শুক্রবার, ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

বৃষ্টির নামায এবং ইমাম রেযা (আ.)-এর দোয়া কবুল হওয়া

পোস্ট হয়েছে: জুন ৮, ২০১৬ 

হাকেম নিশাবুরী শাফেয়ী তাঁর ‘ইতিহাস’ গ্রন্থের মধ্যে লিখেছেন, যখন খলিফা মামুন ইমাম রেযা (আ.)-কে স্বীয় যুবরাজ পদে আসীন করেন, ঘটনাক্রমে সে সময়ে ছিল বৃষ্টির মৌসুম। কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছিল না। আর এ ঘটনাই ইমাম রেযা (আ.)-এর আশপাশের ও যুবরাজ পদের বিরোধিতাকারীদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক লোকের জন্য একটি বাহানা হলো এবং তারা ইমামকে যন্ত্রণার মধ্যে ফেলতে চাইলো। তাদের কথা ছিল : ‘আলী ইবনে মূসা আর-রেযা আমাদের যুবরাজ হয়ে আমাদের থেকে বৃষ্টি ছিনিয়ে নিয়েছেন।’ এসব কথা মামুনের কানেও পৌঁছল। মামুনও তাদের এসব অবান্তর কথাবার্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়লেন। তিনি এক জুমআর দিন ইমাম রেযা (আ.)-কে বললেন : ‘বেশ কিছুদিন বৃষ্টি হচ্ছে না। আপনি যদি দোয়া করেন তাহলে হয়তো বৃষ্টি হতে পারে, এতে খুবই ভালো হতো।’ ইমাম বললেন : ‘দোয়া করব।’ মামুন জিজ্ঞেস করলেন : ‘কখন দোয়া করবেন?’ ইমাম বললেন : “সোমবারে। গতরাত্রে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) ও আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-কে স্বপ্নে দেখেছি। রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বললেন : ‘হে আমার সন্তান! সোমবার পর্যন্ত সবুর করো। সোমবারে মরুভূমিতে যাবে এবং বৃষ্টির জন্য দোয়া করবে। আল্লাহ তাঁর আপন করুণায় তাঁর রহমতের বৃষ্টি এ জনগণের ওপরে বর্ষণ করবেন। বৎস আমার! তোমার প্রতি আল্লাহর বিশেষ করুণার নমুনা জনগণের সামনে প্রকাশ করো। তারা জানুক যে, তুমি আল্লাহর কাছে কোন মর্যাদার অধিকারী!”
সোমবার দিন সমাগত হলে ইমাম রেযা (আ.) ও জনগণ মরুভূমির দিকে রওয়ানা হলেন। ইমাম একটি উঁচু টিলার ওপরে দাঁড়ালেন এবং আল্লাহর হাম্দ ও স্তুতি পাঠ করার পর তাঁর দরবারে এভাবে প্রার্থনা করলেন : ‘হে আল্লাহ! প্রতিপালক আমার! তুমি আমাদের আহলে বাইতের সম্মানকে উচ্চকিত করেছ এবং এরা আমাদের প্রতি যেমনটা তুমি নির্দেশ দিয়েছ তেমনই তাওয়াসসুল করেছে, এরা সাবই তোমার করুণা ও অনুগ্রহের প্রতি পথ চেয়ে বসে আছে। কাজেই এদেরকে এক উপকারী, সর্বজনীন এবং ক্ষতিমুক্ত বৃষ্টি দ্বারা পরিতৃপ্ত করো। আর এ বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হোক এরা এ ময়দান থেকে নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাবার পর থেকে।’
বর্ণনাকারী বলেন : সেই আল্লাহর কসম, যিনি মুহাম্মাদ (সা.)-কে নবী হিসাবে প্রেরণ করেছেন! আলী ইবনে মূসা আর-রেযা’র প্রার্থনার পর অচিরেই বৃষ্টি বহনকারী মেঘমালা আকাশে ভীড় করলো, বজ্র ও বিদ্যুতের চমকানি আকাশকে এমনভাবে পূর্ণ করে দিল যে, লোকেরা অচিরেই বৃষ্টি নামার ভয়ে ঠাঁই খুঁজছিল। ইমাম রেযা (আ.) বললেন : ‘হে লোকসকল! এসব মেঘ তোমাদের প্রাপ্য নয়। এগুলো অন্য অঞ্চলের জন্য।’ এরূপ ঘটনা দশবার ঘটলো এবং ইমাম রেযা (আ.) বললেন : ‘এ মেঘগুলো অমুক অঞ্চলের জন্য।’ একাদশ বারের সময় ইমাম রেযা (আ.) বললেন : ‘হে লোকসকল! মহান আল্লাহ এ মেঘগুলোই তোমাদের জন্য প্রেরণ করেছেন। কাজেই আল্লাহ প্রতি এ নেয়ামত ও করুণার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো। তোমরা যতক্ষণ নিজ নিজ ঘরে ফিরে না যাবে ততক্ষণ বৃষ্টি বর্ষিত হবে না। সুতরাং তোমরা নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাও। যাতে আল্লাহর রহমত তোমাদের ওপর নাযিল হয়।’
বর্ণনাকারী বলেন : আলী ইবনে মূসা আর-রেযা মিম্বর থেকে নিচে নেমে এলেন এবং গৃহের দিকে রওয়ানা হলেন। লোকজনেরাও তা-ই করলো। যখন লোকেরা তাদের বাড়ি-ঘরে পৌঁছে গেল, মেঘগুলো বৃষ্টি বর্ষণ করতে শুরু করলো এবং গোটা শহর জুড়েই বৃষ্টি হতে লাগলো। জনগণও অতিশয় আবেগাপ্লুত হয়ে ইমাম রেযা (আ.)-এর প্রতি প্রশংসা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে লাগলো। তারা বলছিল : ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সন্তানের ওপরে আল্লাহর এ কারামাত মোবারক হোক!’ ইমাম রেযা (আ.)ও এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে মানুষদেরকে উপদেশ ও নসিহত করলেন। তিনি বললেন : ‘হে লোকসকল! আল্লাহর নেয়ামতসমূহের বিপরীতে তাকওয়া অবলম্বন করো এবং গোনাহের মাধ্যমে এ নেয়ামতকে নিজেদের থেকে দূরে সরিয়ে ফেলো না; বরং আল্লাহর অনুগত এবং নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার মাধ্যমে নিজেদের নেয়ামতের বৃদ্ধি ঘটাও। জেনে রাখ যে, আল্লাহর প্রতি ঈমানের পরে এবং আল্লাহর আউলিয়া কেরাম ও তাঁর মহান নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের অধিকার সম্পর্কে মারেফাত অর্জনের পরে কোন কাজই তোমাদের মুমীনদের মধ্যে দুনিয়াবি কাজে পরস্পর ভাইয়ে ভাইয়ে সহযোগিতা করার চেয়ে শ্রেয়তর নয়। এটা হলো তাদের সেই অতিক্রমস্থল যেখান দিয়ে তারা বেহেশত অভিমুখে অগ্রসর হয়। যারা এরূপ কাজে উদ্যোগী হয় তারা আল্লাহর দরবারে বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়।’
অতঃপর ইমাম রেযা (আ.) একটি আশ্চর্যজনক ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন : ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে খবর দেয়া হলো যে, অমুক সাহাবী ধ্বংস হয়েছে। কারণ, সে অমুক গোনাহর কাজ করে।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : ‘বরং সে নাজাত পেয়েছে এবং আল্লাহ তার পরিণতি শুভ করেছেন, তার সমস্ত গোনাহ মুছে দিয়েছেন এবং তদস্থলে তার পুণ্যের কাজগুলো লিখে দিয়েছেন।’
ঘটনাটি হলো : একদিন সে একটি পথ দিয়ে যাচ্ছিল। এসময়ে এমন একজন মুমীনের সাথে দেখা হলো যার লজ্জাস্থান উন্মুক্ত ছিল। সে লোকটি এমনভাবে তার লজ্জাস্থান ঢেকে দিল যেন ওই মুমীন ব্যক্তিটি বুঝতে না পারে এবং লজ্জায় না পড়ে। কিন্তু পরে ওই মুমীন ব্যক্তি ঘটনা এবং লোকটির নিয়্যত বুঝতে পারলো এবং তার জন্য এরূপে দোয়া করলো : ‘আল্লাহ তোমাকে সর্বোত্তম পুরস্কার দান করুন এবং তোমার হিসাব সহজ ও অনায়াস করে দিন।’
রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন : ‘ওই মুমীন বক্তির দোয়ার কারণে এ লোকটির পরিণাম শুভ হলো।’
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এ কথা ঐ লোকটির কানে পৌঁছল এবং এ কথার বরকতেই সে তার পাপ কাজ থেকে তওবা করলো এবং পুনরায় সে ওই কাজে লিপ্ত হয়নি। আল্লাহও তার তওবা কবুল করলেন। অবশেষে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
ইমাম রেযা (আ.) এ কথাগুলো বললেন এবং প্রস্থান করলেন।
বর্ণনাকারী বলেন : আল্লাহ রেযা (আ.)-এর দোয়াক্রমে দেশে দেশে অশেষ বরকত দান করেছেন।১
এ কারামত ইমাম রেযা (আ.)-এর মহান ব্যক্তিত্বের অংশবিশেষ তুলে ধরে এবং তাঁর ইমামতের জ্ঞানের একটি নমুনা উপস্থাপন করে। আর তার চেয়েও বড় কথা হলো তিনি জনগণের অন্তরসমূহকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র বাণীর প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হলেন।
অনুবাদ : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
১. ফারায়িদুস সামত্বাঈন ফি ফাযায়িলিল মুরতাযা ওয়াল বাতুলি ওয়াস সিবত্বাঈনী ওয়াল আয়িম্মাতি মিন যুররিয়াতিহিম (আ.), খ. ২, পৃ. ২১২-২১৪, হাদীস নং- ৪৯০, তারিখে নিশাবুর থেকে বর্ণিত;