বিশ্বের অনন্য এক প্রাকৃতিক নিদর্শন হামেদানের আলিসাদ্র গুহা
পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ১২, ২০১৭
![news-image](https://www.iranmirrorbd.com/wp-content/uploads/2017/10/irph7_10_.jpg)
পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য সুন্দর ও ব্যতিক্রম নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। নানা সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্মারক হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে এই নিদর্শনগুলো। আর যখনই পৃথিবীর বিস্ময়কর প্রাচীন স্থান ও নিদর্শনগুলোর কথা বলা হয় তখনই সবার আগে যে নামটি উচ্চরিত হয় তা হলো ইরানের হামেদানের বিস্ময়কর প্রাকৃতিক গুহা ‘গা’রে আলিসাদ্র’এর নাম। কেননা, এ ধরনের নিদর্শন সমগ্র পৃথিবীতেই বিরল।
হামেদান শহর থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে একটি পাহাড়ের নিচে এই গুহাটি অবস্থিত। ওই এলাকার স্থানীয় লোকজন গুহাটির নাম দিয়েছে আলিসাদ্র। গুহাটির ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্য হলো এর ভেতরে অসংখ্য লেক বা নালা পরস্পর সংযুক্ত হয়ে আছে। লেকগুলো আঁকাবাঁকা। তবে লেকের পানি খুবই স্বচছ। স্বচ্ছতার কারণে পাঁচ মিটার গভীর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। পানির স্বাদ সাধারণ মিষ্টি পানির মতোই। এর মধ্যে যে পানি তার গভীরতা হলো আট মিটার। গুহার উচ্চতা কোথাও কোথাও প্রায় চল্লিশ মিটার।
তবে পানির এই গভীরতা সবসময় সমান থাকে না, মাঝেমধ্যে উঠানামা করে। পঞ্চাশ থেকে একশ’ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়ে কমে। সাত কোটি বছরের প্রাচীন এই গুহাটি ১৯৬৩ সালে প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত হয়েছে। হামেদানের পর্বতবাসী বা পর্বতারোহীরা এই রহস্যময় গুহাটি আবিষ্কার করেন। পাহাড়ের নিচের এই জলগুহাটির এ পর্যন্ত চব্বিশ কিলোমিটার আবিষ্কৃত হয়েছে। কৌতুহলী দর্শকরা পায়ে হেঁটে কিংবা নৌকা বেয়ে গুহার ভেতরের এই লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। তবে খনন কাজ এখনো চলছে।
আলিসাদ্র গুহাটি ‘সরি কিয়েহ’ (হলুদ প্রস্তর) পাহাড়ের নিচে অবস্থিত। পাহাড়টি খুব বেশি উঁচু নয়। আলিসাদ্র গ্রামের দক্ষিণ অংশে পাহাড়টির অবস্থান। এই পাহাড়ে আরও দুটি গুহা আছে। একটির নাম ‘সারব’, অপরটির নাম ‘সুবাশি’। আলিসাদ্র গুহা থেকে সাত এবং এগারো কিলোমিটার দূরে এই গুহাগুলোর অবস্থান। আলিসাদ্র গুহাটি সাফাভি শাসনামলে আবিষ্কৃত হয়। ১৯৬২ সালে হামেদানের পর্বতারোহীরা এই গুহায় প্রয়োজনীয় আলোর ব্যবস্থা করে পর্যটকদের পরিদর্শনের উপযোগী করে তোলে। ধীরে ধীরে এই গুহা ইরানের অন্যতম প্রাকৃতিক ট্যুরিস্ট স্পটে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি আলিসাদ্র গুহার ভেতরে খনন কাজ চালিয়ে বেশকিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এসব নিদর্শন হিজরি চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর বলে অনুমান করা হচ্ছে। প্রাপ্ত জিনিসপত্র থেকে প্রমাণিত হয় যে, সেলজুক শাসনামলে এই গুহার ভেতর মানুষ বাস করত। প্রাপ্ত জিনিসপত্রগুলো হলো বড়ো কলস, প্রদীপ জ্বালাবার জন্যে ব্যবহৃত পিলসূজ, এনামেল বা ধাতব এবং মাটির তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র। ফারসি ১৩৭৩ সাল অর্থাৎ ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক বিস্ময়কর এই আলীসাদ্র গুহার উপর গবেষণা চালাবার জন্যে আসেন। তাদের মধ্যে একজন বিশেষজ্ঞ এই গুহাটির বৈশিষ্ট্যগত স্বাতন্ত্র্যে চমৎকৃত হয়ে বলেছেন, আলিসাদ্র গুহাটি বিশ্বের অন্যান্য গুহার তুলনায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী এবং নিশ্চিতভাবে এই গুহাটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ পানিগুহা।
আলিসাদ্র গুহার ভেতরের অসাধারণ দৃশ্যাবলি, এর ভেতরের চমৎকার আবহাওয়া, সুনসান নীরবতা এত বেশি চিত্তাকর্ষক যে, যে-কোনো পর্যটককেই আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে হামেদানের এই গুহাটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। হাজার হাজার দর্শক প্রতি বছর এই গুহা দর্শনে হামেদান সফরে আসেন। পরিদর্শনকারীদের একটা বিরাট অংশই বিদেশি। বিশ্বের পর্যটকগণ ধীরে ধীরে রহস্যময় এই পানিগুহার সাথে পরিচিত হচ্ছেন।
আলিসাদ্র গুহাটির ভেতরে আপনি যদি বেড়াতে যান, বিস্মিত হয়ে যাবেন। এত সুন্দর করে, এত শৈল্পিকভাবে গুহাটি সুসজ্জিত যে, যেদিকেই তাকাবেন শুধু বিস্ময় আর বিস্ময় আপনাকে কর্মচঞ্চল এই পৃথিবী থেকে নতুন এক পৃথিবীতে নিয়ে যাবে। গুহার মাঝখানে আধা ঘণ্টা নৌকায় বেড়াবার পর আপনি ইচ্ছে করলে নেমে গিয়ে পায়ে হেঁটে উপরের দিকে উঠে যেতে পারেন। আনুমানিক পাঁচশ’ সিঁড়ি উপরে গেলে আপনি ইচ্ছে করলে অন্য রুটে গুহামুখের দিকে ফিরে হেঁটে আসতে পারেন। হেঁটে আসতে গেলে আনুমানিক আধ ঘণ্টা সময় লেগে যেতে পারে। এসময় আপনার কাছে মনে হবে আপনি যেন পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। সে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি।
স্থানীয় দর্শনার্থী এবং বিদেশি পর্যটকরা এই গুহা পরিদর্শন শুরু করেন ১৯৭৫ সালে। ১৯৯১ সালে আলিসাদ্র ট্যুরিজম কোম্পানি পুরো এলাকার উন্নয়ন কাজ শুরু করে। বর্তমানে সেখানে হোটেল, অতিথিশালা, কাঠনির্মিত ভিলা এবং তাঁবু টাটানোর মতো প্রশস্ত জায়গা প্রচুর এবং সহজলভ্য। এছাড়াও আছে বিনোদনের জন্যে সিনেমা-থিয়েটার ও খেলার মাঠ। খাওয়া-দাওয়ার জন্যে আছে রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থা। সবমিলিয়ে আলিসাদ্র গুহা মনোরম একটি অবকাশ যাপন কেন্দ্র হিসেবেও বিখ্যাত। এ ধরনের গুহা পৃথিবীতে বিরল। আমেরিকায় একটি গুহা আছে, কিন্তু সেটির নিচে পানি নেই। আরেকটি আছে ইন্দোনেশিয়ায়। তবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পানিগুহা হিসেবে এই আলিসাদ্রের খ্যাতি আজও অম্লান। সূত্র: পার্সটুডে, আইআরআইবি নিউজ ।