ে দারসের মজলিসে মশগুল ছিলেন। হঠাৎ শ্রেণিকক্ষে এক দরবেশের আগমন হলো। মওলানা রূমী অনেকটা বিরক্তির সুরে জানতে চাইলেন:‘কী চাও?’ দরবেশ উল্টা প্রশ্ন করলেন : ‘ইন চীস্ত?’Ñ এগুলো কী? মওলানার সহজ উত্তর: ‘ইন এলমীস্ত কে তো নমী দা’নী’Ñ এ হলো জ্ঞানচর্চা, যা তুমি জান না।’ দরবেশ অন্যমনস্ক হয়ে চলে গেলেন। মাঝখানে ক্লাসের বিরতি হলো। বিরতির পর এসে মওলানা রূমি দেখলেন, দারস দানের একমাত্র কিতাবটি উধাও। শুরু হলো তল্লাশি। ভবঘুরে দরবেশ ছাড়া কেউ তো এদিকে আসে নি। হাজির করা হলো দরবেশকে। দরবেশ অবজ্ঞার সুরে বললেন : ‘এতো হৈ চৈ কেন, এই নেন আপনার কিতাব।’ এ কথা বলে পাশের পানির হাউজ থেকে হাত দিয়ে তুলে আনলেন ঝরঝরে শুকনো কিতাবটি। একটি হাঁস যেন পুকুরে ডিগবাজি খেয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে এল। মওলানা হতবাক। বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন :‘ইন চীস্ত?’Ñ এটা কী? দরবেশ জবাব দেন: ‘ইন সিররীস্ত কে তো নেমী দা’নী’Ñ এ হচ্ছে রহস্যজ্ঞান, যা আপনার অজানা।’ মওলানা বুঝতে পারলেন, জীবনের পরম আরাধ্য রহস্যজ্ঞানের ধনভা-ার এখন হাতের নাগালে। তখন মাদ্রাসার দারস, মসজিদের ইমামতি, ওয়াযের মজলিস ছেড়ে পাগল হয়ে গেলেন দরবেশের জন্য। তারপর থেকে ঝরনার মতো অনর্গল ধারায় জারি হতে লাগল কবিতা, মসনবী ও দিওয়ানে শাম্সেগযলের ঊর্মিমালা। সেই মহাজ্ঞানী দরবেশ ছিলেন হযরত শাম্সে তাবরিযী (রহ)।
বস্তুত শাম্্সের সাথে সাক্ষাতের পর জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ সম্পূর্ণ পাল্টে যান। র্দাস, ক্লাস, ওয়ায ও দীক্ষা দানের মজলিস এক পাশে ফেলে রাখেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, শাম্সের আত্মিক প্রেরণা ও তাঁর অগ্নিঝরা মুখনিঃসৃত বাণীর আকর্ষণে ও তাঁর প্রাণ-উদ্দীপক সান্নিধ্যের উষ্ণতায় হাকিকী কামালিয়াত ও বাস্তব তত্ত্বজ্ঞানের ঝরনা উৎসে পৌঁছার পথ পেয়ে গেছেন। তিনি শাম্সের আঁচল জড়িয়ে ধরেন। অন্যদের দেখা সাক্ষাৎ হতে চোখ বন্ধ করে নেন। ইবাদত ও পরহেযগারীর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেন। সামা ও নৃত্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। প্রেম ও আধ্যাত্মিকতা আর ভক্তিমূলক গান কবিতা রচনায়ব্রতী হন। মোটকথা, তিনি অন্য এক অবস্থা লাভ করেন, যা না তিনি চিনতেন আর না তার মুরীদান বন্ধু ও ভক্তরা চিনতেন ও বুঝতেন।
শাম্সে তাবরিযীর অন্তর্ধান
এর ফলশ্রুতি দাঁড়ায়, মওলানার সাহচর্যের প্রত্যাশী ও দীক্ষা লাভে আগ্রহীরা তাঁর ব্যাপারে আশা ছেড়ে দেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে মুরীদরা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। চারদিকে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। তিরস্কারের তীক্ষèবাণ নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, শাম্সেতাবরিযী ৬৪৩ সালের ২১ শাওয়াল মওলানার বন্ধুমহল ও মুরীদানের অত্যাচার ও অন্যদের অসন্তুষ্টির কারণে মওলানার সঙ্গে ষোল মাসের সাহচর্যের পর কুনিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং দামেস্ক চলে যান। মওলানা হঠাৎ শাম্সেরপ্রাণ উজ্জীবনী জ্যোতির পরশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তিনি পেরেশান, দিশেহারা হয়ে চারদিকে লোক পাঠান। শেষ পর্যন্ত শাম্সকেদামেস্কে খুঁজে পান। মওলানার ছেলে সুলতান ওয়ালাদের অনুরোধেÑযিনি শাম্সেরখোঁজে দামেস্কে গিয়েছিলেনÑশাম্সপুনরায় কুনিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং জালাল উদ্দীনকে অন্তজর্¦ালা ও বিরহের হাহুতাশ হতে মুক্তি দেন। শাম্্সেতাবরিযীর প্রত্যাবর্তন পুনরায় কুনিয়ার জনগণ ও মওলানার মুরীদগণের মাঝে ক্রোধের আগুন প্রজ্বলিত করে। তারা সবাই শাম্সকে ‘যাদুকর’ আখ্যায়িত করে, তাঁকে নিপীড়ন করতে উদ্যত হয়।
এই হট্টগোলে অজ্ঞ লোকেরাও ফিতনার সৃষ্টি করে, গালমন্দ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অজ্ঞতা ও হিংসার শিকার হয়ে মওলানার একদল হিংসুক মুরীদ ও সাধারণ লোকের হাতে শাম্সেতাবরিযী গোপনে নিহত হন। বলা হয় যে, মওলানার ছেলে আলাউদ্দীনও এদের দলে শামিল ছিলেন।
আফলাকী এবং জামীও এই ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন যে, জনসাধারণের হট্টগোলের কারণে সাধারণ লোকেরা শাম্সে তাবরিযীকেমওলানার ঘরের বাইরে হত্যা করে (৬৪৫ হিজরি)। এ সময় মওলানার বয়স ছিল ৪১ বছর।
‘আল-জাওয়াহেরুল মুদিয়া’ গ্রন্থের লেখক কুনিয়ার জনগণ ও মওলানার মুরীদদের হাতে শাম্সেতাবরিযী নিহত হওয়ার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন যে, শাম্সনিজে নিরুদ্দেশ হয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন। তবে এর মধ্যে ওয়ালাদনামার বর্ণনাটি অধিকতর সঠিক বলে মনে হয়। তিনি বলেন, মুরীদরা যখন শাম্সেতাবরিযীকে জ্বালাতন করতে উদ্যত হয় তখন তিনি ভীষণ মনঃক্ষুণœ হন ও গোপনে কুনিয়া ছেড়ে চলে যান এবং সিদ্ধান্ত নেন যে, আর কোনো দিন কুনিয়া ফিরে আসবেন না।
শাম্্সকে হারিয়ে বেহাল বেকারার
মওলানা রুমী এ ঘটনায় আবারো ব্যথিত হয়ে পড়েন।শামসের খোঁজে দুই বছরকাল এদিক সেদিক লোক পাঠান। তিনি নিজেও দামেস্কে যান। শেষ পর্যন্ত শামসুদ্দীনকে ফিরে পাবার আশা ত্যাগ করেন। কাজেই শাম্্সে তাবরিযী গোপনে কুনিয়া ছেড়ে চলে যাবার বর্ণনাটি অন্য সকল বর্ণনা হতে সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়। এ বিষয়টি ওয়ালাদনামার বর্ণনাকে সত্যায়িত করে। কেননা, শামসুদ্দীন নিহত হবার বিষয়টি যদি মওলানার কাছে নিশ্চিত হত, তাহলে শামসের খোঁজ খবর নেয়া এবং নিজে দামেস্ক সফরে যাবার প্রয়োজন হতো না।
‘মানাকেবুল আরেফীন’ গ্রন্থে আফলাকীর বক্তব্য অনুযায়ী শাম্্সেরঅন্তর্ধান বা দেশত্যাগের পর মওলানা দারুণভাবে অস্থির বেকারার হয়ে যান। তিনি সারাক্ষণ বেদনাভরা মনে বেকারার হয়ে হা হুতাশ করতেন। হৃদয়-মথিত বেদনা নিয়ে তিনি কখনো ছাদে, কখনো মাদ্রাসার আঙ্গিনায় পায়চারি করতেনআর দারুণ অন্তজর্¦ালা নিয়ে কবিতা পড়তেন।
সবসময় পথের পানে চেয়ে থাকতেন। যে কোনো লোক দেখলেই শাম্্সে তাবরিযীর কথা জিজ্ঞাসা করতেন। বলতেন :
لحظه ای قصه کنان قصۀ تبریز کنید
لحظه ای قصۀ آن غمزۀ خونریز کنید.
‘গল্পকাররা একটু থামো তাবরিযেরই গল্প কর
হৃদয়হরি প্রেমাস্পদের একটুখানি গল্প বল।’
হিংসুকদের আচরণে, মানসিক আঘাতে মওলানার অন্তরে বিশাল দুঃখভার চেপে বসেছিল। তিনি ছিলেন বেহাল পেরেশান আত্ম-নিয়ন্ত্রণহারা। শাম্্সের সন্ধান হতে তিনি শান্ত হচ্ছিলেন না। শাম্্সের পুন সাক্ষাৎ পাবার আশায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলেন। কিছুদিন নির্জনতায় চলে যেতেন। আবার প্রেমাস্পদ শাম্্সকে পাবেনÑসে প্রেরণায় নির্জনতা ভঙ্গ করতেন। অবশেষে একাত্মা এক হৃদয় কতক বন্ধুর সঙ্গ পেয়ে যান। যেমন সালাহ উদ্দীন ফরীদুন যারকূব (মৃত্যু ৬৫৭ হিজরি) ও এরপর হুসসাম উদ্দীন হাসান ইবনে মুহাম্মদ চালাবী (মৃত্যু৬৮৩ হিজরি)। তাঁদের পেয়ে মওলানা শান্ত হয়ে যান। এরপরেই হুসসাম উদ্দীন চালাবীর অনুপ্রেরণায় ও অনুরোধে তিনি ‘মসনবী’ রচনায়ব্রতীহন। তখন থেকে তাঁর কাব্য জীবনের সূচনা হয়।
কবিত্বের সূচনা
মওলানার প্রেম-উন্মাদনা ও কবিত্বের অধ্যায় শুরু হয় মূলত ৬৪২ হিজরি থেকে, যে বছর কুনিয়ায় শাম্্সে তাবরিযীর আগমন ঘটেছিল। এ সময় তিনি পিতার কাছ থেকে পাওয়া দীক্ষা, দীর্ঘদিনের পড়াশোনা, শাম্স এর সাহচর্য ও বুরহান উদ্দীন মুহাক্কেক তিরমিযীর দিকনির্দেশনা প্রভৃতির মাধ্যমে ইনসানে কামেল (পূর্ণ মানব) ও আল্লাহর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত আরেফ-এ পরিণত হয়েছিলেন। তাই তিনি জীবনের বাকি অংশ উৎসর্গ করেন তরীকতের সাধকদের পথনিদের্শনা ও দীক্ষা দানের কাজে। খানকায় বসে তিনি মুরীদদের তালিম দিতে থাকেন। এর মাধ্যমে একটি তরীকা গড়ে তোলেন, যা ‘মওলাভিয়া তরীকা’ নামে প্রসিদ্ধ হয়।
‘মসনবী’ রচনা
বেশি দিন না যেতেই মানবজীবন ও বিশ্বজগৎ নিয়ে দীর্ঘ জীবনের ভাবনার ফলশ্রুতিতে তাঁর মধ্যে যে অসাধারণ প্রতিভা, প্রেরণা ও প্রাণস্পর্শী শিক্ষার সঞ্চার হয়েছিল তার সুবাদে সমগ্র রোমে নজিরবিহীন খ্যাতির অধিকারী হন। চারদিক থেকে অসংখ্য জ্ঞানপিয়াসী তাঁর সাহচর্যে আসতে থাকে। এমনকি বাদশাহ-আমীরগণও তাঁর কাছে রক্ষিত জ্ঞান ও পা-িত্যের ভা-ার হতে রতœ কুড়ানোর উদ্দেশ্যে তাঁর দরবারে আসতে থাকেন।
এদিকে অনুমানিক ৬৫৭ হিজরি হতে হুসাসাম উদ্দীন চালাবী’র প্রেরণায় ‘মসনবী’ রচনার ধারাও অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। তিনি ‘মসনবী’র কবিতা অনর্গল বলে যেতেন, আর হুসসাম উদ্দীন চালাবী তা লিখে নিতেন। লেখা শেষ হলে মওলানাকে পুনরায় পড়ে শোনাতেন। সাহিত্য ও আধ্যাত্মিকতা এবং প্রেরণা-উদ্দীপনার এই মজলিশে বহু আশেক, মুরীদ, মওলানা ও ‘মসনবী’র ভক্তরা উপস্থিত হতেন। কোনো কোনো সময় কাব্য রচনা ভোর পর্যন্ত চলতে থাকত। তখন ঘুম, খাওয়া-দাওয়ার খবর পর্যন্ত থাকত না কারো কাছে।
কবিতা, সাহিত্য ও আধ্যাত্মিকতার এসব মজলিশ মওলানার আধ্যাত্মিক ও উচ্চতর মানবীয় চিন্তাধারার ফল্গুধারা নিয়ে হুসসাম উদ্দীনের নিষ্ঠা, ভক্তি ও ঐকান্তিকতার উষ্ণতায় মিশে জাদুময় প্রাণ-সঞ্চারি কবিতার মোহনীয়তার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পনের বছর অব্যাহত থাকে। শেষ পর্যন্ত তাঁর অস্তিত্বের প্রাণসঞ্জিবনী সূর্যের অস্তগমনের সময় উপস্থিত হয়।
চির প্রশান্তির কোলে আশ্রয়
৬৭২ হিজরির ৫ই জামাদিউল আখের রোববার ইসলামি জাহানের এই মুক্তমনের মহান চিন্তানায়ক আলেমে রব্বানী লাগাতার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৬৮ বছর বয়সে এই ক্ষণস্থায়ী জগৎ ছেড়ে চলে যান।
মওলানার ইন্তিকাল গোটা রোমে এক বিরাট দুর্ঘটনা বলে গণ্য হয়। কুনিয়ার লোকেরা দীর্ঘ চল্লিশ দিন শোকে মূহ্যমান থাকে। কবিরা তাঁর শোকে ও মাহাত্ম্য গেয়ে কবিতা রচনা করেন। তাঁর বন্ধু, ভক্ত ও অনুসারীদের মাঝে কান্না আহাজারির করুণ রোল ওঠে। তাঁর জানাযায় কুনিয়ার বেশিরভাগ লোক, এমনকি ইহুদি ও খ্রিস্টানরাও যোগদান করে। তারা সবাই বেদনায় কাতরভাবে কাঁদে, অশ্রুপাত করে। হিজরি ৭ম শতকের বিখ্যাত আলেম শেখ সদরুদ্দীন কুনাভী মওলানার জানাযার নামাযে ইমামতি করেন।পিতা সুলতানুল ওলামা বাহা ওয়ালাদ এর কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। কুনিয়া শহরের গণ্যমান্য লোকেরা ৮০ হাজার দিরহাম অর্থ সংগ্রহ করে তাঁর পবিত্র কবরের ওপর একটি সমাধি নির্মাণ করেন, যা ‘কুব্বাতুল খাযরা’ (সবুজ গম্বুজ) নামে খ্যাতি লাভ করে।
মওলানার জীবনের শেষ গযল
মওলানার ইন্তিকালের রাতে আফলাকীর বর্ণনা অনুযায়ী মওলানার ছেলে হযরত সুলতান ওয়ালাদ অসম্ভব রকমের খেদমত, বিনিদ্রা ও ভগ্ন হৃদয়ের কারণে অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। ফলে মাঝে মধ্যে চিৎকার দিচ্ছিলেনআর কান্নাকাটি করছিলেন, একটুও বিশ্রাম নিচ্ছিলেন না। সেই রাতে হযরত মওলানা বললেন :‘বাহা উদ্দীন! আমি ভালো আছি, তুমি যাও, শুয়ে পড়, একটু আরাম কর।’ হযরত ওয়ালাদ যখন চলে গেলেন ও শুয়ে পড়লেন, তখন মওলানা এই গযল এরশাদ করেন। হযরত চালাবী হুসসাম উদ্দীন তা লিপিবদ্ধ করেন আর রক্তমাখা অশ্রুপাত করেন। এটিই ছিল তাঁর জীবনের সর্বশেষ গযল।
رو سر بنه ببالین تنها مرا رها کن
ترک من خراب شبگرد مبتلا کن.
যাও শুয়ে পড় শিয়রে গিয়ে আমায় তোমরা একলা ছাড়
রাত্রিবেলার ভবঘুরে আমি নষ্ট দুর্ভাগাকে ত্যাজ্য কর।
ماییم و موج سودا، شب تا به روز تنها
خواهی بیا ببخشا، خواهی برو جفا کن.
আমরা আছি, আছে মত্ততার তরঙ্গ ঢেউ রাত্রদিন সমানে,
চাও তো এসো মাফ করে দাও, নয় তো ত্যাজি যাও চলে ।
بر شاه خـوبرویان، واجـب وفـا نبـاشـد
ای زرد روی عاشق تو صبر کن، وفا کن.
যিনি সুন্দরের অধিশ্বর, ওয়াফাদারীতে বাধ্য নন তিনি,
হে ব্যথিত প্রেমিক! তুমিই ধৈর্য ধর, প্রেমের দাবি রক্ষা কর।
خیره کشی است ما را، دارد دلی چو خارا
بکشد، کسش نگـوید تدبیر خونبها کن.
চাহনীর তেজে প্রাণ কাড়ে এমন প্রেমাস্পদ পাষাণ হৃদয়,
খুন করলে কেউ বলবে না তাকে, রক্তমূল্য দাও সমুদয়।
دردیست غیر مردن کآن را دوا نباشد
پس من چگونه گویم کاین درد را دوا کن.
আমান এ ব্যথাÑ মৃত্যু ছাড়া যার নাই কোনো চিকিৎসা,
কাজেই কী করে বলব যে, এই অসুখের চিকিৎসা কর।
در خواب، دوش، پیری در کوی عشق دیدم
با دست اشارتم کرد که عزم، سوی ما کن.
গেল রাতে স্বপ্নে প্রেমের গলিতে দেখলাম এক বৃদ্ধকে,
হাত ইশরায় বলল, চলে এসো তুমি আমার কাছে।
گر اژدها است در ره، عشق است چون زمرد
از برق آن زمـرد، هیـن دفـع اژدهــا کن.
পথে যদিও আছে আযদাহা, প্রেম তো আছে পান্না সম,
সে পান্নারই ঝলক দিয়ে সে আযদাহা দমন কর।
মওলানার খলিফারা
মাযহাবী দিক থেকে মওলানা রূমী (র) ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী। তাঁর ইন্তিকালের পর চালাবী হুসসাম উদ্দীন (মৃত্যু ৬৮৩ হিজরি) তাঁর খলিফা ও স্থলাভিষিক্ত হন। তারপরে মওলানার ছেলে সুলতান ওয়ালাদ (মৃত্যু ৭১২ হিজরি) খেলাফত লাভ করেন।
মওলানা রূমীর ইন্তিকালের পর তাঁর জীবনচরিত নিয়ে, বিশেষ করে শাম্্সেতাবরিযীর প্রতি তাঁর প্রেমাসক্তি নিয়ে বহু রূপকথার জন্ম হয় ও তা লিপিবদ্ধ করা হয়। গবেষকদের মতে এসব রূপকথার মধ্যে অধিকাংশই বানোয়াট ও অনির্ভরযোগ্য। মওলানার জীবনচরিত সম্বন্ধে সবচেয়ে উত্তম ও নির্ভরযোগ্য বিবরণ হচ্ছে, তাঁর ছেলে সুলতান ওয়ালাদ রচিত ‘ওয়ালাদনামা’, যা পদ্যে রচিত। এর পরে রয়েছে শামসুদ্দীন আহমদ আফলাকী রচিত ‘মানাকেবুল আরেফীন’। মওলানার জীবনী সম্পর্কে আরো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে, দওলতশাহ সমরকন্দী রচিত ‘তাযকিরা’ আর মওলানা আবদুর রহমান জামী রচিত ‘নাফাহাতুল উন্্স’ গ্রন্থে মওলানা রূমী সম্পর্কিত বর্ণনা। আরো কিছু কিতাব ভারতবর্ষে রচিত হয়েছে।
মওলানার সমসাময়িক বুযুুর্গ ও আলেম
যেসব বুজুর্গ আলেম ও আরেফ মওলানার সমসাময়িক ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রখ্যাত আরেফ সদর উদ্দীন কুনাভী (মৃত্য ৬৭৩), নাজমুদ্দীন রাযি (মৃত্যু ৬৫৪), সালজুকী রাজকবি কানেয়ী তূসী, আল্লামা কুতুব উদ্দীন শিরাযী (মৃত্যু ৭১০), কাজী সীওয়াস, কাজী সিরাজ উদ্দীন উরমাভী (মৃত্যু ৬৮২), হিজরি সপ্তম শতকের বিশিষ্ট আলেম ফখরুদ্দীন ইবরাহীম ইরাকী (মৃত্যু ৬৮৮ হিজরি) ও প্রখ্যাত আরেফ কবি শেখ সাদী (মৃত্যু ৬৯৪)। মওলানা ও শেখ সা’দীর মাঝে দু’বার সাক্ষাৎ হয়েছিল।
সমকালীন রাজা-বাদশাহ
তাঁর সমকালীন বাদশাহগণ ছিলেন গিয়াস উদ্দীন কায়খসরু দ্বিতীয় (৬৩৪-৬৪৩), ইযযুদ্দীন কায়কাউস দ্বিতীয় (৬৪৩-৬৫৫), রুকন উদ্দীন কালাজ আরসালান চতুর্থ (৬৫৫-৬৬৬) ও অন্যরা। তাঁরা সবাই মওলানার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন এবং তাঁর মুরীদ ছিলেন। তবে যিনি ‘খোদাবান্দগার’ অর্থাৎ মওলানার দরবারে ভক্তি ও শ্রদ্ধায় বিনীত ও একান্ত নিবেদিত ছিলেন তিনি হলেন এশিয়া মাইনরে ইলখানী মোঘলদের গভর্নর মুঈন উদ্দীন পরওয়ানা (মৃত্যু ৬৭৫)
রচনাবলি
১. মসনবী মা’নাবী مثـنوی معـنوی
‘মসনবী’ হচ্ছে ইরান তথা বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও বিরল কাব্যকীর্তি, মানব জাতির চিন্তা ও চেতনার বিস্ময়কর প্রতিফলন-সংকলন। এই ‘মসনবী’ ইরানের সর্বত্র আধ্যাত্মিক কাব্য সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসেবে সমাদৃত। মওলানার একনিষ্ঠ ভক্ত, নিষ্কলুষ মুরীদ হুসসাম উদ্দীন চালাবীর অনুরোধ ও অনুপ্রেরণায় এ অমর ও জাদুময় কাব্যের সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন হয়েছে। হুসসাম উদ্দীনই মওলানার কাছে দরখাস্ত করেছিলেন মওলানা যেন আধ্যাত্মিক, শিক্ষা-দীক্ষা ও দাশর্নিক বিষয়াবলির সমন্বিত একটি গ্রন্থ সানায়ী গযনভীর ‘হাদীকাতুল হাকীকা’ ও শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তারের ‘মানাতিকুত তায়র’ এর আদলে কবিতার আঙ্গিকে রচনা করেন। মওলানা তাঁর দরদিপ্রাণ সাথির প্রত্যাশা পূরণ করেন ও ‘মসনবী’ রচনা আরম্ভ করেন। ‘মসনবী’র প্রথম দফতরটি রচনা করেন ৬৫৭ ও ৬৬০ হিজরির মাঝামাঝি সময়ে। দুই বছর পর দ্বিতীয় দফতরের রচনা শুরু হয় ৬৬২ হিজরির পর। বাকি চারটি দফতর লাগাতারভাবে রচনা করেন। এভাবেই ইরানের আধ্যাত্মিক ও সাহিত্য বিষয়ক রচনাবলির আঙ্গিনায় এক বিশাল কীর্তিগাথা রচিত হয়। আফলাকীর বর্ণনা অনুযায়ী মওলানা কেবল ১৮টি বয়েত স্বহস্তে লিখেন। প্রথম বয়েতটি ছিল মসনবীর সূচনা বয়েত বা প্রথম কলি:
بشنو از نی چون حکایت می کند
وز جـدایـیـهـا شـکـایـت می کـنـد.
‘বাঁশরির কাছে শোনো কী কথা সে বলছে,
সে যে বিরহের করুণ ব্যথার অনুযোগ করেছে।’
শেষ আঠারতম বয়েতটি হলো :
در نیابد حال پخته هیچ خام
پس سخن کوتاه باید والسلام.
বুঝবে না পাকাদের অবস্থা কোনো কাঁচা লোক,
তাই কথা সংক্ষেপ করা চাই, বলি ওয়াস্্সালাম।
‘মসনবী’র বাদবাকি অংশ লিপিবদ্ধ করেন হুসসাম উদ্দীন চালাবী ও তাঁর অপরাপর মুরীদরা, তাঁরা মওলানাকে পড়ে শোনানোর পর সংশোধন করা হতো।
২. ‘মসনবী’ লিপিবদ্ধ হয় ছয় দফতরে। এর বয়েতের সংখ্যা ভিন্নভিন্ন পা-ুলিপি অনুসারে ২৬,০০০ থেকে ২৭,০০০ এর মধ্যে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৩২,০০০ বয়েতেও পৌঁছে যায়। বর্ধিত বয়েতগুলো সংযুক্ত বা আরোপিত বলে গবেষকদের ধারণা।
‘মসনবী’র মরমি, দার্শনিক, তাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সূক্ষ্ম বিষয়গুলো যেহেতু বেশ জটিল, সেহেতু প্রথম থেকেই এই অনন্যসাধারণ গ্রন্থটির বহু ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচিত হয়েছে।
৩. দীওয়ানে শামসدیـوان شمس
মওলানা রূমীর অপর শ্রেষ্ঠ রচনা হচ্ছে তাঁর গযল সংকলন। এই গ্রন্থটি ‘দিওয়ানে কবীর’ বা ‘গাযালিয়াতে শাম্্স’কিংবা ‘দীওয়ানে শাম্্স’নামে প্রসিদ্ধ। মওলানা তাঁর প্রিয় মুর্শিদ শাম্সেতাবরিযীর নামে এর নামকরণ করেন। এর সর্বোত্তম ও সুন্দর মুদ্রণটি প্রকাশিত হয়েছে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হতে মরহুম বদিয়ুয যামান ফরুযানফর এর সম্পাদনায়। কিতাবটিতে বয়েতের সংখ্যা ৩৬,৩৬০টি।
৪. রুবাইয়াত رباعیات
দিওয়ানের বাইরে রয়েছে স্বতন্ত্র ‘রুবাইয়াত’ বা চতুষ্পদী। ‘রুবাইয়াত’ এর সংখ্যা ১,৯৮৩টি। মওলানার প্রাণ-উচ্ছল গযলকাব্য ও আধ্যাত্মিক রুবাইয়াত, যা অবিরাম-নির্ঝর ঝরনার মত, তাঁর আগাগোড়াই মহান আল্লাহর প্রতি অফুরন্ত প্রেম উন্মাদনায় ভরপুর।
৫. ফীহে মা ফীহে, فیه ما فیه এ কিতাবটি আধ্যাত্মিক রহস্যজ্ঞান সম্পর্কিত।
৬. মাকাতীব مکاتیب -এটি মওলানার চিঠিপত্র সংকলন এবং
৭. মাজালীসে সাবআ مجالس سبعه -এই কিতাবটি মওলানার বক্তৃতা সংকলন।