সোমবার, ৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২০শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ভ্রমণ

পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৬ 

বাংলাদেশ ও ইরানের সাংস্কৃতিক বিনিময়
মোঃ মফিদুর রহমান*
হঠাৎ করেই সুযোগটা এসে গেল। ভাবিনি এভাবে হঠাৎ করেই যাওয়া হবে। যাওয়া হবে স্বপ্নের মত সুন্দর দেশ ইরানে। তবে ইরান সফরের আগের গল্পটাও বলা দরকার। সরকারি চাকুরি করার সুবাদে প্রশিক্ষণ আর শিক্ষাসফরের আদলে মাঝে মধ্যে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ ঘটে। এটা যে আবার খুব সহজে পাওয়া যায় তাও নয়। তবে বছরে দু’একবার পাওয়া গেলে তাকে বেশ ভাগ্যের ব্যাপারই বলতে হবে। এক্ষেত্রে আবার ইচ্ছেমত কোন দেশে যাবার সুযোগ নেই। যখন যে দেশে কাজ থাকবে সে দেশেই যাওয়া যাবে।
ছ’মাসের বেশি হবে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছি। এ মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি উপলব্ধি করেছি সংস্কৃতি শুধু সংগীত, নৃত্য, ছবি আঁকা আর নাটকের মতো শিল্পমাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়। এর আরো অনেক মাত্রা রয়েছে। বিশ্বের বহু উন্নত দেশ সেটা উপলব্ধি করতে পারলেও আমরা এখনো পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের চেতনায় সে আলো এখনো এসে পড়েনি। তবে খুব শিগগির সে আলোয় আমাদেরও আলোকিত হতে হবে। সারা দুনিয়া এখন মেতে আছে ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিজ, কালচারাল হেরিটেজ সংরক্ষণ, কালচারাল ট্যুরিজম, ক্রিয়েটিভ ইকোনমি নিয়ে। তৈরি হচ্ছে ক্রিয়েটিভ সিটি, স্মার্ট সিটি ইত্যাদি ধারণা নিয়ে অভিনব সব নগরপরিকল্পনা। এসবের মূলে কিন্তু রয়েছে সংস্কৃতির অভিনব সব উদ্ভাবনা। অবশ্যই সেসব উদ্ভাবনা অভিনব, সৃজনশীল, পরিবেশবান্ধব আর প্রাণপ্রাচুর্যময় আবিষ্কারে ঋদ্ধ। তবে সে সব আলোচনায় পরে আসছি। এবার ইরান প্রসঙ্গ।
ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিনিময় সমঝোতা স্মারকের নবায়ন স্বাক্ষর কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে ছিল। একদিন নিজের দপ্তরে বসে কাজ করছি। হঠাৎ করেই একটি ফোন পেলাম। ফোনের ওপাশ থেকে এক ব্যক্তি তাঁর পরিচয় দিয়ে বললেন যে, তিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত ইরানের মান্যবর রাষ্ট্রদূত এর একান্ত সচিব। তাঁর নাম জনাব ইকবাল। তিনি বললেন, ইরানের রাষ্ট্রদূত চাচ্ছেন বাংলাদেশের সঙ্গে ইরানের চুক্তিটি যেন দ্রুত স্বাক্ষর হয় এবং এজন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করা হয়। শুরু হলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চিঠি চালাচালি। একপর্যায়ে এসে দু’দেশের সরকার সম্মত হলেন চুক্তিটি স্বাক্ষর করতে। এর মধ্যে একটি চমৎকার প্রস্তাব এলো ইরানের কাছ থেকে। তা হলো ৩-১৬ মে ইরানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২৮তম আন্তর্জাতিক বইমেলা। ইরান সরকার চাচ্ছে বাংলাদেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর ঐ মেলা উদ্বোধন কিংবা এর সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকুন এবং একইসাথে চুক্তিটি স্বাক্ষর করুন। এভাবেই মাননীয় মন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে আমার ইরানে যাওয়া এবং চমৎকার একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করা।
কাতার এয়ারওয়েজ এর ফ্লাইট টাইম ভোর রাতে। আমরা রওয়ানা হলাম ১৩ মে ভোর রাত ৩:২৫ মিনিটে। দোহা হয়ে বিমান যখন ইমাম খোমেইনী আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে পৌঁছলো ঘড়ির কাটায় তখন স্থানীয় সময় দুপুর ১২:৩০। বিমানবন্দরে আমাদের স্বাগত জানাতে উপস্থিত ইরানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং অন্য কর্মকর্তাগণ। এসেছেন ইরানের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা। ভিআইপি রুমে আলাপচারিতায় বুঝতে পারলাম আমাদের ইরান সফর স্মরণীয় হতে চলেছে।
এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়ি প্রস্তুত। গাড়ি চলছে দ্রুতবেগে। দু’পাশে বিশালাকৃতির পাহাড়। মনে পড়লো সেই গানের কথা : আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই। এ পাহাড়ের সাথে আমাদের দেশের পাহাড়ের বেশ পার্থক্য চোখে পড়লো। আমাদের দেশের পাহাড়গুলো বেশি উঁচু নয়। আর আমাদের দেশের পাহাড়গুলোয় সবুজের সমারোহ। পাহাড়ের গায়ে জুম চাষ হয়। অন্যদিকে ইরানের পাহাড়গুলো পাথরের। অনেক উঁচু। সবুজ তেমন নয়। তবে রাস্তার ধারে কিছু কিছু পাহাড়ের গায়ে ফুলের চাষ করা হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পাহাড়ের গায়ে লতাগুল্ম সুন্দর করে কেটে ছেঁটে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। রাস্তাঘাট খুব প্রশস্ত আর পরিকল্পিত। হাইওয়েতে সবাই নিয়ম মেনে গাড়ি চালাচ্ছে। পাবলিক বাসের জন্য রয়েছে আলাদা লেন। সেখানে রাস্তায় চলাচলের জন্য সাধারণ মানুষকে দেয়া হয়েছে বেশি গুরুত্ব। যানজট প্রায় চোখেই পড়লো না। যদিও ইরানের সবাই বলাবলি করছিলেন, তেহরান খুব ব্যস্ত শহর; এখানে যানজট আছে। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হলো যানজট থাকলেও তার রূপ আমাদের দেশের মত নয়। আমাদের দেশে যেমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থির হয়ে গাড়ি রাস্তায় আটকে থাকে, একচুলও নড়ে না, এখানে তেমন নয়। এখানে গাড়ি ধীর গতিতে চলতে থাকে।
আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো হোটেল আজাদী ইন্টারন্যাশনালে। এটি ইরানের ফাইভ স্টার হোটেল। হোটের রুম থেকে বিশাল বিশাল পাহাড় আর মেঘের বালিকারা মায়াবি ইশারায় যেন ডাক দেয়। মধ্যাহ্নভোজ সেরে হালকা বিশ্রাম। এরপর বিকেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সাংস্কৃতিক চুক্তি স্বাক্ষর। আমাদের গাড়ি ছুটে চলছে তেহরানের রাস্তায়। আমার রক্তে কেমন যেন উত্তেজনা আর শিহরণ! জীবনের প্রথম ঐতিহাসিক শহর তেহরানে আসা। ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামিক গাইডেন্স মন্ত্রণালয় প্রস্তুত। আমাদের উষ্ণ স্বাগত জানালেন সংস্কৃতি মন্ত্রী জনাব আলী জান্নাতি। ইরান ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা পর্বে দু’দেশের মন্ত্রী এ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তা এবং এর ফলে যা অর্জিত হবে তার ওপর গুরুত্বারোপ করলেন। এরপর চুক্তি স্বাক্ষর হলো। ইরানের সরকারি মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা দু’মন্ত্রীকে কিছু প্রশ্নও করলেন। তবে সবই ছিল সৌজন্যমূলক।
ইরানের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। ১৯৭৭ সালে ইরানের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। এরপর ২০০৪-২০০৭ মেয়াদে সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম স্বাক্ষরিত হয়। এটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে নতুন করে আবার সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম নবায়নকল্পে স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তবে, সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত না হলেও ইরানের সাথে বাংলাদেশের নিবিড় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। যেমন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে প্রতি দু’বছর অন্তর আয়োজিত দ্বিবার্ষিক এশিয়ান চিত্রকলা প্রদর্শনীতে ইরান নিয়মিত অংশগ্রহণ করে আসছে এবং পুরস্কারও পেয়েছে। ইরানের চলচ্চিত্র বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের কাছে অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং শিক্ষণীয়। বিভিন্ন সময় বাংলা ভাষায় ডাবিং করা চলচ্চিত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রদর্শন করা হয়েছে। সংস্কৃতিচর্চায় ইরান বর্তমান বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। ইরান সফরে তা আমরা বেশ উপলব্ধি করতে পেরেছি।
এবারে আসা যাক সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম প্রসঙ্গে। ইরানের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পরিধি বেশ ব্যাপক। এখানে সংস্কৃতির পাশাপাশি বিজ্ঞান ও শিক্ষা কার্যক্রমও স্থান পেয়েছে। বিনিময় কার্যক্রমের মেয়াদ ২০১৫-২০১৮ সাল পর্যন্ত। চুক্তির মধ্যে মোট ৬টি অধ্যায় এবং ৫৬টি আর্টিকেল রয়েছে। প্রথম অধ্যায়েই রয়েছে সংস্কৃতি ও শিল্প। এখানে আর্টিকেল আছে ১৬টি। এখানে বলা হয়েছে, উভয় দেশ নিজেদের মধ্যে সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, ধর্মীয় ও প্রতœতাত্ত্বিক তথ্য, ছবি, সিডি, চলচ্চিত্র, মাইক্রোফিল্ম ইত্যাদি বিনিময় করতে পারবে। তাছাড়া দু’দেশ পারস্পরিক সাংস্কৃতিক সপ্তাহ, বই, হস্তশিল্প, ছবি ও অন্যান্য শিল্পকর্মের মেলা ও প্রদর্শনী করতে পারবে। উভয় দেশ তাদের লেখক, শিল্পী, প্রকাশক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বিভিন্ন সম্মেলন, সভা, ওয়ার্কশপ ইত্যাদিতে অংশগ্রহণের জন্য সহযোগিতা করবে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বইমেলায় পরস্পরকে আমন্ত্রণ জানাবে। বাংলাদেশ ও ইরান বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসবে শিল্পী ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করবে। একইভাবে সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের তথ্য আদান প্রদান ও তাতে অংশগ্রহণের জন্যও উভয়দেশ আমন্ত্রণ জানাবে। দু’দেশ নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানাবে ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে। মোটামুটি এই হলো সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রমের মূল বক্তব্য।
আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি কার্যক্রম শুরু করার। আশা করছি এশিয়ার সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ দেশ ইরানের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বন্ধুত্ব ক্রমাগত সুদৃঢ় হবে।

লেখক : সংস্কৃতি উপদেষ্টা
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার