বিশ্ব সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান
পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ৩, ২০২১
নাজমুল হাসান: মানুষ যখনই লিপির সঙ্গে পরিচিত হয়, নিজেদের হাতে কলম ধরে, নিজেদের চিন্তাগুলোকে লেখায় রূপান্তর করে এবং নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকে এসব বিষয়ে শিক্ষাদান করে তখনই সভ্যতার বিকাশ ঘটে। পরবর্তী সময়ে সভ্যতার ধারণা মানুষের জীবনে বহুমুখী উন্নতি সাধনের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়। সভ্যতা হলো মানব সমাজের বস্তুবাদী ও ভাববাদী উন্নয়নের এক বিশেষ রূপ, যা পরিবর্তনশীল সমাজ, ধর্মীয় বিষয়াদি, নৈতিকতা, সৌন্দর্যতত্ত্ব ও শিল্প, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্কলন, যা এক বা একাধিক সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করে।
ইসলামের বহিঃপ্রকাশের পর এই পৃথিবীতে একটি নতুন এবং বিস্ময়কর সভ্যতা বিকাশ লাভ করে। ইসলাম শুধু ধর্ম প্রচারেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং ইসলাম এবং মুসলমানদের বিশ্ব সভ্যতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান অতুলনীয়। ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে লক্ষ করা যায়, হজরত ঈসার (আ.) জন্মের কয়েক শতাব্দী আগেই বিশে^ সভ্যতার পত্তন হয়। এ সময়ে থেলস, ডেমোক্রিটাস, হিপোক্রিটাস, অ্যারিস্টোটল প্রমুখ কালজয়ী প্রতিভার মাধ্যমে গ্রিসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বিকশিত হয়। কিন্তু খ্রিস্টীয় সাল গণনা শুরুর আগেই সভ্যতার পতন ঘটে। এরপর প্রায় পাঁচ-ছয়শ বছর ধরে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এক অন্ধকার যুগ পরিলক্ষিত হয়। ইসলামী সভ্যতা বিকাশের পর মধ্যযুগে মুসলমানদের মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে নবযুগের সূচনা হয়।
ইসলামী সভ্যতা প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ
প্রায় ৬১০ খ্রিস্টাব্দের দিকে হজরত মোহাম্মদের (সা.) ইসলামের দাওয়াতের মাধ্যমে মক্কায় ইসলামী সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়। ‘ইলম’ বা জ্ঞান শব্দটা কোরআন কারিমে বিভিন্ন স্থানে প্রায় আশিবার ব্যবহৃত হয়েছে এবং ‘আকল’ বা বুদ্ধি শব্দটা কোরআনে সরাসরি না এলেও ‘উলিলআলবাব’ শব্দ দ্বারা কোরআনে বুদ্ধিমানদের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এভাবে ‘হেকমাত’, ‘বুরহান’, ‘ফিকর’ এবং ‘ফিকহ’ শব্দগুলো, যা জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত- কোরআনে বহুবার এসেছে। রাসুলের (সা.) হাদিসে জ্ঞান, জ্ঞানের ফজিলত এবং ওলামা বা জ্ঞানী সম্পর্কে বহু বিবরণ দৃষ্টিগোচর হয়। রাসুলের (সা.) হাদিসে প্রতিটি নর-নারীর ওপর জ্ঞানার্জন ফরজ এবং ঘণ্টাখানেক চিন্তায় মশগুল থাকা এক বছরের ইবাদত থেকেও উত্তম- এ বিষয়গুলোর ওপর তাগিদ প্রদান থেকে বোঝা যায়, ইসলামে জ্ঞান অর্জনের প্রতি কতটা গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইসলামের স্বর্ণযুগ বা জ্ঞান বিস্তারের যুগ অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বিশেষ করে চতুর্থ ও পঞ্চম হিজরি শতাব্দীতে খলিফাদের সাম্রাজ্য বৃদ্ধি পায় এবং শিক্ষা, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। ইসলামের এই যুগগুলোয় কবি, লেখক, দার্শনিক, হস্তশিল্পী, গবেষক, ভূগোলবিদ, রসায়নবিদ, পদার্থবিদ, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য শিল্পগুণের অধিকারী ব্যক্তিদের উত্থান ঘটে এবং সে সময় সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য, অর্থনীতি, ভূগোল, আইন, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, রসায়ন, পদার্থ, চিকিৎসা ও জীববিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়।
সাহিত্যে অবদান
কোরআন মাজিদ বিশ্ব সভ্যতায় সাহিত্যের সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা। কোরআনের অলঙ্কার এই পৃথিবীতে বিরল এবং বিশ্ব সাহিত্যে কোরআনের অবস্থান সবচেয়ে উঁচুতে। রাসুলের (সা.) হাদিসগুলো আরবি সাহিত্যে ধনভাণ্ডারের মতো। রাসুলের (সা.) হাদিসের ওপর ভিত্তি করে সাহিত্যের অন্যান্য শাখা সমৃদ্ধি লাভ করেছে। ইসলামের খলিফা হজরত আলীর (রা.) কাছ থেকে দুটি বিখ্যাত সাহিত্য এখনও পৃথিবীতে সমাদৃতÑ ‘নাহজুল বালাগা’ ও ‘দিওয়ানে আলী’। খলিফা মনসুরের সাহিত্যে বিশেষ ঝোঁক ছিল এবং তার চেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষকতায় আরবি কবিতার সঙ্কলনের কাজ করা হয়। খলিফা হারুন-উর-রশীদ নিজেই একজন কবি ছিলেন এবং তার সময় ও শাসনামলে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা’ রচিত হয়।
ফারসি সাহিত্যকে পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত সাহিত্য হিসেবে গণ্য করা হয়। ফারসি সাহিত্য মুসলমানদের মাধ্যমেই সমৃদ্ধ হয়েছে। ইরানে ইসলামের প্রবেশ ফারসি সাহিত্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ইরানে ইসলামের প্রবেশের শুরুর দিকে (সপ্তম খ্রিস্টাব্দ-একাদশ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত প্রাচীন ইরানের বিখ্যাত জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য ও ইতিহাসের বইগুলো আরবি ভাষায় অনূদিত হয়। কিন্তু সাফফারিয়ান যুগে ‘ফারসি দারি’ ভাষার প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়। ফলে এ ভাষা সরকারি এবং সাহিত্যের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই যুগের কবিতার নিদর্শন থেকে ইয়াকুব লাইস সাফফারের প্রশংসায় মুহাম্মাদ ইবনে ওসিফ কর্তৃক রচিত একটা কাসিদার সন্ধান পাওয়া যায়। গবেষকরা এই কাসিদাকে প্রথম ফারসি কবিতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফারসি সাহিত্যের নিদর্শনগুলো- ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’, রুমির ‘মসনভি’, সাদির ‘গুলিস্তাঁ’ ও ‘বুস্তাঁ, খৈয়ামের ‘রুবাঈ’, হাফিযের ‘দিওয়ান’, আত্তারের ‘মানতেকুত তায়ের’, নেজামির ‘খসরু ও শিরীন’, জামির ‘বাহারিস্তান’ আজও পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত।
ইতিহাসে অবদান
ইতিহাস বিশ্বসভ্যতার একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ইতিহাস হলো অতীতের দর্পণ। ইসলামী সভ্যতা বিকাশ লাভের পর মুসলমানরা ইতিহাস পাঠ, অধ্যয়ন, সঙ্কলন ও লিপিবদ্ধকরণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। হজরত মোহাম্মদের (সা.) জীবনী এবং হাদিস সঙ্কলনের আগ্রহ থেকে মুসলমানদের মধ্যে ইতিহাস বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন মাজিদও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। কোরআনে নবী-রাসুলদের বহু জীবনী উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে মহাগ্রন্থ আল-কোরআনও মুসলমানদের ইতিহাস সঙ্কলনে অনুপ্রেরণা জোগায়।
দর্শনে অবদান
দর্শন শব্দটি মূলত গ্রিক ভাষার ‘ফিলোসোফিয়া’ শব্দ থেকে আগত। দর্শন জ্ঞানের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ শাখা। দর্শনের ধারণা চেতনা ও শিক্ষা সভ্যতা বিনির্মাণে অনন্য অবদান রেখেছে। দর্শন শাস্ত্রের বিস্তৃত মাঠজুড়ে মুসলমানদের সমৃদ্ধ ফসলের চাষবাস। কোরআন এবং হাদিস হলো মুসলিম দর্শনের মূল ভিত্তি।
ইসলামের মূল ভিত্তিই হলো কোরআন ও হাদিস। সুতরাং এটাই স্বাভাবিক, মুসলমানদের জীবনপথের সবকিছুই কোরআন ও হাদিস থেকে উদ্ভূত হবে। কোরআন ও হাদিস যে মুসলিম দর্শনের মূল উৎস, এটা কোনো তত্ত্বকথা নয়। এটা ব্যবহারিক সত্যও বটে। কোরআন ও হাদিসের ওপর ভিত্তি করে মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন দর্শন বিকাশ লাভ করেছে।