ভিনদেশিদের বাংলা শেখা
পোস্ট হয়েছে: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৭
![news-image](https://www.iranmirrorbd.com/wp-content/uploads/2017/02/1486781434.jpg)
নাম ‘লার্ন বাংলা’, যাত্রা শুরু ২০১০ সালে। বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখানো, বাংলা সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে অবহিত করা এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেওয়া এর উদ্দেশ্য।
ভিনদেশি একজন মানুষ যখন বাংলা ভাষায় আপনাকে বলেন—কেমন আছেন? ধন্যবাদ। অথবা বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার কথা জানান দেবে তখন আহলাদিত হওয়া ছাড়া উপায় আছে? সম্প্রতি এমনি এক সুখকর অনুভূতির মুখোমুখি হয়েছি। ভিনদেশিদের মুখে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশংসা শুনেছি। তাদের অনেকেই কেবল বাংলা ভাষা শিখতে বাংলাদেশে এসেছেন। অনেকেই বাংলা ভাষার প্রেমে পড়েছেন। ভাষার মাসে এটা আনন্দের সংবাদ।
এমন আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছে ‘লার্ন বাংলা’। ২০১০ সালের ১৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে ভাষাকেন্দ্রিক এই সংগঠন। উদ্দেশ্য বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখানো, বাংলা সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে অবহিত করা এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেয়া।
অবস্থান বনানীর সাত নম্বর রোডে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, কোরিয়া, ভারতসহ বিশ্বের ৫০টি বেশি দেশের নাগরিকদের বাংলা শেখানো হয় এখানে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজারের বেশি বিদেশি নাগরিক এখানে বাংলা ভাষা শিখেছেন। এখনো অনেকে শিখছেন। বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তা, স্টুডেন্ট ভিসায় যারা বাংলাদেশে পড়তে এসেছেন, বিদেশি এনজিওসহ ব্যবসা ও গবেষণার কাজে যেসব বিদেশি নাগরিকগণ বাংলাদেশে অবস্থান করছেন এবং যারা টুরিস্ট হিসেবে এদেশে এসেছেন তারাই ‘লার্ন বাংলা’র বাংলা শিখছেন। এছাড়া কলকাতায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের নাগরিকরাও ‘লার্ন বাংলা’র সহায়তায় বাংলাদেশে আসছেন বাংলা শিখতে।
শুধু বাংলা ভাষা নয়, বাংলাদেশি রান্না, সঙ্গীত, নাচ, সাহিত্য, কৃষি, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ বাঙালি সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের সঙ্গে পরিচয় করানো হয় এখানে। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিদেশি নাগরিকরা সেখানে বাংলায় গান, অভিনয়, আবৃত্তি, নাচসহ বিভিন্ন আইটেমে অংশগ্রহণ করেন।
বিদেশিদের মুখে শুদ্ধ বাংলা শুনে গর্বিত, আনন্দিত এবং বিস্মিত হয়েছি। আমরা প্রতিনিয়ত দশটি শব্দের মধ্যে তিন-চারটা বিদেশি শব্দ ব্যবহার করি, কিন্তু বাংলা শিখতে আসা বিদেশিরা শতভাগ বাংলা শব্দেই কথা বলছেন। ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেও বাংলাতেই জবাব দেয়ার চেষ্টা করছেন। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশ নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক হে-জিন বলেন, ভবিষ্যতে একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে আমি বাংলাদেশি প্রতিবন্ধী শিশুদের সাহায্য করতে চাই। তাই আমি বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি শিখছি। কিন্তু বাংলা অনেক কঠিন ভাষা।
চীনের নাগরিক সো-কাম লিন বলেন, আমি বাংলাদেশে এসেছি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্য। আমি বস্তি এলাকায় বাচ্চাদের ইংরেজি বলতে সাহায্য করি। তাদের বেশিরভাগ পরিবার ইংরেজি বলতে পারে না। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য বাংলা শিখি। আমি আশা করি, এভাবে আমার ভাষা ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ভবিষ্যতে দৃঢ় হবে।
নিউজিল্যান্ডের নাগরিক জন মেকমুলান বলেন, আমি বাংলা শিখছি, কারণ আমার জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাস ও কাজের জন্য একটি দরজা খুলেছে। বিশেষভাবে পশ্চিম বাংলায়। আমার উদ্দেশ্য হলো সহকর্মী, প্রতিবেশী ও যে বাঙালি পরিবেশে আমি থাকবো তাদের সঙ্গে কথা বলা ও সু-সম্পর্ক তৈরি করা। আমার দেশে আমি শুধু একটি ভাষায় কথা বলি। দক্ষিণ এশিয়ায় আসার পর আমার মনের ভিতরে বিভিন্ন ভাষা সম্পর্কে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বাংলা ভাষা শিক্ষা আমাকে সাহায্য করবে বিভিন্ন অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে।
মার্কিন আমেরিকার নাগরিক জেফির মেইয়ার বলেন, বিশ্বে বাংলা ভাষার স্থান এখন পঞ্চম, যা আমাকে এই ভাষা ও এ ভাষাভাষী মানুষকে জানতে আগ্রহী করেছে। বাঙালির ভাষা শিখে তাদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তৈরির জন্য বাংলা শিখছি।
ফিনল্যান্ডের নাগরিক আরিয়া তৈভাইনেন বলেন, একটি নতুন ভাষা শেখা একটা নতুন পৃথিবী আবিষ্কারের মতো। আজকের বৈশ্বিক যুগে একটি নতুন সংস্কৃতিকে আপন করে নেয়ার জন্য ভাষা শিক্ষা বিশেষ প্রয়োজন। একটা নতুন দেশে নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জন্য আমি মনে করি ভাষাশিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই আমি বাংলা শিখছি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
রুমানিয়ার নাগরিক অক্টাভিয়ান রেটেজান বলেন, বাংলাদেশে নিজস্ব কোনো উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য আমি আসিনি। এ দেশের মানুষদের সেবা করতে এসেছি। এ জন্য ভবিষ্যতে আমার কাজটিকে সহজতর করার লক্ষ্যে প্রথমেই দরকার ভাষা ও সংস্কৃতি শেখা। তাই আমি বাংলা শিখছি। আমি যখন আমার দেশ রুমানিয়ায় ফিরে যাব এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরবো তখন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে তাদের সঙ্গে আদান-প্রদান করতে চাই।
ব্রিটিশ নাগরিক এলিজাবেথ জেম সিম্পসন বলেন, একটি নতুন ভাষা সেই অঞ্চলের মানুষ ও সংস্কৃতিকে বোঝার সর্বোত্তম পন্থা। যেহেতু আমি বাংলাদেশকে আমার ভবিষ্যত কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছি, তাই ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে এদেশের মানুষের কাছে আসার চেষ্টা করছি, সংস্কৃতিকে বোঝার চেষ্টা করছি।
ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক আপনের নাপাদা বিহার বলেন, আমার কাছে অন্য একটি ভাষা শিক্ষার মানে নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করা। আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা এদেশে নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা, এর ভিতর দিয়ে এদেশের মানুষকে সাহায্য করা এবং আমার দেশের মানুষের সাথে এদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা।
ইন্ডিয়ার নাগরিক মনোজ ভর্মন বলেন, আমার বাংলা শেখার একটি মূল কারণ এ ভাষার প্রতি অবারিত ভালবাসা। আমি সবসময় এ চমৎকার ভাষার মধ্যে ডুবে থাকতাম এবং কল্পনা করতাম একদিন এ ভাষায় আমি কথা বলবো। কারণ আমার ছোটবেলায় আমার বাবা-মা এদেশে কাজ করতেন। আমি এ মিষ্টি ভাষার প্রেমে পড়ে গেছি। এখন বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশে কাটাচ্ছি। আরো গভীরভাবে সুন্দর এদেশের মানুষ ও সংস্কৃতিকে বোঝার চেষ্টা করছি।
কানাডার নাগরিক ডানিয়েলা লালন্ডে মাসুদ বলেন, আমি বাংলা শিখেছি, আরো বাংলা শিখতে চাই। আমি মনে করি, একটা ভাষা জানার অনেক সুবিধা রয়েছে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার ক্ষেত্রে, বিশেষভাবে আমার বাঙালি স্বামীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে বাংলা জানাটা খুবই দরকার।
লার্ন বাংলা’র চেয়ারম্যান লেনিন পিনারু বলেন, প্রত্যেকটা দেশেরই একান্ত নিজস্ব কিছু সম্পদ থাকে-যা কখনও ভৌগলিকভাবে পাওয়া আবার কখনও অর্জন করা, যা কখনও কখনও সেই দেশকে সারাবিশ্বে পরিচিত করে তোলে। আমাদের বাংলা ভাষা আমাদের জন্য ঠিক সেরকমই একটি সম্পদ, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে অর্জিত। গর্বের বিষয় আমাদের সেই বাংলা ভাষা আজ বিশ্বের প্রায় ছয় হাজারের বেশি ভাষার মধ্যে পঞ্চম স্থান দখল করে নিয়েছে। আমাদের মাতৃভাষা দিবস আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিদেশিরা আমাদের ভাষা বিষয়ক ইতিহাস শুনে অবাক হয়ে যায়। আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি গর্ব করার মতো। একটা উপলব্ধি আমাদের সবার মধ্যেই থাকা দরকার, আমাদের এই ভাষা নিয়ে আমাদেরকে কাজ করতে হবে। এই ভাষার গৌরব আমাদেরকেই অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।
লার্ন বাংলা’র প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেরি জুলিয়েট পিনারু বলেন, গর্বিত হই, আবেগাপ্লুত হই যখন আমার ভাষা শুনি অন্য ভাষাভাষীদের মুখে। আজ আমার সতের বছরের শিক্ষকতা জীবনে গভীরভাবে অনুধাবন করছি একটি দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব কতখানি। ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বিশ্বের সব দেশেই ভিনদেশিদের জন্য ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সারাবিশ্বজুড়ে সমাদৃত ইংরেজি ভাষায় এখনও নিরলস কাজ পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিব্যাপ্তি চলছে এর ভাবনার বিষয় এক্ষেত্রে আমরা কতটা উদার কতটা সক্রিয় আমাদের এই ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে। পরিতাপের বিষয়, বাংলা ভাষা আজ বলতে গেলে খুব অনাদরেই বড় হচ্ছে। আমাদের পাঠ্যপুস্তক, গল্প, কবিতা আর উপন্যাসের দিকে তাকালে লজ্জা পেয়ে যাই। যেখানে বিদেশিরা আমাদের ভাষা শেখার জন্য আগ্রহী, সেখানে আমরা আমাদের ভাষা থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি।
আমাদের প্রত্যাশা- ‘লার্ন বাংলা’র মতো ভাষাকেন্দ্রিক সংগঠন আরও গড়ে উঠুক। বাংলা ভাষা ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বের সব দেশে। আফ্রিকার কোনো নির্জন স্থানে কেউ বসে গম্ভীর রবীন্দ্রনাথ পড়ুক। আমেরিকার কোনো বাড়িতে পঠিত বাহক নজরুলের কবিতা, সিডিতে বাজুক নজরুল সঙ্গীত। জার্মানির কোনো বড় ফেস্টিভ্যালে দেয়ালে ঝুলতে থাকুক জয়নুল আবেদিনের আঁকা ছবি। সূত্র: ইত্তেফাক।