পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামী ঐক্য
পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৬
অধ্যাপক আ.ন.ম. আব্দুল মান্নান খান : রবিউল আউয়াল মাসের আগমন মুসলিম বিশ্বে এক আবেগময় অবস্থা সৃষ্টি করে। কারণ, এ পবিত্র মাস সৃষ্টির সেবা মানব হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা.)-এর আবির্ভাবের উল্লাস এবং তিরোধানের বেদনা বহন করে আনে। ১২ রবিউল আউয়ালে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মানব ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম দিবস। বিশ্বমানবতার মুক্তিদূতের পুণ্য স্মৃতি বিজড়িত এ দিবস শুধু মুসলমানই নয়, বরং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবকূলের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত।
আজ থেকে ১৪২২ বছর আগে রবিউল আউয়ালে ১২ তারিখে পবিত্র মক্কা নগরীর সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে স্নেহময়ী মা আমিনার ঘরে সারওয়ারে কায়েনাত তাজেদারে মদীনা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। হযরতের জন্মে আকাশে-বাতাসে, জলে-স্থলে, লতা-পাতায়, জড়-চেতনে সর্বত্র সার্থকতা ও পরিপূর্ণতার এক মহাতৃপ্তি ও মহাআনন্দ ভেসে বেড়ায়। পরম আনন্দে সকলের মন ভরে যায়। উল্লেখ্য, শিয়া মাজহাব অনুযায়ী মহানবী (সা.)-এর জন্ম তারিখ হচ্ছে ১৭ রবিউল আউয়াল।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মধ্যে তিনটি স্বতন্ত্র রক্তধারার সংমিশ্রণ ঘটে। হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর মাধ্যমে পারস্যের রক্তধারা, (মিশরের গভর্নরের কন্যা) বিবি হাজেরার মাধ্যমে মিশরের রক্তধারা আর ইসমাঈল (আ.)-এর স্ত্রী দায়লা বা সাঈদার মধ্য দিয়ে জুরহুমী আরবের রক্তধারা। এভাবে তিনটি বিশিষ্ট প্রাচীন সভ্যতার মিলনমোহনায় জন্ম নিলেন বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত ঐক্যের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)।
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি (এ মক্কা নগরীর আদিবাসীদের নিকট) তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠান, যিনি তাদের সামনে আপনার আয়াতসমূহ পাঠ করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবেন। নিশ্চয়ই আপনি মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’- সূরা বাকারা : ১২৯
বস্তুত ইসলামের নবী ছিলেন প্রতিশ্রুত পয়গাম্বর। তাঁর আবির্ভাবের কথা পৃথিবীর সকল জাতিই কমবেশি অবগত ছিল। প্রত্যেক নবীই তাঁর আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। তাওরাত, বাইবেল, বেদ পুরান, জিন্দা-বেস্তা ইত্যাদি প্রাচীনকালের প্রধান ধর্মগ্রন্থসমূহে মুহাম্মাদ (সা.)-এর গুণগান ও আগমন-বার্তা বর্ণিত আছে। তাই তিনি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে তাঁর আগমন হয় যখন সমগ্র আরব তথা সারাবিশ্ব অজ্ঞতা ও পাপাচারের ঘোর তমসায় সমাচ্ছন্ন। নীতির নামে দুর্নীতি, শাসনের নামে শোষণ, ধর্মের নামে অধর্ম ইত্যাদি মনগড়া মতবাদের ফলে সামগ্রিক মানবসমাজ দুঃসহ বেদনায় অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। এ চরম দুর্বিষহ অবস্থায় বিশ্বমানুষের মুক্তির সনদ নিয়ে কোন মহামানবের আগমনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে। তখনকার বিশ্বের চরম দুরবস্থার চিত্র আল্লামা ইকবাল দুটি চরণের মাধ্যমে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন :
‘পূর্বে মোদের বিশ্বে ছিল দৃশ্য অতি হাস্যকর,
কেউ পূজিত গরু বানর, কেউ পূজিত গাছ পাথর।
সাকার পূজায় নিত্য রত বিশ্বনিখিল চরাচর,
কে পূজিত কে মানিত আকারবিহীন এক ঈশ্বর?’
মোটকথা মানুষ তখন পশুত্বের পর্যায়ে পতিত হয়ে গিয়েছিল। এ চরম দুর্গতি হতে মানুষকে উদ্ধার করার জন্য বিশ্বনবীর আবির্ভাব আসন্ন ও অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।
তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শান্তি, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সংহতি ও মানবতার জাগতিক এবং পারলৌকিক কল্যাণের মহান বাণীবাহক ও মুক্তিদূত রূপে তাঁর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে সকল দেশের সকল যুগের ও সকল মানুষের নবী হিসেবে পৃথিবীতে পাঠালেন। আর তাঁকে মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধানদাতা ও জীবনবিধান হিসেবে একটি পূর্ণাঙ্গ শরীয়ত বা আল-কুরআন প্রদান করেন। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘আমি তোমাকে মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।’- সূরা সাবা : ২৮
আর তাঁকে মানবতার শান্তি, মুক্তি, প্রগতি ও সামগ্রিক কল্যাণের জন্য ‘বিশ্ব-রহমত’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ইরশাদ হয়েছে : ‘আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’- সূরা আম্বিয়া : ১০৭
সমস্ত সৃষ্টির জন্য তিনি ছিলেন চিরন্তন আদর্শ। তাঁর শিক্ষা ও কল্যাণধারায় বিশ্বজগতের জন্য তিনি আদর্শ। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’- সূরা আহযাব : ১৭৬
মহানবী (সা.) ছিলেন একজন সার্থক ও সফল নবী। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে তিনি আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। তিনি যা বলতেন তা বাস্তব জীবনে কর্মের মাধ্যমে প্রতিফলিত করতেন। তিনি আল-কুরআনের ঐশী আলোকে আইয়্যামে জাহেলিয়ার শত শত বর্ষের পুঞ্জিভূত অন্ধকার বিদূরিত করে বিভ্রান্ত আত্মভোলা মানবজাতিকে সত্য, সরল ও সঠিক পথনির্দেশ করেছিলেন। তাঁর শিক্ষায় মানুষ শিরক, নাস্তিকতা ও অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেল, মানবমর্যাদা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্যের সন্ধান লাভ করল। স্রষ্টার প্রকৃত পরিচয়, স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক, মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বুঝতে পারল এবং স্রষ্টার প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য উপলব্ধি করল। মহানবীর শিক্ষায় মানুষ আল্লাহর দাসত্ব, রাসূলের আনুগত্য ও অপরাপর মানুষের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষের স্থলে প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের মন্ত্রে উদ্ভাসিত হলো। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের সামনে নিজেদের জান ও মাল কুরবানি করার মনোবল লাভ করল। তাঁর আদর্শে গড়া সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন : ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, তার সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।’- সূরা ফাতহ : ২৯
মহানবী (সা.) বিশ্বমানবের সর্বাঙ্গীন সুখ-শান্তি, সৌহার্দ, ঐক্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কয়েকটি মৌলিক নীতি পেশ করেন যা সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চাবিকাঠি। আর তা হচ্ছে :
১. তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদ
বিশ্বনবীর মিশনই ছিল মানুষে মানুষে অনৈক্য ও বিভেদের প্রাচীর ভেঙে চুরমার করে দিয়ে মানুষকে এক আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান করা। তাওহীদ মানুষকে শিক্ষা দিল যে, মানুষের সৃষ্টিকর্তা, জীবিকাদাতা, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছেন এক আল্লাহ। তাঁর আনুগত্য ও দাসত্বের জন্যই আমাদের সৃষ্টি।
আর মানুষের সুখের জন্যই তিনি সৃষ্টি করেছেন দুনিয়াতে যা কিছু আছে সবই। এ শিক্ষা মানুষকে কল্পিত উপাস্যের দাসত্ব-শৃঙ্খল হতে মুক্ত করে তার শির একমাত্র আল্লাহর সমীপে নত করে। আর আসমান-যমিনের সর্বত্রই আল্লাহর প্রভুত্ব রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : ‘তোমাদের ইলাহ তো এক ইলাহ।’- সূরা হজ : ৩৪
‘তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন।’- সূরা বাকারা : ২৯
২. রিসালাত
মহানবী (সা.) বিশ্বমানুষকে জানিয়ে দেন যে, যুগে যুগে আল্লাহ পাক পথহারা মানুষকে হেদায়াতের জন্য এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বা দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরাও আল্লাহর একত্বের ও ঐক্যের বাণী প্রচার করেছেন। এভাবে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের ওপর বিশ্বাস স্থাপন ও তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অপরিহার্য ও ঈমানের অংশ। ইরশাদ হয়েছে :
‘আমি তোমাদের পূর্বে অনেক রাসূল প্রেরণ করেছিলাম।’- সূরা মুমিন : ১৭৬
৩. আল্লাহর কিতাবসমূহের অভিন্নতা
মহানবী (সা.) পূববর্তী আসমানি কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস করাকে মুসলমানদের ঈমানের অঙ্গ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে :
‘তাদের সকলে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ ও তাঁর রাসূলদের প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে।’- সূরা বাকারা : ২৮৫
৪. দ্বীনের একত্ব
ইসলামের নবী শিক্ষা দেন যে, হযরত আদম (আ.) থেকে মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত নবীদের ধর্ম এক। আর তা হচ্ছে ইসলাম। আর এ ইসলাম মহানবী (সা.)-এর হাতে পরিপূর্ণতা লাভ করে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।
সুত্র: নিউজলেটার