প্রাচীনতম সভ্যতার জন্মস্থান ইরানের টেপ সিয়ালক
পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ৮, ২০১৮

ইরানের ইসফাহান প্রদেশের কাশানের প্রাগৈতিহাসিক স্থান টেপ সিয়ালক। যাকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতার জন্মস্থান। ঐতিহাসিক এই স্থানকে ঘিরে রয়েছে প্রায় ৮ হাজার বছরের বিস্তৃত ইতিহাস। বিশ্বের প্রাচীনতম স্থির বসতি, স্থাপত্য, জিগুরাত (পিরামিড আকৃতির প্রাচীন উপাসনালয়), মৃত্শৃল্পের ভাটা ও প্রাচীনতম ধাতু চুল্লির জন্যও বিখ্যাত এই স্থানটি।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর শেষ ভাগে ইরানে অনেক তৃণভূমির সৃষ্টি হয়। ফলে দেশটির মালভূমির গুহায় বসবাস করা বাসিন্দারা সমতালে এসে বসবাস শুরু করেন। ওই সময় তারা বসবাসের জন্য যেসব স্থানকে বেছে নেন সেগুলোর মধ্যে টেপ সিয়ালক অন্যতম। বিশ্বে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীনতম স্থান এটি। ধারণা করা হয়, গোটা সিয়ালক সভ্যতার জন্ম হয়েছে নিকটস্থ বিশাল পানি সম্পদ থেকে। যেটি বিদ্যমান রয়েছে এখনও।
টেপ সিয়ালক থেকে খামারে পালা প্রাণির বিপুল সংখ্যক হাড়হাড্ডি আবিষ্কার করা হয়েছে। এতে বোঝা যায়, সিয়ালকের বাসিন্দারা গৃহপালিত প্রাণির গোশতভোজী ছিল। এলাকাটি খুঁড়ে হস্তনির্মিত অনেক জিনিসপত্রও পাওয়া গেছে। বর্তমানে যা ব্রিটিশ জাদুঘর লুভরি, নিউ ইয়র্কে মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অব আর্ট ও ইরানের জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শন করা হচ্ছে। এর বাইরে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী বেসরকারি ভাবেও সংগৃহীত আছে।
প্রাচীন এই স্থানটি গড়ে উঠেছে পাশাপাশি থাকা দুটি পাহাড়ের সমন্বয়ে। উত্তর ও দক্ষিণে থাকা পাহাড়দ্বয়ের মাঝে ব্যবধান প্রায় ৬শ মিটার। এর মধ্যে উত্তর দিকের টিলাটি ২৫ মিটার উঁচু। আর দক্ষিণ দিকের টিলাটির উচ্চতা ছয় মিটার।
বিশ শতকের দিকে টেপ সিয়ালকে প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান চালানো হয়। বেরিয়ে আসে প্রাগৈতিহাসিক কালের অনেক অজানা তথ্য। অনুসন্ধান শেষে সেখানকার বসতিগুলোর ইতিহাসকে মোটামুটি ছয়টি সাংস্কৃতিক সময়কালে (পিরিয়ডে) ভাগ করা হয়। সে হিসেবে উত্তর দিকের টিলাটি প্রথম ও দ্বিতীয় সাংস্কৃতিক পিরিয়ডে নির্মিত হয়। প্রথম সময়কালকার স্থাপত্য ছিল অনুন্নত। নলখাগড়ার ছাওনি দিয়ে কুঁড়ে ঘর বানানো হতো এবং তা ঢেকে দেওয়া হতে কাদা দিয়ে। এই সময় প্রাথমিক পর্যায়ের সিরামিক উৎপাদন শুরু হয়। যদিও এর মান বৃদ্ধিতে আরও সময় লেগেছে।
খ্রিস্টপূর্ব প্রায় সাড়ে ৫ হাজার সালে সিয়ালক সভ্যতার দ্বিতীয় পিরিয়ড শুরু হয়। এসময় সেখানকার বাসিন্দারা শিকার,খামার চাষ ও পশুপালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। হাতে তৈরি ইটকে প্রধান নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে এই পিরিয়ডের শেষ ভাগে প্রযুক্তি বিকাশের লক্ষণ পাওয়া যায়। মানুষ প্রাণী ও গাছপালার ছবি আঁকা শুরু করে। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তারা মৃত্শিল্পের পণ্যসামগ্রীতে জ্যামিতিক নকশা আঁকা শুরু করেন। কপারের ব্যবহার করে ছোট ছোট জুয়েলারি সামগ্রীও বানানো শুরু হয় এই সময়ে।
তৃতীয় সাংস্কৃতিক কাল শুর হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪ হাজার সালে। এসময় সিয়ালকের অধিবাসীরা উত্তর দিকের টিলা থেকে দক্ষিণ দিকের টিলায় স্থানান্তরিত হন। এই যুগে সম্ভবত ইরানিরাই প্রথম মাটির তৈরি চাকা আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। তারা কাদামাটি দিয়ে সূক্ষ্ম আকৃতি আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাশাপাশি তারা এসব মাটির তৈরি সামগ্রী চুল্লিতে তাপ দিয়ে মজবুত করতেন। আর তাপ নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে হতো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে তথা নিজ হাতে। মৃম্ময় পাত্রের শৈল্পিক নকশা ক্রমান্বয়ে আরও দৃষ্টিনন্দন ও জটিল প্রকৃতির হয়ে ওঠে। সেই সাথে এতে মানুষের ছবিরও ব্যবহার শুরু হয়।
সিয়ালক সভ্যতার এই পিরিয়ডে গম ও যবের চাষ হতো এবং এই দুই কৃষিপণের ওপর ভিত্তি করে বাণিজ্যিক মিথস্ক্রিয়া সংঘটিত হতো। তৎকালীন সময়ে ইরানিরা খনি থেকে রুপা উৎপাদন শুরু করে। এসময় তারা রুপার বাসনও উৎপাদন শুরু করেন। তথ্য প্রমাণ থেকে দেখা যায়, টেপ সিয়ালক বসতির তৃতীয় ও চতুর্থ পিরিয়ডে মধ্য ইরানের ধাতু উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এটি।
সিয়ালক ইতিহাসের চতুর্থ পিরিয়ড শুরু হয় প্রায় খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে ৩ হাজার সালে। এসময় লিখিত পদ্ধতির বিকাশ ঘটে। বসতি অর্জন করে রমরমা বাণিজ্যিক অভিজ্ঞতা। উল্লেখযোগ্য ভাবে এখানকার জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। বিশ্বের প্রাচীনতম জিগুরাত তথা পিরামিড আকৃতির উপাসনালয়ের যে ধ্বংসাবশেষ রয়েছে তা এই সময়কার বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এরপর এক শতাব্দীর বেশি সময় পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল সিয়ালক। অতঃপর নতুন করে আরও দুই পিরিয়ডে এখানে বসতি গড়ে ওঠে। এই দুই পিরিয়ড থেকে যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক দেহাবশেষ আবিষ্কার করা হয়েছে তা মূলত দুটি সমাধিস্থল থেকে পাওয়া গেছে। যা সমাধিস্থল ‘এ’ ও সমাধিস্থল ‘বি’ নামে পরিচিত।
সভ্যতার ৫ম সময়কাল শুরু হয় প্রায় ৩ হাজার ২শ বছর আগে। তখনকার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে অস্ত্র ও ব্রোঞ্জের তৈরি অন্যান্য বস্তু। জুয়েলারি ও কিছু লোহার সামগ্রীও পওয়া গেছে। এই সময়কার সিরামিকের রঙ ছিল ধূসর কালো বা লাল বর্ণের। কখনও এসব সামগ্রী জ্যামিতিক সাজসজ্জা দিয়ে সুসজ্জিত করা হতো।
পরবর্তী কালে সিয়ালকে নতুন বসতি গড়ে ওঠে প্রায় ২ হাজার ৯শ বছর আগে। সে সময় বসতি স্থাপনকারীরা আগের সময়কার ধ্বংসাবশেষের ওপরেই তাদের বাসাবাড়ি তৈরি করেন। ফলে সাবেক বাসিন্দাদের প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।
বাস্তবতা হলো টেপ সিয়ালক থেকে মানবসভ্যতার অমূল্য তথ্য পাওয়া যায়। তাইতো বিশ্বের প্রত্নতাত্ত্বিকরা স্থানটি সংরক্ষণে ক্যাম্পেইন চালু করেছেন। লন্ডনে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্কলার ও প্রত্নতত্ত্ববিদরা একটি পরামর্শ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই কমিটি ডিজিটাল ডাটাবেজ স্থাপন ও টেপ সিয়ালকের জন্য একটি ওয়েবসাইট চালু নিয়ে কাজ করবে। স্কলাররা ফ্রান্স ও জার্মানিতে অনুষ্ঠিতব্য পরবর্তী দুই সম্মেলনে স্থানটি ঘিরে তাদের চালানো গবেষণার ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সূত্র: প্রেসটিভি।