বুধবার, ২৬শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ফার্সি নববর্ষ ১৪০৪ উপলক্ষে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পূর্ণাঙ্গ বার্তা

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ২৩, ২০২৫ 

news-image

ফার্সি নববর্ষ ১৪০৪ উপলক্ষে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর বার্তা নিচে তুলে ধরা হলো:

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

‘ইয়া মুকাল্লিবাল কুলূব ওয়াল আবসার, ইয়া মুদাব্বিরাল লাইলি ওয়া ন্নাহার, ইয়া মুহাভভিলাল হালি ওয়াল আহওয়াল, হাভভিল হালানা ইলা আহসানিল হাল।’

(হে অন্তরসমূহ ও দৃষ্টিসমূহের বিবর্তনকারী। হে রাত ও দিবসের পরিচালনাকারী! হে বৎসর ও অবস্থানসমূহের পরিবর্তনকারী। আমাদের অবস্থাকে উত্তম অবস্থায় পরিবর্তন করুন।)

ক্বদরের রাতগুলো এবং মুমিনদের নেতার (সালাওয়াতুল্লাহ ওয়া সালামুল্লাহ আলাইহি) শাহাদাতের দিনগুলোতে নতুন বছর শুরু হচ্ছে। আশা করছি, এই রাতগুলোর বরকত এবং মুত্তাকিদের নেতার মনোযোগ পুরো বছর জুড়েই আমাদের প্রিয় জনগণ, আমাদের জাতি, আমাদের দেশ এবং যেসব মানুষের নববর্ষ (ফার্সি) নওরোজের মাধ্যমে শুরু হয় তাদের সকলের উপর অটুট থাকবে।

বিদায়ী ফার্সি বছর ১৪০৩ ছিল একটি ঘটনাবহুল বছর। বিদায়ী বছরে ধারাবাহিকভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ফার্সি ১৩৬০ সালের ঘটনাবলীর মতোই ছিল যা আমাদের প্রিয় মানুষদের জন্য কষ্টের কারণ হয়েছে। বিদায়ী বছরের শুরুতেও ইরানি জাতির প্রিয় প্রেসিডেন্ট জনাব রায়িসি শাহাদাতবরণ করেন। এর আগে দামেস্কে আমাদের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা শহীদ হন। এরপর তেহরানে ও পরবর্তীতে লেবাননে বিভিন্ন ঘটনা ঘটে এবং ইরানি জাতি ও মুসলিম উম্মাহ তাদের মূল্যবান উপাদানগুলো হারায়। এগুলো ছিল তিক্ত ঘটনা। এছাড়াও সারা বছর ধরে বিশেষ করে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থনৈতিক সমস্যা জনগণের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে এবং জীবিকা সংক্রান্ত কষ্ট মানুষকে ভুগিয়েছে।

এই সমস্যাগুলো গত বছর জুড়েই ছিল। কিন্তু অপরদিকে মহান এবং বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে, আর তা হলো ইরানি জাতির ইচ্ছাশক্তি, আধ্যাত্মিক চেতনা, ঐক্য এবং উচ্চ পর্যায়ের প্রস্তুতি প্রদর্শন। প্রথমত, প্রেসিডেন্টের শাহাদাতের পর জনগণ যেভাবে তাঁকে বিদায় জানিয়েছে, জনগণ যেসব স্লোগান দিয়েছে এবং যে ধরণের উচ্চ মনোবল দেখিয়েছে তাতে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, (প্রেসিডেন্টের বিদায়) অনেক কষ্টকর হলেও তা ইরানি জাতির মধ্যে নিজেকে দুর্বল হিসেবে গণ্য করার মনোভাব তৈরি করতে পারেনি। এরপর আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে একজন প্রেসিডেন্টকে বাছাই করতে পারা এবং সরকার গঠন করে প্রেসিডেন্টের বিদায়ে সৃষ্ট শূন্যতা থেকে দেশকে বের করে আনতে পারা- এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসবই ইরানি জাতির উচ্চ মনোবল ও উচ্চ সক্ষমতা এবং আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতিফলন। এ জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। এছাড়াও, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যখন আমাদের অনেক লেবাননি ভাই, আমাদের ঐসব ধর্মীয় ভাই লেবাননে সমস্যার সম্মুখীন হলেন তখন ইরানি জনগণ উদারতার সঙ্গে তাদের সাহায্য করতে সক্ষম হন। এই পরিস্থিতিতে ঘটে যাওয়া ঘটনা অর্থাৎ লেবাননি ও ফিলিস্তিনি ভাইদের প্রতি মানুষের সাহায্যের বিস্ময়কর বন্যা, আমাদের দেশের ইতিহাসের একটি স্থায়ী এবং অবিস্মরণীয় ঘটনা। আমাদের জনগণ অর্থাৎ নারীরা যেভাবে উদারতার সঙ্গে তাদের স্বর্ণ দান করেছেন, একইসঙ্গে পুরুষেরা যেভাবে সহায়তা প্রদান করেছেন- তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা জাতির দৃঢ় ইচ্ছা শক্তি প্রদর্শন করে। এই চেতনা, এই উপস্থিতি, এই প্রস্তুতি ও এই আধ্যাত্মিক শক্তি দেশের ভবিষ্যতের জন্য এবং আমাদের প্রিয় ইরানের জন্য চিরকালীন এক সম্পদ। ইনশাআল্লাহ, দেশ এই পুঁজির সর্বোচ্চ ব্যবহার করবে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ গোটা জাতির উপর তাঁর অনুগ্রহ বর্ষণ করতে থাকবেন।

গত বছর আমাদের স্লোগান ছিল, জনগণের অংশগ্রহণে উৎপাদন বৃদ্ধি, যা দেশের জন্য প্রয়োজনীয় এবং এক অর্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বিদায়ী ১৪০৩ সালের বিভিন্ন ঘটনা এই স্লোগান পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছে। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে অনেক চেষ্টা করা হয়েছে এবং সরকার, জনগণ, বেসরকারি খাত, বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তারা ভালো ভালো কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে অনেক ব্যবধান রয়েছে। তাই এই বছরও আমাদের প্রধান সমস্যা হলো অর্থনীতি। এই বছর আমি সম্মানিত সরকার, সম্মানিত কর্মকর্তা এবং আমাদের প্রিয় জনগণের কাছে প্রত্যাশা হিসেবে যা উত্থাপন করছি তা আবারও অর্থনৈতিক সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা এবং অর্থনৈতিক বিনিয়োগের সাথে সম্পর্কিত বিষয় এ বছরের স্লোগান হিসেবে গণ্য হবে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হল উৎপাদনশীল বিনিয়োগ।

বিনিয়োগ করা হলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। অবশ্যই মূলত জনগণকেই বিনিয়োগ করতে হবে। সরকারের উচিত নানা পদ্ধতি উপস্থাপন করা। কিন্তু যেখানে মানুষের বিনিয়োগের প্রেরণা বা ক্ষমতার অভাব থাকবে, সেখানে সরকারও এই অঙ্গনে প্রবেশ করতে পারে। জনগণের সাথে প্রতিযোগিতা হিসেবে নয় বরং জনগণের বিকল্প হিসেবে সরকার কাজ করতে পারে। যেখানে জনগণ আসে না, সেখানে সরকারের উচিত বিনিয়োগ করা এবং এগিয়ে আসা। যাই হোক, উৎপাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ দেশের অর্থনীতির জন্য এবং মানুষের জীবিকার সমস্যা সমাধানের জন্য একটি প্রয়োজনীয় বিষয়।

জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য পরিকল্পনা প্রয়োজন। কিন্তু এ ধরণের প্রস্তুতি ছাড়া এমন পরিকল্পনা সম্ভব নয়।

সরকার এবং জনগণ উভয়কেই উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং অত্যন্ত দৃঢ় সংকল্প ও প্রেরণার সাথে তা অনুসরণ করতে হবে। সরকারের কাজ হলো উৎপাদনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা এবং বাধা দূর করা। জনগণের কাজ হলো উৎপাদনে তাদের ছোট-বড় পুঁজি ব্যবহার করা। যদি মূলধন উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা আর স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা কেনার মতো ক্ষতিকারক কাজের দিকে পরিচালিত হবে না। ক্ষতিকর কাজ আর হবে না। এই ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভূমিকা পালন করতে পারে এবং সরকারও অনেক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। অতএব, এই বছরের স্লোগান হলো “উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ”।

ইনশাআল্লাহ মানুষের জীবিকার সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী উৎস হবে এবং জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণে গৃহীত সরকারি পরিকল্পনায় দেশ ও জাতির সমস্যার সমাধান হবে।

গত কয়েক দিনের ঘটনাবলীর দিকেও একটু ইঙ্গিত করছি। গাজার উপর দখলদার ইহুদিবাদী সরকারের নতুন হামলা অত্যন্ত গুরুতর এবং বিপর্যয়কর অপরাধ। ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলিম জাতিকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মধ্যকার মতপার্থক্য দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। কারণ এই সমস্যাটি মুসলিম উম্মাহর সমস্যা। এছাড়া, এই বিশ্বাসঘাতকতামূলক ও বিপর্যয়কর কাণ্ডকে আমেরিকা, ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশের তথা গোটা বিশ্বের সকল স্বাধীনচেতা মানুষের পক্ষ থেকে গুরুত্ব সহকারে মোকাবিলা করতে হবে। আবারও শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে, ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হচ্ছে, মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, মানুষের পক্ষ থেকে এই ট্র্যাজেডি বন্ধ করতে হবে। অবশ্যই আমেরিকাও এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। বিশ্বের যারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন তারা সবাই এটা বলছেন যে, আমেরিকার নির্দেশে অথবা অন্তত আমেরিকার অনুমোদন ও সবুজ সংকেতে এটা করা হয়েছে। কাজেই আমেরিকাও এই অপরাধে জড়িত। ইয়েমেনের ঘটনাগুলোও একই রকম। ইয়েমেনি জনগণের ওপর, ইয়েমেনের বেসামরিক নাগরিকদের উপর আক্রমণও একটি অপরাধ যা বন্ধ করতে হবে।

আশা করছি যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ এই নতুন বছরে মুসলিম জাতির জন্য কল্যাণ, সাফল্য ও বিজয় দান করবেন এবং ইরানি জাতি আনন্দ, সন্তুষ্টি, ঐক্য ও সাফল্যের সাথে নতুন বছর শুরু করে বছরের শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখতে সক্ষম হবেন। আশা করছি যুগের অভিভাবকের [ইমাম মাহদি (তাঁর জন্য আমাদের প্রাণ উৎসর্গ হোক)] পবিত্র হৃদয়, মহান ইমামের [ইমাম খোমেনী (রহ.)] পবিত্র আত্মা এবং শহীদদের পবিত্র আত্মা আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে।

ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ

আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী

২০ মার্চ, ২০২৫

পার্সটুডে/