শুক্রবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

বসন্তের হাত ধরে আসে ইরানি নওরোজ, প্রাণের দোলা পহেলা বৈশাখ

পোস্ট হয়েছে: জুন ৩, ২০২০ 

সিরাজুল ইসলাম –

ইরানি ‘নওরোজ’ সারা বিশ্বের এক অনন্য সংস্কৃতির ধারা। বসন্তের হাত ধরে পত্র-পল্লবিত ফুলশোভিত হয়ে আসে এ নওরোজ। নব আনন্দের এক দিগন্তজোড়া বার্তা ছড়িয়ে দেয় বিশ্বের দিকে দিকে। ঈদের খুশি নিয়ে আসে নওরোজ। আসলে ইরানিদের কাছে নওরোজ মানেই ঈদ। নওরোজ শুরুর দু’চারদিন আগে থেকেই ইরানিরা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেনÑ ‘ঈদে শোমা মুবারাকে’ যা আমাদের বাংলা অঞ্চলে ঈদ মুবারক বলে পরিচিত। কালের পরিক্রমায় নওরোজ এখন বিশ্ব ঐত্যিহের অংশ। নওরোজ একটি ফারসি শব্দÑ যার অর্থ হলো নতুন দিন। জনপ্রিয় এ সাংস্কৃতিক উৎসব আজ শুধু ইরানের জাতীয় উৎসব নয়, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, আযারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক ও ইরাকেও এ উৎসব জাতীয় পর্যায়ে উদ্যাপিত হয়। নওরোজের উৎসব কম-বেশি পালিত হয় জর্জিয়া, পাকিস্তান ও ভারতেও। সাধারণত ২০ বা ২১ মার্চ ফারসি নববর্ষ শুরু হয়। এই সময় শুরু হয় ইরানে বসন্তকাল। বসন্তকেই আলিঙ্গন করে আসে ইরানি নওরোজ।
নওরোজ বিশ্বের প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম। প্রাচীন ইরান বিস্তৃত ছিল মধ্য এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর-আফ্রিকার এক বিশাল অঞ্চলজুড়ে। তাই এইসব অঞ্চলের অন্যতম প্রধান উৎসব হলো এই নওরোজ। নওরোজ উৎসবকে আন্তর্জাতিক উৎসব যে বলা যায় তা তো ইউনেস্কোর স্বীকৃতি থেকেই পরিষ্কার।
নওরোজ উৎসবের কোনো কোনো প্রথা সেই সুদূর প্রাচীনকাল থেকে এখনো প্রচলিত। এইসব প্রথা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয় নতুনত্ব ও বসন্তের আমেজ। নওরোজ-কেন্দ্রিক একটি প্রাচীন প্রথার নাম হলো ‘খনে তেক্কনি’ বা ঘর নাড়া দেয়া। এই পর্বটির উদ্দেশ্য হলো ঘর ও ঘরের আসবাবপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। বছরের শেষের দিকে ইরানে রাস্তাঘাটের মতো সর্বসাধারণের ব্যবহৃত স্থানগুলোও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার ধুম পড়ে যায়। বিত্তবানরা ঘরের পুরনো সব আসবাবপত্র, পর্দা, পোশাক ইত্যাদি ফেলে দিয়ে বা বিক্রি করে দিয়ে ঘর-বাড়িকে আবার নতুন করে সাজান। ঈদ বা নওরোজের অনেকে আগেই পুরোনো আসবাবপত্র বা জরাজীর্ণ জিনিস ফেলে দিয়ে তাঁরা নতুন জিনিস কেনেন। নতুন জামা-কাপড়,
জুতা প্রভৃতি কেনার হিড়িক পড়ে যায়। নওরোজের মেহমানদারির জন্য তাঁরা প্রচুর পরিমাণ ফল, মিষ্টি ও অন্যান্য খাদ্য-সামগ্রী কিনে থাকেন। এ সময় স্থায়ী বাজার ছাড়াও অনেক অস্থায়ী বাজার বা মেলার আসর জমজমাট হয়ে ওঠে।
নওরোজ উৎসবের প্রাক্কালে কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। সাধারণত এ সময় বেশি বেশি কেনা হয় পোশাক, আজিল নামে পরিচিত শুকনো কিসমিসসহ নানা ধরনের ফল ও বুট-বাদামের মিশ্রণ, তাজা ফল, মিষ্টি ও ঘরবাড়ির কোনো কোনো সামগ্রী ইত্যাদি। নতুন বছরে সবাই নতুন পোশাক পরতে আগ্রহী। এছাড়াও তাঁরা মেহমানকে আপ্যায়নের জন্য সবচেয়ে ভালো খাবার কিনতে চান। ফলে ব্যবসায়ীদের জন্যও এই সময়টা খুব ভালো কাটে।
ইরানিরা নওরোজের সময় ঘরের মধ্যে ৭টি আইটেম সাজিয়ে রাখেন। এই সাতটি আইটেমকে বলা হয় ‘হাফ্্ত সিন’। হাফত সিন অর্থ সাতটি সিন। ওই সাতটি জিনিসের নামের প্রথম অক্ষর ফারসি বা আরবি বর্ণমালার ‘সিন’ অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়ায় সেগুলোকে এ নাম দেয়া হয়েছে। এ ৭টি সামগ্রী হলো, ‘সাবজে’ বা গম বা ডালের সবুজ চারা, ‘সামানু’ বা গমের অঙ্কুর দিয়ে তৈরি করা খাবার, ‘সিব’ বা আপেল, ‘সেনজেদ’ নামের একটি বিশেষ ফল, ‘সোমাক্ব’ নামক বিশেষ মশলা, ‘সির’ বা রসুন এবং ‘সের্কে’ বা সিরকা। এসব সামগ্রী হলো নব-জীবন, প্রবৃদ্ধি, ফলবান হওয়া, প্রাচুর্য, সৌন্দর্য, সুস্থতা, ভালোবাসা, আনন্দ ও ধৈর্য প্রভৃতির প্রতীক। এছাড়া, নওরোজের দস্তরখানে ডিম, ফুল, আয়না, পানি, লাল রংয়ের ছোট মাছ ও ধাতব মুদ্রা রাখা হয়। এসবেরই রয়েছে বিশেষ অর্থ। ফুল ও সবুজ কিশলয় আনন্দ ও নব-জীবনের প্রতীক। প্রকৃতিতে নব-জাগরণের বার্তা নিয়ে আসে বসন্ত। চারদিকে ফুলের সমারোহ এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, কেবল প্রকৃতি নয়, মানুষের মনও হওয়া উচিত ফুলের মতো সুরভিত ও সুন্দর।
নওরোজ উপলক্ষে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় ঈদের আনন্দকে ভাগ করে নেয়ার জন্য অনেক ইরানি বিশেষ ত্রাণ-তহবিলে অর্থ বা নানা জিনিস-পত্র দান করে থাকেন। এসব অর্থ বা জিনিসপত্র গরীব, এতিম ও অভাবগ্রস্তদের দান করা হয়। ফলে নওরোজ হয়ে ওঠে গণমুখী, সবার উৎসব। এ যেন এক আধ্যাত্মিক উৎসব, মানবীয় উৎসব তো বটেই।
ঠিক কবে এবং কে প্রথম নওরোজ উৎসব চালু করেছিলেন তা ¯পষ্ট নয়। কবি ফেরদৌসির অমর কাব্য ‘শাহনামা’ ও ঐতিহাসিক তাবারির বর্ণনা অনুযায়ী ইরানের প্রাচীন কিংবদন্তিতে উল্লিখিত বাদশাহ জামশিদ ছিলেন এ উৎসবের প্রথম আয়োজক। কেউ কেউ বলেন, ইরানের হাখামানেশী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট দ্বিতীয় সাইরাস বা কুরুশ বাবেল বা ব্যাবিলন জয়ের বছর তথা খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে সর্বপ্রথম নওরোজকে জাতীয় উৎসব হিসেবে ঘোষণা ও পালন করেন। পারস্য সম্রাট প্রথম দারিউশের শাসনামলে এ উৎসব পার্সেপোলিস প্রাসাদ কমপ্লেক্স বা তাখ্তে জামশিদে অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা এ উৎসবে উপস্থিত হয়ে ইরানি সম্রাটকে নানা উপহার সামগ্রী দিতেন।
প্রথম দারিউশ নওরোজ উপলক্ষে খ্রিস্টপূর্ব ৪১৬ সনে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। আশকানি ও সাসানি সম্রাটদের যুগেও নওরোজ উৎসব পালিত হতো। সাসানি শাসনামলে নওরোজের প্রথম ৫ দিন ছোট নওরোজ হিসেবে অভিহিত হতো। এ সময় সাধারণ জনগণ বা প্রজারা সম্রাটের সাথে দেখা করতো এবং সম্রাট তাদের কথা শুনতেন। কিন্তু ষষ্ঠ দিনকে বলা হতো বড় নওরোজ। এ দিনে কেবল সম্রাটের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করত এবং বিশেষ উৎসব পালিত হতো। খ্রিস্টিয় ২৩০ সালে সাসানি সম্রাট আর্দেশিরের সঙ্গে যুদ্ধে রোমান সেনারা পরাজিত হয়। আর্দেশির বিজিত অঞ্চলেও নওরোজ পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সাসানি যুগেই নওরোজ উৎসবের অনুষ্ঠানমালা ও পর্বগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি বিস্তৃত হয়েছিল।
ইসলামের আবির্ভাবের পর ইরানে নওরোজ উৎসবের রীতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। ইসলামি আচার-অনুষ্ঠান যুক্ত হয় এ উৎসবের সাথে। মুসলমানরা বসন্ত ঋতুতে গাছপালার পুনরায় সবুজ হওয়াকে পারলৌকিক জীবনের প্রমাণ বলে মনে করেন। বিশেষ দোয়া পাঠের মধ্য দিয়ে ইরানি মুসলমানরা নওরোজ বা নববর্ষ শুরু করেন। মুনাজাতে তাঁরা বলেন, ‘হে অন্তর ও দৃষ্টির পরিবর্তনকারী এবং দিন ও রাতের পরিচালনাকারী এবং অবস্থার পরিবর্তনকারী (মহান আল্লাহ)! আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় রূপান্তরিত করুন।’ নওরোজের প্রথম সেকেন্ডেই সবাই এ দোয়া পাঠ করেন। এ সময় তাঁদের সামনে টেবিলে বা দস্তরখানে থাকে পবিত্র কোরআন, তসবিহ এবং ‘হাফ্্ত সিন’ নামে খ্যাত সাতটি বিশেষ সামগ্রীসহ আরো কিছু সামগ্রী।
ইরানিরা নওরোজের দিন মা-বাবাসহ নিকটাত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় বেশ কয়েকদিন ছুটি থাকে এবং ইরানিরা দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সফর করেন; কেউ কেউ বিদেশেও যান। অনেক ইরানি নওরোজের প্রথম প্রহর বা প্রথম দিনটি পবিত্র কোনো স্থানে কাটাতে পছন্দ করেন। যেমন, অনেকেই পবিত্র মাশহাদ শহরে বিশ্বনবী হযরত মুমহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাজার জিয়ারত করেন। অনেকে এ উপলক্ষে পবিত্র কোম শহরে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর বোন হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর মাজারে, কিংবা শিরাজ শহরে অবস্থিত তাঁর ভাই হযরত শাহ চেরাগ (র.)-এর মাজারে যান, কেউবা ইরাকে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মাজারে বা আহলে বাইতের অন্য কোনো সদস্যের মাজারে নববর্ষ শুরু করেন। ইমামদের পরিবারের অন্য সদস্যদের মাজারেও এ সময় ভীড় দেখা যায়। তেহরানের আধিবাসীদের অনেকেই ভীড় জমান দক্ষিণ তেহরানে অবস্থিত হযরত শাহ আবদুল আজিম (র.) কিংবা শহরের অন্যান্য অঞ্চলে অবস্থিত কয়েকটি মাজারে। নওরোজের দিন অনেকেই একে-অপরকে উপহার বা বখশিশ দিয়ে থাকেন। ছোট শিশুরা বড়দের কাছ থেকে বখশিশ পেয়ে খুব খুশি হয়।
ফারসি প্রথম মাস বা ফারভারদিন মাসের এক তারিখ থেকে শুরু হয় নওরোজ উৎসব এবং শেষ হয় ১৩ তারিখে। ১৩ তারিখে ইরানিরা কেউই ঘরে থাকেন না। তাঁরা সেদিন ঘরের বাইরে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও মনোরম প্রাকৃতিক ¯পটে সময় কাটান। বিশেষ করে উদ্যান, ঝরনা, পাহাড়, পার্কÑ এসব স্থানে তাঁরা চাদর বিছিয়ে বা তাঁবু খাটিয়ে খোশ-গল্প করে এবং মজাদার খাবার খেয়ে সময় কাটান।
যেকোনো ঈদ বা উৎসব মানবীয় আনন্দের অপার উৎস। মানুষ আনন্দ-উৎসব ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। তবে আল্লাহর স্মরণই মানুষকে জোগায় সবচেয়ে বড় প্রশান্তি এবং অপার মানসিক সুখ। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) বলেছেন, যে দিনটিতে মানুষ কোনো পাপ করে না, সে দিনটিই তার জন্য ঈদ বা উৎসবের দিন।

বাংলা নববর্ষ
ইরানি নওরোজের মতো বাংলাদেশেও অত্যন্ত আড়ম্বরের সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করা হয়। যদিও ইরানি নববর্ষের মতো দীর্ঘ সময় জুড়ে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করা হয় না তবে একদিনের আনন্দ-উৎসব কিন্তু কোনো অংশেই কম নয়। পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশে নববর্ষ হিসেবে উদ্যাপিত হয়। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ।
বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত সম্রাট আকবরের সময় থেকেই। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।
নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত নববর্ষে তাঁরা বাড়িঘর পরিষ্কার রাখেন, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করেন এবং সকালে গোসল সেরে পবিত্র হন। এ দিনটিতে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা এবং ভালো পরতে পারাকে ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করেন অনেকেই। নববর্ষে ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি-পিঠা-পায়েসসহ নানা রকম লোকজ খাবার তৈরির ধুম পড়ে যায়। একে অপরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় চলে।
প্রিয়জনকে উপহার দেয়ার মাধ্যমেও নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়, যা শহরাঞ্চলেও এখন বহুল প্রচলিত। এ দিন রাজধানী ঢাকার রমনা বটমূলে চলে নানা রঙের, নানা ঢঙের বৈশাখী উৎসব। চলে পান্তা ইলিশের অফুরান আনন্দ। শহরে নগরে করা হয় আল্পনার বিস্তৃত কারুকাজ।
নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা। এ মেলা অত্যন্ত আনন্দঘন হয়ে থাকে। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়। এছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য, যেমনÑ চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্র্যময় সমারোহ থাকে মেলায়। মেলায় বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগায়ক ও লোকনর্তকদের উপস্থিতি থাকে। তাঁরা যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, গাজীর গান, আলকাপ গানসহ বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি ইত্যাদি আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন।
লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি আখ্যানও উপস্থাপিত হয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদি মেলার বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া শিশু-কিশোরদের আকর্ষণের জন্য থাকে বায়োস্কোপ। শহরাঞ্চলে নগর সংস্কৃতির আমেজেও এখন বৈশাখী মেলা বসে এবং এই মেলা বাঙালিদের কাছে এক অনাবিল মিলন মেলায় পরিণত হয়। বৈশাখী মেলা বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক।
এত কিছুর পরও যে কথাটি বলতে হয় তাহলো এ বছর ইরান কিংবা বাংলাদেশÑ কোথাও সেভাবে নতুন বছর উদ্যাপন করা যায় নি। এর একমাত্র কারণ বিশ্বেজুড়ে করোনাভাইরাসের মহামারি।
এর মধ্যে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ইরানে মারা গেছেন পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। আর বাংলাদেশে মারা গেছেন শতাধিক। এ বছর যেভাবে ইরান ও বাংলাদেশে নওরোজ কিংবা পহেলা বৈশাখ উদ্যাপিত হয়েছে এর আগে এমনটা আর কখনো দেখা যায় নি। দু দেশেই বলতে গেলে কোনো উৎসব অনুষ্ঠান ছিল না। বড় বেশি ¤¬ান ছিল এবারের নওরোজ ও পহেলা বৈশাখ। তবে আশাÑ হয়ত আগামীতে নওরোজ আর পহেলা বৈশাখ আসবে দ্বিগুণ উদ্দীপনা নিয়ে।