ফারসি নওরোজ ও বাংলা নববর্ষ
পোস্ট হয়েছে: মার্চ ২০, ২০১৯
সাইদুল ইসলাম: ফারসি “নওরোজ” শব্দটির অর্থ নতুন দিন। ফারসি নতুন বছরের প্রথম দিনকে বলা হয় নওরোজ। পৃথিবীর সবদেশেই নববর্ষের উৎসব পালিত হলেও ইরানি নববর্ষের উৎসব অন্যযেকোন নববর্ষের উৎসবের চেয়ে আলাদা। কারণ বাংলা নববর্ষ থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের নববর্ষের উৎসব যত আনন্দময় ও জাঁকজমকপূর্ণভাবেই পালিত হোক না কেন তা নববর্ষের প্রথম দিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে একমাত্র ফারসি নববর্ষই দীর্ঘ সময়জুড়ে পলিত হয়ে থাকে। কারণ নওরোজ বা নববর্ষ ইরানি জাতির সবচেয়ে বড় জাতীয় উৎসব। রাষ্ট্রীয়ভাবেও নওরোজ বা ফারসি নববর্ষকে ইরানের সবচেয়ে বড় জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
ইরানিরা এই উৎসবকে সবচেয়ে বড় ঈদ বলেও মনে করে। নববর্ষের প্রথম দিন থেকে ১৩ দিন পর্যন্ত তারা এই উৎসব পালন করে থাকে। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এই উৎসবের জন্য দেশটিতে অন্য যেকোন জাতীয় উৎসবের চেয়ে বেশিদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এই উৎসব উপলক্ষ্যে দেশটির স্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছুটি থাকে প্রায় দীর্ঘ এক মাস। ফারসি নতুন বছর শুরু হয় বসন্তের প্রথম দিন থেকে। বসন্তে প্রকৃতি যেমন নতুন করে সাজে। গাছে গাছে যেমন পুরনো পাতা ঝড়ে নতুন পাতা গজাতে থাকে, ফুলে ফুলে মুখরিত হতে থাকে চারদিক, পাখির কণ্ঠ থেকেও যখন ভেসে আসে গানের সুর। তখন প্রকৃতি আর ইরানি জাতি বসন্ত ও নতুন বছরের আনন্দে একাকার হয়ে যায়।
নওরোজের আগেই ইরানিরা ঘরদোর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে তারা পাড়া-পড়শী ও আপনজনদের সহায়তা করেন। ঈদ বা নওরোজের অনেক আগেই পুরোনো আসবাবপত্র বা জরাজীর্ণ জিনিস ফেলে দিয়ে তারা নতুন জিনিস কেনেন। নতুন জামা-কাপড়, জুতা প্রভৃতি কেনার হিড়িক পড়ে যায়। নওরোজের মেহমানদারির জন্য তারা ব্যাপক পরিমান ফল, মিষ্টি ও অন্যান্য খাদ্য-সামগ্রী কিনে থাকেন। এ সময় স্থায়ী বাজার ছাড়াও অনেক অস্থায়ী বাজার বা মেলার আসর জমজমাট হয়ে ওঠে।
ইরানি জাতির নওরোজ বা ফার্সি নব বর্ষের উৎসব পালনের ইতিহাস অনেক প্রাচীন হলেও ইসলামের আবির্ভাবের পর ইরানে নওরোজ উৎসবের রীতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান যুক্ত হয় এ উৎসবের সাথে। মুসলমানরা বসন্ত ঋতুতে গাছপালার পুনরায় সবুজ হওয়াকে পারলৌকিক জীবনের প্রমাণ লে মনে করেন। বিশেষ দোয়া পাঠের মধ্য দিয়ে ইরানি মুসলমানরা নওরোজ বা নববর্ষ শুরু করেন। এ মুনাজাতে তারা বলেন, ” হে অন্তর ও দৃষ্টির পরিবর্তনকারী এবং দিন ও রাতের পরিচালনাকারী এবং অবস্থার পরিবর্তনকারী (মহান আল্লাহ)! আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় রূপান্তরিত করুন।” নওরোজের প্রথম সেকেন্ডেই সবাই এ দোয়া পাঠ করেন। এ সময় তাদের সামনে টেবিলে বা দস্তরখানে থাকে পবিত্র কোরআন, তসবিহ এবং “হাফতসিন” নামে খ্যাত সাতটি বিশেষ সামগ্রীসহ আরো কিছু সামগ্রী।
“হাফতসিন” অর্থাৎ সাতটি “সিন”। ওই সাতটি জিনিসের নামের প্রথম অক্ষর ফারসি বা আরবি বর্ণমালার “সিন” অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়ায় সেগুলোকে এ নাম দেয়া হয়েছে। এ ৭টি সামগ্রী হল, ” সাবজে” বা গম বা ডালের সবুজ চারা, সামানু বা গমের চারা দিয়ে তৈরি করা খাবার, সিব বা আপেল, “সেনজেদ” নামের একটি বিশেষ ফল, ” সোমাক্ব” নামক বিশেষ মশলা, সির বা রসুন এবং সের্কে বা সিরকা।
এসব সামগ্রী হল নব-জীবন, প্রবৃদ্ধি, ফলবান হওয়া, প্রাচুর্য, সৌন্দর্য, সুস্থতা, ভালবাসা, আনন্দ ও ধৈর্য প্রভৃতির প্রতীক। এছাড়াও নওরোজের এ দস্তরখানে ডিম, আয়না, পানি, লাল রংয়ের ছোট মাছ ও ধাতব মুদ্রা রাখা হয়। এসবেরই রয়েছে বিশেষ অর্থ।
ইরানিরা নওরোজের দিন বাবা-মাসহ নিকট-আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় বেশ কয়েকদিন সরকারি ছুটি থাকায় ইরানিরা দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সফর করেন এবং কেউ কেউ আবার দেশের বাইরেও বেড়াতে যান। অনেক ইরানি নওরোজের প্রথম প্রহর বা প্রথম দিনটি পবিত্র কোনো স্থানে কাটাতে পছন্দ করেন।
ফার্সি প্রথম মাস বা ফারভারদিন মাসের এক তারিখ থেকে শুরু হয় নওরোজ উৎসব এবং শেষ হয় ১৩ তারিখে। ১৩ তারিখে ইরানিরা কেউ-ই ঘরে থাকেন না। তারা সেদিন ঘরের বাইরে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও মনোরম প্রাকৃতিক স্পটে সময় কাটান। বিশেষ করে উদ্যান, ঝর্ণা, পাহাড়, পার্ক- এসব স্থানে তারা চাদর বিছিয়ে বা তাবু খাটিয়ে খোশ-গল্প করে এবং মজাদার খাবার খেয়ে সময় কাটান।
যে কোনো ঈদ বা উৎসব মানবীয় আনন্দের অপার উৎস। মানুষ আনন্দ-উৎসব ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। তবে আল্লহর স্মরণ মানুষকে জোগায় সবচেয়ে বড় প্রশান্তি এবং অপার মানসিক সুখ। নওরোজ উপলক্ষে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় ঈদের আনন্দকে ভাগ করে নেয়ার জন্য অনেক ইরানি বিশেষ ত্রাণ-তহবিলে অর্থ বা নানা জিনিস-পত্র দান করে থাকেন। এসব অর্থ বা জিনিস গরীব, এতিম ও অভাবগ্রস্তদের দান করা হয়।
ফারসি নববর্ষ একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি হলেও বাংলা নববর্ষের সংস্কৃতিও কম সমৃদ্ধ নয়। এদিন দেশের সর্বস্তরের মানুষ নববর্ষের আনন্দে একাকার হয়ে যায়। এদিন থাকেনা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, কে ধনী কে গরিব, বা কে কোন মতাদর্শে বিশ্বাসী তারও কোন পার্থক্য থাকে না। বাংলাদেশ যে একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষের উৎসবই তার প্রমাণ।
সম্প্রসারিত হয়েছে। নতুন নতুন মাত্রা লাভ করে বিশাল এক অসাম্প্রদায়িক আনন্দ মেলার রুপ পরিগ্রহ করেছে, বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তর বৈশাখী মেলা। এটি এখন আর ব্যবসা-বাণিজ্যের লাভ-ক্ষতির হিসেব-আশ্রয়ী হালখাতানির্ভর অনুষ্ঠানমাত্র নয়, এ অনেক ব্যাপক, দূরসঞ্চারী এবং বহুমাত্রিকায়-পূর্ণ আমাদের অন্যতম জাতীয় উৎসব। বাঙ্গালি জাতীয়তার এবং আত্মপরিচয়েরও ভিত্তি।
এই দিনটি এলে, সবার অন্তরঙ্গ একাত্মতার মধ্যে বড় হয়ে ওঠে বাঙ্গালিত্বের অনুভব। প্রতিবছরই এতে য্ক্তু হতে থাকে নতুন মাত্রা। বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসমাগম ও উৎসাহের জোয়ার। দেশের সর্বত্র, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনুভূত হয় এর স্পন্দন। অবশ্য, নববর্ষ উৎসব পালনের ধরন নিয়ে বিরুপ মন্তব্যও শোনা যায়। কেউ কেউ এর মধ্যে বিজাতীয় ঐতিহ্যের গন্ধ খুঁজে পান। কিন্তু যেভাবেই পালিত হোক, বাঙ্গালী একটি দিনের জন্য হলেও তার জাতিসত্তাকে অনুভব করে, শেকড়ের কাছে ফিরে আসে।