বৃহস্পতিবার, ২০শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ভাগ্য বনাম চেষ্টার প্রশ্নে খরগোশ ও সিংহের যুক্তিতর্ক

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ৮, ২০২০ 

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

সুন্দর মনোরম এক বনে পশুপাখিরা পরম সুখে বাস করছিল। বন্য পশুদের ছুটাছুটি আর সকাল-সন্ধ্যা পাখিদের কূজনে মুখরিত ছিল মায়াবী বনটি। কিন্তু পশুপাখিদের এত সুখের মাঝে বিপত্তির কারণ ছিল একটি হিং¯্র সিংহ। যখন তখন বন্য পশুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এই বনের রাজা। ফলে পশুদের জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। আতঙ্কে তারা সদা তটস্থ থাকত কখন সেই সিংহ হামলে পড়বে এ আশঙ্কায়। এই কঠিন সংকট সমাধানের পথ বের করতে পশুরা এক সমাবেশে মিলিত হল। সিদ্ধান্তের পর সিংহের কাছে গিয়ে তারা প্রস্তাব দিল : ‘ওহে বনের রাজা মহামতি সিংহ! আপনি আমাদের রাজা। আপনি রোজ দৌড়ঝাঁপ দিয়ে আমাদের শিকার করেন। তাতে আপনার বড় কষ্ট হয়। তার পরিবর্তে আমাদের একটি প্রস্তাব আপনি বিবেচনা করে দেখুন। প্রতিদিন আমরা লটারির মাধ্যমে আমাদের মাঝ থেকে একটি প্রাণী বাছাই করে আপনার কাছে পাঠাব। সে-ই আপনার ঐ দিনের খাবার হবে। এমনটি হলে আমরাও আপনার অকস্মাৎ আক্রমণ থেকে নিশ্চিন্ত হব। আপনিও শিকার করার কষ্ট থেকে রেহাই পাবেন।’ সেই প্রস্তাব অনুযায়ী বনের পশুরা অঙ্গীকার পালন করে যাচ্ছিল। প্রতিদিন লটারি হতো। লটারিতে যার নাম উঠত, সিংহের খাবার হবার জন্য সে চলে যেত। একদিন লটারিতে নাম ওঠে এক খরগোশের। কিন্তু খরগোশ বেঁকে বসল। সে সাথিদের বলল : ‘আমি আজ একটু বিলম্বে যাব। আর এর মধ্যেই সিংহের দফা চিরদিনের জন্য রফা করার ব্যবস্থা করব।’ তার কথায় পশুরা সায় দিল। গোপন পরিকল্পনামাফিক খরগোশ ধীর পদে সিংহের ডেরায় পৌঁছল একটু দেরীতে। গিয়ে দেখে বিলম্বের কারণে সিংহ তার ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। খরগোশ তার বিলম্বের ওযর পেশ করে বলল : “জাহাপনা! আমার বিলম্বে পৌঁছার কারণ হলো, আমার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে আপনার রাজ দরবারে আসছিলাম। কিন্তু পথে এই বনেরই আরেকটি সিংহ আমাদের পথ আগলে জিজ্ঞাসা করে, ‘কোথায় যাও?’ আপনার কাছে আসছি বলাতে সে ভীষণ রেগে যায়। অবশেষে আমি আমার সাথি সেই খরগোশকে তার কাছে জিম্মী রেখে এখানে এসেছি।’ এই বনের রাজা আরেক সিংহÑ এমন দাবির কথা শুনে সিংহ রাগে গর্জে উঠল। বলল : ‘হুম! আমাকে নিয়ে চল সেই কুলাঙ্গারের কাছে।’ খরগোশ সিংহকে এক কূপের ধারে নিয়ে গেল। খরগোশ সিংহকে বলল : ‘এই কূপের মধ্যে দেখুন, সেই সিংহ কেমন রেগে আছে!’ সিংহ যখন কুয়ার মধ্যে উঁকি দিল তখন তার ছবি প্রতিফলিত হলো কূপের পানিতে। সেই সাথে তার পাশে থাকা খরগোশের ছবিও। সিংহ মনে করল যে, সেখানে আরেকটি সিংহ রাগে ফেটে পড়ছে আর সেটার পাশের রয়েছে জিম্মি খরগোশটি। তাই সে কূপের মধ্যে দেখা সেই সিংহের ওপর লাফিয়ে পড়ল। এভাবে ক্ষুদ্র খরগোশ বুদ্ধির জোরে বধ করল জালিম সিংহকে। আর স্বাধীনতা বয়ে আনল বনের পশুদের জন্য।
মওলানা রূমি বলছেন যে, এই গল্প তিনি চয়ন করেছেন ভারতে রচিত গ্রন্থ ‘কলিলা ও দিমনা’ হতে। কিন্তু কলিলা ও দিমনার মূল গল্পকে মওলানা রূমী বিস্তৃত আকারে সাজিয়েছেন। তাতে আধ্যাত্মিকতা, দর্শন, চরিত্রবিজ্ঞান ও কালামশাস্ত্রের সারিসারি অট্টালিকা গড়েছেন। যা দেখে যে কোনো পাঠক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়।
মওলানা বনের পশুদের মিষ্টিমধুর ভাষার আঙ্গিকে অতিশয় সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক তত্ত্বকথা উপস্থাপন করেছেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় তাওয়াক্কুল, আল্লাহতে তুষ্টি, শোকর ও ফানা প্রভৃতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম, প্রাজ্ঞ ও মনোজ্ঞ বর্ণনা দিয়েছেন। মওলানা রূমির ভাষ্যমতে খরগোশ ও সিংহের এই গল্পের মূল প্রতিপদ্য হচ্ছে তাওয়াক্কুল ও যুহদ। তাওয়াক্কুল মানে আল্লাহর ওপর ভরসা করা। বনের পশুরা সিংহকে গিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল, আল্লাহর ওপর ভরসা করে বসে থাকুন। দেখবেন, আল্লাহই আপনার আহার যোগান দিচ্ছেন। পশুরা বুঝাতে চায় যে, ভাগ্যের হাতে সব ছেড়ে দিলে আল্লাহই সবকিছু ঠিক করে দিবেন। সিংহ পশুদের এই ব্যাখ্যা মানতে রাজি হয়নি। সিংহের সাফ কথা, অবশ্যই নিজের চেষ্টা-সাধনায় জীবনকে গড়তে হবে। আল্লাহর নবী-রাসূলগণ (আ.) সবচেয়ে বড় তাওয়াক্কুলকারী ছিলেন। অথচ তাঁরা চেষ্টা-সাধনা ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকেন নি। কাজেই ‘যেমনি নাচাও তেমনি নাচি পুতুলের কি দোষ’ দর্শন মানতে রাজি নয় সিংহ। বরং তার বক্তব্য হচ্ছে, ‘তদবীরে তকদির গড়ে নাও তুমি, হবে মহিমান্বিত, করবেন জগৎস্বামী।’ কারণ, আল্লাহর নবী-রাসূলগণ জীবনভর সংগ্রাম করেছেন, সাধনা করেছেন, আবার আল্লাহর ওপর তাঁদের নির্ভরতা ছিল সর্বোচ্চ মাত্রায়। বস্তুত মওলানা রূমী অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী নানা দৃশ্যপট এঁকে প্রাঞ্জল ভাষায় যুক্তিতর্কের আসর সাজিয়ে নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে দেয়া বা নিজ হাতে নিয়তি গড়ার বিপরীতমুখি দর্শনের সমাধান দিয়েছেন। মানবসভ্যতায় আবহমানকাল ধরে চলে আসা এই বিতর্ক, বিশেষ করে ইসলামে জাবরিয়া মতবাদের প্রাদুর্ভাবে ধর্মীয় চিন্তার ভারসাম্য বারবার ভেঙে পড়ার গতিরোধ করার চিরস্থায়ী ব্যবস্থা দিয়েছেন। মওলানার কালোত্তীর্ণ এই পরিবেশনার প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে অধ্যয়ন করতে হবে মূল মসনবী। ছয় খ- মসনবীর ১ম খ-ের ৯০০-১৩৮৯ বয়েত অর্থাৎ মোট ৪৮৯ বয়েত জুড়ে এই গল্পটি পরিবেশিত। আলহামদুলিল্লাহ মনসবীর এ অংশটি¬ পূর্ণাঙ্গ আকারে তরজমা ও ব্যাখ্যার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ‘মসনবী শরীফ’ নামে বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার খায়রুন প্রকাশনী। মওলানার ভাষায় গল্পের শুরুতে পশুরা সিংহের কাছে এসে বলল :
جمله گفتند ای حکیم با خبر
الحذر دع لیس یغنی عن قدر.
“জুমলা গোফতান্দ আয় হাকীমে বা’ খবর
আলহাযর দাঅ লাইসা ইয়ুগনী  আন ক্বদর”

‘বলল সবাই : ওহে প্রাজ্ঞ মনীষী প্রবর
সতর্কতা ছাড়ুন, ভাগ্যের সামনে তা অকার্যকর।’ ১/৯০৮
সতর্কতা, চেষ্টা-সাধনা ত্যাগ করুন। কারণ, তকদিরের যে ফায়সালা তার সামনে এসব কিছু কোনো কাজে আসবে না। কপালের লিখন খ-ানোর শক্তি কারো নাই। সতর্কতা দেখানো আর চেষ্টা-সাধনায় ব্যতিব্যস্ততা সকল পেরেশানির মূল। কাজেই আল্লাহর ওপর ভরসা করে তাওয়াক্কুল নিয়ে বসে থাকাই উত্তম। সিংহ তার জবাবে বলে :
گفت آری گر توکل رهبر است
این سبب هم سنت پیغمبر است.
‘গোফত অ’রি গর তায়াক্কুল রাহবর আস্ত
ইন সবব হাম গোফতেয়ে পয়গাম্বর আস্ত’

‘বলল : হ্যাঁ, তাওয়াক্কুল জীবনের গন্তব্যে নিয়ে যায় যদিও
কিন্তু উপায় অবলম্বন নবীর সুন্নত সন্দেহ নাই তাতেও।’ ১/৯১২
সিংহ বনের পশুদের বুঝিয়ে বলল : হ্যাঁ, যদি আল্লাহর ওপরে ভরসাই সাধনার পথে সঠিক পথপ্রদর্শক, কিন্তু জীবনপথে এগিয়ে চলার আরো একটি শর্ত আছে। সেটি হলো, উপায়-উপকরণ অবলম্বন বা চেষ্টা ও সাধনা। এটি পয়গাম্বর (সা.)-এর সুন্নাত। তার মানে, যে সত্যিকার তাওয়াক্কুল অবলম্বন করবে বা আল্লাহর ওপর ভরসা করাকে জীবনের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করবে, তাকে চেষ্টা-সাধনাও চালাতে হবে, উপায়-উপকরণ কাজে লাগাতে হবে। কারণ হলো-
گفت پیغمبر به آواز بلند
با توکل زانوی اشتر ببند.
‘গোফত পয়গাম্বর বে আওয়া’যে বুলন্দ
বা’ তাওয়াক্কুল যা’নূয়ে উশতোর বেবন্দ’

‘উচ্চকণ্ঠে নবীজি ঘোষণা করেছেন এই নীতি
তাওয়াক্কুল নিয়ে বাঁধ আগে উটের পা’টি।’ ১/৯১৩
এক বেদুইন সাহাবী মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করতে মসজিদে নববীতে আসেন। মসজিদে প্রবেশ করলে তাকে হযরত জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমার বাহন উট কোথায় বেঁধে রেখেছ?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করে এমনিতে খোলা রেখেছি। (আল্লাহই দেখবেন, আল্লাহর হুকুম ছাড়া তো ধুলাও নড়তে পারে না)।’ হযরত (সা.) তখন তাকে নির্দেশ দিলেন, ‘আগে তোমার উট বেঁধে আস। তারপরে তাওয়াক্কুল কর।’-জামে সাগীর, ১ম খ-, পৃ. ৪৬।
সিংহ আরো বুঝিয়ে বলল-
رمز الکاسب حبیب الله شنو
از توکل در سبب کاهل مشو.
“রামযে আল-কা’সেব হাবিবুল্লাহ শোনো
আয তাওয়াক্কুল দর সবব কা’হেল মশো”

‘শোনো উপার্জনকারী আল্লাহর বন্ধু, এর রহস্যকথা
তাওয়াক্কুলে গিয়ে উপায় অবলম্বনে হবে না পিছপা।

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে : ‘ওয়ালি কাসেবু হাবিবুল্লাহ’- উপাজর্নকারী আল্লাহর বন্ধু। ১/৯১৪
(সূত্র : মসনবী শরীফ, ১ম খ-, বয়েত নং ৯০০-৯১৪ পরবর্তী)