বাংলাদেশে ফারসির খেদমতে ড. কুলসুম আবুল বাশার মজুমদার
পোস্ট হয়েছে: এপ্রিল ৯, ২০২৪

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়েই ফার্সী ও উর্দু বিভাগ তার যাত্রা শুরু করে। নানারকম চড়াই-উৎরাই ও উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আজকের এপর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা,অতঃপর পাকিস্তান আমল অর্থাৎ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের আগ পর্যন্ত ফারসি বিভাগ তেমন একটা দ্যূতি ছড়াতে পারেনি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যার হাত ধরে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ নবউদ্যম ও মাত্রা পেয়েছে তিনি হলেন ড. কুলসুম আবুল বাশার মজুমদার। যাকে ‘মাদারে ফারসিয়ে বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশে ফারসি মাতা বা জননী) হিসেবে অভিহিত করা হয়। বহুভাষী কুলসুম আবুল বাশারের জন্ম,বেড়ে ওঠা, শৈশব কৈশোর,শিক্ষা-দীক্ষা সব ভারতের মুম্বাইয়ে হলেও তাঁর পূর্বপুরুষের নিবাস ছিলো নোয়াখালী জেলায়। তিনি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ফেব্রুয়ারি বোম্বেতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল তদানিন্তন পূর্ব-বাংলার নোয়াখালী জেলার চাটখিলে। বোম্বে থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক,উচ্চ মাধ্যমিক ও বি.এ অনার্স সমাপ্ত করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সী ও উর্দু বিভাগ হতে ১৯৭১ ও ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে উর্দু এবং ফারসি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২রা জুলাই ফার্সী ও উর্দু বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের বৃত্তি নিয়ে মাশহাদের ‘ফেরদৌসী বিশ্ববিদ্যালয়ে’ ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য ইরান গমন করেন। তখন শাহ বিরোধী আন্দোলনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ড.আন্দালিব শাদানি,হায়াত আওর কারনামা'(ড.আন্দালিব শাদানি ও তাঁর সাহিত্যকর্ম)শিরোনামে উর্দু ভাষায় অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। অভিসন্দর্ভটি ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
বর্তমানে ঢাকা,রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এবং ঢাকা ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের যারা ফারসি ভাষা কোর্সের শিক্ষক ও পাঠদান করে থাকেন তাদের প্রায় সবাই কুলসুম আবুল বাশার মজুমদারের সরাসরি শিক্ষার্থী। একারণেই বাংলাদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর নাম ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের খণ্ডকালীন শিক্ষক ও ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র পরিচালিত ফারসি ভাষা শিক্ষা কোর্সের শিক্ষক হিসেবেও তিনি ফারসি ভাষা পাঠদান করেছেন। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের হিন্দি ভাষা বিভাগের খণ্ডকালীন হিন্দি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জুন তিনি অবসর গ্রহণ করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি অনুবাদ ও লেখালেখিতেও ছিলেন সমান পারদর্শী। বহুভাষী কুলসুম আবুল বাশার মজুমদারের ফারসি,উর্দু,বাংলা ও ইংরেজি ভাষা মিলিয়ে প্রকাশিত মোট প্রবন্ধের সংখ্যা ৩৫ । তন্মধ্যে ফারসিতে ১৭ টি,উর্দুতে ১৩,বাংলাতে ২টি ও ইংরেজিতে ৩টি।
তাঁর রচিত গ্রন্থাবলি : ফারসিয়ে জাদিদ বারায়ে দানেশ আমুজানে দাওরেয়ে মোকাদ্দামাতি,গোলশানে ফারসি,আসান উর্দু,সালাসাসায়ে গাসসালে-বাহরে ফারসি,গোযিদেয়ে আহভাল ভা অ’সা’রে কাজী নজরুল ইসলাম -শায়েরে মিল্লিয়ে বাঙ্গালাদেশ, ড.আন্দালিব শাদানি,হায়াত আওর কারনামে,ফার্সী-বাংলা-ইংরেজী অভিধান,যাবান ভা আদাবিয়াতে ফারসি দার বাঙ্গালাদেশ,বাংলাদেশ মেঁ উর্দু আদব এবং ড.আন্দালিব শাদানী’র অপ্রকাশিত ডায়েরী।
অনুবাদ গ্রন্থসমূহ : ফিলিস্তিন, চড়ুই পাখি ও মস্ত হাতী,অ’মূযেশে যাবানে ফারসি(অযফা)।
এছাড়াও ড. কুলসুম আবুল বাশার মজুমদার দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সে ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ ও প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
২০২৩ সালের ২৮ জুন এই মহান শিক্ষক পরলোকগমন করেন। দেশে ও দেশের বাহিরে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষার্থী,শিক্ষক,লেখক, গবেষক ও সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে বাংলাদেশে তাঁর ফারসির খেদমতের বিষয় ও অবদান তুলে ধরার জন্য তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় তাঁর শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবুল কালাম সরকার, কুলসুম আবুল বাশার মজুমদারের বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম নিয়ে ফারসিতে রচনা করেন তাঁর জীবনীগ্রন্থ ‘আরজ নামেয়ে উস্তাদ কুলসুম আবুল বাশার ‘ গ্রন্থ। পরবর্তীতে কুলসুম আবুল বাশার মজুমদার ও তাঁর পরিবারের সদ্যস্যদের অনুরোধে বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য বাংলাতে ‘বাংলাদেশে ফারসির আলোকবর্তিকা’ শিরোনামে জীবনীগ্রন্থটি প্রকাশ করেন। গ্রন্থটিতে ড.কুলসুম আবুল বাশার মজুমদারের জীবন ও কর্মের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা চিত্রের মতো উপস্থাপন করা হয়েছে।
সুজন পারভেজ
শিক্ষার্থী, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।