‘ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কিয়াম এর প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে ’
পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ৬, ২০১৬
‘প্রকৃত শিয়া ও সুন্নির মধ্যে বিরোধ নেই। প্রকৃত সুন্নিরা কখনো ইয়াজিদের সমর্থক নয়। কারবালার ব্যাপারে শিয়া-সুন্নি একমত। শিয়া-সুন্নির ঐক্যের চর্চা বাড়াতে হবে… যারা ইয়াজিদকে নির্দোষ বলতে চান তারা ঐতিহাসিক সত্যকে ঘুরিয়ে ফেলতে চান।’ —এ কথাগুলো উচ্চারিত হয়েছে ‘শোহাদায়ে কারবালা ও আহলে বাইত-এর মর্যাদা’ শীর্ষক ঢাকার এক সেমিনারে।
কারবালার মহাবিপ্লব সাড়ে তেরো’শ বছর পর আজও কেবল মু’মিন মুসলমানের অন্তরের অন্তঃস্থলে আদর্শিক দিক-নির্দেশনা এবং আলোচনার অন্যতম প্রধান প্রেরণাই নয়। একইসঙ্গে তা ইসলামী ঐক্যেরও যে সোপান- বিষয়টি স্পষ্ট করছে এ জাতীয় সেমিনার।
শুক্রবার ঢাকার মিরপুর লালকুঠি দরবার শরিফ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ওই মহতী সেমিনার। আহলে বাইত সঙ্ঘ ও শিয়া সুন্নি ঐক্য পরিষদ-এর যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সেমিনারটির সভাপতিত্ব করেন লালকুঠি দরবার শরিফের পীর ও ঢাকা ভার্সিটির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব শাহ সুফি আহসানুল হাদি।
এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ইরানিয়ান আল মোস্তফা ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ শাখার শিক্ষক হুজ্জাতুল ইসলাম ইউনুস আলী গাজী। আলোচনায় অংশ নেন ড. জহির উদ্দিন মাহমুদ, অধ্যাপক এম এ হামিদ, অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম। মূল প্রবন্ধ পেশ করেন কবি আমিন আল আসাদ।
সভাপতির ভাষণে লালকুঠি দরবার শরিফের পীর জনাব শাহ সুফি আহসানুল হাদি বলেন, ‘প্রকৃত শিয়া ও প্রকৃত সুন্নিদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। প্রকৃত সুন্নিরা কখনো ইয়াজিদের সমর্থন করতে পারে না এবং করেনি। শোহাদায়ে কারবালার কথা মানুষ কখনো ভুলবে না। এই ইতিহাস চর্চা অব্যাহত থাকবে। কেউ তা বন্ধ করতে পারবেনা। শিয়া ও সুন্নির ঐক্যের মৌলিক বিষয়গুলোর চর্চা বাড়াতে হবে। শিয়াদের বদলে দিয়ে সুন্নি বানানো যাবে না, আবার সুন্নিদের বদলে শিয়া বানানো যাবে না, কিন্তু ঐক্যের মূল বিষয়গুলো চর্চার মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে দূরত্ব কমবে ও মহব্বত বাড়বে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে হুজ্জাতুল ইসলাম ইউনুস আলী গাজী বলেন, ‘মুসলমানদের মধ্যে যখন ঐক্য ও স্থিতিশীল অবস্থা থাকে তখন মুসলমানেরা শিল্প, বিজ্ঞান, কলা, সাহিত্য, গবেষণা ইত্যাদিতে চরম উন্নতি সাধন করে। তখন মুসলমানদের মধ্যে গড়ে ওঠে ইবনে সিনা, আল বিরুনি, আল ফারাবি প্রমুখ। আর যখন পরস্পর ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয় তখন তাদের মন মগজ ব্যস্ত থাকে বিবাদে। রাসুলের সুন্নাতকে শিয়া-সুন্নি সবাই আঁকড়ে ধরেছে, আর রাসুলের আহলে বাইতকে শিয়া সুন্নি সবাই ভালবাসে, তাহলে কিসের বিভেদ? সাম্রাজ্যবাদীরা ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ তথা ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতিতে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করছে।’
ইউনুস আলী গাজী আরও বলেছেন, ‘আমরা মুসলমান। আমাদের আল্লাহ্ এক, রাসুল এক, কিবলা এক, কলেমা এক। শিয়া-সুন্নির মধ্যে বিয়ে শাদি সামাজিক সম্পর্ক আছে। কারবালার ঘটনার ব্যাপারে শিয়া সুন্নি সবাই একমত। এখানে নবী-পরিবারের উপর জুলুম করা হয়েছে। ইমাম হুসাইন শাহাদাত বরণ করে এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যা কিয়ামত পর্যন্ত সব মানুষ স্মরণ রাখবে। ইমাম হুসাইন আহলে বাইতের সদস্য। আহলে বাইতকে মহব্বত করা ঈমানের অঙ্গ। ইয়াজিদ- ইমাম হুসাইন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর ও আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রা) এ তিনজন থেকে বায়াত আদায়ে চাপ প্রয়োগ করতে আদেশ দিয়েছিলো। বায়াত না হলে হত্যার আদেশ দিয়েছিলো।’
সেমিনারে আলোচনায় ড. জহিরউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন,‘আজকাল আমাদের দেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, পত্র-পত্রিকায়, ওয়াজে-আলোচনায় কারবালার ব্যাপারে একটা ধূম্রজাল তৈরি করা হচ্ছে। কারবালার আত্মদান ও ইমাম হুসাইন (আ)-এর আন্দোলনকে খাটো করে এবং একে গৌণ করার জন্যে ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা ঘটনার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে- এটাই একমাত্র ঘটনা নয় আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিংবা বলা হয় এই ঘটনাটি হঠাৎ করেই এদিনে ঘটে গেছে। বলা হয় ইয়াজিদ নির্দোষ। সে এই ঘটনার জন্যে অনুতপ্ত। একদল একে ইমাম হোসাইন ও ইয়াজিদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই হিসেবে চিত্রিত করেন। আবার কেউ কেউ বলেন, ইমাম হাসান ও হুসাইন (আ) প্রাণ দিয়ে উম্মতের গোনাহ মাফের ব্যবস্থা করে গেছেন- যেভাবে খ্রিস্টানরা বলে, যিশু ক্রুশে জীবন দিয়ে তাদের পাপ মোচন করে গেছেন! এভাবে কারবালা সম্পর্কে নানামুখী কথা বলে ইমাম হুসাইনের আন্দোলনের প্রকৃত ঘটনাকে ধামা চাপা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
ড. মাহমুদ আরও বলেন, ‘ইমাম হুসাইন তাঁর নিজের ভাষ্যেই তাঁর আন্দোলনের মূল কথা ব্যক্ত করেছেন। ইমাম বলেছেন, আশি যশ বা খ্যাতির জন্য কিংবা ফিতনা সৃষ্টি করার জন্য আসিনি। আমি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করতে এসেছি। আমার নানার সুন্নতকে বদলে ফেলা হচ্ছে। আমি একে পুনঃস্থাপন করতে এসেছি।’ আজকে যারা ইয়াজিদকে নির্দোষ বলতে চান তারা ঐতিহাসিক সত্যকে ঘুরিয়ে ফেলতে চান। ইয়াজিদ ক্ষমতায় এসেই মদিনার গভর্নর ওলিদের কাছে ফরমান পাঠিয়ে ইমাম হুসাইনের উপর চাপ প্রয়োগ করে জোরপূর্বক বাইয়াত আদায়ের চেষ্টা করে। বাইয়াত না করলে তাঁকে হত্যা করতে হবে বলে আদেশ দেয়। ইমাম হুসাইন (আ)-এর শাহাদাতের পর সে বিজয়-উল্লাস করে। আজকে যারা বলে ইয়াজিদ কিছুই জানতো না, যত দোষ সব ইবনে জিয়াদের আর শিমারের। তাহলে সে ইবনে জিয়াদ ও শিমারকে শাস্তি দেয়নি কেনো? তাই আমাদেরকে হাজারো কথা-বার্তার ভিড় থেকে কারবালার আসল ইতিহাস জানতে হবে। ইমাম হুসাইন মদিনা থেকে মক্কা, মক্কা থেকে কুফার পথে যাত্রাকালে এমনকি কারবালার ময়দানে অনেকগুলো ভাষণ দেন যার মাধ্যমে তিনি মুসলিম উম্মাহকে তাঁর নানার সুন্নাতের পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।
সেমিনারে জুরানপুর ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক শেখ মুহাম্মদ আবদুল হামিদ বলেন, ‘আহলে বাইতের মহব্বত ঈমানের অঙ্গ। এই মহব্বতই শিয়া-সুন্নি ঐক্যের মূল রশি। আমরা এক আল্লাহ্র বান্দা এক রাসুলের উম্মাত, এক কুরআনের অনুসারী, এক কালেমার শরীক মুসলমান। আমাদেরকে ঐক্যের সূত্র আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। ইমাম হুসাইন কালজয়ী মহাপুরুষ। রাসুল বলেছেন হুসাইন আমা হতে আমি হুসাইন হতে। তেমনিভাবে হুসাইনের পিতা হজরত আলী সম্পর্কেও বলেছিলেন, ‘আমি জ্ঞানের নগরী আলি তাঁর প্রবেশ-দ্বার’ তিনি বলেন, ইয়াজিদের দলের ভেতরও হুসাইনভক্ত লোক ছিল, কিন্তু তারা ইমানের দুর্বলতা হেতু গর্দান যাওয়ার ভয়ে হুসাইনের পক্ষে আসতে পারেনি। একজন এসেছিলেন তাঁর নাম হোর। ইয়াজিদকে নির্দোষ ভাবার প্রশ্নই আসে না। কোনও প্রকৃত সুন্নি ইয়াজিদকে সমর্থন করতে পারে না।’
অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বাবর বলেন, ‘ছোটবেলায় দেখেছি কারবালার ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা হোতো, এখন হয় না। আমাদের দাদা-নানারা পুঁথি পরতেন। কারবালা সংক্রান্ত একটি পুঁথি ছিল জঙ্গনামা। এসব পুঁথি-পাঠে ও শ্রবণে অশ্রু ঝরত মানুষের।’ তিনি বলেন আমাদেরকে আহলে বাইতের মহব্বতের সাথে সাথে তাঁদের আদর্শ ও আমলকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে।’
অনুষ্ঠান শুরু হয় ক্বারী আলমগীর হোসেন মোল্লার কণ্ঠে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কবি আতিক হেলাল। নাত পরিবেশন করেন তরুণ কণ্ঠশিল্পী মোঃ আশরাফুজ্জামান। মর্সিয়া পেশ করেন কবি নুরুল মনির ও মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক মিয়া।