বই পরিচিতি
পোস্ট হয়েছে: মে ২১, ২০১৭
গুলিস্তাঁ ও বোস্তাঁ
রচনা : মহাকবি শেখ সাদী
অনুবাদ : কবি মাহমুদুল হাসান নিযামী
প্রকাশক : রিয়াজ খান
রোদেলা প্রকাশনী
রুমী মার্কেট (২য় তলা) ৬৮-৬৯, প্যারিদাস রোড
৩৫ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০
প্রচ্ছদ : সজিব খান ও মোবারক হোসেন লিটন
প্রকাশকাল : প্রথম প্রকাশ একুশে বইমেলা, ২০১৭
মূল্য : গুলিস্তাঁ-৩০০ টাকা ও বোস্তাঁ ২০০ টাকা ।
মহাকবি শেখ সাদী (র) ছিলেন বিখ্যাত পারস্যপ্রতিভা। ইসলামের ইতিহাসে যে সকল জ্ঞানী গুণী সাধক পুরুষ জন্মেছিলেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই জন্মেছিলেন ইরানে। ইরানের বিখ্যাত কবি শেখ সাদী (রহ)-এর দুটি অমর কাব্যগ্রন্থ গুলিস্তাঁ ও বোস্তাঁ। এই অমর গ্রন্থ দুটির পাঠ ও মূল্যায়ন হয়েছে যুগ যুগ ধরে। বাংলা ভাষায়ও এর অনুবাদ হয়েছে বহুবার। অনেকেই এর অনুবাদ করেছেন। তবে সেসব অনুবাদ ছিল গদ্যানুবাদ। কাব্যানুবাদ চোখে পড়ে নি বললেই চলে। পদ্য আকারে আংশিক অনুবাদ করেছেন কেউ কেউ। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় (২০১৭) রোদেলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবিতা মঞ্চ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কবি মাহমুদুল হাসান নিযামীর অনুদিত মহাকবি শেখ সাদীর অমর কাব্য গ্রন্থ গুলিস্তাঁ ও বোস্তাঁ।
শেখ সাদী (র)-এর উক্ত গুলিস্তাঁ ও বোস্তাঁ গ্রন্থ দুটি একসময় আমাদের দেশে মাদ্রাসাসমূহে পাঠ্য ছিল। এখন মাদ্রাসাগুলো থেকে ফারসিচর্চা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে প্রায়। তারপরও কোন কোন মাদ্রাসায় ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে ফারসি চর্চার অংশ হিসেবে গুলিস্তাঁ ও বোস্তাঁর অংশবিশেষ পাঠ্য রয়েছে। এছাড়া স্কুল-কলেজের সাহিত্য পুস্তকেও একসময় আমরা শেখ সাদীর জীবনের গল্প অথবা শেখ সাদীর গুলিস্তাঁ বোস্তাঁর নীতিগল্প আমরা পড়েছি।
শেখ সাদী (র)-এর সাহিত্য শুধু ইরান বা ফারসি সাহিত্যেরই সম্পদ নয়, তা বিশ্ব সাহিত্যের সম্পদ। বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে তা এক অমুল্য স্থান দখল করে আছে। অনুদিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। সেই কল্যাণ চিন্তা থেকেই কবি মাহমুদুল হাসন নিযামী উক্ত গ্রন্থ দুটি অনুবাদ করেন। তাঁর অনুদিত গুলিস্তাঁ গ্রন্থে রয়েছে নয়টি অধ্যায় এবং বোস্তাঁ গ্রন্থে রয়েছে এগারোটি অধ্যায়। উভয় গ্রন্থে একটি সাধারণ অধ্যায় হিসেবে রয়েছে মহাকবি শেখ সাদী (র)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী। সে জীবনীতে উল্লেখ আছে তাঁর জন্ম, বংশ পরিচয়, শৈশব, কৈশোর, শিক্ষাজীবন, ধর্মীয় জ্ঞান লাভ, আধ্যাত্মিক সাধনা, কাব্য সাধনা, দেশভ্রমণ ও আধ্যাত্মিক গুরুর বাইয়াত লাভ ইত্যাদি বিষয়। গুলিস্তাঁ গ্রন্থটি প্রথম শুরু হয়েছে নাতে রাসূল (সা.) দিয়ে। এতে প্রথম স্থান পেয়েছে বিশ্ববিখ্যাত ও কালোত্তীর্ণ সেই নাত যা সর্বজনবিদিত। ‘বালাগাল উলা বি কামালিহি/ কাশাফাদ দুজা বি জামালিহি// হাসুনাত জামিও খিসালিহি/ সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি।’ এছাড়া রয়েছে বেশ কয়েকটি নাত।
দ্বিতীয় অধ্যায় বাদশাহদের কাহিনীতে রয়েছে রাজা-বাদশাহদের সাধারণ চরিত্র, ভোগবিলাস, লোভ-লালসা, ফখর বা আত্মম্ভরিতা, যুলুম, আগ্রাসন ইত্যাদি। বাদশাহদের বাদশাহিও একদিন শেষ হয়ে যায়। মাটিতে বিলীন হয়ে যায় তাদের বিলাসি ও আয়েসি শরীর। কিন্তু ন্যায় বিচারক ও মহান শাসকরা বেঁচে থাকেন, যেমন ইরানের শাসক নওশিরওয়ানের কথা শেখ সাদী উল্লেখ করেছেন। এভাবে অন্য অধ্যায়গুলোতে রয়েছে দরবেশ ও ধার্মিকদের চরিত্র, ধৈর্যের ফলাফল, নীরবতা অবলম্বনের উপকারিতা, যৌবনকাল ও ভালোবাসা, দুর্বলতা ও বার্ধক্য, শিক্ষা এবং দীক্ষা ও সাহচর্যের অনুষঙ্গ।
বোস্তাঁ গ্রন্থটি শুরু হয়েছে হাম্দ বা আল্লাহর প্রশংসা সংগীত দিয়ে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ন্যায় বিচার ও রাজ্য চালনার পদ্ধতি ছন্দে ছন্দে শেখ সাদী (র) ব্যক্ত করেছেন।
ইসলাম ও মানবতার অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে ইহসান। এটি এক মানবীয় গুণ। এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে ‘ইহসান’ শীর্ষক অধ্যায়ে। এছাড়া ‘প্রেম-ভালোবাসা’ অধ্যায়ে ব্যক্ত হয়েছে জাগতিক, মানবিক প্রেমের বৈশিষ্ট্যের সাথে আধ্যাত্মিক প্রেমের পার্থক্য ও সামঞ্জস্য। ‘বিনয়’ অধ্যায়ে বেশ কিছু ঐতিহাসিক কাহিনী ও গল্প বর্ণনার মাধ্যমে বিনয়ের মাহাত্ম্য প্রচার করা হয়েছে। ‘আল্লাহর ফায়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা’ একটি চিরন্তন বক্তব্য। যিনি আল্লাহর ফায়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকতে পারেন তিনিই সফল। কিন্তু আমাদের ঈমানের দুর্বলতা হেতু অনেক সময় তা হয়ে ওঠে না। জীবন ভরে ওঠে আফসোস আর হাহাকারে। ‘অল্পতে তুষ্ট থাকা একটি মহৎ গুণ’Ñ ‘চরিত্র সংশোধন’ অধ্যায়ে মানব চরিত্র গঠনের নানা বক্তব্য এসেছে ছন্দোবদ্ধ গল্পের মাধ্যমে। ‘কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং তওবা’ অধ্যায়টিও মানব জীবনের আরেকটি অমূল্য অধ্যায় যা ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বোস্তাঁর শেষ অধ্যায়ে রয়েছে একটি মোনাজাত। হাম্দ ও নাত দিয়ে যে গ্রন্থ দুটি শুরু হয়েছিল মুনাজাত দিয়ে এর অন্ত হয়েছে।
কবি মাহমুদুল হাসান নিযামীর উক্ত অনুবাদ দুটি নুতন মাত্রা যোগ করেছে। তাঁর অনুবাদের ভাষাও স্বতন্ত্র। কারণ, মাহমুদ হাসান নিযামী যেহেতু নিজেই একজন কবি সেকারণে গুলিস্তাঁ ও বোস্তাঁর কাব্যভাষা সম্পর্কে ছিলেন সচেতন। উক্ত গ্রন্থ দুটি বাংলা ও ফারসি সাহিত্য গবেষকদের, ফারসি সাহিত্যানুরাগীদের কাজে লাগবে। উপকৃত হবে ধর্মীয় মহল। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়ক গ্রন্থ হিসেবেও পাঠযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে।
বই দুইটির প্রচ্ছদ চমৎকার এবং মূদ্রণও ভালো। আমরা উক্ত অনুবাদ গ্রন্থ দুটির ব্যাপক পঠন ও পর্যালোচার দাবি রাখছি।
□ আমিন আল আসাদ