সোমবার, ১০ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৭শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

পবিত্র আহলে বাইত ও চিরকালের কান্না

পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ৩, ২০২১ 

আবদুল মুকীত চৌধুরী
১. আহলে বাইত
‘আহলে বাইত’ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের কালাম : “…হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের হইতে অপবিত্রতা দূর করিতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করিতে।”- আল-কুরআনুল করীম, সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৩৩) ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা।
‘…অহফ এড়ফ ড়হষু রিংযবং / ঞড় ৎবসড়াব ধষষ ধনড়সরহধঃরড়হ / ঋৎড়স ুড়ঁ, ুব গবসনবৎং / ঙভ ঃযব ঋধসরষু, ধহফ ঃড় সধশব / ণড়ঁ ঢ়ঁৎব ধহফ ংঢ়ড়ঃষবংং.’- ঞযব ঐড়ষু ছঁৎধহ: ঞৎধহংষধঃরড়হ ধহফ ঈড়সসবহঃধৎু, অ. ণঁংঁভ অষর, চধমব ১১১৫-১৬.
‘আহলে বাইত’ সম্পর্কে ব্যাখ্যা-ভাষ্যে আল্লামা ইউসুফ আলী বলেন,
“ঘড়ঃরপব ঃযব ঃৎধহংরঃরড়হ রহ ঃযরং পষধঁংব ঃড় ঃযব সধংপঁষরহব মবহফবৎ, যিরষব নবভড়ৎব ঃযরং ঃযব াবৎনং ধহফ ঢ়ৎড়হড়ঁহং বিৎব রহ ঃযব ভবসরহরহব মবহফবৎ ধং ৎবভবৎৎরহম ঃড় ঃযব পড়হংড়ৎঃং. ঞযব ংঃধঃবসবহঃ রহ ঃযরং পষধঁংব রং হড়ি সড়ৎব মবহবৎধষ, রহপষঁফরহম (নবংরফবং ঃযব পড়হংড়ৎঃং) ঃযব যিড়ষব ভধসরষু, হধসবষু, ঐধুৎধঃ ঋধঃরসধ ঃযব ফধঁমযঃবৎ, ঐধুৎধঃ ‘অষর ঃযব ংড়হ-রহ-ষধ,ি ধহফ ঃযবরৎ ংড়হং ঐধংধহ ধহফ ঐঁংধরহ, ঃযব নবষড়াবফ মৎধহফংড়হং ড়ভ ঃযব চৎড়ঢ়যবঃ. ঞযব সধংপঁষরহব মবহফবৎ রং ঁংবফ মবহবৎধষষু রহ ংঢ়বধশরহম ড়ভ ধ সরীবফ ধংংবসনষু ড়ভ সবহ ধহফ ড়িসবহ.” – ওনরফ, চ.১১১৬
দশম হিজরিতে নাজরানের এক খ্রিস্টান প্রতিনিধিদল প্রধান ধর্মযাজক আবু হারিসা ইবনে আলকামাহ এর নেতৃত্বে মদীনায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে মুবাহালার মানসে আসেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) আহলে বাইতের সদস্য ‘আলী (রা.), ফাতেমা (রা.), হাসান (রা.) ও হুসাইন (রা)-কে তাঁর চাদরের মধ্যে নিয়ে প্রতিনিধিদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে উল্লেখিত আয়াত তিলাওয়াত করেছিলেন।
মহানবী (সা.)-এর পরিবার-পরিজনের পবিত্র চেহারার প্রভাবে যাজক মুগ্ধ হয়ে মুবাহালা থেকে বিরত হন এবং এই পবিত্রতা সকল শক্তির বিরুদ্ধে জয়ী হবে বলে ঘোষণা করেন।
আল্লামা যামাখশারী মুবাহালার আয়াত সম্পর্কিত ব্যাখ্যার শেষে বলেন, “মুবাহালার মহা ঘটনা এবং এ আয়াতের বিষয়বস্তু ও মর্মার্থ ‘আসহাবে কিসা’ অর্থাৎ মহানবী (সা.) যাঁদেরকে তাঁর চাদরের নিচে স্থান দিয়েছিলেন, তাঁদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের সবচেয়ে বড় দলিল এবং ইসলাম ধর্মের সত্যতারও এক জীবন্ত সনদ।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-, আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী, অনুবাদ : মোহাম্মদ মুনীর হোসেন খান, পৃ. ৩৭১
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে ধর্মযাজকের কথাবার্তা হয়। ‘ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র’ এই বিশ্বাসের অবস্থানে যাজক। এ সময় সূরা আলে ইমরানের ৫৯ নং ক্রমিকের আয়াত নাযিল হয় : “আল্লাহর নিকট নিশ্চয়ই ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের দৃষ্টান্ত সদৃশ। তিনি তাহাকে মৃত্তিকা হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন; অতঃপর উহাকে বলিলেন, ‘হও’; ফলে সে হইয়া গেল।”
আলে ইমরানের ৬১তম আয়াত মিথ্যায় বিশ্বাসীদের মুবাহালায় যাওয়া এবং নিজেদের উপর ¯্রষ্টার লানত (অভিশম্পাৎ) চাওয়া সংক্রান্ত। এর টীকায় বলা হয়েছে, ‘নাজরান অঞ্চলের খৃষ্টানগণ ঈসা (আ.) সম্পর্কে কুরআনের বর্ণনা স্বীকার না করিলে আল্লাহর নির্দেশে হযরত (সা.) তাহাদিগকে মুবাহালার (দুই পক্ষের পরস্পরের জন্য বদ দু‘আ করা) জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু খৃষ্টান পাদ্রীগণ ভীত হইয়া ইহা হইতে বিরত থাকনে ও জিযয়া দিতে স্বীকার করিয়া সন্ধি করেন।’ -জালালাইন; আল কুরআনুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃ. ৮৬
ইমামুল মুমিনীন আলী (রা.) এই বিশেষ বিজয়ের সন্ধি চুক্তিপত্র লিখেন।
বিশিষ্ট সাহাবী আবূ যর গিফারী (রা) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, “আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আমার আহলে বাইতের সদস্যগণ আমার উম্মতের জন্য তেমনি নাজাতের তরী, যেমনি আল্লাহর নবী নূহ (আ.)-এর তরী বিধ্বংসী বন্যার সময় তাঁর জন্য আশ্রয় ও নাজাতের তরী ছিল।”
ইমাম শাফি‘ঈ (রহ.) বলেন, ‘ইয়া আহলে বাইতে রাসূল। আপনাদের মুয়াদ্দাত (আনুগত্যপূর্ণ ভালবাসা) পবিত্র কুরআনে ফরয করা হয়েছে। যে ব্যক্তি নামাযে আপনাদের উপর দরুদ না পড়বে, তার নামাযই কবুল হবে না।’- সাওয়ায়েকে মোহরেকা, ইবনে হাজার মক্কী, পৃ. ৮৮, ৭৭১
২. আমীরুল মু‘মিনীন ‘আলী (রা.)
রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন সায়্যিদুল মুরসালীন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে ‘আলী (রা.)-এর পারিবারিক নৈকট্য ও ¯েœহের সম্পর্ক ছিল অনন্য। ‘আলী (রা.)-এর পিতা আবূ তালিব মুহাম্মদ (সা.)-কে পিতৃ¯েœহে ও মাতা ফাতেমা বিনতে আসাদ মাতৃ¯েœহে লালনপালন করেন। পিতা ‘আবদুল্লাহ-র মৃত্যু ও পরবর্তীতে মাতা আমেনার মৃত্যুর পর বিশেষভাবে তাঁর জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন তাঁরা। সেই পরম শ্রদ্ধেয় চাচা-চাচীর সন্তান ‘আলী (রা.)। তিনিই প্রথম তাঁর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। সর্বোত্তম ফয়সালাকারী (কাযী) তিনি।
গাদীরে খুমে উপস্থিত সাহাবিগণের অঙ্গীকার গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “আমি যার মাওলা, ‘আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ, তুমি তাকে বন্ধু গণ্য করো, যে একে (‘আলীকে) বন্ধু গণ্য করে এবং যে একে (‘আলীকে) শত্রু গণ্য করে, তাকে শত্রু গণ্য করো এবং রাগান্বিত হও তার প্রতি যে একে রাগান্বিত করে।”
খায়বারে হযরত ‘আলীর মহাবিজয় সম্পর্কে রাসূল (সা.) আগেই বলেন, “আগামীকাল এ পতাকা এমন এক ব্যক্তির হাতে দেব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালবাসেন। সে এমন ব্যক্তি, যে শত্রুর প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেনি এবং কখনই যুদ্ধ হতে পলায়ন করেনি।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.) দ্বিতীয় খ-, পৃ. ২০৮। সূত্র : মাজমাউল বায়ান, ৯ম খ-, পৃ. ১২০; সীরাতে হালাবী, ২য় খ-, পৃ.৩৭; সীরাতে ইবনে হিশাম ৩য় খ-, পৃ. ৩৩৪।
খায়বারের দরজা উপড়ানোর শক্তিমত্তার অলৌকিকতার দিকটিতে জিজ্ঞাসার জবাবে ‘আলী (রা) বলেন, ‘আমি কখনো মানবীয় শক্তিতে তা উপড়াইনি; বরং আল্লাহর শক্তি ও মহান আল্লাহর সাক্ষাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের বলে তা করেছি।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-, পৃ. ২১২। সূত্র : বিহারুল আনওয়ার, ২১তম খ-, পৃ. ২১।
আমীরুল মুমিনীন ‘আলী (রা.) তাঁর এক ভাষণে স্পষ্ট করে বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।… আমি তাঁকে গোসল দিয়েছি এবং ঐ অবস্থায় ফেরেশতারা আমাকে সাহায্য করেছেন।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-, পৃ. ৪২৯। সূত্র : নাহজুল বালাগাহ।
হযরত ‘আলী (রা.) খারিজী ইবনে মুলজিমের আঘাতে গুরুতর আহত ও ওফাতশয্যায় থাকা অবস্থায় হাসান (রা)-কে খিলাফতের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করেন।
৩. খাতুনে জান্নাত ফাতেমা যাহরা (রা)
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চির বিশ্বস্ত নারীশ্রেষ্ঠ খাদিজা তাহেরা (রা.)-এর কন্যা ফাতেমা (রা.)। রাসূল (সা.) বলেন, “ফাতেমা আমার দেহের টুকরা। যা তাকে সন্তুষ্ট করে, তা আমাকেও সন্তুষ্ট করে; আর তার ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি আমারই ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি।”- সহীহ বুখারী, ৫ম খ-, পৃ. ২১
কন্যার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে সফরে বেরোতেন না তিনি এবং ফিরেও প্রথমেই তাঁর সাথে দেখা করতে যেতেন। যে কয়েক দিন রাসূল (সা.) ওফাত-শয্যায় শায়িত ছিলেন, সে দিনগুলোতে ফাতেমা (রা.) পিতার শয্যাপাশে বসে থাকতেন। এ সময়ে পিতার কাছ থেকে তাঁর আসন্ন ওফাতের কথা শুনে তিনি কেঁদে ফেলেন। আবার রাসূল (সা.)-এর সাথে তিনিই প্রথম মিলিত হবেন, এ ভবিষ্যদ্বাণী শুনে হাসেন তিনি। রাসূল (সা.) তাঁকে বলেছিলেন, “আমার আহলে বাইতের মধ্য থেকে তুমিই প্রথম আমার সাথে মিলিত হবে।”- আত তাবাকাতুল কুবরা, ২য় খ-, পৃ. ২১৯
মহানবী (সা.)-এর এখতিয়ারে ছিল বিনা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ একটি উর্বর অঞ্চল ফাদাক। এটি ছিল খায়বারের কাছে। নিকটাত্মীয়গণের বৈধ প্রয়োজনাদি সম্মানজনকভাবে মেটাতে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ রয়েছে সূরা শূরার ষষ্ঠ ও সপ্তম আয়াতে। সূরা ইসরার ২৬তম আয়াত নাযিলের প্রেক্ষিতে কন্যা ফাতেমাকে ডেকে ফাদাকের স্বত্ব হস্তান্তর করেন নবীজী। আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণিত এ হাদীস।- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-। সূত্র : মাজমাউল বায়ান, ৩য় খ-, পৃ. ৪১১; শরহু নাহজুল বালাগাহ, ১৬তম খ-, পৃ. ২৪৮
খিলাফত প্রশাসন প্রাথমিক পর্যায়ে ফাতেমা (রা.)-এর এ দাবির স্বীকৃতি দেন নি।- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-। সূত্র : ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজুল বালাগাহ, ১৬তম খ-, পৃ. ৩৭৪; সীরাতে হালাবী ৩য় খ-, পৃ. ৪০০
মালে গণীমতের এক পঞ্চমাংশ থেকেও আহলে বাইত কিছু পেতেন না।- ঐ, সূত্র শারহু নাহজুল বালাগাহ, ১৬তম খ-, ২৩৬
শেরে খোদা হযরত ‘আলী (রা.)-এর শাহাদাতের পর মুয়াবিয়ার শাসনকালে তিনি মারওয়ান, আমর ইবনে উসমান ও পুত্র ইয়াযীনের মধ্যে ফাদাক বণ্টন করে দেন। মারওয়ানের দায়িত্বকালে সকল অংশ তার পুত্র আবদুল আযীযকে হিবা করে দেয়। এ ধারা চলতে থাকে। বনী উমাইয়্যা শাসকদের মধ্যে ‘উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ.) ফাদাক ভূখ- হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বংশধরদের কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু তাঁকে বুঝিয়ে মূল মালিকানা হাতে রেখে সম্পত্তির ব্যয় ফাতেমা (রা.)-এর বংশধরদের মধ্যে বণ্টনে তাঁকে রাজি করা হয়েছিল।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-। সূত্র : ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজুল বালাগাহ, ১৬তম খ-, পৃ. ২৭৮
তাঁর ইন্তেকালের পর পরবর্তীরা ফাদাক সরকারে ফিরিয়ে নেয়। বনী উমাইয়্যা শেষ দিন পর্যন্ত কর্তৃত্বে ছিল।
হযরত ‘আলী (রা.) বসরার গভর্নর ‘উসমান ইবনে হুনাইনের কাছে লেখা এক পত্রে ফাদাক প্রসঙ্গে বলেন, “হ্যাঁ, যেসব কিছুর উপর আকাশ ছায়া প্রদান করেছে, সে সবের মধ্যে ফাদাক গ্রামের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূ-সম্পত্তিও অন্তর্ভুক্ত, যা আমাদের হাতে (কর্তৃত্বে) ছিল। কিন্তু কোনো কোনো গোষ্ঠী এ ব্যাপারে কার্পণ্য করল। আর একদল উদার ও মহানুভব ব্যক্তি বিশেষ কতিপয় বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে তা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। তবে মহান আল্লাহই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী।”- নাহজুল বালাগাহ, পত্র ৪৫
৪. ইমাম হাসান বিন ‘আলী (রা.) : সায়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ
বারা বিন আযীব (রা) থেকে বর্ণিত : “আমি হাসানকে রাসূল (সা.)-এর কাঁধ মুবারকে দেখলাম। আল্লাহর নবী বলেন, “হে আল্লাহ! আমি তাকে ভালবাসি। সুতরাং আপনিও তাকে ভালবাসুন।”- বুখারী শরীফ; মুসলিম শরীফ, বাবু ফাযাইলিল হাসানী ওয়াল হুসাইনী।
হযরত আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত : “মদীনায় বাজার থেকে ফিরে এসে রাসূল (সা.) বললেন, ‘ছোট শিশুটি কোথায়?’ এ কথা তিন বার বললেন। অতঃপর বললেন, ‘হাসান ইবনু ‘আলীকে ডাকো।’ দেখা গেল হাসান ইবনু ‘আলী হেঁটে আসছেন। তাঁর গলায় ছিল মালা। নবী (সা.) এভাবে তার হাত উঠালেন। হাসানও এভাবে তাঁর হাত উঠালেন। তারপর রাসূল (সা) তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি একে ভালবাসি; আপনিও তাকে ভালবাসুন এবং যে ব্যক্তি তাকে ভালবাসে, তাকেও আপনি ভালবাসুন।’- বুখারী শরীফ
হযরত আলী (রা.)-এর শাহাদাতের পর ইমাম হাসান (রা.) খলীফা হন। আমীরে মুয়াবিয়া তাঁর খিলাফত মেনে নিতে অস্বীকার করলে ইমাম হাসান তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন। অতঃপর ৫০ হিজরিতে ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।
৫. ইমাম হুসাইন বিন ‘আলী (রা.): সায়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ
ইমাম হাসান (রা.)-এর পর পবিত্র আহলে বাইতের কনিষ্ঠ সদস্য ইমাম হুসাইন (রা.)। তাঁর প্রতি মুসলিম জনগণের ‘ভালবাসা ও আনুগত্য’ সর্বোচ্চ থাকবে, এটাই প্রত্যাশিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনচেতনায় তা ছিলও। কিন্তু পিতৃসূত্রে ক্ষমতাধর খিলাফতের পদলোভী ইয়াযীদের পক্ষ থেকে বিস্ময়করভাবে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কাছে ‘আনুগত্য’ তথা বায়‘আতের দাবি করা হয়। তাতে আত্মসমর্পণ না করলে ভয়ঙ্কর পরিণতির কথাও জানিয়ে দেওয়া হয়। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের পক্ষ থেকে প্রেরিত মানবজাতি তথা সৃষ্টিজগতের প্রতি কল্যাণ ও শান্তির বার্তাবাহী রাসূল রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরম আদরের দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা.) মাথা নত করলেন না। ফলে কারবালায় ইয়াযীদের নির্দেশিতদের আক্রমণে অবাঞ্ছিত অসম যুদ্ধে পানিবিহীন অবস্থায় ইমাম পরিবারের সদস্যসহ ৭২জন ফোরাত তীরে শহীদ হন। পিতা খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত ‘আলী (রা.)-এর শাহাদাত এবং বড় ভাই ইমাম হাসান (রা.)-এর বিষপ্রয়োগে শাহাদাতের পর এ শাহাদাত মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে তো বটেই, গোটা মানবেতিহাসেও অনন্য করুণ। ইয়াযীদ ও তার দোসরদের পাশবিকতার প্রতি উম্মাহর তথা বিশ্বমানবতার ধিক্কার। এর বিপরীতে রাসূল (সা.) ও ইমাম প্রেমিকরা চিরকাল শ্রদ্ধা জানাবে মূলত অপরাজেয় ‘মৃত্যুহীন’ কালোত্তীর্ণ ইমামকে।
ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কাছ থেকে জোরপূর্বক বায়‘আত গ্রহণের জন্য মদীনার গভর্নর ওয়ালিদের কাছে ইয়াযীদ এক পত্রে নির্দেশ দিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, তিনি তা করতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁর শির কেটে তার কাছে পাঠানোর জন্য।
ইবনে যিয়াদ বলে, ‘আমি আল-হুসাইনকে হত্যা করেছি; কারণ, তিনি আমাদের ইমাম (ইয়াযীদ)-এর বিরুদ্ধে বিপ্লব করেছিলেন এবং এই ইমামই (ইয়াযীদ) হুসাইনকে হত্যার জন্য আমার কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। হুসাইনের হত্যা যদি পাপ হয়ে থাকে, তা হলে এ জন্য ইয়াযীদ দায়ী।’
বিষয়টি শুধু এ হত্যায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। পরবর্তীতে পবিত্র মক্কা ও মদীনা আক্রান্ত হয়েছে। বহু জীবন হানি ও ক্ষয়ক্ষতি ঘটেছে। সত্য-মিথ্যার যুদ্ধে কারবালার অনন্য শোকাবহ হত্যাকা-ের পর আল্লাহর ঘর কা‘বা ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্মৃতিবাহী মদীনা আক্রমণের দুঃসহ ব্যথা নিয়ে মুসলিম উম্মাহ হাজার ও শত শত বছর পাড়ি দিচ্ছে। আল্লাহর খিলাফত- মানবকল্যাণ ও বিশ্বশান্তির শাসন ব্যবস্থা স্তব্ধ করে দিয়েছে অবৈধ রাজতান্ত্রিক ক্ষমতালোভী ও পরবর্তীতে তাদের দোসররা।
কুরআন মজীদের ৩৭তম সূরা সাফ্ফাত-এর ক্রমিক ১০৭তম আয়াত ‘মিল্লাতের পিতা’ নবী ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক তাঁর সন্তান ইসমাঈল-এর কুরবানির মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় বিকল্প কুরবানি বিষয়ক : “আর আমি তাকে মুক্ত করলাম বিরাট কুরবানীর বিনিময়ে।”- আল কুরআনের বিষয়ভিত্তিক আয়াত, ৩য় খ-, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, বাংলাদেশ।
আল্লামা ইউসুফ আলী কৃত তাঁর ‘ঞযব ঐড়ষু ছঁৎধহ: ঞৎধহংষধঃরড়হ ্ ঈড়সসবহঃধৎু’-তে এ আয়াতের অনুবাদ: ‘অহফ বি ৎধহংড়সবফ যরস রিঃয ধ সড়সবহঃড়ঁং ংধপৎরভরপব.’ ঝধভভধঃ ৩৭ : অুধঃ ১০৭, চ. ১২০৬
এ আয়াতে ‘সড়সবহঃড়ঁং ংধপৎরভরপব’ সম্পর্কে টীকায় বিশ্লেষণাত্মক মন্তব্যে এই অনুবাদক-ভাষ্যকার ইমাম হুসাইন (রা.)-এর আত্মদানকে সর্বোচ্চ ভাবনায় উত্তীর্ণ করে বলেন- ‘ঞযব ধফলবপঃরাব য়ঁধষরভুরহম ‘ংধপৎরভরপব’ যবৎব, ‘ধুরস’ (মৎবধঃ, সড়সবহঃড়ঁং) সধু নব ঁহফবৎংঃড়ড়ফ নড়ঃয রহ ধ ষরঃবৎধষ ধহফ ধ ভরমঁৎধঃরাব ংবহংব. ওহ ধ ষরঃবৎধষ ংবহংব রঃ রসঢ়ষরবং ঃযধঃ ধ ভরহব ংযববঢ় ড়ৎ ৎধস ধিং ংঁনংঃরঃঁঃবফ ংুসনড়ষরপধষষু. ঞযব ভরমঁৎধঃরাব ংবহংব রং বাবহ সড়ৎব রসঢ়ড়ৎঃধহঃ. ওঃ ধিং রহফববফ ধ মৎবধঃ ধহফ সড়সবহঃড়ঁং ড়পপধংরড়হ, যিবহ ঃড়ি সবহ, রিঃয পড়হপবৎঃবফ রিষষ, ‘ৎধহমবফ ঃযবসংবষাবং রহ ঃযব ৎধহশং’ ড়ভ ঃযড়ংব ঃড় যিড়স ংবষভ-ংধপৎরভরপব রহ ঃযব ংবৎারপব ড়ভ এড়ফ ধিং ঃযব ংঁঢ়ৎবসব ঃযরহম রহ ষরভব.
ঞযরং ধিং ধ ঃুঢ়ব ড়ভ ঃযব ংবৎারপব যিরপয ওসধস ঐঁংধরহ ঢ়বৎভড়ৎসবফ, সধহু ধমবং ষধঃবৎ, রহ ৬০ অ. ঐ. ধং ও যধাব বীঢ়ষধরহবফ রহ ধ ংবঢ়ধৎধঃব ঢ়ধসঢ়যষবঃ…..’
৬. নজরুল কাব্য ও সংগীতে আহলে বাইত
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি তিনি। বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান (মরহুম) কাজী নজরুল ইসলামের মূল্যায়নে বলেন, ‘…নজরুল আমাদের জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক।… সাথে সাথে সাদী-হাফেজ-আত্তার-রুমী-জামী-নিজামী-সানাঈ-ফেরদৌসীর বাংলা সংস্করণ ও প্রতীক নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য সকল মহলের সাগ্রহ প্রচেষ্টা আরজ করছি।’ তাঁর দৃষ্টিতে বিশ্বখ্যাত কালোত্তীর্ণ এই কবিদের ‘বাংলা সংস্করণ ও প্রতীক নজরুল ইসলাম’। তাঁর সংগীত ও কবিতা থেকে আহলে বাইতের শানে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করছি :
“খয়বর জয়ী আলী হায়দার
জাগো জাগো আরবার।
দাও দুশমন দুর্গ-বিদারী
দু’ধারী জুলফিকার ॥
এস শেরে খোদা ফিরিয়া আরবে-
ডাকে মুসলিম ‘ইয়া আলী’ রবে-
হায়দরী-হাঁকে তন্দ্রা-মগনে
কর কর হুঁশিয়ার ॥
আল-বোর্জের চূড়া গুঁড়া করা
গোর্জ আবার হানো,
বেহেশতী সাকী, মৃত এ জাতিরে
আবে কওসর দানো ॥
আজি বিশ্ববিজয়ী জাতি যে বেহোঁশ,
দাও তারে নব কুওত ও জোশ;
এস নিরাশার মরুধূলি উড়ায়ে
দুলদুল আসওয়ার ॥”

“ওগো মা- ফাতেমা- ছুটে আয়,
তোর দুলালের বুকে হানে ছুরি।
দীনের শেষ বাতি নিভিয়া যায় মাগো
(বুঝি) আঁধার হ’ল মদিনা-পুরী ॥

কোথায় শেরে-খোদা; জুলফিকার কোথা
কবর ফেড়ে’ এস কারবালা যেথা-
তোমার আওলাদ বিরাণ হ’ল আজি
নিখিল শোকে মরে ঝুরি’ ॥”

কোথা আখেরী নবী, চুমা খেতে তুমি
যে গলে হোসেনের,
সহিছ কেমনে? সে গলে দুশমন
হানিছে শমসের;”

“খাতুনে-জান্নাত ফাতেমা জননী
বিশ্ব-দুলালী নবী-নন্দিনী।
মদিনা-বাসিনী পাপ-তাপ নাশিনী
উম্মত-তারিণী আনন্দিনী ॥
সাহারার বুকে মাগো তুমি মেঘ-মায়া
তপ্ত মরুর প্রাণে ¯েœহ-তরু-ছায়া;
মুক্তি লভিল মাগো এর শুভ পরশে
বিশ্বের যত নারী বন্দিনী ॥”

“নবী-নন্দিনী ফাতেমা মোদের সতী নারীদের রাণী,
যাঁর ত্যাগ, সেবা, ¯েœহ ছিল মরুভূমে কওসর পানি,
যাঁর গুণগাথা ঘরে ঘরে প্রতি নর-নারী আজো গায় ॥”

“মোহররমের চাঁদ এল ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়।
ওয়া হোসেনা; ওয়া হোসেনা তারি মাতম শোনা যায় ॥
কাঁদিয়া জয়নাল আবেদীন বেহোঁশ হল কারবালায়।
বেহেশতে লুটিয়া কাঁদে আলী ও মা ফাতেমায় ॥”

“কাঁদে বিশ্বের মুসলিম আজি, গাহে তারি মর্সিয়া
ঝরে হাজার বছর ধরে অশ্রু তারি শোকে হায় ॥”

“মনে পড়ে আসগরে আজ পিয়াসা দুধের বাচ্চায়
পানি চাহিয়া পেল শাহাদৎ হোসেনের বক্ষে রয়ে ॥
এক হাতে বিবাহের কাঙন এক হাতে কাশেমের লাশ
বেহোঁশ খিমাতে সকিনা অসহ বেদনা স’য়ে ॥”

‘শূন্য পিঠে কাঁদে দুলদুল হজরত হোসেন শহীদ,
আসমানে শোকের বারেষ, ঝরে আজি খুন হয়ে ॥”

“ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে
অঝোর নয়নে রে।
দু’হাতে তুলিয়া পানি ফেলিয়া দিলেন অমনি
পড়িল কি মনে রে॥”


নব জীবনের “ফোরাত”-কূলে গো কাঁদে “কারবালা” তৃষ্ণাতুর,
ঊর্ধ্বে শোষণ-সূর্য, নি¤েœ তপ্ত বালুকা ব্যথা-মরুর।
ঘিরিয়া য়ুরোপ এজিদের সেনা এপার, ওপার, নিকট, দূর,
এরি মাঝে মোরা “আব্বাস” সম পানি আনি প্রাণ পণ করি।”
(তরুণের গান)

“বহিছে সাহারায় শোকের ‘লু’ হাওয়া
দুলে অসীম আকাশ আকুল রোদনে।
নূহের প্লাবন আসিল ফিরে যেন
ঘোরে অশ্রু শ্রাবণ-ধারা ঝরে সঘনে ॥”

ফাল্গুধারা-সম সেই কাঁদন-নদী
কুল-মুসলিম-চিতে বহে গো নিরবধি,
আসমান ও জমীন রহিবে যতদিন
সবে কাঁদিবে এমনি আকুল কাঁদনে ॥”

লেখক: সাবেক সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্য সম্পাদক, নিউ নেশন, ঢাকা